রূদ্ধশ্বাস ছয় ঘন্টা | রূপান্তরের গল্প ২৪৪ | Rupantorer Golpo 244 | দস্যুমুক্ত সুন্দরবন | সুন্দরবনের গল্প | জীবনে ফেরার গল্প | Jibone Ferar Golpo | Sundarbaner Goppo | Story of Sundarbans | মোহসীন উল হাকিম | Mohsin Ul Hakim
রূপান্তরের গল্প ২৪৪ : ‘অবৈধ বাজার থেকে অস্ত্র আর গুলিগুলো শুধু কিনেই গেছি। ব্যবহার করা লাগেনি। মাঝে মাঝে জঙ্গলের জেলেদের ভয় দেখানোর জন্য কয়েকটা ফাঁকা ফায়ার করছি। সাথে শিকারী নাই বলে হরিণ বা পাখি শিকার করিনি’। ক্যামেরায় দেওয়া সাক্ষাতকারে কথাগুলো বলছে বনদস্যুরা।
সাগর বাহিনী নামের এই দস্যুদলটি সুন্দরবনে নেমেছে তিন মাস আগে। দস্যুনেতা বললো, ‘সুন্দরবনে ডাকাত দল গড়তে গেলে অস্ত্র আর গুলি লাগবে। সেই লাইন নাই। যাদের লাইন-ঘাট ভালো তাদের অস্ত্র জোগাড় করতে সময় লাগে না’।
জিজ্ঞেস করলাম, অস্ত্র জোগাড়ের লাইন থাকলেই হয়? টাকাও তো লাগে। দস্যুনেতা বললো, টাকা বাঁকী রাখা যায় ভাই। যখন জেলখানা থেকে বের হই তখন তো আমার কাছে এক টাকাও ছিলো না। আমাকে বিশ্বাস করে এগুলো দিয়েছে বড় ভাই। প্রথমে আটটা বন্দুক দেয়। সাথে একশ’ গুলিও ছিলো। দাম ধরে দশ লাখ টাকা। সুন্দরবনে ডাকাতি করতে নামলাম। তারপর প্রথম মাসের রোজগার দিয়েই সেই দশ লাখ টাকা শোধ করে দেই।
খুব অল্প সময়ের মধ্যে অস্ত্র-গুলি গুছিয়ে নিয়েছে সাগর বাহিনী। সুন্দরবনে যেকোনো প্রতিপক্ষ দস্যুদলের সাথে বন্দুক যুদ্ধ করার জন্য ওই আটটি অস্ত্রই যথেষ্ট ছিলো। কিন্তু তারপরও অস্ত্র কিনলে কেন তোমরা? আলমগীর বললো, গোলাগুলি তেমন করা লাগে না। সাথে অস্ত্র আছে এটাই সাহস। অন্য দস্যু দলগুলো আক্রমণ করার সময় হিসাব করবে। এখন তো আর অনেক বেশি অস্ত্র ওয়ালা বনদস্যু দল জঙ্গলে নাই।
মধ্য রাত। বড় বস্তা খালের মাথায় আমরা। নৌকায় দাঁড়িয়ে কথা বলছি সাগর বাহিনীর সাথে। নিউজের জন্য আমরা আমাদের কাজ করছি, একই সাথে জঙ্গল থেকে উঠে আসার আগ মুহুর্তের গোছগাছ করে নিচ্ছে বনদস্যুরা। আত্মসমর্পণের প্রস্তুতি বলতে তেমন কিছু না। জেলখানায় ব্যবহারের জন্য নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিষপত্র গোছাচ্ছে তারা। অস্ত্র আর গুলিগুলো আগেই গুছিয়ে জমা করেছে আমাদের নৌকায়।
এই ব্যস্ততার মধ্যে যাতে নতুন কোনো বিপদ না আসে সেদিকেও খেয়াল রাখা দরকার। লোকালয়ের কাছে বলে এই ঝুঁকি অনেক বেশি। আবার এই দিকটাকে ছোট ছোট দস্যুদলও থাকে। যারা হুটহাট গুলি করে বসে। অন্যদিকে সাগর বাহিনী নিয়ে আইন শৃংখলা বাহিনীগুলোর মাথা ব্যাথা একটু বেশি। তাই ঝুঁকিও বেশি। জোংড়া খালের গোঁড়ায় RAB-এর ট্রলারে না যাওয়া পর্যন্ত আমরা বিপদ মুক্ত না।
