রূপান্তরের গল্প ২৩২ | Rupantorer Golpo 232

সারেন্ডার নিয়ে বিভক্ত বনদস্যুরা | রূপান্তরের গল্প ২৩২

সারেন্ডার নিয়ে বিভক্ত বনদস্যুরা | রূপান্তরের গল্প ২৩২ | Rupantorer Golpo 232 | দস্যুমুক্ত সুন্দরবন | সুন্দরবনের গল্প | জীবনে ফেরার গল্প | Jibone Ferar Golpo | Sundarbaner Goppo | Story of Sundarbans | মোহসীন উল হাকিম | Mohsin Ul Hakim


রূপান্তরের গল্প ২৩২ : তীব্র ক্ষুধা নিয়ে বসেছি নৌকায়। ভাত খাবো। সাথে আছে চিংড়ি-সবজির একটি তরকারি, আর গরম ভাত। কিন্তু খেতে গিয়ে থমকে গেলাম। কাঁচা কাঁচা রান্না। ভালো লাগছে না একদম। ইদানিং বেলায়েত সরদারের রান্না ছাড়া খেতে পারি না। কৌশলগত কারণে এই সফরে সরদারকে রেখে এসেছি।

পাশে বসা কামরুল আর হাসান আর কামরুল। ওরা বুঝতে পারলো আমি খেতে পারছি না। উঠে দাঁড়ালো দুজনই। চুলায় তোলা হলো কড়াই। বন্দুকটি ঘাড়ে ঝুলিয়ে মরিচ ভাজতে বসলো কামরুল। সরিষার তেল দিয়ে কড়াই-এ ছেড়ে দিলো শুকনা মরিচ। অন্যদিকে দা নিয়ে বসে বড়লো হাসান। পেঁয়াজ কেটে মরিচসহ এনে সামনে রাখলো। ওরা জানে, একটু শুকনা মরিচ আর কাঁচা পেঁয়াজ হলেই চলে।

বনদস্যুদের রান্না সাধারণত ভালোই হয়। প্রতিটি দলে একজন বাবুর্চি থাকে। আর এজন্য তাকে দস্যুনেতার বিশ্বস্ত হতে হয়। জানতে হয় রান্নাও। এমনিতেই বড় লটবহর নিয়ে চলে দস্যুরা। সাথে থাকে অপহৃত জেলেরা। কখনও শত মানুষের দু্ই বেলার রান্নাও হয় সুন্দরবনের দস্যুদের ডেরায়।

আজ দুপুরে রান্না হবে অন্তত ৫০জনের জন্য। দস্যুদলের সদস্যদের সাথে যোগ হয়েছে প্রায় ২৫/৩০ জন জেলে। যাদের সকালে আটকে দিয়েছে ওরা। কিন্তু কী রান্না হবে আজ? ওরা বললো, খবির মামা খালপাটা জালের মাছ তুলবেন, সেগুলো নিয়ে আসবেন এখানে, তারপর শুরু হবে রান্নার কাজ।

এই মুহুর্তে বনদস্যু সাগর বাহিনীর সদস্য সংখ্যা একুশ জন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আত্মসমর্পণ কতোজন করবে জানি না। তাই ক্যামেরার কাজ শুরুর আগে বিষয়টি পরিস্কার করতে বললাম। ওদের মধ্যে কয়েকজনের বিষয়ে বাইরের মানুষ জানে না। তারা বলছে, চুপচাপ লোকালয়ে ফিরে যাবে তারা। আমরা কাউকে না বললে ওরা সাধারণ জীবনে মিশে যেতে পারবে। বললাম, কাউকে জোর করে সারেন্ডার করানোর ইচ্ছা আমার নাই। তাই যাদের সারেন্ডার নিয়ে আগ্রহ নাই, তারা চাইলে এখনই চলে যেতে পারে। বললাম, আজ যারা সারেন্ডারের জন্য আবেদন করবে, শুধু তারাই যাবে আমার সাথে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে।

দুপুর হয়ে গেছে। চলছে সকালের নাস্তা। এর মধ্যে সাগর বাহিনীর সদস্যদের মধ্যে বচসা শুরু হলো। মাথা গরম করে কেউ বলছে সবাইকেই সারেন্ডার করতে হবে। কেউ বলছে, যাদের সারেন্ডারের ইচ্ছা নাই তাদের এখনই উঠিয়ে দেওয়া হোক। আমি ভাবছি এখানে বাহিনীর পৃষ্ঠপোষকের লোকজন আছে। সেজন্যই কেউ কেউ সারেন্ডার করতে চাইছে না।

একটু পর শ্যুটিং করবো বলে বিষয়টি নিয়ে কথা শুরু হয়েছে। বুঝলাম, যে কয়জন আত্মসমর্পণ করবে না তাদের অন্য পরিকল্পনা আছে। সাগর বাহিনী আত্মসমর্পণ করে উঠে গেলেও তারা সম্ভবত থেকে যাবে, সাগর বাহিনী নামেই চালাবে দস্যুদল।

