রূপান্তরের গল্প ২৪১ | Rupantorer Golpo 24

লুকোচুরি খেলা | রূপান্তরের গল্প ২৪১

লুকোচুরি খেলা | রূপান্তরের গল্প ২৪১ | Rupantorer Golpo 241 | দস্যুমুক্ত সুন্দরবন | সুন্দরবনের গল্প | জীবনে ফেরার গল্প | Jibone Ferar Golpo | Sundarbaner Goppo | Story of Sundarbans | মোহসীন উল হাকিম | Mohsin Ul Hakim


রূপান্তরের গল্প ২৪১ : ও ভাই, এই সোর্সেরা তো বাথরুমেও যেতে দিচ্ছে না। কী করি বলেন তো? বেলায়েত সরদার ফোন করে বললেন কথাগুলো। জানালেন, ট্রলার সরানোর উপায় নাই। চিলা বাজারের ঘাটে কেউ না কেউ পাহারা দিচ্ছে। বললাম, আজকে কিছু করার নাই। ট্রলার তৈরি রাখেন। বেশি দূরের পথ তো না। মংলা থেকে অন্য ট্রলারে আসবো। তারপর আপনার ট্রলারে উঠে দিবো টান।

আজকের সফরে আমাদের সাথে আরেকটি ট্রলার নিয়ে থাকবে বরিশাল RAB-এর একটি টিম। বনদস্যু সাগর বাহিনীকে নিয়ে সাথে সাথে তাদের ট্রলারে উঠিয়ে দিবো। কেউ কিছু বুঝে ওঠার আগেই কাজ সেরে ফেলবো। সরদারকে বললাম, ট্রলারের ইঞ্জিন চেক করেন। পর্যাপ্ত জ্বালানী তেল রাখবেন।

১৯ অক্টোবর ২০১৬। সকালে রওনা দিয়ে দুপুরের মধ্যে গোপালগঞ্জ পৌঁছেছি। মংলা থেকে নামবো পশুর নদীতে। রাতের বেলা ঢুকবো সুন্দরবন। জোংড়া খাল অর্থাৎ বনদস্যুদের সাথে দেখা করতে যে খালে ঢুকেছিলাম এবারও সেই খালেই ঢুকবো। দস্যুরা ঠিক কোন জায়গায় থাকবে জানি না। শেষ কথা ছিলো, খালের ভিতরে ঢুকে সোজা চলতে থাকবো। রাতের জোয়ারে ঢুকবো। ওরা আলো দিয়ে ইশারা দিবে। এবার মাঝখানে আর কোনো সোর্স বা মাধ্যম থাকবে না।

এই সফরে আমার সঙ্গে আছে বায়জিদ ইসলাম পলিন ও দস্যুনেতা আলমগীরের ছোট ভাই। বাগেরহাট থেকে সঙ্গী হবেন ইয়ামীন আলী। গোপালগঞ্জ থেকে রওনা দিয়ে মংলা যেতে সময় লাগবে আনুমানিক তিন ঘন্টা। তাই সময় হিসাব করে রওনা দিবো। আগে গেলে অনেকে দেখে ফেলবে। সুন্দরবনে ঢুকতে সমস্যা হবে। সেই হিসাবে রওনা দিলাম সন্ধ্যার পর পর। রাত আটটায় জোয়ার আসবে। আমরা নামবো আধা জোয়ারে। অর্থাৎ রাত এগারোটায় ট্রলার ভাসবে।

বিকালের মধ্যে বরিশাল থেকে রওনা দিবে RAB সদস্যরা। মেজর আদনান কবীর বললেন, আগেই মাঠ পর্যায়ের দুই গোয়েন্দা সাদা পোশাকে পৌঁছে গেছে। বিশ্বস্ত একজনের মাধ্যমে তারা একটি ট্রলার ভাড়া করে রেখেছে আগেভাগে। সেই ট্রলার থাকবে মংলা থেকে একটু দূরে, পশুর নদীর পারে। সেখান থেকেই ছাড়বে তাদের ট্রলার। তাদের বলে রাখলাম, আমরাও উঠবো সেই ট্রলারে। মাঝ নদীতে গিয়ে পার হবো বেলায়েত সরদারের ট্রলারে।

বনদস্যুদের আস্তানায় যাওয়া এখন আগের মতো কঠিন কাজ না। সুন্দরবনের ভিতরে ঢুকে গেলে আর সমস্যা থাকে না। কিন্তু এই দফায় কাজটি অনেক কঠিন হয়ে গেছে। প্রতিবন্ধকতাগুলো এড়িয়ে চলা, সময় ধরে জায়গায় পৌঁছানোর কাজটিও তাই আর সহজ নাই। অনেক বেশি সতর্ক থাকতে হবে। আমাদের পরিকল্পনার কথা কেউ জানতেও না পারে তা নিশ্চিত করতে হবে।

