রূপান্তরের গল্প ২৩১ | Rupantorer Golpo 231

হাসানরা দস্যু হয় মামলায়, ঋণে পড়ে, সোর্সদের অত্যাচারে | রূপান্তরের গল্প ২৩১

হাসানরা দস্যু হয় মামলায়, ঋণে পড়ে, সোর্সদের অত্যাচারে | রূপান্তরের গল্প ২৩১ | Rupantorer Golpo 231 | দস্যুমুক্ত সুন্দরবন | সুন্দরবনের গল্প | জীবনে ফেরার গল্প | Jibone Ferar Golpo | Sundarbaner Goppo | Story of Sundarbans | মোহসীন উল হাকিম | Mohsin Ul Hakim


রূপান্তরের গল্প ২৩১ : কাবীর, নান্না, হাসান, মিলন, কামরুলসহ সহ প্রায় সকলেই বয়সে তরুন। একজনের বয়স একটু বেশি, ৪০ এর মতো হবে। তাঁর নাম কয়লা খোকন। দস্যুনেতা আলগমীরের বয়স খুব বেশি হলে ৩২ বছর হবে। এদের প্রত্যেকেই সুন্দরবনের জেলে ছিলো। পশুর বাওনের সুন্দরবনে মাছ-কাঁকড়া ধরতো। এদের মধ্যে সর্বকণিষ্ঠ দস্যু মিলন। সমবয়সী আরেকজন হাসান।

ছোট্ট এক খাল। এর শেষ মাথায় একটির পর একটি নৌকা সাজানো। ভরা জোয়ারে সেগুলো ভাসছে। আমরাও নৌকায় বসে ভাসছি। সুন্দরীর বন এখানে বেশ ঘণ, গাছগুলোও বড় বড়। বন্যা জোয়ারের পানি উঠে পড়েছে বাদায় (জঙ্গল)। কোথাও হাঁটু পানি, কোথাও কোমড় সমান। এর নিচে কাঁদা আর কাঁটার অভাব নাই। সুন্দরী গাছের শুলোগুলোও (শ্বাসমূলগুলো) বেশ শক্ত ও ধারালো। কখন পায়ে ব্যাথা পাই ভেবে পানিতে নেমে হাঁটাহাঁটি করতে ইচ্ছা করছে না। এমনিতে আগের রাতের ঝক্কি আর টেনশন থেকে বের হতে পারিনি।

দুই নৌকায় দুটি চুলা জ্বলছে। রান্না হচ্ছে। সকালের নাস্তায় থাকছে গরম ভাত আর সবজি দিয়ে চিংড়ি। নৌকায় হেলান দিয়ে বসে আছি আমি। পাশে জামাল মেম্বার। পরের নৌকায় ঘুম দিয়েছেন আমাদের ভিডিওগ্রাফার মিরাজ ও বাগেরহাটের সহকর্মী ইয়ামীন ভাই। দস্যুনেতা বসা সামনের নৌকায়। বললো, একটু বিশ্রাম নেন ভাই।

শরীরটা ভেঙ্গে পড়ছে। কিন্তু এই জঙ্গলে আসলে আমার তো ঘুম আসে না। দস্যুনেতাকে বললাম, খাবার হলে খেয়ে তারপর একটু বিশ্রাম নিবো। তবে আবহাওয়া ভালো থাকতে থাকতে আপনাদের সাথে আমার কাজগুলো শেষ করবো। নৌকায় বসে শ্যুটিং করা মুশকিল। ভাটা হলে জঙ্গলে নেমে কাজগুলো করবো।

খবির মামাকে খুঁজে পাচ্ছি না কেন? কোথায় গেলেন উনি? আলমগীর বললো, আশেপাশের খালে খালপাটা দিতে গেছে। বিকালে খাওয়ার কিছু নাই। আপনি শিকারও করতে না করেছেন। এর মধ্যে আর কিছু পাবোও না। তাই মরাপশুরের আগার দিকে খালপাটা জাল পেতেছেন উনি। এদিকে খালপাটায় নাকী বড় বড় মাছ পাওয়া যায়।

খালপাটা আবার কেমন জাল? পাশে বসা জামাল মেম্বার বললেন, চলেন দেখে আসি। বললাম, এখন বের হওয়া যাবে না। আমরা ভিতরে আসছি সেই খবর এতোক্ষণে জানাজানি হয়ে গেছে। যদি কোনো ভাবে প্রশাসন জানতে পারে যে আমরা জোংড়ার ভিতরে ঢুকেছি তাহলে আমাদের অনুসরণ করবেই।