অস্ত্রগুলো একটি একটি করে বুঝে নিলাম। গুলি আছে পাঁচ শতাধিক। দস্যুনেতা বললো, ‘এই সব কিনতে প্রায় ৩৫ লাখ টাকা খরচ হয়ে গেছে। এর মধ্যে ২৭ লাখ টাকা দিলাম। বাকী ৮ লাখ টাকা দেওয়া হয়নি। এনিয়েই টেনশনে আছি ভাই। ওঠার পর তো আর ইনকাম থাকবে না’। আমি আবারও বললাম, ‘আত্মসমর্পণের পর এসব নিয়ে আর কোনো চাপ আসবে না। আসলে আমাকে বলবেন। আমরা আইন শৃংখলা বাহিনীর সহযোগিতা নিবো। তবে মনে হয় না আর টাকা চাইবে তোমার সেই বড় ভাই’।
পাশ থেকে আরেক বনদস্যু বললো, ‘অস্ত্রের ব্যবসায়ীরা দ্বিগুন লাভ করে। আমাদের এখানে যা অস্ত্র-গুলি আছে তার দাম খুব বেশি হলে কুড়ি লাখ টাকা হবে। শহরের ব্ল্যাক মার্কেট থেকে কিনলে এই দামেই পাওয়া যেতো সব। শুধু আমাদের কাছে আসলেই এগুলোর দাম যা মন চায় তাই নেয়। সুন্দরবনে ডাকাতি করতে নামি আমরা। জেলেদের ওপর অত্যাচার করি আমরা। চাঁদা নেই, মুক্তিপণ নেই। অবৈধ রোজগার যা করি তার বড় অংশই নিয়ে যায় এই অস্ত্রের ব্যবসায়ীরা।
এই সফরে বেলায়েত সরদার ছিলেন। সাথে অন্য যারা ছিলেন তাঁরাও অভিজ্ঞ। মানে আমার সাথে একই ধরনের সফর করেছেন আগে। তাই তাদের নিয়ে দুশ্চিন্তা করতে হচ্ছে না। উনারা জানেন কোন সময়ে কী করতে হবে। প্রথমত চারপাশে খেয়াল রাখতে হবে। সেই কাজ করেন বেলায়েত সরদার। দস্যুদের ভিতরে অসংলগ্ন কিছু থাকলে তা খেয়াল করার দায়িত্ব ইয়ামিন ভাই-এর। ছবি তোলার পাশাপাশি পলিনের দায়িত্বও দস্যুদের গতিবিধি খেয়াল রাখা।
সন্দেহজক কেউ থাকলে তাকে আলাদা ভাবে পাহারা দেওয়ার দায়িত্ব থাকে আরেক সহযাত্রী নিজাম উদ্দীনের ওপর। আগের সফর বেশ জটিল হয়ে পড়েছিলো বলে অভিজ্ঞ সবাইকে নিয়ে নেমেছি এবার।
আগের সফরে এসে সন্দেহভাজন চারজন বনদস্যুকে পেয়েছিলাম যারা দস্যুনেতা আলমগীরের বিশ্বস্ত না। ওদের পাঠিয়েছিলো অস্ত্র সরবরাহ করা বড় ভাই। সেই বড় ভাই দস্যুদলটির আত্মসমর্পণ চায়নি।
ওই চারজনকে চিহ্নিত করতে না পারলে হয়তো আজকে এই সফলতা আসতো না। হয়তো ওদের দিয়ে দলের মধ্যে গোলাগুলি করে অঘটন ঘটানো হতো, অথবা দল ভেঙ্গে ফেলা হতো, অস্ত্রগুলো দুই ভাগ হয়ে যেতো। এভাবেই ভাগ হয় সুন্দরবনের দস্যুদল।
এই দফায় আমার চেষ্টা ছিলো, দল ভাগ হতে দিবো না। অনেক প্রতিবন্ধকতা ছিলো। কিন্তু শুরুতেই চারজনকে আলাদা করে ফেলায় সাগর বাহিনী আর ভাগ হতে পারেনি। ২০টি অস্ত্র নিয়েই উঠে যাচ্ছে তারা।
গোছগাছ শেষে আমরা রওনা হলাম। হাতে সময় নাই। আগামী দুই ঘন্টার মধ্যে আমাদের জোংড়া খালের মুখে পশুর নদীতে রাখা RAB-এর ট্রলারে পৌঁছাতে হবে। ভাটা শুরু হয়েছে। তাই যেতে বাড়তি সময় লাগবে না।
