রূপান্তরের গল্প ২৪২ | Rupantorer Golpo 242

বড় বস্তা খালে অপেক্ষায় বনদস্যুরা | রূপান্তরের গল্প ২৪২

বড় বস্তা খালে অপেক্ষায় বনদস্যুরা | রূপান্তরের গল্প ২৪২ | Rupantorer Golpo 242 | দস্যুমুক্ত সুন্দরবন | সুন্দরবনের গল্প | জীবনে ফেরার গল্প | Jibone Ferar Golpo | Sundarbaner Goppo | Story of Sundarbans | মোহসীন উল হাকিম | Mohsin Ul Hakim


রূপান্তরের গল্প ২৪২ : খটখট খটখট আওয়াজ করছে আমাদের ট্রলারের ইঞ্জিন। বিকট আওয়াজে খানখান হয়ে গেছে সুন্দরবনের নিরবতা। অভয়াশ্রমে এতো শব্দ করে চলাফেরা করতে খারাপ লাগছে। নিজেদের অপরাধী মনে হচ্ছে।

ট্রলারের পিছনে দাঁড়িয়ে হাল ধরে দাঁড়ানো বেলায়েত সরদার। আর গলুই-এ দাঁড়িয়ে আমি। চিৎকার করে বললাম, ও ভাই, আর কোনো ট্রলার পেলেন না? এতো আওয়াজ কেন? ইঞ্জিনের শব্দে আমার কথা শুনতে পেলেন না সরদার। ইশারায় সামনে এগুতে বললাম।

জোংড়া খালের ভিতরে আমরা। একটির পর একটি বাঁক পার হচ্ছি। দুই পাশের ছোট খালগুলোতে নজর রাখছি। একটিও খালি নাই। ডিঙ্গি নৌকার অভাব নাই। রাতের বেলা জঙ্গলের ভিতরের ছোট খালগুলোতে মানুষ থাকলে বুঝা যায়।

আমাদেরকে যে জেলে পথ দেখাচ্ছে সে বললো, বড় বস্তা খালে আছে সাগর বাহিনী। বললাম, তোমাকে পাঠালো কেন? ওরা কেউ আসতে পারলো না? ছেলেটি বললো, আমিও মনে করেন ওদেরই লোক। অন্ধকারে প্রথমে খেয়াল করিনি। ভালো করে তাকিয়ে দেখি গেলো সফরে অস্ত্র হাতে দেখেছি তাকে।

নাম কামরুল। প্রথম তার সাথে দেখা হয়েছিলো কয়েক বছর আগে, এই খালের ভিতরে। তখন সে বাবা ও বড় ভাইয়ের সাথে মাছ ধরতো সুন্দরবনের এই অঞ্চলে। কৈশোর পেরুনোর পর নিজের একটা নৌকা হয়। নিজের মতো করে মাছ ধরে সে। কোনো মহাজনের ধার ধারতো না বলে তার উপর বেশ চাপ ছিলো। বনরক্ষীরা চাপে রাখতো, দস্যুরাও নানা ভাবে বিরক্ত করতো।

কয়দিন পর কয়রার এক জেলের সাথে বন্ধুত্ব হয় কামরুলের। তারপর দুই বন্ধু অংশিদারীত্বের ভিত্তিতে মাছ ধরতো, মাছ বিক্রি করে ভাগ করে নিতো টাকা। আরও কিছুদিন পর কয়রার বন্ধু তাকে নতুন পদ্ধতিতে মাছ ধরা শিখায়। বিষ দিয়ে সেই মাছ শিকার অনেক বেশি লাভজনক। সপ্তাহ জুড়ে জঙ্গলে থাকতেও হবে না। কারণ জোংড়া-ঝাপসি-ভদ্রা এলাকায় মাছের অভাব নাই। এক বোতল বিষ দিয়ে মণকে মণ মাছ মারা যায়।

লোভে পড়ে যায় কামরুল। হঠাৎ করে বদলে যায় তার জীবন যাপন। এতো মাছ কী করে পাচ্ছে সে? মংলার আড়তে তুললে এতো মাছ দেখে সন্দেহ করে মানুষ। এমনিতেই মহাজনরা তাকে ভালো চোখে দেখে না।

আপন মনে জীবনের গল্প বলে যাচ্ছে বনদস্যু কামরুল। বললো, শুরুর দিকে বেশ ভালো চলছিলো। তারপর এক সময় সুন্দরবনের এই অঞ্চলে তার নাম ছড়িয়ে পড়ে বিষ কামরুল নামে।

কানের কাছে এসে কামরুল বললো, ও ভাই এসব ষড়যন্ত্র। এই অঞ্চলে কি আমি একাই বিষ দিয়ে মাছ ধরি? বললাম, তুমি জঙ্গলে বিষ দাও কেন?কেন এই জঘন্ন কাজে নামলে? বললো, দস্যুদল রাজু উঠে যাওয়ার পর শহীদুল বাহিনী নিয়ন্ত্রণ করতো এই অঞ্চল। আবার আসাদ নামের আরেকটি বনদস্যুদের দলও ডাকাতি শুরু করে। ওরাও অনেকগুলো অস্ত্র নিয়ে চলাফেরা করতো।