দুশ্চিন্তায় আছি। এমনিতে সাগর বাহিনীকে ধরার জন্য পাগল হয়ে আছে একটি পক্ষ। তারা কিছুতেই এদের সারেন্ডার করতে দিবে না।
জানলাম, খালপাটা জাল হলো খুব সাধারণ একটি জাল। ছোট খালগুলোর মুখে পাতা হয়। খালের মুখের দুই পাশের গাছের সাথে বাঁধা হয় জালের দুই প্রান্ত। মাঝে দুইটি বা তারচেয়ে বেশি খুঁটি পোঁতা হয়।

ভাটার সময় যখন পানি একদম কমে যায় তখন জাল টানানো হয়। এরপর ভরা জোয়ারে টেনে দেওয়া হয়। জোয়ারে খালের ভিতরে থাকা সব মাছ আটকা পড়ে যায়। এরপর যখন ভাটা হয় তখন সব পানি বেরিয়ে যায়। খাল শুকিয়ে যায়। মাছগুলো আটকা পড়ে। এরপর হেঁটে হেঁটে বড় মাছগুলো কুড়িয়ে নেন জেলেরা। খালপাটা জাল এই সুন্দরবনে নিষিদ্ধ। তবে খালে খালে এই জাল পাতা থাকে সারা বছর।

দস্যুদের অনেকেই আছে এখানে। কিন্তু হাসানকে দেখছি না। দস্যুনেতা বললো, হাসান আছে খালের মাথায়, আজকে দুই জায়গায় পাহাড়া বসানো হয়েছে। দূর থেকে নজর রাখার জন্য গাছের মাথায় মাচা করে পাহাড়া বসেছে আজ। দুই জায়গায় দুইজন করে চারজন সশস্ত্র দস্যু আছে টাওয়ারে। জোয়ারের সময় খালে খালে চলাফেরা করে জেলে নৌকা। সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হয়।

ভাটা না হলে কাজে নামতে পারছি না। রান্না হতে সময় লাগবে আরও অন্তত ঘন্টা খানেক। দম বন্ধ করা পরিবেশ। একটু বাতাসও নাই। তাই নৌকা বেয়ে একটু ঘুরে বেড়াবো। একটি নৌকা নিয়ে খালের গোঁড়ার দিকে রওনা দিলাম।

জঙ্গলের ওপরে এখনও অনেকটুকু পানি। সুন্দরী, গড়ান, গেওয়া গাছের গোঁড়াগুলো সব ডুবে আছে লবণ পানিতে। মাডস্কিপার আর কাকিলার মাছ ঘুরে বেড়াচ্ছে পানির ওপর। আর ছোট ছোট কাঁকড়াগুলো গাছের গুঁড়ি বেয়ে উঠছে ওপরের দিকে। জোয়ারের সময় সুন্দরবনে শুকনো জায়গা কমে যায়। শুনেছি বন্যপ্রাণিরা এসময় কেউ কাউকে আক্রমণ করে না।

খালের মুখে একটু সোরগোল শুনতে পাচ্ছি। বুকটা ধক করে উঠলো। কোনো সমস্যা না তো? দস্যুনেতা বললো, মনে হয় জেলে নৌকা আটকেছে ওরা। বিপদ হলে সিগন্যাল দিতো। বললাম, খালের গোঁড়ার দিকেই চলো। দেখে আসি ওদের।

খালের গোঁড়ায় বড় বড় দুটি সুন্দরী গাছ আছে। তার ওপর মাচা বানিয়েছে দস্যুরা। নিচে মনে হলো ১৫/২০টি নৌকা একসাথে হয়েছে। মানে এদিক দিয়ে যাওয়ার সময় আটকেছে দস্যুরা। কাছে গিয়ে দেখি হাসানসহ আরেক বনদস্যু তাদের বকাঝকা করছে।

মজার ব্যাপার হলো এই জেলেদের মধ্যে অনেকেই আমার পূর্ব পরিচিত, বাড়ি চিলা বাজারের ওদিকে। এরা সবাই হাসানের প্রতিবেশি। তাদের আটকে দেওয়ায় বেশ ক্ষুব্ধ তারা। একজন তো রীতিমতো হুমকি দিচ্ছিলো যে এখানে সমস্যা করলে তারাও এলাকায় ঝামেলা করবে, হাসানের মাকে এলাকা ছাড়া করবে। আমাকে দেখতেই পরিবেশটা হাল্কা হয়ে গেলো।

