পাশের খালে প্রশাসন, কী করি এখন? | রূপান্তরের গল্প ২৩৪ | Rupantorer Golpo 234 | দস্যুমুক্ত সুন্দরবন | সুন্দরবনের গল্প | জীবনে ফেরার গল্প | Jibone Ferar Golpo | Sundarbaner Goppo | Story of Sundarbans | মোহসীন উল হাকিম | Mohsin Ul Hakim
রূপান্তরের গল্প ২৩৪ : ছোট্ট খালের মধ্যে পানি এসেছে। তার মানে জোয়ার প্রায় অর্ধেক হয়ে গেছে। সেখানে কুড়িটি নৌকা একটির সঙ্গে একটি বাঁধা। তার উপর বনদস্যু, জেলে ও আমরা একসাথে বসা। শেষ মাথায় বাঁধা হলো খবির মামা’র নৌকা। খোল থেকে বের হলো প্রায় মণ খানেক মাছ।
কয়েক জাতের চিংড়ি, পারশে, চান্দা, দাতিনা, পায়রা, রুছো, ভেটকীসহ অনেক জাতের মাছ উঠেছে জালে। দুই কেজির কয়েকটি ভেটকি মাছ নিয়ে কাটাকুটি শুরু হলো। ভেটকীর ভুনা হবে, দাতিনা ভাজা হবে আর কেওড়া দিয়ে হবে পাতলা ডাল।
মানুষ বেশি বলে রান্নাও একটি বেশি করে করতে হবে। তাই দুইটি নৌকা মিলিয়ে বানানো হলো রান্নাঘর। দুই চুলার একটিতে চা জ্বালানো হচ্ছে। আরেকটিতে উঠেছে ভাত। তবে এই এক পাতিল ভাতে সবার হবে না। তাই আরেকটি নৌকায় জ্বালানো হলো চুলা। সেখানেও উঠলো আরেকটি ভাতের হাঁড়ি।
আধা ঘন্টার মধ্যে জোয়ারের পানিতে ভাসবে নৌকা বহর। তবে একটু ভালো করে বাঁধা হবে নৌকাগুলো। কাঁদার ওপর রাখা নৌকাগুলো দেখতে দারুণ লাগছে।
এখান থেকে ভালো করে আকাশ দেখা যায় না। তাই আবহাওয়ার অবস্থা ঠিক বুঝতে পারছি না। আকাশের খবর নিচ্ছি কারণ ভারী বৃষ্টি আসলে নিজেদের রক্ষা করতে হবে। অফিসের ক্যামেরা ও যন্ত্রপাতিগুলোকেও পানি থেকে রক্ষা করতে হবে। সেজন্য একটি নৌকায় মজবুত করে ছই দিতে বললাম।
নৌকাটি প্রস্তুত করা হলো। বৃষ্টি হলেই যন্ত্রপাতি নিয়ে ওই নৌকায় উঠে পড়বে আমার সহযাত্রীরা। অবশ্য জোয়ার পুরোটা হতে হতে সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত হবে। তার আগে রান্না হবে। খাওয়া দাওয়া করবো।
জোয়ারে জায়গা বদলে আশেপাশের অন্য কোনো খালে যাবো। রাত কাটাবো সেখানেই। সকালের জোয়ার ধরবো আমরা। ফিরে যাবো জোংড়া খালে রাখা ট্রলারে।
রান্নাবান্নার কাজে অনেকেই হাত লাগিয়েছে। মাছ কাটার কাজ করছে কয়েকজন জেলে। তাদের সহযোগিতা করছে শহরের সেই চারজনের তিনজন। নেতা গোছের ছেলেটি বসা মাঝখানের একটি নৌকায়। তাকে ঘিরে দুইজন শস্ত্র দস্যু পাহাড়া দিচ্ছে সব সময়ের জন্য।
দস্যুনেতাকে জিজ্ঞেস করলাম, তাদের বিষয়ে সিদ্ধান্ত কী হবে? ওরা কি আপনাদের সাথে থেকে যাবে? নাকী উঠিয়ে দিবেন? এবিষয়ে বেশ দুশ্চিন্তায় সে। বললো, আপনারা যাওয়ার পর ওদের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিবো।
কানের কাছে ফিসফিস করে বললাম, ওরা থাকলে তোমরা সারেন্ডার করতে পারবে না। আমার মন বলছে সকালে ওরা তোমার বড় ভাইদের সবকিছু জানিয়ে দিয়েছে।
সকাল থেকে দস্যুনেতার ভাগ্নে মিলনসহ আরও চারজন ছিলো খালের মাথায়। চা খেয়ে নতুন করে চারজন যাবে টাওয়ারে। ওরা পৌঁছালে ফিরবে ডিউটিতে থাকা চারজন। দস্যুনেতাকে বললাম, ওদের সাথে আমি আর তুমি যাবো। একটু লোকালয়ের খবর নিতে হবে। আবারও বলছি, তোমাদের নিয়ে প্রশাসনের একটি অংশ খুব বেশি তৎপর। তাদের সোর্সরাও চাপের ওপর আছে, তারাও ছুটে বেড়াচ্ছে, তোমাদের খোঁজ খবর নিচ্ছে।
