রূপান্তরের গল্প ২২৯ | Rupantorer Golpo 229

বনদস্যুরা অপেক্ষায়…! কাঁদার ওপর দিয়ে চললো নৌকা | রূপান্তরের গল্প ২২৯

বনদস্যুরা অপেক্ষায়…! কাঁদার ওপর দিয়ে চললো নৌকা | রূপান্তরের গল্প ২২৯ | Rupantorer Golpo 229 | দস্যুমুক্ত সুন্দরবন | সুন্দরবনের গল্প | জীবনে ফেরার গল্প | Jibone Ferar Golpo | Sundarbaner Goppo | Story of Sundarbans | মোহসীন উল হাকিম | Mohsin Ul Hakim


রূপান্তরের গল্প ২২৯ : হাতে বন্দুক নিয়ে এতো ভয় কীসের? দস্যুদের কাছে জানতে চাইলাম, বন্দুকগুলো চলে তো? সাথে সাথে একজন বন্দুক তুলে নিলো হাতে। খট করে ভেঙ্গে গুলি ভরা আছে কী না দেখলো। তারপর আমাকে দেখিয়ে বললো, তাজা গুলি। কয়দিন আগে কিনেছে প্রতি পিস ১৪০০ টাকা করে। বলেই বন্দুক জোড়া লাগিয়ে ঘাড়ে ঝুলালো। বললাম, সেফটি লক টানলে না? তরুন সে বনদস্যু বললো, ভুলে গেছিলাম ভাই।

সেফটি লক করতে ভুলে গেলে? তোমাদের ট্রেনিং হয় না? পাশ থেকে কাবীর বললো, জাল-দড়ি ধরার ট্রেনিং আছে ভাই। কিন্তু বন্দুক চালানোর ট্রেনিং নাই। দেখে দেখে চালানো শিখছি। বললো, বন্দুক চালানো কোনো ব্যাপার না ভাই। গুলি ভালো হলে যুদ্ধ করতে পারবো। বললাম, তোমাদের যা অবস্থা! বন্দুকই তো ধরতে পারো না ঠিকঠাক।

আরেকটা বিষয় মাথায় আসে না! বন্দুকের গুলির এতো দাম কেন? ওরা বললো, অবৈধ মার্কেটে সবকিছুরই দাম বেশি। এমনিতে খুলনা বা মংলা’র নিষিদ্ধ মার্কেটে এই গুলি পাঁচশ’ টাকা করে পাওয়া যায়। কিন্তু জঙ্গলে আমাদের হাতে আসতে আসতে আরও এক বা দুই হাত বদল হয়। তারপর ১২শ’ থেকে ১৪শ’ টাকায়। বনদস্যুরা বললো, মাঝে মাঝে দাম দিয়েও ভালো গুলি পাই না, ঠকায় আমাদের। কিন্তু এসব নিয়ে কিছু বলাও যায় না। বললাম, আর বলা লাগবে না তোমাদের। কয়েকদিনের মধ্যে এসে নিয়ে যাবো। সারেন্ডার করবে তোমরা। গল্পে গল্পে সময় কাটছে জঙ্গলের গহীনে। রাত তখন সাড়ে তিনটা হবে। আরেক দফা চা হলো।

অনেক ক্ষণ হলো আটকে আছি চিপা’র খালে। চা খেয়ে একটু চাঙ্গা হয়েছে সবাই। আরেকটু বিশ্রাম নিয়ে আবারও নৌকা ঠেলা শুরু হবে। ওরা বললো, কোনো রকমে কাবীরের খাল পর্যন্ত যেতে পারলে নৌকা ভাসবে।

কাবীরের খাল মানে? এই নামে কোনো খাল আছে এখানে? নান্না বললো, একটু সামনেই কাবীরের খাল। চিপা থেকে পূর্ব দিকে গেছে ওই খাল। আন্ধারিয়ার বিল পর্যন্ত। বললাম, কিন্তু খালের নাম কাবীরের খাল কেন? বললো, আমাদের এই কাবীর নিজে বানাইছে এই খাল। সেজন্য ওই খাল আমরা কাবীরের খাল নামে চিনি।

ভিতরে ভিতরে ভয় পাচ্ছি। কাঁদার উপর আটকে থাকতে এমনিতে খারাপ লাগে না। কিন্তু জঙ্গলের এই জায়গায় বিষয়টি বেশ অনিরাপদ। কিন্তু আতঙ্ক ছড়ানো যাবে না। তাই মনের টেনশন মনে রেখে হাল্কা গল্পগুজব করছি।

আগাতে হবে। সবাই রেডি হন। বলতে বলতে ঝুপঝাপ করে নেমে পড়লো দস্যুরা। কোমড় সমান কাঁদায় নেমে নৌকা দুটো ঠেলা শুরু করলো তারা। রাতের অন্ধকারে চিপা’র খালে নৌকায় বসা আমরা। কাঁদার ওপর দিয়ে চলছে আমাদের নৌকা।

পিঠে ঝোলানো বন্দুকগুলো কাঁদা-পানিতে ভিজে যাচ্ছে। তাই নৌকা ঠেলছে যারা তাদের বন্দুক আর পোসেসগুলো আমাদের নৌকায় রাখলো। এলোমেলো ভাবে রাখা বন্দুকগুলো। কয়েকটির নল আমার দিকে করা। বললাম, আমার দিকে নল ঘুরিয়ে রাখছো কেন? মারবা আমাকে?