কী হলো হাসান? সমস্যা কোথায়? জেলেদের ঝামেলা করছো কেন? বলতে বলতে মতিউর নামের এক পরিচিত জেলে লম্বা সালাম দিয়ে বসলো। বললো, ও ভাই হাসানকে দেখছেন? সেই দিনের ছেলে এখন বনদস্যু হয়ে গেছে। বন্দুক ধরতে পারে না ঠিকমতো। কিন্তু আওয়াজের শেষ নাই। আমাদেরও ছাড় দিচ্ছে না সে। বললাম, মাথা ঠান্ডা করেন। জঙ্গলের পরিবেশ ভালো না।

এই দস্যুদের ওপর অনেক চাপ যাচ্ছে। তাই ওরাও একটু বেশি চাপ দিচ্ছে আপনাদের। বললাম, আজকের দিনটা আমাদের সাথে থাকেন। অন্য সবাইকে বললাম, আজকের মতো একটু কষ্ট করেন সবাই। ভিতরে চলেন। নৌকাগুলো রেখে এই বেলা আমরা সবাই মিলে পিকনিক করবো।

জেলেরা অসন্তুষ্ট। কারণ জোগার গোন চলে। এখনই মাছ-কাঁকড়া ধরার সময়। কিন্তু তাদের ছেড়ে দিলে অনেক বড় বিপদ হয়ে যেতে পারে। দস্যুরা তাই সামনে পড়া জেলেদের আটকে দেয়। রাতে জায়গা পরিবর্তনের সময় এদের ছাড়া হয়। আজও এদের সাথে তাই করা হবে।

আলমগীর বললো, এরা সবাই আমাদের প্রতিবেশি। আগে একসাথে মাছও ধরেছি। তাই ওদের কাছ থেকে কোনো চাঁদা নেই না। কিন্তু এখন কাউকে ছাড়া যাবে না। এদের মধ্যে কেউ প্রশাসন বা সোর্সদের জানিয়ে দিলে সর্বনাশ হয়ে যাবে। দস্যুদের ডিউটি বদল হলো। নতুন করে খালের মাথার এই টাওয়ারে আসলো দুইজন। হাসানসহ আরেকজন নৌকায় উঠে বসলো। এগিয়ে চললাম খালের আগার দিকে।

হাসান বেশ লজ্জা পাচ্ছে এখনও। ওকে নিয়ে পাশে বসালাম। খালের আগায় গিয়ে সবাইকে রেখে হাসানকে নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। জঙ্গলের ভিতরে ঘুরে বেড়াবো আর শুনবো তরুন এই দস্যুর জীবনের গল্প। চারপাশে গাছ আর ঝোপঝাড়। জোয়ারের পানি নামছে। তবে নৌকা বেয়ে ঘোরা যাবে।

হাসানের বয়স তখন ১৯ পেরিয়েছে। ঈদের সময় পাড়ার বন্ধুরা মিলে তাশ খেলছিলো একটি ঘেরের ঘরে। এক সোর্স খবর দিয়ে পুলিশ নিয়ে আসে। পুলিশ আসতেই সবাই দৌড়ে পালায়। কিন্তু ধরা পড়ে যায় হাসান। এরপর তাকে থানায় নেওয়া হয়, মামলা হয়। পরদিন আদালতে চালান দেওয়া হয়। সেখান থেকে জেল হাজত। জামিন নেওয়ার কোনো প্রস্তুতি ছিলো না। কারণ সংসারের তার মা ছাড়া আর কেউ নাই।

হাসান বলছে তার জীবনের কথা। চোখ টলমল করছে। হাতের বন্দুকটি নাড়তে নাড়তে বললো, উকিল খরচ জোগাড় করতে পারিনি ভাই। জেলখানায় পরিচিত একজনের মাধ্যমে খবর পাঠালাম মায়ের কাছে। সে একজনের কাছ থেকে সূদে দশ হাজার টাকা নেয়। তারপর আদালত থেকে জামিন নেওয়া হয়।

মাস দেড়েক পর জেলখানা থেকে মুক্ত হয়ে বাড়ি ফিরে হাসান। সূদের মহাজন প্রথম মাস থেকে সূদের টাকার জন্য চাপ দিতে থাকে। কিন্তু টাকা দিবে কোত্থেকে? কোনো রোজগার তো নাই।

