বিপদ মাথায় নিয়ে নৌকা ছাড়লাম | রূপান্তরের গল্প ২৩৫ | Rupantorer Golpo 235 | দস্যুমুক্ত সুন্দরবন | সুন্দরবনের গল্প | জীবনে ফেরার গল্প | Jibone Ferar Golpo | Sundarbaner Goppo | Story of Sundarbans | মোহসীন উল হাকিম | Mohsin Ul Hakim
রূপান্তরের গল্প ২৩৫ : দেখতে দেখতে বৃষ্টি নামলো। ঝড়সহ বৃষ্টি। বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে মুহুর্মুহু। অন্ধকার এই বনের ভিতরে সে এক মহাদুর্যোগ। সকালে আটকে রাখা জেলেদের ছেড়ে দেওয়া হয়েছে কিছুক্ষণ আগে। ওরা চলে গেছে যে যার মতো।
দস্যুদের নৌকা বহর ভাসছে। জেলেদের একটি ডিঙ্গি নৌকা আছে সাথে। ভেসে আছি মরাপশুরের ভাড়ানীতে।
বিকাল থেকে মেঘ জমছে। বৃষ্টির প্রস্তুতি ছিলো। তবে ঝড়ো বাতাসসহ এতো ভারী বৃষ্টি হবে ভাবতে পারিনি। তাই সবাই যে যার মতো নৌকার ছই, পলিথিন দিয়ে তৈরি ছাউনির নিচে বসে পড়লাম। ঝড়-বৃষ্টি কমার আগে আপাতত কিছু করার নাই। এদিকে সন্ধ্যা নেমে গেছে, অন্ধকার চারপাশ।
হাতে একদমই সময় নাই। বনদস্যুদের এই জায়গা ছাড়তে হবে এখনই। আমাদেরও সরে যেতে হবে। দিনের আলো থাকলে কিছুটা সময় পেতাম। অন্তত প্রশাসনের নৌকা বা ট্রলার দূর থেকে দেখতে পেতাম। কিন্তু অন্ধকারে সেই সুযোগ নাই। অন্ধকার মানেই অনিশ্চয়তা। কোন দিক থেকে কী হয়ে যায় কেউ বলতে পারে না।
খবর হলো, RAB-এর একটি অভিযান চলছে সুন্দরবনের এদিকটায়। ওদের টার্গেট বনদস্যু সাগর বাহিনী। আমরাও যে এই দস্যুদের সাথেই আছি সেকথা তারা জানে কী না জানি না। জেনে থাকলে অভিযান হবে এক রকম। আর আমাদের অবস্থানের কথা না জানলে কী হবে বলতে পারি না।
শুধু মনে হচ্ছে যেকোনো সময় গুলি শুরু হবে। এই অন্ধকারে সেই আক্রমণের তান্ডব কোন পর্যায়ে যাবে বলা যাচ্ছে না। আমার সাথে থাকা দস্যুরাও বন্দুকে গুলি ভর্তি করে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত।
প্রশিক্ষিত দস্যুরা সাধারণত প্রশাসনের সাথে গোলাগুলি করে না। নিজেদের জীবন বাঁচাতে যতোটুকু না করলে নয় সেটুকুই করে। এর মধ্যে নিজেদের আড়াল করে ফেলে। কিন্তু এই দস্যুদলের সদস্যরা সবাই নতুন। সম্মুখযুদ্ধের অভিযজ্ঞতা এদের কারোই নাই। বন্দুক চালানোর অভিজ্ঞতাও কম ওদের। তাই সামনে যাই আসুক এই মুহুর্তে আমার প্রথম কাজ দস্যুদের থেকে আলাদা হওয়া।