বিকালে কথা হলো দস্যুনেতার সাথে। ওদিকের সব ঠিকঠাক। তবে মংলার সেই সোর্স নাকী প্রতি ঘন্টায় ফোন দিচ্ছে। বললাম, আমরা না আসা পর্যন্ত এমন জায়গায় থাকবেন যেখানে নেটওয়ার্ক আছে। সার্বক্ষণিক ওই সোর্স এর সাথে কথাবার্তায় থাকবেন। আমরা না যাওয়া পর্যন্ত কথা চালিয়ে যাবেন। তাকে বলবেন, কয়েক দিনের মধ্যে আপনারা সারেন্ডার করবেন। তাদের মাধ্যমেই করবেন।

দস্যুনেতাকে বললাম, কয়েকজন মাছ ব্যবসায়ীকে ফোন করে বলবেন, আত্মসমর্পণ নিয়ে আপনাদের ওপর অনেক চাপ। কিন্তু কিছুতেই সারেন্ডার করবেন না। একই সাথে খুলনার সেই বড় ভাইকেও বলবেন, তার কাছ থেকে আনা অস্ত্র-গুলির বকেয়া শোধ না করা পর্যন্ত আত্মসমর্পণ করবেন না। বলবেন, মোহসীন উল হাকিমের সাথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করেছেন। এই কলগুলো করবেন আপনাদের যে মূল ফোন আছে, সেই নাম্বার থেকে। এতে করে আইন শৃংখলা বাহিনীর যারা আপনাদের ট্র্যাক করছে তারাও বিভ্রান্ত হবে। আলমগীর বললো, পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ করবে সে। মধ্যরাত পর্যন্ত নেটওয়ার্কে থাকবে।

সন্ধ্যা পর্যন্ত সময় কাটাতে চলে গেলাম গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়ায়। সেখানকার কান্দি বিলে ঘুরে বেড়ালাম। বিলের শোল আর কৈ মাছের ভুনা দিয়ে সারলাম দুপুরের খাবার। বিকালে শৈলদাহ নদীতে মাছ ধরতে বসলাম। সন্ধ্যা পর্যন্ত সময় কাটিয়ে রওনা হলাম। পথে বাগেরহাটের কাটাখালী থেকে সঙ্গী হলেন জেলা প্রতিনিধি ইয়ামীন ভাই।

পথে আরেকটি বিরতি নিলাম দিগরাজে। রাতের খাওয়া দাওয়া সেরে নিলাম সেখানকার ছোট্ট একটি রেস্তোঁরায়। এসময় গাড়ি থেকে যমুনা টিভির স্টিকার তুলে ফেলা হলো। আমিও জুতা খুলে স্যান্ডেল পড়লাম। সাধারণ পোশাক পড়ে নিলাম যাতে হুট করে আমাদের দেখে সন্দেহ না করে। মংলা বাস স্ট্যান্ড বা খেয়া ঘাটে যাবো না। ওদিকে গেলে পরিচিত কারও সাথে দেখা হয়ে যাতে পারে। এখন কোনো রকম ঝুঁকিতে যাবো না।

পশুর নদীতে নোঙ্গর করা আছে RAB-এর ভাড়া করা ট্রলার। মংলায় গিয়ে গাড়ি থামালাম খেয়া ঘাট থেকে একটু দূরে, পশুর নদী ও মংলা খালের মুখে পিকনিক কর্নারে। সেখান থেকে উঠে পড়লাম ট্রলারে। কিছুক্ষণের মধ্যে আসলো বরিশালের টিম। রাত তখন সাড়ে এগারোটা। আধা জোয়ার পেরিয়ে গেছে। হাতে সময় নাই।

ট্রলার ছাড়লো। এদিকের কেউ খেয়াল করেনি। নিরবে চলে গেলাম মাঝ নদীতে। ঘন্টা খানেক এই নদী ধরে এগুবো। ওদিকে রওনা দেওয়ার জন্য প্রস্তুত বেলায়েত সরদারের ট্রলার। ফোনে কথা হচ্ছে তার সাথে। বললেন, জোড়া ব্রিজ-এর সেই সোর্স এখনও বাজারে আছে। আরও কয়েকজন সোর্স একসাথে বসে চা খাচ্ছে ঘাটের পাশের এক দোকানে।

হাতে এখনও এক ঘন্টা সময়। সরদারকে বললাম, আশেপাশে অন্য কোনো ট্রলার আছে কী না দেখেন তো! আর বলতে হলো না। আমার ইশারা বুঝে গেলেন তিনি। ইলিশ মাছ ধরার কয়েকটি ট্রলার ভিড়েছে বড় নদীতে। সেখানে গিয়ে এক প্রতিবেশির ট্রলার নিলেন। এক টানে চলে আসলেন মাঝ নদীতে। তারপর একটি ইলিশের জালের সাথে ট্রলার বেঁধে বসে বসে থাকলেন। আমাদের মূল ট্রলার চিলা খালের ঘাটে বাঁধা।