এই বাহিনীর বেশির ভাগ দস্যু আমার বিশ্বস্ত, পূর্ব পরিচিত। তবে কয়েকজন অপরিচিত এবং তাদের আচরণে সন্দেহ বাড়ছে। প্রত্যেকেই অস্ত্রধারী, সাথে আছে গুলি। হুট করে কোনো দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে। ঝুঁকি নেওয়া যাবে না। এমনিতেই সবাই হয়রান। রাতে ঘুম হয়নি। তাই ঝুঁকি কমাতে হবে।

সবার নাস্তা শেষ হতে হতে দুপুর পেরিয়ে গেলো। ভাটায় জঙ্গলের পানি নেমে গেছে অনেকটা। এই মুহুর্তে সুন্দরবনের এই জায়গার চেহারা একদম অন্য রকম। তিন ঘন্টা আগের চেহারার সাথে কোোন মিল নাই। চারপাশের গাছপালা আর ঝোপঝাড় এখন পরিস্কার দেখা যাচ্ছে।

মধ্য অক্টোবরে সুন্দরবনে ভীষণ গরম থাকে। মাঝে মাঝে বৃষ্টি হয়। দীর্ঘস্থায়ী না হলেও ভারী বৃষ্টি হয়। বিশেষ করে শেষ জোয়ার ও শেষ ভাটায় বৃষ্টি হবেই হবে। এর মধ্যে একটু বাতাস ছাড়ে। এলোমেলো বাতাস। গরম আবহাওয়া তখন আর অসহনীয় লাগে না। কিন্তু বাতাস পাওয়া যায় বড় খাল বা নদীতে। বনের ভিতরে পৌঁছে না। বৃষ্টি হলে গরমটা একটু কমে। সেজন্য শেষ ভাটা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।

ভাটা পুরো শেষ হতে আরও ঘন্টা খানেক সময় লাগবে। এর মধ্যে আমরা বনে নামবো। শ্যুটিং এর কাজ করবো হেঁটে হেঁটে। তবে তার আগে কে কে সারেন্ডার করবে না তাদের আলাদা করতে হবে। মনে মনে ভাবছি, ওদের হাত থেকে অস্ত্র-গুলি নিয়ে নিতে হবে কৌশলে।

আজ হয়তো তারা কোনো ঝামেলা করবে না। তবে আমরা চলে যাওয়ার পর অবশ্যই দলের মধ্যে বড় কোনো ঝামেলা হবে। আত্মসমর্পণের আগে এই ঝুঁকি থাকে। সারেন্ডারে আগ্রহী দস্যুদলগুলোকে নিয়ে তাই অতিরিক্ত সতর্ক থাকতে হয়, মাথা খাটিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে হয়। একটু ফাঁক রেখে এই কাজ এগিয়ে নেওয়া যাবে না, আমি কারও জীবনের ঝুঁকি নিতে চাই না।

বনের নামার আগে দস্যুনেতার সাক্ষাতকার নিয়ে ফেলবো। মূল শ্যুটিং-এ নামার আগে একটু সময় নেওয়া প্রয়োজন। হাসান আর কামরুলকে ইশারায় চারপাশে নজর রাখতে বললাম। একটি নৌকায় বসে পড়লাম সাগর বাহিনীর প্রধান আলমগীরকে নিয়ে।

ক্যামেরা বের করা হয়েছে আরও ঘন্টা খানেক আগে। ভিডিওগ্রাফার মেহেদী মিরাজ প্রস্তুত। নৌকায় বসে আত্মসমর্পণের আবেদন লিখলো ওরা। তারপর তুলে দিলো আমার হাতে।

সাধারণত দস্যুদলগুলো সাক্ষাৎকার দিয়ে আত্মসমর্পণের আবেদন করে। একই সাথে লিখিত আবেদনও করে। সেই আবেদন সরকারের সংশ্লিষ্টদের কাছে পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব থাকে আমার ওপর।

খালের পানি নেমে গেছে অনেকখানি। তাই নৌকা নিয়ে ঘুরে ঘুরে শুটিং করতে পারলাম না। কী আর করা! এক জায়গায় নোঙ্গর করে নৌকায় বসে কাজ শুরু হলো।

ইন্টারভিউ চলছে। দস্যুনেতা বললো, সুন্দরবনে মাছ-কাঁকড়া শিকার করে তার সংসার চলতো। তারপর সঙ্গদোষে অপরাধে জড়িয়ে পড়ে। খুলনা ভিত্তিক একটি অপরাধী চক্রের সাথে মিশে বিপথে চলে যায় সে। তারপর লোকালয় ছাড়তে হয়, অপরাধ থেকে বের হওয়ার সব পথ বন্ধ হয়ে যায়। মামলায় মামলায় জর্জরিত হয়ে আলমগীর হয়ে পড়ে ফেরারি আসামী।

