রূপান্তরের গল্প ২৩৭ | Rupantorer Golpo 237

পাশ দিয়ে হাঁটছে বাঘ | রূপান্তরের গল্প ২৩৭

পাশ দিয়ে হাঁটছে বাঘ | রূপান্তরের গল্প ২৩৭ | Rupantorer Golpo 237 | দস্যুমুক্ত সুন্দরবন | সুন্দরবনের গল্প | জীবনে ফেরার গল্প | Jibone Ferar Golpo | Sundarbaner Goppo | Story of Sundarbans | মোহসীন উল হাকিম | Mohsin Ul Hakim


রূপান্তরের গল্প ২৩৭ : বিজলি চমকাচ্ছে। বাতাস বন্ধ হয়ে গেছে। এই চিপা খাল থেকে আকাশ দেখতে পাচ্ছি না। আবহাওয়ার অবস্থাও বুঝতে পারছি না। তবে চারপাশের দম বন্ধ করা পরিবেশ বলছে, বৃষ্টি নামবে। আবারও বৃষ্টি নামবে ভাবিনি। ঘন্টা খানেক আগেই তো বৃষ্টি হলো! নৌকার মাঝি বললেন, আশ্বিন মাসের বৃষ্টি এমনই।

নৌকা ঢুকে পড়েছে চিপা’র খালের সরু অংশের মধ্যে। দেখতে দেখতে টিপটিপ বৃষ্টি নামলো। কিছুক্ষণের মধ্যে শুরু হলো মুষলধারে বৃষ্টি। শরৎ কালের এই বৃষ্টি নিয়ে বেশ বিপদেই থাকতে হয়। বৃষ্টির পানি থেকে বাঁচতে প্রস্তুতি নেওয়ার সময় পাওয়া যায় না।

পলিথিন দিয়ে ক্যামেরার যন্ত্রপাতি ও ব্যাগগুলো ঢাকা। তবে আমরা ভিজে গেলাম বৃষ্টিতে। এর কিছুক্ষণের মধ্যে ঝড় নামলো। কয়েক মিনিটের সেই ঝড়ের দাপট অবশ্য টের পেলাম না আমরা। সুন্দরবনের সরু খালে থাকলে ঝড় টের পাওয়া যায় না।

নৌকার সামনে বসে সহযাত্রীরা গল্প করছেন। অন্ধকারের মধ্যে সুন্দরবনের এই জায়গায় ঝুঁকিগুলো তাদের মাথায় নাই। অভিজ্ঞতা আছে বলে আমি ভয় পাচ্ছি। এখানকার পরিবেশে স্বস্তি পাচ্ছি না। নৌকা আগাচ্ছে, ভাবছি কোনো ভাবে এই সরু জায়গাটি পার হতে পারলেই হয়।

সামনে জোংড়া খাল। তার উত্তরে করমজল। আরও সামনে ঢাংমারি। আমাদের পূর্ব দিকে পশুর নদী। আর পশ্চিমে ঝাপসি, ভদ্রা হয়ে শিবসা নদী। মধ্য সুন্দরবনের এই জায়গাটি অভয়াশ্রম। জঙ্গলে বাঘ, জলে কুমির এখানকার বাস্তবতা। লোকালয়ের কাছাকাছি হলেও বাঘ-কুমিরের আনাগোনা আছে এই অঞ্চলে।

বেশ কিছুদিন আগে সুন্দরবনের পর্যটনকেন্দ্র করমজলে গেছি। দুপুর বেলা, কোনো কারণে পর্যটক ছিলো না। হাঁটা পথ ধরে সামনে এগিয়ে বনের মধ্যে নেমে যাই। হঠাৎ বাঘের গন্ধ নাকে আসে। দৌড়ে ফিরে আসি ফরেস্ট অফিসের সামনে। বনকর্মীরা বিশ্রাম নিচ্ছিলেন। ভয় পেয়ে করমজলের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা রউফ সাহেবকে ডেকে তুলি। সবকিছু শুনে আমার ওপর বেশ রাগ করলেন। বললেন, একটি বাঘ এদিকে থাকে সব সময়।

