বনদস্যুদের নিয়ে ঢুকে পড়লাম খালের আগায় | রূপান্তরের গল্প ২৩০ | Rupantorer Golpo 230 | দস্যুমুক্ত সুন্দরবন | সুন্দরবনের গল্প | জীবনে ফেরার গল্প | Jibone Ferar Golpo | Sundarbaner Goppo | Story of Sundarbans | মোহসীন উল হাকিম | Mohsin Ul Hakim
রূপান্তরের গল্প ২৩০ : গহীন বনে ফুটেছে সকালের আলো। দারুণ পরিবেশ। সরু খালের মাঝখানে ভাসছি আমরা। দু’টি নৌকার একটিতে আমি ও সহকর্মীরা। আরেকটিতে দস্যুরা। বাম পাশের জোলা খাল অর্থাৎ সরু খালটিতে ঢুকতে হবে। কিন্তু অর্ধেক জোয়ার হওয়ার আগে পাড়েই ভিড়তে পারবো না। খালে ঢুকবো কী করে?
ওদিকে জঙ্গলে দাঁড়িয়ে একজন দস্যু বলছে, খালের ভিতরে নৌকা ঢোকাও। আমি বললাম, তোমার নাম কী? একটু বাঁকা হয়ে দাঁড়িয়ে বললো, তার নাম মিলন, লিডারের ভাগিনা। বললাম, মিলনের তো বিরাট ভাবসাব দেখছি। শুনে পাশের দস্যুরা মুখ টিপে হাসছে। মিলনকে বললাম, তোমার হাতের বন্দুকটা ঠিকমতো ধরো। বানরে টান দিয়ে নিয়ে যাবে কিন্তু!
সবাই হেসে উঠলো। তবে দস্যুনেতার ভাগনে একটু মন খারাপ করলো। জানলাম, জঙ্গলে সে একদম নতুন। মামার দলে ডাকাতি করতে আসছে কিছু টাকা রোজগারের জন্য। এমন শখের বশে ডাকাত হওয়ার ঘটনা আরও দেখেছি।
মরাপশুরের ভাড়ানীর মাঝখানে ভাসছি আমরা। মিলনকে বললাম, তোমার মামাকে ডাক দাও। এই জোলা খালে তো নৌকা ঢুকবে না। কাঁদার ওপর দিয়ে ঠেলে ঢুকতে হবে। এমনিতে এরা সবাই সারা রাত নৌকা ঠেলেছে। একদম ছোট খালকে বলা হয় জোলা খাল।
পাশ থেকে এক দস্যু বললো, সেই যে কাল বিকাল বেলা ভাত খাইছি মামা, তারপর আর খাওয়া হয়নি। শরীর আর চলে না। সত্যিই তো। সুন্দরবনের এই জায়গা থেকে আমাদের নিতে গেছে তারা। গত সন্ধ্যা থেকে জঙ্গলে দাঁড়ানো। না খেয়ে মধ্য রাত পর্যন্ত বাইড়ে পোকার কামড় খেয়েছে। এরপর নৌকা বেয়ে অথবা ঠেলে এ পর্যন্ত আসা। তাদের আর কষ্ট দেওয়া যাবে না। মিলনকে বললাম, লিডারকে ডাক দাও।
কথা বলতে বলতে জঙ্গলের ভিতর থেকে হেঁটে আসলো কয়েকজন সশস্ত্র বনদস্যু। সামনের মাঝারী গড়নের যুবকটি এসে সালাম দিলো। এই সেই দস্যুনেতা আলমগীর। বললাম, গত কয়েক মাস ধরে পশুর বাওন গরম করে রাখছেন আপনিই?