এর মধ্যে নভেম্বর মাস চলে আসে। শুরু হয় দুবলা‌র চরের শুঁটকির মৌসুম। একটি সাবাড়ে চাকরি নিয়ে সে চলে যায় দুবলায়। মাসের বেতন দিয়ে ঋণ শোধ করতে হবে বলে মন দিয়ে কাজ করছিলো। টানা চার মাস বাড়িতে আসা হয়নি। এর মধ্যে তার দফায় দফায় এসেছে মামলার সমন। হাজিরা না দেওয়ায় হলো ফেরারি। এরপর বাড়িতে পুলিশ আসে, সোর্সরা খুঁজে বেড়ায় তাকে। হাসান হয়ে পড়ে স্থানীয় পুলিশের ওয়ান্টেড আসামী।

দুবলার মৌসুম শেষ হয়। হাসানের আর বাড়ি ফেরা হয় না। চলে যায় চট্টগ্রামে। সেখানে দিন মজুরের কাজ করতো। পলাতক জীবন আর চলে না। ঋণের টাকাও দেওয়া বাঁকী।

সূদ টানতে টানতে জীবন শেষ। আবার সূদের কারবারীর কাছে ব্ল্যাংক চেক দেওয়া। মামলা করলে নতুন করে বিপদে পড়তে হবে। চট্টগ্রামে পলাতক এই জীবন টেনে বেড়ানো যাচ্ছে না। হাসানকে বললাম, তখন আমাকে একটু ফোন দাওনি কেন? দশ হাজার টাকার ব্যবস্থা তো করতেই পারতাম। বললো, সোর্সদের জ্বালায় দিশেহারা ছিলাম ভাই। এতো জ্বালাইছে ওরা!

ফেরারি জীবন খুব কঠিন জীবন ভাই। কিছুই গোছানো যায় না। এর মধ্যে দস্যুদের আত্মসমর্পণ শুরু হলো। তারপর এই সাগর বাহিনী ডাকাতি করতে নামলো। কামরুল নামের এক বন্ধুও এই দলে যোগ দিয়েছে। ফোনে তার সাথে কথা বললাম।

কামরুল হাসানকে ফোন দেয় প্রায়। বলে, ডাকাত দলে যোগ দাও। ঋণের টাকা শোধ করতে পারবে। আর পলাতকই যদি থাকবে তাহলে জঙ্গলে এসে থাকাই ভালো। হাসান বললো, তাও আসতাম না ভাই। যখন শুনলাম সাগর বাহিনী সারেন্ডার করবে, তখন আর কোনো দিকে তাকাইনি। সোজা এসে যোগ দিয়েছি এই দলে।

সামান্য তাশ খেলা থেকে মামলা, সেখান থেকে ফেরারি হওয়া, তারপর সশস্ত্র বনদস্যু বনে যাওয়া হাসান বললো, আমাকে মায়ের কাছে ফিরায়ে দেন ভাই। সারেন্ডারটা করায়ে দেন। আমরা এখানে যারা দস্যু হইছি তাদের সবার জীবনের কাহিনী কমবেশি একই রকম। বললাম, তোমরা সারেন্ডার করে সাধারণ জীবনে ফিরবে তো? বনদস্যু হাসান বললো, পুরো জীবন সামনে পড়ে আছে। সারেন্ডারের সুযোগ পেলে আর কোনোদিন বিপথে যাবো না।

গল্পগুলো ক্যামেরায় বলতে চাইলো হাসান। বললাম, এই কাহিনীগুলো আমাদের মধ্যে থাক। আপাতত জীবনটা নিয়ে ফিরো। তোমাদের জীবনে ফিরাতেই আমার এই চেষ্টা। এখনই কথাগুলো বললে সোর্সরা আবার তোমাকে ফাঁসানোর চেষ্টা করবে।

ভাটা হয়ে গেছে অনেকটা। কিছুক্ষণের মধ্যে জঙ্গল থেকে পানি নেমে যাবে। তখন আর নৌকা বেয়ে ফিরতে পারবো না। হাসান বৈঠা ধরলো পিছনে। আমি সামনে। দুজন মিলে বৈঠা মেরে এগিয়ে গেলাম খালের আগার দিকে। এতোক্ষণে নিশ্চয়ই রান্না হয়ে গেছে। ভাত খেতে হবে, ক্ষুধা লাগছে অনেক। পিছনে তাকিয়ে দেখি হাসানের চোখে পানি…!!

(ছবি : সাগর বাহিনীর আস্তানা। অক্টোবর ২০১৬। সুন্দরবন)

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top