অনিশ্চিত সাগর বাহিনীর আত্মসমর্পণ! | রূপান্তরের গল্প ২৪০ | Rupantorer Golpo 240 | দস্যুমুক্ত সুন্দরবন | সুন্দরবনের গল্প | জীবনে ফেরার গল্প | Jibone Ferar Golpo | Sundarbaner Goppo | Story of Sundarbans | মোহসীন উল হাকিম | Mohsin Ul Hakim
রূপান্তরের গল্প ২৪০ : গভীর রাত। মংলা থানায় একটি বৈঠক চলছে। বিভিন্ন আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর স্থানীয় কর্মকর্তারা অনেকেই আছেন। ডাকা হয়েছে সোর্সদেরও। বৈঠকে উপস্থিত আছেন স্থানীয় সাংবাদিকদের কয়েকজন। আমার সফর সঙ্গী হন এমন একজন সাংবাদিকও সেই বৈঠকে আমন্ত্রণ পেয়েছেন।
আলোচনা চলছে বনদস্যু সাগর বাহিনী আত্মসমর্পণ নিয়ে। দস্যুদলটির প্রধান আলমগীরসহ অন্য সদস্যরা মংলা ও রামপালের বাসিন্দা। তাইই এই দলটিকে আত্মসমর্পণ করাবে ওখানকার আইন শৃঙ্খলা বাহিনীগুলো। সবচেয়ে জরুরি বিষয়, কিছুতেই ঢাকার সাংবাদিক মোহসীন যেন এদের কাছে ভিড়তে না পারে।
১৬ অক্টোবর ২০১৬ রাতের সেই বৈঠকের খবর পেলাম পরদিন সকালে। আমার পরিচিত কোনো সাংবাদিক বা সোর্স এই খবর দেননি। পুরো বিষয়টি জানালো দস্যুনেতা আলমগীর। মংলার জোড়া ব্রিজ এলাকার এক সোর্স নাকী পুরো বিষয়টি সমন্বয় করছে।
সকাল বেলা সেই সোর্স আলমগীরকে ফোন দিয়েছে। আমার সাথে দস্যুদের দেখা হওয়ার বিষয়ে জানতে চেয়েছে। দস্যুনেতা অস্বীকার করেছে। কিন্তু চাপের মুখে কিছুক্ষণের মধ্যে স্বীকার করতে বাধ্য হয়। সোর্স তার সঙ্গে দস্যুনেতার এক আত্মীয়র সাথেও কথা বলিয়ে দেয়। বলা হয়, সোর্স এর কথা মতো না চললে বাড়ীতে সমস্যা হবে।
এ সময় সেই সোর্স জানায়, তার মাধ্যমে আত্মসমর্পণ করতে হবে। আমার সাথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করতে হবে। সাগর বাহিনীর ফোন ট্র্যাক করা হচ্ছে। আমার সাথে কথা বললে মহা বিপদে পড়তে হবে বলেও জানানো হয় দস্যুনেতাকে। ভয় পেয়েছে আলমগীর। আতঙ্কিত হয়ে পড়েছে দলের অন্য সদস্যরা।
একটু পর নতুন একটি নাম্বার থেকে ফোন দিলো আলমগীর। বুদ্ধি করে ফোন দিয়েছে আমার গোপন নাম্বারে। বিস্তারিত জানলাম। অভয় দিয়ে বললাম, তোমরা ফোন বন্ধ করবে না। ওদের সাথে কথাবার্তা চালিয়ে যাও। আমার সাথে যোগাযোগ হচ্ছে, বুঝতে দিও না। RAB সদর দপ্তর আর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সাথে আমি কথা বলছি। তোমাদের পরিবারের কিছু হবে না।
দস্যুনেতার ফোন রেখে এবার ফোন দিলাম আমার আস্থাভাজন সাংবাদিককে। আগের রাতে মংলা থানায় হওয়া বৈঠকটির খোঁজ খবর নিলাম। শুনলাম সেখানে সোর্সদের বেশ বকাঝকা করেছেন কর্মকর্তারা। বলেছেন, সাগর বাহিনীর সাথে সাংবাদিকের দেখা হয়ে গেলো? ঢাকা থেকে এসে ওরা বনের ভিতরে ঢুকলো, দুই দিন থাকলো, আবার ঢাকা ফিরে আসলো? কেউ জানতে পারলে না? খুলনা থেকে সেই খবর পেতে হলো?