লজ্জায় হেঁট হয়ে গেলো আলমগীর। বললো, সে কথা বলবো ভাই। তার আগে ভিতরে আসেন। বললো, পথে সমস্যা হয়নি তো? বললাম, চিপা’র খালে আটকা পড়ছিলাম। তবে তোমার সদস্যরা সবাই মিলে ঠেলে আনছে আমাদের।
দস্যুনেতা বললো, খালের ভিতরে এভাবে থাকাটা নিরাপদ না ভাই। বলেই পাশের দস্যুদের নামিয়ে দেওয়া হলো খালে। নামলো আমাদের সাথের দস্যুরাও। সবাই মিলে নৌকা ঠেলে ঢুকিয়ে ফেললো খালের ভিতর। দুই বাঁক ঘুরতেই দেখলাম ওদের নৌকা বহর। সবাই সেখানে গিয়ে দাঁড়ালাম। খালের মুখে দুইজন সশস্ত্র যুবক পাহাড়ায় থাকলো।
চুলা জ্বললো। পানি উঠলো। সব মিলিয়ে আমরা প্রায় ২৫জন। চা হলো। কিন্তু কাপ কম থাকায় ভাগে ভাগে চা খেলাম। একটি গ্লাসে করে আমাকে দুধ চা দেওয়া হলো। সাথে বিস্কিট ও ফল। সাগর বললো, বাজার সদা তেমন কিছু করতে পারিনি ভাই। আমাদের ওপর খুব চাপ। আপনাদের জন্য যে বাজার আনছিলো তার নৌকা RAB ধরে ফেলছে। তাই খাওয়া দাওয়ার আয়োজন তেমন করতে পারিনি।
পিছন থেকে এক তরুণ বনদস্যু বললো, দাদা’র জন্য হরিণ শিকার করবো। পিছনে তাকিয়ে দেখি হাসান। মংলার চিলা বাজারের বাড়ি ছেলেটির। কৈশোরে আমাদের সাথে ঘুরে বেড়াতো, থাকতো বেলায়েত সরদারের ট্রলারে। বললাম, তুমি ডাকাতি করতে আসলে কেন? বন্দুক হাতে মানাচ্ছে তোমাকে? আবার বলছো, শিকারে যাবে। হাসান দৌড় দিয়ে সরে গেলো গাছের আড়ালে।
এই জায়গায় কি আমাদের থাকা উচিৎ হবে? ওরা বললো, এখানে থাকা যাবে না। এই খালের ভিতরে রাতে কাঁকড়ার জেলেরা ঢুকছে। ওরা আমাদের দেখেছে। এছাড়া এক খালে দুই রাত থাকিও না আমরা। বললাম, তাহলে আরেকটু জোয়ার আসলে বের হবো আমরা। পুরো জোয়ার আসার আগে অন্য কোনো সরু খালের ভিতরে ঢুকবো, চলে যাবো একদম খালের আগায়। এই সফরে কোনো রকম ঝুঁকি নিবো না আমরা।
আধা জোয়ারের আগেই আমরা নৌকা ভাসাবো। একটু কষ্ট হবে এখান থেকে বের হতে। কিন্তু বের আমাদের হতেই হবে। কোনো রকম ঝুঁকি নেওয়া যাবে না। কারণ দূরত্ব বিবেচনায় এই জায়গাটি লোকালয় থেকে একদম কাছে। বাগেরহাটের মংলা, খুলনার দাকোপ কিংবা পাইকগাছার বন উপকূল থেকে এই জায়গায় যে কেউ চলে আসতে পারবে।
পথ ঘাট চিনলে আমাদের ওপর হামলা চালানো কোনো ব্যাপার না। আমাদের উত্তরে জোংড়া, দক্ষিণে মরাপশুর খাল। দুই খালেই বন টহল ফাঁড়ী আছে। আবার পশ্চিমে আছে আদাচাই ফরেস্ট অফিস। সব মিলিয়ে চারপাশেই প্রশাসনের উপস্থিতি।
অন্যদিকে সুন্দরবনের এই অঞ্চলে সারা বছর একটি বড় দস্যুদল এসে বিশ্রাম নেয়। মাঝারি বা ছোট দস্যুদল তো আছেই। তাদের সামনেও পড়া যাবে না কোনো ভাবে। দুশ্চিন্তায় আছি কারণ এই দস্যুদলের সদস্যরা বন্দুক চালাতে পারদর্শী না। হঠাৎ কোনো দস্যুদল এসে আক্রমণ করলে তারা নিজেরা বাঁচতে পারবে না, আমাদেরও বাঁচাতে পারবে না। এছাড়া এই দলের ওপর সবারই নজর আছে।
ধীরে ধীরে বৈঠা বেয়ে ছোট খাল থেকে বের হলাম। উঠলাম মরাপশুরের ভাড়ানীতে। ভাড়ানী অর্থ হলো দুটি খালের সংযোগ খাল। সেটি হতে পারে ছোট বা বড়। সাধারণত ডিঙ্গি নৌকা নিয়ে এক দিক থেকে আরেক দিকে বের হওয়া যায় এমন খালগুলোকেই ভাড়ানী বলে। দোয়া বলে একাধিক খালের মিলনস্থল বা মোহনাকে।