ছোট বেলা থেকে নরম প্রকৃতির যুবক ছিলো আলমগীর। বাবা-মা তাকে ডাকতো ছোট খোকন বলে। পলাতক জীবন থেকে বাঁচতে সে আদালতে আত্মসমর্পণ করে। জেলখানায় কেটে যায় বেশ কয়েক মাস। সেখানেই পরিচয় খুলনার এক অবৈধ অস্ত্র ব্যবসায়ীর সাথে। সেই লোকটিই তাকে সুন্দরবনে দস্যু বাহিনী করার পরামর্শ দেয়।

অস্ত্র-গুলি গুলো সেই শহরের বড় ভাই সরবরাহ করে। চড়া দামে সেগুলো কিনেছে আলমগীর। নগদ টাকায় না, কিস্তিতে ফেরত দিবে অস্ত্রের টাকা। কিছু টাকা ধারও নিতে হয়েছে শুরুতে।

দস্যুতা করতে জঙ্গলে নামার সময় সঙ্গী হিসাবে আলমগীর বেছে নেয় স্থানীয় কয়েকজন ফেরারি যুবককে। পরবর্তীতে এই দলে যোগ দেয় বাইরের কয়েকজন। সেই অস্ত্র ব্যবসায়ীই নাকী পাঠিয়েছে তাদের।

সাগর বাহিনীর উৎপাতের কাহিনী শুনে ভেবেছিলাম হুট করে কেউ নেমেছে। দুই/চারটি পাইপগান নিয়ে ছোট ছোট দল মাঝে মাঝেই নামে। কিন্তু ওখানে গিয়ে ভুল ভাঙ্গলো। হঠাৎ করে নামেনি এই দস্যুদল। পরিকল্পনা করে তাদের নামানো হয়েছে।

দস্যুনেতাকে জিজ্ঞেস করলাম, যখন বনদস্যুরা আত্মসমর্পণ করে উঠে যাচ্ছে, তখন নতুন করে দল নামানোর চিন্তা কেন আসলো? সে বললো, আমি তো নামতে চাইনি। ওই বড় ভাই নামিয়ে দিলো। তারপর নাম ছড়িয়ে গেলো। ফিরার পথ গেলো বন্ধ হয়ে। ভাবছিলাম কয়েকদিন জঙ্গলে ডাকাতি করবো, কেউ জানতে পারবে না।

সুন্দরবনে নামা বনদস্যুরা শুরুতে এভাবেই ভাবে। বড় ভাইরা তাদের সুন্দর করে বুঝিয়ে নামিয়ে দেয়। বলে, জঙ্গলে গেলে কেউ জানতেও পারবে না। কিছুদিন রোজগার করে উঠে পড়বা। তারপর তোমাদের মামলাগুলো টাকা দিয়ে বন্ধ করে ফেলবা।

অনেক টাকার হাতছানি দেখিয়ে দিকভ্রান্ত তরুনদের নামান বড় ভাইরা। তারপর যথারীতি নাম ছড়িয়ে যায়। আয়-রোজগারগুলো যেতে থাকে ওই বড় ভাইদের পকেটে। বনদস্যুদের পরিণতি তখন শুধুই ক্রসফায়ার। ফেরারি ওই যুবকরা আটকা পড়ে বনের ভিতরে।

এদিকে দস্যুদলটির কয়েকজন দেখলাম বেশ ক্ষিপ্ত। কিছুতেই অস্ত্রগুলো হাতছাড়া করতে চাচ্ছে না। এগিয়ে গেলাম তাদের কাছে। বললাম, শ্যুটিং এর সময় ক্যামেরায় চারপাশের ছবি আসবে। এসময় তোমাদের হাতে অস্ত্রশস্ত্র থাকা উচিৎ হবে? ওগুলো নৌকার মধ্যে রাখো। এখানে পাশেই থাকো তোমরা। আমাদের শ্যুটিং এর কাজ শেষ হলে আবার অস্ত্রগুলো নিও।

বিভ্রান্তিতে পড়ে গেলো ওরা। কিন্তু উপায় নাই। তারা অস্ত্রগুলো রাখলো। চোখের ইশারায় সেগুলো দখলে নিলো কামরুল ও হাসানসহ অন্যরা।

আমরা নেমে পড়লাম জঙ্গলে। সবাইকে নিয়ে শ্যুটিং-এর কাজ শেষ করবো। এই জঙ্গলে বাঘের ভয় আছে। সবাইকে চারপাশ খেয়াল রাখতে বললাম। এক কাপ চা খেয়ে নেমে পড়লাম সুন্দরবনে। ক্যামেরায় কথা বলবে সবাই। বনদস্যুরা বলবে যার যার জীবনের গল্প।

ছবি: আত্মসমর্পণের আবেদন করছে দস্যুনেতা আলমগীর। মধ্য অক্টোবর ২০১৬। সুন্দরবন)

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top