সারিবদ্ধ ভাবে নৌকাগুলো রাখা হলো। প্রথম নৌকায় দুইজন বনদস্যু অস্ত্র হাতে থাকবে। দ্বিতীয় নৌকায় থাকবে দস্যুনেতা ও আমরা। এই নৌকাতে বাকী অস্ত্রগুলো রাখা। পরের নৌকাগুলোতে অন্য দস্যুরা থাকবে। শেষের নৌকায় থাকবে দু্ইজন সশস্ত্র দস্যু।
সরু খাল ধরে নৌকা বেয়ে এগিয়ে চললাম। সবাই একদম চুপ। পানিতে বৈঠার বাড়ির শব্দ ছাড়া কোনো শব্দ নাই। দুই পাশে গভীর বন। বাঘের আনাগোনাও আছে। তাই কোনো রকমের ঝুঁকি নিবো না। আধা ঘন্টা চললাম এভাবে। পৌঁছে গেলাম সেই দোঢালায়। এখানে ট্রলার রেখে গেছি।
দোঢালায় এসে দেখি ট্রলার নাই। মানে যেখানে রেখে গেছি সেখানে নাই। ডানে বামে যতোদূর টর্চ এর আলো যায় সে পর্যন্তও কিছু দেখছি না। গেলো কোথায় ট্রলার? বেলায়েত সরদারকে বললাম, হবে কী এখন? ট্রলার কী চলে গেলো আমাদের রেখে? সবকিছু ঠিকঠাক চলছিলো। এর মধ্যে এই বিপদ আসবে ভাবিনি। মনের মধ্যে অনেক রকমের দুশ্চিন্তা এসে ভীড় করলো।
চিৎকার করে বললাম, নৌকা থামান। সবাই আবার খালের ভিতরে ঢুকে পড়েন। কী হয়েছে জানি না কিন্তু ট্রলারটি জায়গায় না থাকাটা বিরাট সন্দেহের ব্যাপার। ওরা ইঞ্জিন চালায়নি নিশ্চিত। ইঞ্জিন চালিয়ে চলে গেলে শব্দ পেতাম। তার মানে হয় স্রোতে ভেসে চলে গেছে অথবা সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। আবার হতে পারে অন্য কোনো কারনে ট্রলারটি আশেপাশে কোথাও সরিয়ে রেখেছে।
সরদার বললেন, ট্রলারে রাজু নামের একটি ছেলে ছিলো। চিলা বাজারেই বাড়ি। ওর তো এমনি এমনি চলে যাওয়ার কথা না। বলতে বলতে আমরা যেদিক থেকে এসেছিলাম সেদিকের খালের ভিতরে ফিরে আসলাম।
এক বাঁক ফিরে এসে নিজেদের আড়াল করলাম। তারপর সরদার একটি নৌকা নিয়ে দোঢালার দিকে রওনা দিলেন। বুকটা আবার ধকধক শুরু করলো। আবার কোন অভিযান নামলো না তো? প্রতিপক্ষ কেউ এসে অ্যামবুশ করবে না তো?
মহা দুশ্চিন্তা নিয়ে অপেক্ষা করছি আমি। এদিকে কাবীর আর কামরুল বললো, ‘আমরা একটু জঙ্গলের ভিতর দিয়ে দেখে আসি? বললাম, তোমরা বন্দুক লোড করে রেডি থাকো। আশা করি কোনো ঝামেলা হবে না শেষ পর্যন্ত। কিন্তু সামনে কেউ যদি পড়ে যায়, যদি ওরা গুলি করে তখন তো পাল্টা গুলি করতে হবে। এখন জঙ্গলে নামলে আবার তোমাদের খুঁজতে লোক পাঠাতে হবে। যেভাবে বলছি সেভাবে চলো। কেউ নামবে না’। দস্যুনেতা আলমগীরও আমার কথায় সায় দিলো।
মিনিট কুড়ি পর বাম পাশ থেকে কুঁই আসলো। মানে সিগন্যাল দিলো কেউ একজন। বললাম, ওই তো বেলায়েত সরদার। পাল্টা কুঁই দিলো এদিক থেকে একজন। তারপর একটি নৌকা নিয়ে এগিয়ে গেলাম আমি। সামনে পিছনে সশস্ত্র দুই দস্যুকে বললাম, গুলি লোড করা আছে? ওরা বললো, আমরা রেডি। দোঢালার দিকে এগিয়ে গেলাম।