করমজলে আছে কুমিরের কৃত্রিম প্রজণন কেন্দ্র। ফরেস্ট অফিসের পিছনে দুইটি পুকুর আছে। তার মধ্যে একটিতে থাকে রোমিও ও জুলিয়েট নামের কুমির দম্পতি। লবণ পানির কুমিরের এই জুটি থেকে নিয়মিত ডিম আসে। কৃত্রিম ভাবে সেই ডিম ফুটানো হয়। বড় করা হয় তারপর ছেড়ে দেওয়া হয় সুন্দরবনের খালে। মূলত সুন্দরবনের কুমিরের সংখ্যা বাড়ানোর জন্য এই উদ্যোগ নিয়েছে বন বিভাগ।

করমজল ইকোট্যুরিজম কেন্দ্রের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা রউফ সাহেব নিজে এসব দেখভাল করেন। উনার সাথে হাঁটতে হাঁটতে পুকুরের পাশে গেলাম। চারপাশে দেওয়াল দেওয়া। সেই দেওয়ালে হাত দিয়ে বাড়ি দিয়ে তিনি ডাকলেন কুমিদের নাম ধরে। মিনিট খানেকের মধ্যে রোমিও ও জুলিয়েট ভেসে উঠলো।

রউফ ভাই বললেন, আশেপাশে বাঘ আছে। একটু খেয়াল করে দেখেন, একটি বানরও নাই, বনের হরিণ ও বন্যশুকরগুলোও কোথায় জানি গায়েব হয়ে গেছে। বাঘ আশেপাশে থাকলে পাখির ডাকাডাকিও থেমে যায়। এখানে বন্যপ্রাণি বলতে দেখলাম ঘেরাও দেওয়া একটি জায়গায় কয়েকটি চিত্রা হরিণ। এর পাশের মাঠে হরিণের জন্য ঘাস কাটছে এক যুবক।

সেই সফর থেকে ফিরার পর পর দু:সংবাদ আসলো করমজল থেকে। ঢাংমারির এক যুবককে বাঘে ধরেছে। খোঁজ খবর নিয়ে জানতে পারলাম, হরিণের জন্য ঘাস কাটছিলো যে যুবক তাকেই আক্রমণ করেছে বাঘ। আমরা যেই বাঘের ভয় পেয়েছিলাম সেই বাঘটিই নাকী ধরে নিয়ে গেছে ছেলেটিকে। খবর পেয়ে স্থানীয়রা ঢুকে পড়ে বনের ভিতর। বাঘের মুখ থেকে কেড়ে আনে সেই যুবকের মৃতদেহ।

নৌকায় বসে সেই হতভাগ্য যুবকের কথা ভাবছি। পুরো শরীর বেড়ে পোকায় ছেয়ে ফেলেছে। বৃষ্টিতে ভেজা শরীরের খোলা অংশ পোকার কামড়ে ফুলে গেছে। সাথে টর্চ লাইট নাই বলে দেখতে পারছি না। এই মুহুর্তে কিছু করারও নাই। বৃষ্টির পানিতে নৌকার খোল ভরে গেছে। পানি ফেলতে হচ্ছে দ্বিগুন গতিতে।

হঠাৎ করে বৈঠা বাওয়ার গতি কমে গেলো। পিছনে বসে মাঝি উসখুস করছেন। চোখে কিছু দেখছি না। তবে নাক আর কান খাড়া করে বুঝার চেষ্টা করছি। নিরব চারপাশ। কেমন একটা গন্ধ পাচ্ছি। তবে সুন্দরবনের এখানে সেখানে পঁচা গন্ধ পাওয়া যায়। পাত্তা দিলাম না। পিছন ফিরে মাঝিকে জিজ্ঞেস করলাম, কোনো সমস্যা?