আমাদের উত্তরে আছে চিপা’র খালের দোয়া ও ঝাপসি’র দোয়া। সেদিকে যাবো না। নামবো দক্ষিণে। এদিক দিয়ে সোজা নৌকা বেয়ে গেলে পড়বো মরাপশুর খালে। বেশ লম্বা পথ। এছাড়া ডিঙ্গি নৌকা ছাড়া এদিক দিয়ে চলাফেরা করা অসম্ভব। স্পিডবোট বা ট্রলারে করে এখানে আসা সম্ভব না।
আধা ঘন্টার মতো দক্ষিণে নামলাম। খাল এখানেও বেশ সরু। সামনে নাকী চিপার খালের মতোই সরু হয়ে গেছে। দুই পাশে অনেক খাল। ছোট ছোট খাল। ভাড়ানী নাই এমন একটি খাল দেখে ঢুকে পড়লাম আমরা। ভাড়ানী নাই মানে খালের ওই পাশটা অন্য কোনো খালে বের হয়নি। নাম না জানা সেই খালের ভিতরে চললাম আরও আধা ঘন্টা।
খালের শেষ মাথায় গিয়ে থামলো বনদস্যুদের নৌকা বহর। জায়গাটি পড়েছে মরাপশুরে। এখান থেকে পায়ে হেঁটে গেলে পশুর নদী খুব বেশি হলে এক ঘন্টার পথ। বিকট শব্দ করে বড় নদীতে চলাচল করছে জাহাজ।
নৌকাগুলো একটার পর একটা রাখা হলো। পুরো জোয়ার আসলে আরও ভিতরে যাবো আমরা। তবে এর মধ্যে চুলা জ্বালানো হলো। সকালের নাস্তা হবে ভাত আর মাছ। ককশিটের বাক্স খুলে বড়রে রাখা চিংড়ি মাছ বের করছে একজন। চিংড়ি ভুনা আর ডাল হবে। বললাম, আমাদের সাথে বাজার আছে। শাক সবজি আছে কয়েক ব্যাগ ভর্তি। সেগুলো বের করে নাও। পুঁইশাক দিয়ে চিংড়ি রান্না করো। আপাতত ডাল রান্নার দরকার নাই।
এদিকে খালের মাথায় দুইজনকে পাঠানো হলো পাহাড়া দেওয়ার জন্য। অপরিপক্ক হাতে বন্দুক ধরা দুজনেরই। বললাম, তোমরা কেমন করে ডাকাত হলে বলো তো?
উপরে বসে সাগর বাহিনীর যে নাম ডাক শুনলাম তাতে মনে হলো যে ডাকসাইটে সব বনদস্যু আছে এই দলে। কিন্তু তোমাদের অস্ত্র ধরা দেখে মনে হচ্ছে সবাই নতুন। আলমগীর বললো, এই দলে আমরা যারা আছি সকলেই জঙ্গলে মাছ ধরে খেতাম। সারা বছর মাছ-কাঁকড়া ধরে চলতো সংসার। কিন্তু আমাদের অনেকেই অন্য ডাকাতের নির্যাতনের শিকার।
মাস্টার বাহিনীর আত্মসমর্পণের পর জাহাঙ্গীর বাহিনীর দাপট বেড়ে গেছে। কয়েক মাস আগে এই দলের কয়েকজনকে ধরে নিয়ে যায় তারা। ওরা মাছ ধরতো এদিকে। তারপর জনপ্রতি এক লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করে।
এতো টাকা ওরা দিবে কোত্থেকে? মহাজন কোনো দায়িত্ব নেয়নি। পরে কেউ জমি বন্দক রাখছে, কেউ গয়না বন্দক রেখে সূদে টাকা ধার নিয়েছে। এখন সেই টাকা পরিশোধ করবে কী করে? এলাকায় মহাজনের চাপ। আবার চেক এর মামলাও দিয়েছে। পুলিশের সোর্সরা তাদের চাপ দিচ্ছে। বাড়িতে থাকার উপায় নাই। আলমগীর বললো, দস্যুদের অত্যাচার ও সূদে ধার নিয়ে মামলায় পড়া কয়েকজন এই দলে দস্যুতা করছে।
বছর দু্ই আগেও হাসান থাকতো আমাদের ট্রলারে, ঘুরঘুর করতো চারপাশে। অথচ তার হাতে উঠেছে অস্ত্র। হাসান এখন বনদস্যু। খোলামেলা ঘুরে বেড়ানো এই তরুণ এখন ক্রসফায়ারের আসামী। হাসানকে ডেকে নিলাম পাশে। শুনবো তার দস্যু হওয়ার গল্প।
(ছবি: অক্টোবর ২০১৬ | সুন্দরবন)