হাতের বাম দিক থেকে এসেছে সরদারের কুঁই। তার মানে মূল খালের দিকে ওরা। দোঢালার কাছাকাছি আসতে কথা বলার শব্দ পেলাম। বেলায়েত সরদার মন খুলে গালিগালাজ করছে ট্রলারে থাকা ছেলেটিকে।
আমরা নৌকা বেয়ে সেদিকে এগুলাম। দেখি ট্রলারটি রাখা জঙ্গল ঘেঁষে। আরও কাছে গিয়ে দেখি ট্রলারের পিছনটা ঢুকে আছে জঙ্গলের ভিতরে। ওরা দুইজন মিলে ট্রলারটি ছাড়ানোর চেষ্টা করছে। আমার নৌকা থেকে দুইজন নেমে তাদের কাজে হাত লাগালো। একটু কসরৎ করে জঙ্গল থেকে নামানো হলো ট্রলার। তারপর মাঝ খালে এনে নোঙ্গর করা হলো।
কুঁই দিয়ে অন্য নৌকাগুলোকে ডাকলাম। কিন্তু সাড়া পেলাম না। নৌকা থেকে নেমে পড়লো দুই দস্যু। তারা জঙ্গলের ভিতর দিয়ে পায়ে হেঁটে যাবে ওই নৌকাগুলোর ওখানে। নিয়ে আসবে তাদের। সরদার এখন একটু ঠান্ডা হলেন। বললেন, এইসব ছেলেপেলে নিয়ে জঙ্গলে চলা যায় ভাই? জানতে চাইলাম, কী করে সরলো ট্রলার? এখানেই বা আসলো কী করে?
রাজু অর্থাৎ ট্রলারের রেখে যাওয়া কিশোরটি ঘুমিয়ে পড়েছিলো। নোঙ্গর করা ছিলো ট্রলার। কিন্তু শেষ জোয়ারের চাপে নোঙ্গর উঠে যায়। ছেলেটি কিছুই বলতে পারছে না। সে তো ঘুমে। ধারণা করছি বন্যা জোয়ারে ভাসতে ভাসতে ট্রলার আরও ভিতরে চলে যায়। তারপর ভাটার টানে নেমে আসে। নামার পথে জঙ্গলের এই কেওড়া গাছের সাথে আটকে যায়। অবস্থা এমন যে আরেকটু ভাটা হলে এই ট্রলার আর নামানোই যেতো না।
বেলায়েত সরদারের বকাঝকা শেষ হচ্ছে না। থামিয়ে তাকে বললাম, ট্রলারে তাকে একা রেখে যাওয়া উচিৎ হয়নি আমাদের। সদ্য ঘুম থেকে উঠে ছেলেটি বেশ বিব্রত। কী করবে, কী বলবে বুঝতে পারছে না।
কিছুক্ষণের মধ্যে দস্যুদের নৌকা বহর এসে ভিড়লো। ঝটপট সবাইকে ট্রলারে উঠিয়ে নিলাম। বললাম, নৌকাগুলো কী করবেন? দস্যুনেতা বললো, এগুলো যেই জেলেদের কাছ থেকে নিলাম, তাদের হাতে ফেরত চলে যাবে। নৌকার মালিকদের বলা আছে। এখানেই কোনো খালে রাখা থাকবে নৌকাগুলো। ওরা এসে নিয়ে যাবে।
ইঞ্জিন চালু হলো। বিকট শব্দ চারপাশের নিরবতা ভেঙ্গে ফেললো। ভাটার স্রোত আর ইঞ্জিনের গতি মিলিয়ে এগিয়ে চললাম আমরা। ট্রলার চালাচ্ছেন বেলায়েত সরদার। সামনে দাঁড়ানো আমি। টর্চ হাতে পথ দেখাচ্ছি। বড় বস্তা খাল থেকে বেরিয়ে পড়লাম জোংড়া খালে। তারপর এক টানে পশুর নদী। জোংড়ার মুখে পশুর নদীতে রাখা RAB-ট্রলার। সোজা গিয়ে ভিড়লাম সেখানে।
দস্যুনেতাসহ ১৩ জন বনদস্যু উঠে পড়লো ওই ট্রলারে। তারপর অস্ত্র ও গুলিগুলো বুঝিয়ে দিলাম। আমরাও নিজেদের জিনিষপত্র নিয়ে উঠের পড়লাম ওই ট্রলারে। বেলায়েত সরদার ইলিশের ট্রলারটি নিয়ে বিদায় নিলেন। আমরা পশুর নদীর পশ্চিম পাশ ধরে এগিয়ে চললাম মংলার দিকে। শেষ হলো আমাদের ছয় ঘন্টার রূদ্ধশ্বাস অভিযান!
(ছবি: সাগর বাহিনীর সারেন্ডারের আগের রাত)