জোয়ারের চাপ বেড়েছে। স্রোত উত্তরমুখি। আমরা চলছি দক্ষিণে, স্রোতের বিপরীতে। দূর থেকে টর্চ লাইট দিয়ে সিগন্যাল দিলো সরদার। পাল্টা সিগন্যাল দিলাম। ট্রলার ছেড়ে এগিয়ে এলো ওরা। RAB-এর ট্রলারের পাশে এসে ভিড়লো ইলিশের সেই ট্রলার। ক্যামেরাসহ অন্যান্য যন্ত্রপাতি নিয়ে আমরা ট্রলার বদলালাম।

জোংড়া খালের সামনে থাকবে RAB-এর ট্রলার। আমরা ঢুকে পড়বো খালের ভিতরে। বনদস্যুদের নিয়ে আসবো আমরাই। এর পরের দায়িত্ব তাদের। সময় লাগবে দুই থেকে তিন ঘন্টা। এই সময়ের মধ্যে খালের ভিতরে কাউকে ঢুকতে দিবে না তারা। RAB-এর দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা উঠলেন জোংড়া বন টহল ফাঁড়িতে। আমরা ফিরে না আসা পর্যন্ত উনারা এখানেই থাকবেন।

জোংড়া খাল আমার বেশ পরিচিত। রাতের বেলা হলেও এই খালের ভিতরের উপ-খালগুলো চিনতে পারবো। আধা ঘন্টা চলার পর হাতের বাম পাশে পড়বে চিপা’র খাল। পশ্চিমে চলে গেলে দুই বাঁক পর পড়বে ছোট বস্তা খাল। তার পরের খালের নাম বড় বস্তা। আরও পশ্চিমে এগিয়ে গেলে যে মাঝারি খালটি পড়বে তার না টগিরবগির।

আরও পশ্চিমে গেলে ছোট জোংড়া। সেই ভাড়ানী পার হলেই ভদ্রার আগা, মানে ভদ্রা নদী শুরু হয়েছে এখান থেকে। ভদ্রা ধরে দক্ষিণে গেলে পড়বে ঝাপসি। আরও দক্ষিণে চললে পড়বে মূল ভদ্রা নদী। সেখান থেকে পূর্ব দিকে গেলে পশুর নদী। পশ্চিমে গেলে আদাচাই-এর ভাড়ানী। পশ্চিমে আরও বেশ কয়েকটি খাল আছে যেগুলো দিয়ে গেলে পড়বো শিবসা নদীতে। আমাদের অবশ্য এতো দূর যেতে হবে না। তার অনেক আগেই আলোর ইশারা পাওয়ার কথা।

খালের ভিতরে কয়েক মিনিট চলতেই একটি জেলে নৌকা দেখলাম। সম্ভবত কাঁকড়ার জেলে। আরেকটু এগিয়ে দেখি একসাথে কয়েকটি নৌকা বাঁধা। জেলেদের নৌকা বহর। অভয়াশ্রম হলেও এই অঞ্চলে জেলেদের আনাগোণা থাকে সারা বছর। গোন লাগলেই তারা ঢুকে পড়ে। কিছুতেই ঠেকানো যায় না।

এদিকের জেলেরা ছোট ডিঙ্গি নৌকা নিয়ে চলাফেরা করে। মাছ পরিবহনের জন্য থাকে ভরের নৌকা। সেই নৌকায় থাকে বড়ফের কেবিন। ঘুরে ঘুরে জেলেদের কাছ থেকে মহাজনের লোকজন মাছ সংগ্রহ করে। অথবা জেলেরা এসে ভরের নৌকায় মাছ দিয়ে যায়। জোংড়ায় ঢুকেই জেলেদের দেখছি যখন, তখন বনদস্যু দলটি আশেপাশে নাই। আমাদের বেশ দূরে যেতে হবে।

ভুল ভাঙ্গলো আধা ঘন্টার মধ্যে। চিপা‌র খাল পেরিয়ে এক বাঁক ঘুরতেই একটি নৌকা থেকে সিগন্যাল পেলাম। ছোট টর্চ দিয়ে কেউ একজন ইশারা দিলো। সাথে সাথে গতি কমালাম। নৌকাটি এগিয়ে আসলো। ট্রলারে বেঁধে উঠে পড়লো একজন। না, বনদস্যুদের কেউ না। বৈদ্যমারীর এক জেলে।

ট্রলারের গলুই-এ এসে পাশে দাঁড়ালো সেই জেলে। বললো, ওরা সামনেই আছে। বড় বস্তা খালের আগায়।

(ছবি: চিলা খালের ঘাটে বাঁধা বেলায়েত সরদারের ট্রলার)

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top