বৃষ্টি কমতেই ছই থেকে বের হলাম। দস্যুনেতাকে বললাম, প্রশাসন আছে উত্তর-পশ্চিম দিকের কোনো খালে। তোমরা যাবে দক্ষিণে বা দক্ষিণ পূর্ব দিকের কোনো খালের মাথায়। এই জোয়ারটা খুব সতর্ক থাকবে।
আমার সহযাত্রীরাও কী করবে বুঝতে পারছে না। বললাম, সবাই মাথা ঠান্ডা রাখবেন, আমাকে অনুসরণ করবেন। আপাতত নিজের সিদ্ধান্তে কিছু করবেন না। দস্যুনেতাকে বললাম, আপনারা এই জায়গা ছাড়েন।
চিপা’র খাল দিয়ে যে নৌকাটি নিয়ে এসেছিলাম যাওয়ার পথে ওই নৌকাটিই নিচ্ছি। আসার পথে গাছের গুঁড়িতে ধাক্কা খেয়ে এই নৌকার তলা ফেটে যায়। দিনভর সারানোর চেষ্টা করলেও পুরোটা ঠিক হয়নি।
নৌকার তলের ফাটা অংশ দিয়ে পানি ঢুকছে। মাঝি এই ফাটা নৌকা নিয়ে ফিরতে চাচ্ছেন না। কিন্তু বিকল্প কিছু তো নাই। বললাম, কিছু তো করার নাই মামা। অতিরিক্ত কোনো নৌকাও নাই এখানে। সবাই যে যার মতো চলে গেছে।
ক্যামেরাসহ যন্ত্রপাতিগুলো নৌকায় স্থানান্তর করছেন সহযাত্রীরা। সাথে আনা আমাদের ব্যাগগুলোও তোলা হচ্ছে। সাথে খাবার পানি ও কিছু শুকনা খাবার নিতে বললাম।
রওনা দেওয়ার আগে দস্যুনেতার সাথে প্রয়োজনীয় আলাপগুলো সেরে নিলাম। বললাম, যদি ঠিকঠাক উঠে যেতে পারি তবে ঢাকা ফিরেই তোমাদের সারেন্ডারের বিষয়টি চুড়ান্ত করবো। মাঝের সময়টুকুতে সর্বোচ্চ সতর্ক থাকবে। আর শহর থেকে আসা ওই চারজনকে আগামী কালই উঠিয়ে দিবে। নিরাপদে লোকালয়ে পৌঁছে দিয়ে আমাকে জানাবে।
সন্ধ্যা সাড়ে সাতটা বাজে। বৃষ্টি আরেকটু কমে এসেছে। তবে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। বাতাস কমেনি এখনও। ছোট খাল বলে সেই ঝড়ো বাতাসের চাপ নিতে হচ্ছে না। তবে নৌকা ছেড়ে এগুলে সামনে বড় খাল পড়বে। ওই পর্যন্ত যেতে যেতে বাতাস না কমলে আমাদের ছোট কোনো খালে ঢুকে পড়তে হবে।
শেষ জোয়ার থাকতে থাকতে চিপা’র খালে ঢুকতেই হবে। ভাটা হয়ে গেলে আবারও আটকা পড়তে হবে। সেই বিপদে পড়া যাবে না কিছুতেই। আসার সময় সশস্ত্র দস্যুরা ছিলো সাথে। কিন্তু এবার নিজেদেরই পার হতে হবে ওই খাল। তার ওপর নৌকার তলা ফাটা। জানি না কী ভাবে পার হবো ওই সরু খাল!