সোর্সরা ঠিক বুঝতে পারছে না কী ভাবে কী হলো! আমার গতিবিধি খেয়াল রাখার চেষ্টা করেছে। সার্বক্ষণিক বেলায়েত সরদারকেও নজরদারিতে রেখেছিলো তারা। কিন্তু সরদার বাড়িতেই আছে। তাঁর ট্রলারও ঘাটে বাঁধা। তারপরও কী ভাবে বনে ঢুকলাম মাথায় আসছে না তাদের। দস্যুদের সাথে দেখা করে ফিরে আসলাম, রাতে চিলা বাজারে খাওয়া দাওয়া করলাম, কোনো কিছুই টের পায়নি তারা।
সোর্সদের ইচ্ছা মতো বকাঝকা করছেন স্যারেরা। মংলা, বাগেরহাট ও খুলনার যে কয়টি আইন শৃঙ্খলা বাহিনী আছে, সবগুলোর দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন। আমার বিশ্বস্ত স্থানীয় সাংবাদিককে বলা হয়, ‘এখন থেকে তাদের সহযোগিতা করতে হবে। মোহসীন উল হাকিমের সঙ্গ ছাড়তে হবে’।
তার মানে বেশ বড় ঝামেলা তৈরি হয়েছে।
মাত্র সুন্দরবন থেকে ফিরলাম। ভেবেছি কয়েকটা দিন বিশ্রাম নিবো। হলো কোথায়? এর মধ্যে বরিশাল RAB-এ নতুন অধিনায়ক যোগ দিয়েছেন। উনার সাথেও বোঝাপড়ার ব্যাপার আছে। RAB সদর দপ্তরেও কথা বলতে হবে। সাগর বাহিনীর আত্মসমর্পণের বিষয়টি অনেক বেশি জটিল হয়ে পড়েছে।
দস্যুদল হিসাবে সাগর বাহিনী নতুন। সন্দেহভাজন চার সদস্যকে উঠিয়ে দেওয়ার পর আমার সাথে তাদের দেখা হওয়ার ঘটনা জানাজানি হয়েছে। সেদিন দেখা হওয়া জেলেরাও বলে দিয়েছে আমাদের কথা। ঝামেলার শুরু সেদিক থেকেই। দস্যুনেতার শহরের বড় ভাই বিষয়টি ভালো ভাবে দেখছেন না। শুনলাম, সারেন্ডার ঠেকাতে মরিয়া তিনি।
এদিকে স্থানীয় ভাবেও চাপ শুরু হয়েছে। দস্যুনেতার পরিবারের সদস্যদের তীব্র চাপের মধ্যে রেখেছে সোর্সরা। সুন্দরবন উপকূলের অপরাধ নিয়ন্ত্রণে যাদের সহযোগিতা নেয় আইন শৃঙ্খলা বাহিনী, তাদের দাপটে অতীষ্ট মানুষ। সুন্দরবনের দস্যুদের পরিবারের সদস্যরা থাকে মহা চাপের মধ্যে। যে পরিবারগুলো দস্যুতার সুবিধা নেয় তারা টাকা-পয়সা আর মাছ দিয়ে সোর্সদের সামাল দেয়। অন্যরা থাকে মহাবিপদে। আমি বুঝতে পারছি, দ্রুত সবকিছু গুছিয়ে নিতে না পারলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে।
সেদিনই RAB সদর দপ্তরে যাই। গোয়েন্দা প্রধানের সাথে আলোচনা করি। দ্রুত আত্মসমর্পণের তারিখ চূড়ান্ত করতে হবে। সেই দায়িত্ব উনাদের। সন্ধ্যায় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বাসায় যাই। উনার সাথে কথা বলি। আদ্যোপান্ত জানাই। দুই-তিন দিনের মধ্যে সময় দেওয়ার অনুরোধ করি। তখনই RAB মহাপরিচালককে ফোন দেন তিনি। ঠিক হয়, ২০ অক্টোবর সময় দিবেন মন্ত্রী।
মাঝখানে আর মাত্র দুই দিন। এদিকটা সামাল দিলাম। কিন্তু দস্যুদেরও তো আনতে হবে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বাসা থেকে বের হয়ে দস্যুনেতাকে ফোন দেই। ফোন বন্ধ অথবা নেটওয়ার্ক-এ নাই। ওদের সাথে কথা বলতে হলে পরের দিন পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।
আমার সোর্সদের মাঠে নামালাম। দস্যুনেতার ঘনিষ্ঠ কারও সাথে কথা বলতে চাই। আলমগীরের ছোট ভাই ঢাকায় থাকে। একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করে। যোগাযোগ হলো তার সাথে।
পরদিন ১৮ অক্টোবর অফিসে আসেন সেই ছোট ভাই। বললেন, অনেক রকমের চাপ আছে। তবে আত্মসমর্পণ করলে আমার মাধ্যমেই করবে সাগর বাহিনী। সুন্দরবন থেকে তখনই ফোন করলো আলমগীর। দিন ক্ষণ জানালাম। ঠিক হলো, ১৯ তারিখ রাতে উঠাবো তাদের। ২০ অক্টোবর সারেন্ডার।
বরিশাল RAB-এর উপ-অধিনায়ক মেজর আদনান কবীরের সাথে সার্বক্ষণিক যোগাযোগে আছি। জানালেন, সদর দপ্তর থেকে নির্দেশ এসে গেছে। এবারের অনুষ্ঠান হবে বরগুনায়।
মেজর আদনানকে বললাম, এদিকের সবকিছু ঠিক। কিন্তু মেহমানদের তুলে আনতে হবে তো। মেহমান মানে বনদস্যুরা। যারা আত্মসমর্পণ করে তাদের আমরা মেহমান বলি।
১৯ অক্টোবর ২০১৬। সাত সকালে ঢাকা থেকে রওনা দিলাম। গন্তব্য সুন্দরবনের সেই জোংড়া খাল। এবার আমাদের সহযাত্রী হলো দস্যুনেতার ছোট ভাই। বেলায়েত সরদারকে ফোন দিয়ে বললাম, তৈরি হন। দেখা হবে সন্ধ্যার পর। বললাম, ট্রলার নিয়ে তৈরি থাকবেন। চারপাশে জানাবেন, সুন্দনবনে যাবেন মাছ ধরতে। সরদার বললেন, সোর্সরা চারপাশ থেকে ঘিরে রেখেছে। ওদের চোখ ফাঁকি দেওয়া সহজ হবে না।