ওরা তোমাদের বনের ভিতরেই ধরার চেষ্টা করবে, এখানেই তোমাদের শেষ করতে চায়। আবারও বলি, বনদস্যুদের নিয়ে সরকারের মনোভাব খুবই কঠোর। গুলি চালাতে এক সেকেন্ডও দেরি করবে না।
আমার কথা বিশ্বাস করলো না আলমগীর। বললো, ঘন্টা খানেকের মধ্যে ডিউটি পরিবর্তন হবে। তখন এই খালে ভরপুর পানি থাকবে। কষ্ট করে আর কাঁদা ভাঙ্গতে হবে না। আমরা একটি নৌকা নিয়ে খালের গোঁড়ায় যাবো।
উঁচুতে উঠলে জোয়ারের সময় নেটওয়ার্ক ভালোই পাওয়া যায়। আলমগীর বললো, আপনারা আসছেন বলে ফোন সব বন্ধ রেখেছি। প্রশাসন ট্র্যাকিং করে যাতে আমাদের লোকেশন জানতে না পারে। বললাম, সেটা ভালো কথা। কিন্তু একটু দূরে গিয়ে কোনো গাছের মাথায় উঠে একটু খোঁজ খবর নেওয়া প্রয়োজন।
গত রাত খেকেই মনের ভিতরটা খচখচ করছে। আর সুন্দরবনে আসলে মনে হয় আমার ষষ্ঠ ইন্দ্রীয় একটু বেশি কাজ করে। এই যে দুপুর বেলা শহর থেকে আসা ওই চারজনের ব্যাপারটা খেয়াল না করলে এতোক্ষণে কিছু একটা ঘটে যেতো অন্তত অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে পালাতো ওরা। ওদের কাছে ফোনও ছিলো। গতকাল আমাদের আসার খবর হয়তো কেউ পায়নি। কিন্তু আজকে কী চলছে ওদিকে কে জানে?
দস্যুদের সাথে দেখা করতে গেলে সাধারণত বেশ গল্পগুজব কেটে সময় কাটে। কিন্তু এই দফায় বেশ দুশ্চিন্তা যাচ্ছে। বড় কোনো দুর্ঘটনা ঘটতেও পারে বলে মনে হচ্ছে।
আর এক মুহুর্তও নষ্ট করা যাবে না। আলমগীরকে নিয়ে একটি নৌকা খুলে রওনা দিলাম। খালের মাথায় গিয়ে দেখি মাচায় বসে গভীর ঘুমে আমাদের দুই পাহাড়াদার। গালি দিয়ে তাদের ঘুম ভাঙ্গালো দস্যুনেতা। চোখ ডলতে ডলতে গাছ থেকে নামলো ওরা। দুটি সুন্দরী গাছ মিলিয়ে করা হয়েছে মাচা। বেশ উঁচুতে।
সুন্দরী গাছগুলো বেশ লম্বা হয়। বলতে গেলে পূর্ব সুন্দরবনের সুন্দরী গাছগুলো একটু বেশিই বড় হয়। এর মগডালে বানানো মাচাটিও বেশ মজবুত। সুন্দরী গাছ কেটে বানানো। কিন্তু ওখানে আমি উঠবো কী করে?
আমার সুবিধার জন্য ওরা একটু পর পর পা রাখার জায়গা বানিয়ে দিলো। দশ মিনিটের মধ্যে গাছে ওঠার পরিবেশ তৈরি হলো। শুরুতে উঠলো দস্যুনেতা। তার পিছনে পিছনে উঠলাম আমি। উঠতে উঠতে হাত, পা আর বুকের কয়েকটি জায়গায় ক্ষত হলো। কিছু করার নাই।
মাচায় বসে কয়েকটি ফোন বের করলো আলমগীর। ব্যক্তিগত একটি ফোন খুলে বিশ্বস্ত এক সোর্সকে ফোন দিলো সে। ওপাশ থেকে জানালো সবকিছু আগের মতো আছে। কোনো বাহিনীর অভিযানের খবর তার কাছে নাই।
একটার পর একটা ফোন দিলো সে। কিন্তু কেউ আমাদের আসার খবর জানে না। সাগর বাহিনীকে সারেন্ডার করানো বা তাদের নির্মূল করা নিয়ে কোথাও নাকী কোনো আলোচনা নাই।
আলমগীর বললো, কোনো সমস্যা নাই ভাই। এই জঙ্গলে এসে অভিযান চালানোর মতো বাহিনী এখনও তৈরি হয়নি। আমি বললাম, নিশানখালীর বেলমারীর অভিযানের কথা মনে আছে? সেখানে কিন্তু রাজু বাহিনীর আস্তানা ঘিরে ফেলেছিলো যৌথ বাহিনী। ওই জায়গা এখান থেকে অনেক দূরে, জঙ্গল সেখানে আরও গভীর।