দস্যুনেতাকে কাছে ডেকে নিলাম। কানের কাছে এসে বললো, আমাদের খবর কী করে পেলো প্রশাসন? বললাম, তোমাদের সাথে থাকা খুলনার ওই চারজন সদস্যের কাজ এটা। ধারণা থেকে বললাম, গতকাল সকালেই খুলনার সেই বড় ভাইকে ওদের কেউ ফোন বা মেসেজ দিয়েছে। জানিয়েছে আমাদের আসার কথা। অবস্থানের কথাও নিশ্চয়ই বলেছে।
সেই বড় ভাই সরাসরি বা কোনো মাধ্যম দিয়ে কথাটি জানিয়েছে সোর্সকে। সোর্স জানিয়েছে প্রশাসনকে। তারপর দিনের ভাটাতেই ট্রলার বা স্পিডবোট নিয়ে তারা নেমে পড়েছে জঙ্গলে। ছুতারখালী বা ঢাংমারী থেকে নেমেছে বলে তোমাদের মংলা’র কোনো সোর্স খবর পায়নি। একমাত্র ওদের মাঝিই জানতে পেরে তোমাদের কাছে খবরটি পৌঁছেছে।
আগাম খবর না পেলে আজ রাতে হয়তো বড় কোনো দুর্ঘটনা ঘটে যেতো। আলমগীর বললো, ওদের ফোনগুলো চেক করেছি। কিন্তু কল লিস্ট-এ কিছু পাইনি। মেসেজেও কিছু নাই। বললাম, কল লিস্ট ও মেসেজ তারা রেখে দিবে? বললাম, ওরা খবর না দিলে এতো তাড়াতাড়ি জায়গা মতো অভিযান চলা সম্ভব না। সাথে আছে একজন দক্ষ সোর্স (পরে জেনেছি)।
ঢাংমারী’র সোর্স নজির হাওলাদার। বন-উপকূলের এই মানুষটি বেশ চতুর প্রকৃতির। বনের পথঘাট ভালো চিনেন। আবার দস্যুদের গতিবিধির খবরও রাখেন। এর আগে করমজলের বাওনে যে অভিযানটি হয়েছিলো সেই অভিযানেও RAB-এর সাথে ছিলেন এই নজির।
দস্যুনেতা আলমগীর বললো, ওরা সামনে পড়লে কী করবো? বললাম, এড়িয়ে চলতে হবে। এদিক থেকে যেন একটি গুলিও না হয়। বিদায় নেওয়ার সময় বললাম, ওই চারজনকে কিছু বলবে না, ওদের কোনো রকম শাস্তিও দিবে না। কালকেই ওদের লোকালয়ে পৌঁছানোর ব্যবস্থা করবে।
নৌকায় মালপত্র উঠে গেছে। সহযাত্রীরাও উঠে বসেছে। একজন নৌকার খোলের পানি ফেলছে। মনে হচ্ছে আমি উঠলেই ডুবে যাবে নৌকা। টর্চ জ্বালিয়ে চারপাশে আরেকবার দেখলাম। যদি নৌকাটি বদলানো যায়। কিন্তু বাড়তি কোনো নৌকা নাই।
হাতের টর্চলাইটটি এক দস্যুর হাতে দিলাম। সে আলো ফেললো। সতর্কতার সাথে উঠে বসলাম নৌকায়। দুলে উঠলো নৌকা, একপাশ কাত হয়ে পানিও ঢুকলো। তারপর ভারসাম্য ঠিক করে আস্তে করে বসে পড়লাম। বিদায় দিলাম ওদের।
দস্যুরা মিনিট খানেকের মধ্যে চোখের আড়াল হয়ে গেলো। এসময় মনে পড়লো আমার টর্চটি ফেরৎ নেওয়া হলো না। চিৎকার করে যে ওদের ডাক দিবো সেই সাহসও হলো না। কারণ এখন কোনো শব্দ করা যাবে না।
সামনের পথটুকু আমাদের সর্বোচ্চ সতর্ক থাকতে হবে, কোনো আওয়াজ করা যাবে না। নৌকায় সবার সামনে বসেছেন জামাল মেম্বার। হাতে তাঁর বৈঠা। তারপর সহকর্মী মিরাজ ও ইয়ামীন ভাই এ সারিতে বসা। খোলের সামনে বসা নৌকার সহযোগী এক কিশোর। সারাক্ষণ পানি ফেলছে সে। এরপর বসেছি আমি। আর আমার পিছনে নৌকার মাঝি। ছোট্ট নৌকায় মানুষ আমরা ছয়জন।
