রূপান্তরের গল্প ২৩৮ | Rupantorer Golpo 238

মরতে মরতে বেঁচে ফিরলাম | রূপান্তরের গল্প ২৩৮

মরতে মরতে বেঁচে ফিরলাম | রূপান্তরের গল্প ২৩৮ | Rupantorer Golpo 238 | দস্যুমুক্ত সুন্দরবন | সুন্দরবনের গল্প | জীবনে ফেরার গল্প | Jibone Ferar Golpo | Sundarbaner Goppo | Story of Sundarbans | মোহসীন উল হাকিম | Mohsin Ul Hakim


রূপান্তরের গল্প ২৩৮ : হুম হুম আওয়াজ তুলে বৈঠা বাইছেন মাঝি। নির্বিঘ্নে সামনের পথটুকু পারি দিতে হবে। তাই পানি সেঁচা বাদ দিয়ে গলুইয়ে গিয়ে বসেছে নৌকার সহকারি কিশোরটি। চারপাশ অন্ধকার। মোবাইলের টর্চের আলো মিইয়ে এসেছে।

আবছা আলোতে সরু এই খালের ভিতর দিয়ে তর তর করে এগুচ্ছি। গাছের ডাল, কাঁটা আর লতাপাতার বাড়ি খেতে খেতে অভ্যস্ত হয়ে গেলাম। ক্ষত-বিক্ষত হচ্ছে হাত-পা। ডান পাশে বাঘ হাঁটছে। দেখতে পাচ্ছি না। কিন্তু স্পষ্ট বুঝতে পারছি। অনুভব করছি। শুনতে পাচ্ছি বেঙ্গল টাইগারের হাঁটার খুটখাট শব্দ।

সাথে বড় টর্চ নাই। বন্দুকও নাই। বাঁচবো কী করে? পিছন থেকে মাঝি বললেন, বাঁচানোর মালিক আল্লাহ। তারে ডাকতে থাকেন। আমরা আমাদের চেষ্টা চালাই। আপনারা নড়াচড়া করবেন না। এখানে নৌকা ডুবলে আর বাড়ি ফেরা হবে না।

নৌকা দুলে উঠলো হঠাৎ করে। ভারসাম্য হারিয়ে জঙ্গলের ভিতরে উঠে পড়লো নৌকার সামনের দিকটা। এই আতঙ্কের মধ্যে নৌকাটি ডানপাশে উঠে গেছে। মানে যেদিকে মামা সেদিকেই। ভাগ্যিস পানি কমেছে।

ভাটা চলছে। ঘন্টা খানেকের মধ্যে দুই পাশের ডাঙ্গা জেগে গেছে। তাই ছোট হলেও মূল খালটি এখন স্পষ্ট। কেওড়া গাছের একটি ভাঙ্গা ডালের সাথে ধাক্কা খেয়ে থামলো নৌকা। সাথে সাথে সামনে বসা কিশোর নেমে গেলো। ঠেলা দিয়ে খালে নামিয়ে আনা হলো। টালমাটাল অবস্থায় কোনো রকমে ভারসাম্য রেখে গলুই-এ উঠে বসলো সে।

এদিকে নৌকার খোল ভরে গেছে পানিতে। অপরিপক্ক হাতে পানি সেঁচছে মিরাজ। নৌকা বাওয়ার সাথে পানি সেঁচার ছন্দ ঠিক মিলছে না। তাই টলমল করছে নৌকা। হুস হুস শব্দে একটানা চলছি আমরা। দেখতে দেখতে কমছে পানি। মাঝি বললেন, কোলের কাছে বাঘ। কাঁদায় আটকানো যাবে না মামা। বলেই সজোনে বৈঠা মারলেন পানিতে।

নৌকা দুললে চলতে সমস্যা হয়। তাই সবাইকে সোজা হয়ে বসার নির্দেশ দিলাম। বললাম, আরও দশ মিনিট এভাবে চলতে হবে। মনে মনে বললাম, বাঘটিকে পাশে রেখেই চলতে হবে। মাঝি বললেন, ভয় পাইয়েন না মামা। ও আক্রমণ করলে এতোক্ষণে করে ফেলতো। মনে হয় ক্ষুধা নাই। বললেন, নিজেরা ভয় পাবেন না, ওদেরকেও ভয় দেখানো যাবে না।