আমরা আরও কিছুক্ষণ বসবো ওখানে। ভালোই লাগছে। এদিকটায় হাল্কা বাতাস আছে। আকাশে মেঘ। পশ্চিম আকাশ কালো হয়ে আসছে। মনে হচ্ছে ঝড়সহ বড় বৃষ্টি হবে।
সারেন্ডারের সময় কী হয়, উকিল কাকে করবে, জামিন নিয়ে বের হয়ে কী করবে, মামলাগুলোর কী হবে, এসব নিয়ে কথাবার্তা হলো। এসব নিয়ে দস্যুনেতার খুব বেশি মাথা ব্যাথা নাই। তার খালি একটাই দুশ্চিন্তা, অস্ত্রের দাম শোধ করা হয়নি।
সবশেষ যে গুলিগুলো কিনেছে সে, তার দামও দেওয়া হয়নি। সব মিলিয়ে প্রায় আট লাখ টাকা পাবে তার শহরের বড় ভাই। বললাম, সারেন্ডার করার পর তোমাদের কাছে এই টাকা ফেরত চাওয়ার সাহস পাবে না ওরা। বললাম, সারেন্ডারের পর তোমাদের দায়িত্ব সরকার নিবে। এসব নিয়ে এতো ভাবনার কোনো দরকার নাই। কবে সারেন্ডার করবে সেটা বলো। আলমগীর বললো, আপনি যেদিন বলবেন সেদিনই উঠে যাবো আমরা।
ঘন্টা খানেক বসলাম সেখানে। দুই পাশে খালের অনেকটা দূর পর্যন্ত দেখা যায়। উত্তর মাথায় আরেকটি মাচা করা। সেখানে আছে আরও দুইজন সশস্ত্র যুবক। এদিক থেকে এখনও কোনো ঝামেলা দেখছি না। এর মধ্যে জোয়ারের পানিতে ভরে গেছে খাল। জোয়ার চলবে আরও দুই ঘন্টার মতো। এদিকে নিচে একটি নৌকা এসেছে। দুইজন দস্যু বসবে পাহাড়ায়।
নৌকা বেয়ে ফিরলাম নৌকা বহরে। সেখানে রান্না চলছে মহাসমারোহে। আমার সহযাত্রীরা নৌকায় একটু জায়গা করে নিয়ে ঘুমাচ্ছেন। এদিকে পশ্চিম আকাশ অন্ধকার হয়ে এসেছে। আধা ঘন্টার মধ্যে রান্না শেষ হলো। সবাই যে যার মতো করে খেয়ে নিলো। আমরাও বসে পড়লাম।
খাওয়া দাওয়া শেষ করতে করতে বিকাল গড়িয়ে গেলো। সন্ধ্যা নামার আগেই ছোট খাল থেকে বের হয়ে মরাপশুরের ভাড়ানীতে গেলাম। জেলেদের নৌকাগুলোও একই সাথে আছে। জোয়ারে পানি বাড়ে, দুশ্চিন্তাও বাড়ে। আমিও দুশ্চিন্তায় আছি। কারণ এই রাতটি পার করা আমাদের জন্য সহজ হবে বলে মনে হচ্ছে না। লোকালয়ের অনেক কাছে বলে দুশ্চিন্তা একটু বেশিই হচ্ছে।
এক কাপ চা খাবো এখানে। ডিউটিতে থাকা দস্যুরা সবাই ফিরবে। তারপর নৌকা বেয়ে রওনা দিবো অন্য কোনো খালের উদ্দেশ্যে। এরই মধ্যে জেলেদের নৌকাগুলো ছেড়ে দেওয়া হলো। ওরা দ্রুত গতিতে চোখের আড়ালে চলে গেলো। এই জোয়ারে বড় খালে বের হবে তারা। এরপর যে যার মতো করে ভাটি দিবে মানে দক্ষিণে নেমে পড়বে। এই গোন মাছ ধরে একবারে ফিরবে তারা।
চারপাশ ঘুটঘুটে অন্ধকার। বৃষ্টির ফোঁটা বড় হচ্ছে। তার মধ্যে দাঁড়িয়ে চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছি। হঠাৎ করে কুঁই আসলো সামনের মাচা থেকে। ঝটপট গাছ থেকে নেমে পড়লো পাহাড়ায় থাকা দস্যুরা। খালের পাড়ে দাঁড়িয়ে যা বললো, তাতে শিড়দাঁড়া বেয়ে কিছু একটি নেমে গেলো।
ওরা বললো, কেবলই প্রশাসনের এক মাঝি ফোন করেছিলো। খুলনা থেকে একটি ট্রলার নেমেছে সুন্দরবনে। শিবসা দিয়ে তারা ঢুকেছে ঝাপসিতে। আমাদের আশেপাশের কোনো খালের ভিতরে অবস্থান নিয়েছে তারা। রাতে সাগর বাহিনীর নৌকা বহরে টার্গেট করে গুলি চলবে। প্রশাসনের এই দলটিকে পথ দেখাচ্ছে ঢাংমারীর এক সোর্স। কী করবো এখন? আমাদের অবস্থানের খবর কে জানালো তাদের?
(ছবি: সাগর বাহিনীর আস্তানা, সুন্দরবন ২০১৬)