রূপান্তরের গল্প ২৪৩ | Rupantorer Golpo 243

বাঁচতে চাই, বাড়ি ফিরতে চাই | রূপান্তরের গল্প ২৪৩

বাঁচতে চাই, বাড়ি ফিরতে চাই | রূপান্তরের গল্প ২৪৩ | Rupantorer Golpo 243 | দস্যুমুক্ত সুন্দরবন | সুন্দরবনের গল্প | জীবনে ফেরার গল্প | Jibone Ferar Golpo | Sundarbaner Goppo | Story of Sundarbans | মোহসীন উল হাকিম | Mohsin Ul Hakim


রূপান্তরের গল্প ২৪৩ : একবার ডিঙ্গি নৌকায় করে যাচ্ছিলাম সুন্দরবনের মাঝারি একটি খাল ধরে। জোংড়া খালের সেই পাশ খালে ঢুকতেই দেখি বিশাল এক কুমির রোদ পোহাচ্ছে। আমাদের দেখেও ঝাঁপ দিলো পানিতে। ভয়ে সিঁটিয়ে গেলাম। আমরা যে নৌকায় বসা, তার চেয়েও বড় কুমিরটি। পানির নিচ দিয়ে এসে আক্রমণ করবে না তো?

আমাকে ভয় পেতে দেখে নৌকার মাঝি হেসে দিলো। সামনে বসা ছোট্ট ছেলেটা পেলো মজা। বললো, জঙ্গলের পশু পাখি যদি আক্রমণ করতো, তাহলে মানুষ আর জঙ্গলে ঢুকতে পারতো না। মিনিট খানেক পর দেখলাম কিছুটা দূরে ভেসে উঠলো কুমিরটি। হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম।

লোকালয়ের কাছে হলেও এদিকের বন বেশ গভীর। সুন্দরবনের বাঘ থেকে শুরু করে সব ধরনের বন্যপ্রাণির আনাগোনা দেখা যায়। বিশেষ করে কুমির, হরিণ আর বানর দেখা যায় অহরহ। এদিকে সামনা সামনি বেঙ্গল টাইগারের দেখা পাইনি। তবে ছোট ছোট বাচ্চাসহ মেছো বাঘের একটি পরিবার দেখেছিলাম। ভোঁদড়ের অভাব নাই।

যেকোনো খালের চরে ওদের পায়ের ছাপ দেখি, সামনা সামনিও দেখেছি অনেক বার। সবকিছু ছাপিয়ে এই জঙ্গলের সবচেয়ে আনন্দের উপলক্ষ্য আমার কাছে নানা রকমের পাখির ডাক। এসব দেখতে হলে, অনুভব করতে হলে শব্দ ছাড়া চলাফেরা করতে হয়, ইঞ্জিন চালিত ট্রলারে চড়ে এসব দেখা যায় না।

মধ্য রাতে বিকট শব্দের ট্রলার নিয়ে বনে ঢুকেছি। শুধু বন্যপ্রাণি না, এই শব্দে আশেপাশের জেলেরাও দূরে চলে গেছে। আমরা এসেছি জোংড়া খালের ভিতরের খাল- বড় বস্তায়। বনদস্যু সাগর বাহিনী রাতেই উঠবে সুন্দরবন থেকে।

দস্যুদের নিয়ে কোনো রকমে জোংড়ার মুখে রাখা RAB-এর ট্রলার পর্যন্ত গেলেই আমরা নিরাপদ। সেখান থেকে আবার মংলা পর্যন্ত যেতে হবে পানি পথে। তারপর সড়ক পথে দস্যুদের নিয়ে যাওয়া হবে বরগুনায়। সাথে আমরাও যাবো। পরদিন অর্থাৎ ২০ অক্টোবর সকালে আসবেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।