মাঝি বললেন, ক্ষুধা না থাকলে এভাবেই হাঁটবে সে। কিছু বলবে না। বললাম, ভয় পাচ্ছি না। কিন্তু ভিতরে ভিতরে ভয়ে ঘেমে গেছি। আগে ভাবতাম, বাঘ দেখলে ভয় পাবো। কিন্তু উনাকে না দেখে বাঘের ভয়টা যে অনেক বেশি তীব্র, অসহনীয় তা জানা ছিলো না। আমি সেই অদেখা ভয় মাথায় নিয়ে নির্বিকার বসে আছি।

হঠাৎ করে হাতের মোবাইল ফোনটির আলো বন্ধ হয়ে গেলো। চার্য শেষ। এবার অন্ধকার চারপাশ। আবছা আলোয় খাল দেখা যাচ্ছে। কিন্তু এতোক্ষণ লাইটের বাড়ি মেরে বাঘকে ভয় দেখানোর যে চেষ্টা করছিলাম সেটি বন্ধ হয়ে গেলো।

সহযাত্রী জামাল মেম্বার পকেট থেকে গ্যাস লাইটার বের করলেন। এর সাথে যে ছোট্ট এলইডি বাতি থাকে সেটি জ্বালিয়ে পথ দেখালেন। নৌকার মাঝি আর আমি ছাড়া বাঘের উপস্থিতি কেউ টের পায়নি। তাদের বলতেও চাই না। এভাবেই কাটুক আরও কয়েক মিনিট।

এই ভয়ঙ্কর সময়ে সাথে বনদস্যুরা থাকলে এতো বিপন্ন লাগতো না। হুট করে RAB-এর অভিযান না হলে ওরা আমাদের জোংড়া পর্যন্ত পৌঁছে দিতো। বন্দুকধারীরা পাশে থাকলে আর কিছু না হোক, ফাঁকা গুলি করে ভয় দেখানো যেতো বাঘটিকে। কিন্তু পরিস্থিতিই এমন ছিলো। ওদের সাথে বিচ্ছিন্ন হওয়া ছাড়া বিকল্প ছিলো না।

সামনে একটি বাঁক পড়বে। সেখানে খালের পুরোটা জুড়ে আছে একটি বড় বাইন গাছ। সেই গাছের একটি বড় ডাল ডুবে আছে পানির নিচে। আরেকটি ডাল ঠিক মাথার ওপরে। দুই ডালের মধ্যে দূরত্ব তিন ফুট হবে। তার ভিতর দিয়ে নৌকা নিয়ে পার হতে হবে।

অনেক কসরৎ করে জায়গাটি পার হলাম। তারপর আরেকটি বাঁক পেরুতেই খাল একটু চওড়া হলো। এরপর মিনিট পাঁচ চললাম। দুটি পাশ খাল মিশেছে। খাল এবার বেশ প্রশস্ত। নৌকা মাঝ বরাবর নিয়ে বৈঠা ছেড়ে দিলেন মাঝি।

দুজনের দীর্ঘশ্বাস পড়লো একসাথে। নৌকায় বসা অন্য সহযাত্রীরা ভাবছেন হয়রান হয়ে বৈঠা বাওয়া বন্ধ করেছেন মাঝি। বললাম, তা নয়। বিশাল বিপদ পার করে আসলাম। আস্ত বাঘ এতোক্ষণ আমাদের ডান পাশ দিয়ে হাঁটলো। মজা করে বললাম, মামায় পাহাড়া দিলো। এবার ওরা নির্বাক। এতোক্ষণ যে ভয় আমাকে আচ্ছন্ন করে রেখেছিলো সেটি ছড়িয়ে পড়লো সবার মধ্যে।