আসাদের বাড়ি ছিলো রামপালে। তবে সেই দলে মংলার অনেকেই ছিলো। ওদের মাধ্যমে আসাদ বাহিনীর সাথে যোগাযোগ হয়। ওদের সাথে ভাও করে মাছ ধরা শুরু করবো ভাবলাম। তবে তার আগেই আসাদ বাহিনী অপহরণ করে। ধরে নিয়ে বেশ কয়েকদিন বেঁধে রাখছদলো। মুক্তিপণ নিলো পঞ্চাশ হাজার টাকা। সেই টাকা দিবে কে? পরে একজনের কাছ থেকে ধার করে আনলাম। ছাড়া পেয়ে আর এলাকায় যাইনি।

আমি বললাম, যখন ছোট ছিলে তখন দেখা হতো। তারপর অনেক দিন দেখা হয় না। ভাবতাম, মাছ ধরেই চলছে তোমাদের। কিন্তু কাজ বাদ দিয়ে অকাজ শুরু করলে কেন? প্রথমে বিষ মারা শুরু করলে। এখন আবার ডাকাতি করতে নামছো? কামরুল বললো, দস্যুদের মুক্তিপণ দিয়ে দুর্বল হয়ে পড়লাম। বাপ আর ভাই আলাদা থাকে। আমাকে একটু সহযোগিতা করার কেউ ছিলো না। পঞ্চাশ হাজার টাকা দেনা শোধ করা সোজা কথা?

বন উপকূলের টগবগে যুবকদের দস্যুতায় আসার গল্পগুলো প্রায় একই রকম। কামরুল-হাসানের মতো তরুনরা ডাকাতি করতে নামে দেনা শোধ করতে। কেউ আসে লুকিয়ে থাকতে। আইনের চোখে পলাতক আসামীদের পালিয়ে থাকার জন্য সুন্দরবনের দস্যু জগৎ নিরাপদ জায়গা।

এদিকে কামরুলের মতো ছেলেরা ছোটবেলাতেই সুন্দরবনে ঢুকে পড়ে। তারপর কারও সারা জীবন কেটে যায় মাছ বা কাঁকড়া ধরে। কেউ জড়িয়ে পড়ে অবৈধ হরিণ শিকারে। অনেকেই বনের গাছ কেটে বিক্রি করে। কেউ আবার অবৈধ জায়গায় অবৈধ পদ্ধতিতে মাছ ধরে, আবার কেউ বিষ দিয়ে মাছ ধরে সুন্দরবনটাকে ধ্বংস করে ফেলে। এদের মধ্যে কেউ কেউ ভিড়ে যায় দস্যুতার মতো অপরাধে।

সুন্দরবনের অর্থনৈতিক চক্র যারা নিয়ন্ত্রণ করে, তারা ভীষণ শক্তিশালী, চতুর। সবকিছু নিজেদের মতো করে সাজিয়ে রেখেছে তারা। বনের সম্পদ নিয়ে বাইরের লোকজনের পরিস্কার ধারণা নাই। কাউকে ধারণা পেতেও দেয়নি তারা। বনের ভিতরে কী হয়, কী ভাবে চলে মাছ-কাঁকড়ার কারবার, সবকিছুই গোপন থাকে। অবৈধ মাছ শিকার, হরিণ-বাঘ শিকার, বনদস্যুতা নিয়ে আইন শৃংখলা বাহিনীর ধারণা কম। গোয়েন্দা তথ্যেরও ঘাটতি আছে। অন্যদিকে বন বিভাগের সাথে কারও বনিবনা নাই। এই সুযোগ নিয়েই চলছে সুন্দরবনের অর্থনৈতিক চক্র।

এই চক্রে সুন্দরবনের ভিতরে যারা থাকে, যাওয়া-আসা করে তাদের অবস্থা নিতান্তই দিন মজুরের মতো। নানা ভাবে বনের সম্পদ আর দস্যুতার টাকাগুলো চলে যায় সিন্ডিকেটের পকেটে। কামরুলের সাথে গল্প করতে করতে অন্য জগতে হারিয়ে যাই। ভাবছি, আমি ঠিক পথে চলছি তো? এগিয়ে চলছে আমাদের ট্রলার। ইঞ্জিনের গতির সাথে জোয়ারের স্রোত মিলিয়ে দ্রুত গতিতে চলছি আমরা।

গভীর রাত। জোংড়া খাল ধরে চলছে আমাদের ট্রলার। দুই বাঁক পর হাতের ডান পাশে পড়লো ছোট বস্তা খাল। তারপরেই বড় বস্তা। সেই খালে পৌঁছানোর আগেই দূর থেকে টর্চ-এর ইশারা এলো। বড় টর্চ এর আলো। মানে ওই খালের ভিতরে আছে সাগর বাহিনী।

ট্রলারের গতি কমিয়ে সেই আলোর উৎসের দিকে এগুলাম। সেখানে আরেকটি ডিঙ্গি নৌকা নিয়ে অপেক্ষা করছে দুইজন। বড় বস্তা খালের ভিতরে ঢোকার ইশারা দিলো তারা। ট্রলার ঘুরিয়ে ঢুকে পড়লাম খালের ভিতর। বেলায়েত সরদারকে বললাম, ইঞ্জিন বন্ধ করে দেন। এতো শব্দ করে বনদস্যুদের কাছে গেলে আশেপাশের সবাই বুঝে যাবে আমরা এখানে আছি, দস্যুরাও আছে এখানেই। এমনিতে বাগড়া বাঁধানোর লোকের অভাব নাই।

বাইরের কেউ আমাদের আসার খবর পেলো কী না বুঝতে পারছি না। তবে সামনে যাই আসুক, আজ সাগর বাহিনীকে উঠিয়ে নিবো আমরা।

(ছবি: বনদস্যুদের নৌকা। সুন্দরবন ২০১৬)

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top