দাঁড়িয়ে পড়লাম সবাই। সবগুলোতে গুলি ভরা। দুটি বন্দুকের সেফটি লক দেওয়া নাই। বললাম, ঝাঁকি লাগলেও তো অনেক সময় বন্দুক থেকে গুলি বের হয়। খেয়াল না করলে কী যে হতো আজ! নান্না এসে সবগুলো বন্দুকের গুলি বের করলো। তারপর আবার শুরু হলো নৌকা ঠেলা।

কাবীরের খাল আর কতোদূর? ওরা বললো, এই তো সামনে, দুই বাঁক পরেই। হাসতে হাসতে বললাম, বাঁক আর শেষ হয় না।

আরও আধা ঘন্টা এভাবেই চললাম। কাবীরের খাল আসেনি। তবে এখানে পানি দেখা যাচ্ছে। খাল একটু একটু করে চওড়া হচ্ছে। কিছুক্ষণের মধ্যে নৌকা ভাসলো। কাঁদাসহ সবাই উঠে পড়লো। এবার বৈঠা বেয়ে চললাম আমরা। চলার পথে পুর্ব পাশে অনেকগুলো ছোট ছোট খাল পড়লো। পেরিয়ে গেলাম কাবীরের খাল।

প্রায় দুই ঘন্টা পর নৌকা ভাসল। আমরা এগিয়ে গেলাম দক্ষিণে। চিপার দোয়ায় এসে একটু দাঁড়ালাম। এখান থেকে পশ্চিমে চলে গেছে ঝাপসি খাল। সোজা মরাপশুরের ভাড়ানী।

বনদস্যু কাবীর বন্দুক নিয়ে জঙ্গলে নেমে পড়লো। সুনশান নিরবতা চারপাশে। ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক চলছে একটানা, সাথে পানির স্রোতের সরসর শব্দ। জঙ্গল দিয়ে হেঁটে ঝাপসির ভাড়ানী ও মরাপশুর ভাড়ানীতে কেউ আছে কী না দেখে আসবে সে। সে পর্যন্ত কেউ কথা বলবো না। জঙ্গলে কথার শব্দ অনেক দূর থেকে শোনা যায়।

মিনিট দশ এভাবে চুপচাপ বসে থাকলাম। নি:শব্দে ফিরে আসলো কাবীর। না, সামনে কেউ নাই। আমাদের নৌকা দুটি রওনা দিলো আবার। চিপার খাল শেষ করে উঠে পড়লাম দোয়ায়। দোয়া মানে দুই বা তার চেয়ে বেশি খালের মিলনস্থল। ডানে ঝাপসি রেখে সোজা ঢুকে পড়লাম মরাপশুরের ভাড়ানীতে। এই খালটিও বেশ সরু।

ভোর হচ্ছে। সূর্য না উঠলেও চারপাশ বেশ পরিস্কার হয়ে আসছে। আকাশে মেঘ নাই। তারাগুলো জ্বলজ্বল করছে। এখানে জোনাকী পোকাও প্রচুর। খালের দুই পাশ ধরে এক ছন্দে তারা জ্বলছে-নিভছে। আকাশের তারা ও জোনাকী পোকার আলোয় খালটিকে অপরূপ লাগছে। এমন সৌন্দর্য দেখা হয় না সচরাচর।

ভাটা শেষ হয়ে জোয়ার লেগেছে। কুকু পাখি ডাকছে মুহুর্মুহু। আশেপাশের জঙ্গল থেকে মোরগ ডাকছে গলা ছেড়ে। খালের দুই পাশে টর্চ মেরে দেখি পারশে মাছের ঝাঁক। লাফঝাঁপ করছে নানা জাতের চিংড়ি মাছ।

একটু পর পর রুছো মাছ লাফ দিয়ে পোকা মাকড় ধরার চেষ্টা করছে। পা দুটো পানিতে ডুবিয়ে রেখেছি। বেশ আরাম লাগছে। কিন্তু খালের পাশে জায়গায় জায়গায় পানির সাপ দেখে ভয়ে পা উঠিয়ে বসলাম। খালের পাশে শিকার ধরার চেষ্টা করছে বড় বড় গুঁইসাপ। ভয় পেয়ে গুটিসুঁটি হয়ে বসলাম নৌকায়। আমার সহযাত্রীরা তখন বসে বসে ঘুম।

বনের ভিতর দিয়ে বন্যশুকরের দল বেশ শোরগোল পাকাচ্ছে। অনেক দূর থেকে ডাকছে হরিণ। মাঝে মাঝে খেউ খেউ করে ডাকছে বার্কিং ডিয়ার। বানরদের ঘুম ভেঙ্গেছে মাত্র। সামনে এগুতেই দেখি এক ঝাঁক ধাইড়ে (উদবিড়াল) পার হলো। বাঘ ছাড়া সুন্দরবনের প্রায় সবগুলো বন্যপ্রাণির অস্তিত্ব টের পাচ্ছি এখানে।

এদিকের খাল-নদীতে প্রচুর মাছও পাওয়া যায়। অভয়াশ্রম হলেও তাই এই অঞ্চলে জেলেরা থাকে সারা বছর। বনদস্যু আর বনরক্ষীদের সাথে চুক্তি করে জেলেরা মাছ ধরে এখানে।

মিনিট দশ চলার পর জঙ্গলের ভিতর থেকে কুঁই আসলো। মানে সিগন্যাল দিলো কেউ। দ্রুত বেয়ে চললাম আমরা। পাল্টা কুঁই দিয়ে আমাদের অবস্থান নিশ্চিত করলো কাবীর। চলে এসেছি। এখনই দেখা হবে বনদস্যু সাগর বাহিনীর প্রধান আলমগীরসহ অন্যদের সাথে।

(শেষ ভাটায় মরাপশুরের ভাড়ানী। অক্টোবর ২০১৬)

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top