ট্রলার থামানোর নির্দেশ দিয়েছিলা। তবে গিয়ার না থাকায় ইঞ্জিন বন্ধ করলেও থামতে থামতে দেরি হয়ে গেলো। ট্রলার উঠে পড়লো জঙ্গলো। ধাক্কা খেলো একটি কেওড়া গাছের সাথে। পড়িমরি করে কোনো রকমে সামলে নিলাম।

ঝুপঝাপ করে নেমে পড়লো দুইজন। গাছের ডালের ভিতর থেকে ঠেলে বের করলো ট্রলার। জোয়ার থাকায় কষ্ট হয়নি তেমন। এরপর স্রোতে ভাসতে ভাসতে এগুতে থাকলাম। দ্বিতীয় নৌকাটি থেকে একজন উঠে আসলো ট্রলারে। মধ্যবয়সী এই বনদস্যুর নাম খোকন, জঙ্গলে তিনি পরিচিত কয়লা খোকন নামে। জিজ্ঞেস করলাম, কতো দূরে ওরা? উনি বললেন, অনেক ভিতরে, একদম খালের আগায়, ট্রলার নিয়ে ওই পর্যন্ত যাওয়া যাবে না।

চারপাশে ধুপধাপ আওয়াজ হচ্ছে। অন্ধকারে কিছু দেখতে পাচ্ছি না। তবে বুঝতে পারছি যে খালের মধ্যে বড় বড় মাছ লাফঝাঁপ দিচ্ছে। শেষ জোয়ার ও শেষ ভাটায় যখন স্রোত থেমে যায় তখন বড় মাছেরা জানান দেয়। কামমরুলকে জিজ্ঞেস করলাম, কী মাছ এগুলো? সে বললো, কয়েক জাতের মাছ আছে এখানে। লেজে বাড়ি দিচ্ছে যেগুলো সেগুলো পাঙ্গাস মাছ।

সুন্দরবনের এদিকে প্রচুর মাছ হয়। আশ্বিন-কার্তিক মাসে বড় মাছগুলো ঢুকে পড়ে খালে খালে। এ সময় কেওড়া পাকে। এই ফল পাঙ্গাসের প্রিয় খাবার। বড় বস্তা খালের মুখে আসতেই মাছদের লাফালাফির শব্দ পাচ্ছি। খালপাটা, চরপাটা আর ফাঁস জালের জেলেরা তাই ভীড় করে বনের এই অঞ্চলে। অভয়াশ্রম হলেও বনদস্যুদের সাথে সমঝোতা করে মাছ ধরে জেলেরা। বইশেলরাও এসময় মাছ পায় বেশি।

বড় বস্তা খালটি দেখতেও অসাধারণ। জোংড়া থেকে ঢুকে গেছে উত্তরে। তারপর বেশ খানিকটা এগুলো দোঢালা পড়বে। মানে ওখান থেকে দুই দিকে চলে গেছে দুটি খাল। ট্রলার নিয়ে সেই দোঢালা পর্যন্ত গেলাম। তারপর সাথে থাকা দুটি ডিঙ্গি নৌকায় উঠে বসলাম সবাই। জোয়ার প্রায় শেষের দিকে। ভাটা শুরু হতে হতে আমাদের বেরিয়ে যেতে হবে।

সাথে এখন দুইটি ডিঙ্গি নৌকা আছে। সহযাত্রীদের নিয়ে উঠে পড়লাম নৌকায়। সঙ্গে নিলাম ক্যামেরার যন্ত্রপাতি। দোঢালা থেকে ডান পাশের খালে ঢুকলাম। গা শিরশির করছে, বুত ধকধক করছে। কারণ খাল ক্রমেই সরু হয়ে আসছে। জায়গাটি অনেকটা চিপা’র খালের মতো। কয়দিন আগেই সেখানে বাঘের ভয় পেয়েছি।

একটার পর একটা নৌকা চলছে। সামনের নৌকায় বড় খোকন বন্দুক হাতে দাঁড়ানো। পিছনের নৌকায় দাঁড়ানো কামরুল। এবার তার হাতেও বন্দুক। কামরুল বললো, দুশ্চিন্তা করবেন না। বাঘ সামনে পড়লেও সমস্যা নাই।