মরাপশুরের ভাড়ানী ধরে উত্তরে যাবো আমরা। মাঝে বেশ কয়েকটি পাশখাল পড়বে। আমরা যাবো ডানপাশ ধরে। প্রশাসনের নৌকা বা ট্রলার সামনে পড়লে ডানের কোনো খালের ভিতরে ঢুকবো আমরা। আর যদি তাদের সামনে না পড়ি তবে সোজা বেয়ে যাবো। ডানপাশ ধরে চলছে আমাদের নৌকা। জোয়ারের শ্রোত এখনও আছে। তাই উজান বেয়ে চলতে একটু কষ্ট হচ্ছে।
একের পর এক পাশ খাল পারি দিচ্ছি। সামনের দিকে সতর্ক দৃষ্টি। আমি অতো বুঝি না। তবে নৌকার মাঝির ওপর ভরসা আছে। ওরা অন্ধকারেও অনেক দূর পর্যন্ত দেখতে পায়। চলার পথে কোনো জেলে নৌকায় নজরে এলো না।
আমাদের সাথে থাকা নৌকাগুলো আগেই বেরিয়ে গেছে। প্রশাসনের নৌকার সামনে ওরা কেউ পড়লেই আটকে ফেলবে। আর ওদের কেউ মুখ খুললে আমাদের খবর আছে।
সুন্দরবনে এমনিতে বিপদের কোনো শেষ নাই। আমার এই কয়েক বছরের অভিজ্ঞতাও তেমনই। যদিও এখন পর্যন্ত পড়া সবগুলো বিপদ থেকে কোনো না কোনো ভাবে উদ্ধার পেয়েছি। কিন্তু প্রতিবারই যে বেঁচে যাবো সে কথা বলা যায় না।
নৌকার মাঝি বললেন, আপনারা নড়াচড়া করবেন না। এমনিতেই লোক বেশি। তার ওপর পানি ঢুকছে। নৌকার দুই পাশে এক ইঞ্চি করে জেগে আছে। এর মধ্যে যদি নড়াচড়া করেন তাহলে ডুবে মরতে হবে।
এখন ভরা জোয়ার। খাল ভর্তি পানি। আধা ঘন্টার মতো এগিয়ে পৌঁছে গেলাম চিপা’র দোয়া। এখান থেকে বাম পাশে চলে গেলে ঝাপসির খাল। আমরা ঢুকে পড়বো সোজা চিপা’র খালে। ফিসফিস করে মাঝি ভাইকে বললাম, এখানে একটু দাঁড়ান। প্রশাসনের লোকজন যদি ট্রলার বা স্পিডবোট নিয়ে আসে তাহলে এখানে কোথাও থাকবে।
বললাম, ট্রলার নিয়ে ওরা ছোট খালে ঢুকবে না। আর ওরা থাকলে অবশ্যই একটু হলেও আলো জ্বালানো থাকবে। নৌকা থামলো। ডান পাশের একটি কেওড়া গাছের নিচে ঢুকে পড়লাম।
খাল থেকে নৌকা নিয়ে ঢুকে পড়বো বনের ভিতরে। একটু দূর দিয়ে ধীরে ধীরে চলে যাবো পূর্ব দিকে। জোয়ার বলে জঙ্গলের ভিতরে ঢুকতে সমস্যা হলো না। জঙ্গলের ভিতর দিয়ে কিছুটা এগিয়ে আবার খালের দিকে ঘুরলো নৌকা। এখান থেকে সোজা ঝাপসি খালের ভাড়ানী খালটি দেখা যাচ্ছে।
ওই খালের প্রথম বাঁকের আগেই একটি মাঝারি খাল আছে। সেই খালের মুখে একটি ট্রলার। বুঝতে বাঁকি রইলো না ওরা কারা। আরেক দফা ভয় পেলাম। নৌকা নিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লাম সেখানেই। সামনে বসা মেম্বার বললেন, দাঁড়ানো যাবে না এখানে। আমাদেরকে দেখলেও ওরা এই পর্যন্ত আসার আগেই চিপা’র খালে ঢুকে পড়বো। বললাম, বৈঠা মারেন। সামনে যা হওয়ার হবে। ওদিক থেকে গুলি চালালেও বৈঠা বাওয়া থামাবেন না। সামনে যা আসে আসুক, এগিয়ে যেতে হবে।
(ছবি: সাগর বাহিনী। মরাপশুরের ভাড়ানী। সুন্দরবন। অক্টোবর ২০১৬)