নৌকার মাঝি ছটফট করছেন। নিজেকে বোঝানোর চেষ্টা করছিলাম, অন্য কিছু। কিন্তু মাঝি বললেন, বিরাট সমস্যা। মামা আশেপাশেই আছে। অর্থাৎ আমাদের খুব কাছাকাছিই আছে বাঘ। সাথে টর্চলাইট নাই? বললাম, টর্চ তো ডাকাতদের কাছে রেখে আসছি। মাঝি বললেন, এখন একটা টর্চ লাইট লাগবেই। ফিসফিস করে বললেন, বাঘ আমাদের ডান পাশ দিয়ে হাঁটছে। এখন ওকে ভয় দেখাতে হলে বড় আলো লাগবে।

নাই জেনেও ব্যাগের ভিতরে আবার খোঁজাখুঁজি শুরু করলাম। টর্চ নাই। সাথের মোবাইল ফোনের চার্য নাই। ব্যাগের ভিতর থেকে পুরনো একটি মোবাইল ফোন বের হলো। চাইনিজ ফোন। চালু করলাম। এর সাথে যে লাইট আছে তা জ্বালালাম। পর্যাপ্ত না হলেও এই আলোই এখন ভরসা।

ছোট টর্চ দিয়ে খালের দুই পাশে আলো ফেলছিলাম। বাঘকে বিভ্রান্ত করার জন্য জঙ্গলের উপর টর্চ এর আলোর বাড়ি দিতে হয়। আমি সেই কাজটিই করতে থাকলাম। মাঝি বললেন, বাঘ মামা আছে ডান দিকে। জঙ্গলের একটু ভিতর দিয়ে হাঁটছে। বেশি না, কয়েক হাত ভিতর দিয়ে হাঁটছে আস্ত একটি বাঘ। এক হাতে নৌকা ধরে আছি। আরেক হাতে আলো ফেলছি খালের পাশে। চিপার খাল এখানে খুব বেশি হলে তিন ফুট। দুই পাশে হাত দিয়ে জঙ্গল ছোঁয়া যায়।

হৃৎপিন্ডটি মনে হয় বুকের খাঁচা ভেঙ্গে বের হয়ে আসবে। ধকধক শব্দ নিজেই শুনতে পাচ্ছি। কান পেতে আছি। ডান পাশের বনের ভিতর থেকে মাঝে মাঝে খুটখাট শব্দ আসছে। মনে হয় বাঘ মামার পায়ের তালুর নিচে গাছের শুকনো ডাল পড়ছে। শুধু মনে হচ্ছে যেকোনো সময় হামলে পড়বেন উনি।

সৃষ্টিকর্তার কাছে সাহায্য চাইছি। আল্লাহকে বললাম, বাঘ আক্রমণ করলেও যেন আমাকেই করে। সহযাত্রীদের কিছু হলে তার জবাব আমি কী করে দিবো?

ভয়ঙ্কর এই বিপদ নিজের মধ্যেই রাখলাম। সামনে বসা সহযাত্রীদের বুঝতে দেইনি। আতঙ্ক ছড়াতে চাইনি। এভাবে টানা প্রায় পঁয়তাল্লিশ মিনিট চললাম। দুশ্চিন্তায় বেড়ে পোকার কামড়ের কথা ভুলে গেছি। হাতের ওই মোবাইল ফোনের ব্যাটারি শেষ পর্যায়ে। আলো কমছে ক্রমেই। ক্যামেরার ব্যাগে যে বড় লাইট আছে সেটিও মনে পড়েনি।

ছপছপ করে পানি সেঁচার শব্দের সাথে চলছে বৈঠার বাওয়ার শব্দ। ঝিরঝির বাতাসের সাথে মিশে গেছে ঝিঁঝিঁ পোকার শব্দ। কোনো জোনাকী পোকা দেখছি না। নিশাচর কোনো বন্যপ্রাণির হাঁটাচলারও কোনো আলামত নাই।

এদিক দিয়ে চলার সময় সাধারণত হরিণের ডাক শোনা যায়, বানরের চেঁচামেচি শুনি। তাদেরও কোনো খবর নাই। গাছপালার ভিতর দিয়ে নৌকা চলছে। বাঘের ভয়ে সাপের ভয় ভুলে গেছি। চোখ বন্ধ করলেই মনে হয় দেখতে পাচ্ছি, বিশাল একটি বেঙ্গল টাইগার হাঁটছে আমাদের ডানপাশ দিয়ে।

(ছবি: সৈয়দ আনাছ, ক্লাব ৯৮)

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top