একটার পর একটি ছোট খাল, দোয়া আর ভাড়ানী পেরিয়ে পৌঁছে গেলাম খালের একদম মাথায়। সাগর বাহিনীর সদস্যরা সেখানে অপেক্ষা করছে। দেখা হলো সাগর বাহিনীর সাথে।

দস্যুনেতা আলমগীর জড়োসড়ো হয়ে দাঁড়ানো। দেখেই বুঝতে পারছি বেশ চাপে আছে। তাকে জিজ্ঞেস করলাম, সবকিছু ঠিকঠাক? বললো, একটু আগেও মংলা থেকে সেই সোর্স ফোন করেছিলো। তাদের বলেছি, আপাতত সারেন্ডারের কোনো পরিকল্পনা নাই। বললাম, একারণেই মাঠ পর্যায়ের এরা খোঁজ পায়নি। তবে ওপরের স্যারেরা কাল সকালেই খবর পেয়ে যাবে, অনেকে হয়তো খবর পেয়েও গেছে। কারণ RAB মহাপরিচালক, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসবেন বরগুনায়। এই খবর গোপন থাকার কথা না।

দস্যুরা তিনটি নৌকা নিয়ে অবস্থান করছিলো। তার মধ্যে দুইটি তাদের নৌকা, একটি জেলেদের। আমাদের শ্যুটিং করতে হবে। নৌকাগুলো একটির পাশে একটি বাঁধা হলো। সব মিলিয়ে বেশ প্রশস্ত জায়গা পেলাম। তখন বন্যা জোয়ার। খালের আগায় পানি আছে স্থির হয়ে। দ্রুত সবাই কাজে নেমে পড়লাম।

সাগর বাহিনীর দস্যুরা একে একে অস্ত্রগুলো একসাথে করে জমা দিলো। তারপর শুরু হলো গুলি গননার কাজ। বললাম, গুলিগুলো একসাথে করেন। গণনার কাজ পরে করা যাবে। ভাটা শুরু হবে এখনই। আমরা এই ভাটাতেই নেমে যাবো।

ক্যামেরার সামনে সুন্দরবনের এই দস্যুদের চেহারা দেখা যাবে কাল। সবাইকে জিজ্ঞেস করলাম, কারও চেহারা দেখাতে আপত্তি আছে? ওরা বললো, এখন চেহারা না দেখালে বিপদ হবে। আমাদের সবাইকে ক্যামেরায় নেন। বড় আলো জ্বালিয়ে ভিডিওগ্রাফার বায়েজিদ ইসলাম পলিন ছবি তুললেন। অস্ত্রগুলো বুঝে নিলাম।

এতো অল্প সময়ের মধ্যে ২০টি অস্ত্র জোগাড় করে ফেলেছে এরা। আর কিছুদিন সময় পেলে মাঝারি আকৃতির এই দস্যুদলটি হয়তো পরিণত হতো বড় দস্যুদলে। তখন হয়তো এই দলের প্রধান সাগর অর্থাৎ আলমগীর থাকতো না। শহরের সিন্ডিকেট তাদের মতো করে লিডার নির্ধারণ করে এই দস্যুদলটিকে দিয়ে বড় করে দস্যুতার কাজ চালাতো।

দস্যুরা তাদের শেষ মুহুর্তের গোছগাছ সেরে নিচ্ছে। মাইক্রোফোন হাতে দাঁড়ালাম আমি। একজন একজন করে দস্যুদের সবার সাথে কথা বললাম। প্রত্যেকেরই আকুতি- বাঁচতে চাই, বাড়ি ফিরতে চাই।

(ছবি: বাশে দাঁড়ানো দস্যুনেতা আলমগীর। তার বাম পাশে কয়লা খোকন, একদম বামে কাবীর। বড় বস্তা খাল। সুন্দরবন। অক্টোবর ২০১৬)

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top