মিরাজকে সরিয়ে এবার এগিয়ে বসলাম। নৌকার পানি সেঁচার কাজটা ভালো পারি। মাঝখানে বসে পানি ফেলছি আমি। দ্রুত গতিতে এগুতে থাকলাম। মিরাজকে জিজ্ঞেস করলাম, গত দেড় ঘন্টায় দুই দফা প্রাণ নাশের ঝুঁকি গেছে, টের পাইছো? মিরাজ বললো, কিচ্ছু টের পাইনি ভাই। সুন্দরবনে আমার সহযাত্রীরা এমনই। বিপদ-আপদ নিয়ে কোনো চিন্তা করে না। চোখ বন্ধ করে ভরসা করে।

দস্যুদের বিদায় দিয়ে প্রায় তিন ঘন্টার পথ পারি দিলাম। এরপর চিপা’র খাল থেকে বের হলাম। জোংড়া খালটি এখানে বেশি বড় না। বের হতেই দেখি একটি ট্রলার নোঙ্গর করা। বুকটা আবার ধক করে উঠলো। আমাদের ট্রলার তো পাশের আরেকটি খালের ভিতরে থাকার কথা। এটা প্রশাসনের বা অন্য কারও ট্রলার না তো? জামাল মেম্বার বললেন, ওটা খবিরের ট্রলার। মানে আমাদের ট্রলার।

রাত তখন এগারোটার মতো বাজে। ভীষণ ক্ষুধার্ত। শরীরটা অবসাদে ভরা। ট্রলারে উঠেই চা বানাতে বললাম। আপাতত চা আর বিস্কিট খেয়ে থাকতে হবে। সুযোগ মতো ট্রলার নিয়ে এই খাল থেকে বের হবো। ভিতরে যেহেতু অভিযান চলছে তাই এদিকেও প্রশাসনের নজরদারি থাকার কথা। মাঝি বললেন, এদিকের ফরেস্টাররা কিছু জানবে না মামা। RAB ঢুকছে শিবসা দিয়ে। আর আমরা বের হবো পশুর নদী দিয়ে।

অর্ধেক ভাটা হয়ে গেছে। চা খেতে খেতে ১২টা বাজলো। ফিরার সময়ও বনরক্ষীদের কিছু জানাতে চাই না। ঠিক করলাম, ট্রলার ছেড়ে কিছুক্ষণ চলবো। তারপর ইঞ্জিন বন্ধ করে ভাটার স্রোত ধরে বেরিয়ে যাবো খাল থেকে বড় নদীতে। একবার পশুরে পড়তে পারলে আর পায় কে? নৌকাটি বেঁধে ট্রলার ছাড়লাম।

পরিকল্পনা অনুযায়ী চলছিলো সবকিছু। কিন্তু বনরক্ষীদের চোখ এড়াতে পারলাম না। জোংড়া ফরেস্ট অফিসের সামনে গিয়ে স্রোতের চাপে ট্রলার ঠেকলো জেটিতে। বন বিভাগের বেঁধে রাখা নৌকায় ধাক্কা খেলাম। ঘুমিয়ে পড়া ট্রলার মাঝি উঠেই দিলো চিৎকার! সাথে সাথে অফিস থেকে বেরিয়ে আসলো দুই বনরক্ষী।

আমরা প্রস্তুত ছিলাম। সাথে সাথে ইঞ্জিন চালু করে দিলাম টান। পিছনে তাকানোর সময় নাই।

ভাটার স্রোত নিচের দিকে টানছে। কিন্তু দক্ষিণে আর যাওয়া যাবে না। আবার এই স্রোত ঠেলে মংলায় যাওয়াও মুশকিল। কী আর করা। নদীর উল্টো পাশের লোকালয় চিলা বাজারে বিরতি নিবো। ফোন অন করে বেলায়েত সরদারকে ফোন দিলাম। ওরা তখনও বাজারে আড্ডা দিচ্ছে। বললাম, ফরেস্টারদের তাড়া খাইছি ভাই। পশুর পারি দিয়ে আপনাদের ওখানে আসবো। ক্ষুধা লাগছে। ভাত খাবো। রাত তখন একটা।

(ছবি: সুন্দরবনের সরু খাল)

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top