কী করবো এখন? | রূপান্তরের গল্প ২৪৬ | Rupantorer Golpo 246 | দস্যুমুক্ত সুন্দরবন | সুন্দরবনের গল্প | জীবনে ফেরার গল্প | Jibone Ferar Golpo | Sundarbaner Goppo | Story of Sundarbans | মোহসীন উল হাকিম | Mohsin Ul Hakim
রূপান্তরের গল্প ২৪৬ : সুন্দরবনের দস্যু জগতটা উল্টেপাল্টে গেছে। সাতটি দল আত্মসমর্পণ করেছে। যোগাযোগ চলছে পশ্চিম সুন্দরবনের দস্যু আলিফ বাহিনী ও মধ্য সুন্দরবনের দস্যুদল নোয়া বাহিনীর সাথে। দু্টি দলই বেশ মজবুত। তবে তারচেয়ে বেশি দাপুটে দল জাহাঙ্গীর বাহিনী। এই দলটির সাথে সেভাবে যোগাযোগ নাই। কারণ ওরা ঘোষণা দিয়েছে সারেন্ডার করবে না। তিনটি দলই জেলেদের উপর ব্যাপক অত্যাচার করছে।
আলিফের সাথে কথাবার্তা চুড়ান্ত সেই জুলাই থেকে। ২০১৬ সালে মজনু বাহিনীর আত্মসমর্পণের পর থেকে। কিন্তু সে নয়ছয় করে সময় কাটাচ্ছে। নোয়া মিয়ার বাহিনীটিও সে ভাবে সাড়া দিচ্ছে না। ওরা সম্ভবত এখনও তাদের পুরনো নেতা রাজুর ইশারায় চলছে।
এদিকে ছোট একটি দস্যু বাহিনী অনেক দিন ধরে ডাকাতি করছে পূর্ব সুন্দরবনে। পশুর নদীর পূর্ব পাশ, সেলা নদীর এপাশ-ওপাশ মিলিয়ে বেশ জ্বালাচ্ছে তারা। এছাড়া বড় সুমন বাহিনী নামের দস্যুদলটির নেতৃত্বে নাকী পূর্ব সুন্দরবনের নিচের দিকটা বেশ গরম। তাহলে এই যে দস্যুদলগুলো আত্মসমর্পণ করছে তার প্রভাব কি পড়ছে না?
সুন্দরবনের কয়েকজন বড় ব্যবসায়ী এই কথাটিই বলে যাচ্ছেন শুরু থেকে। বিভিন্ন মহলে ছড়ানো হচ্ছে একটি কথা- আত্মসমর্পণে তাদের কোনো উপকার হচ্ছে না।
ঢাকা ফিরে অফিসের দৈনন্দিন কাজে মন দিলাম। তবে টেলিফোনে খোঁজ খবর নিচ্ছি আত্মসমর্পণ করা বনদস্যুদের। দূর থেকে তাদের পরিবারের সদস্যদের দেখভালও চলছে পুরো দমে। সোর্সদের সাথে যোগাযোগ কমিয়ে দিয়েছি। নতুন করে নিজের সোর্স তৈরির চেষ্টা করছি। তবে জীবনে ফিরে আসা দস্যুদের পরিস্কার বলেছি, কারও সোর্স হিসাবে তারা যেন কাজ না করে।
ভাবি এক, হয় আরেক। জেলখানা থেকে জামিনে বের হওয়া সাবেক দস্যুদের নিয়ে টানা হেঁচড়া শুরু হলো। জঙ্গলের বিদ্যমান বনদস্যুদের ঘায়েল করতে সাবেক দস্যুদের ব্যবহার করার চেষ্টা বাড়তে থাকলো। জনে জনে বলছি, এই মানুষগুলোকে সোর্স বানানো বন্ধ করেন। এদের সোর্স বানানোটা হবে আত্মঘাতী। বুঝিয়ে বললাম অনেককে। কিন্তু কাজ হচ্ছে না।
৩১ মে ২০১৬ থেকে অক্টোবর পর্যন্ত আত্মসমর্পণ করা দস্যুদের মধ্যে তিনটি দলের সদস্যরা বাড়িতে আছে। মজনু আর ইলিয়াস বাহিনীর সদস্যরা জামিন পায়নি । বাড়ি ফেরা লোকগুলোকে নিয়ে বিপত্তিতে আছি। সোর্স-এর কাজ করার জন্য তাদের লোভ দেওয়া হচ্ছে, চাপ দেওয়া হচ্ছে।
মাস্টার বাহিনীর প্রধান মোস্তফা শেখ নিরিবিলি জীবন যাপন করছেন। দস্যু জগতে অ্যাম্বুশ মাস্টার হিসাবে পরিচিতি ছিলো বলে তার ওপর চাপ বেশি। গহীন বনে প্রতিপক্ষ বনদস্যু দলকে ঘায়েল করতে তার জুরি ছিলো না। বর্তমান দস্যুদলগুলোর বিরুদ্ধে অভিযান চালাতে তাই মাস্টারকে ব্যবহারের চেষ্টা করছিলো সংশ্লিষ্ট কয়েকটি আইন শৃঙ্খলা বাহিনী। তবে শেষ পর্যন্ত কথা শুনেছে মাস্টার। রাজি হয়নি। একই ভাবে সোর্স হওয়ার প্রস্তাব এড়িয়ে যায় দস্যুনেতা আলম ও বারেক তালুকদার।
সাগর বাহিনীকে আত্মসমর্পণ করাতে না পারায় কয়েকজন কর্মকর্তা বেশ ক্ষুব্ধ ছিলেন। সেই ব্যর্থতা যায় তাদের সোর্সদের উপর। বিশেষ করে মংলা, ঢাংমারী, ঢাংমারী, ছুতারখালী, কালাবগী, কয়রা ও শ্যামনগরের সোর্সদের মধ্যে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া হলো।
আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর সোর্সদের অনেকেই গোপনে আমার সাথে যোগাযোগ করলো। তাদের কাছ থেকে জানলাম, আমার বিরুদ্ধে একজোট হয়েছে সবাই মিলে। বলা হচ্ছিলো, আগে সাংবাদিককে ঠেকাতে হবে। সে পর্যন্ত দস্যুবিরোধী অভিযান চললেও কাউকে আত্মসমর্পণ করতে দেওয়া হবে না।
আমার পরবর্তী টার্গেট আলিফ বাহিনী। দস্যু দলটির নেতা আলিফের কথার সাথে কাজের মিল পাচ্ছি না। সে রীতিমতো আমাকে বোকা বানাচ্ছে, ঘুরাচ্ছে। দেখা করবো বলছি, এড়িয়ে যাচ্ছে। আরেক দস্যুদল নোয়া বাহিনী বলছে, আপাতত সারেন্ডার নয়।
এদিকে নতুন করে মোশাররফ বাহিনী যোগাযোগ করেছে। বলছে তারা সারেন্ডার করতে চায়। ফোনে কয়েক দফা কথা হলো। বললো, প্রশাসনের সাথেও তাদের কথাবার্তা চলছে। মংলার এক সোর্স তাদের আত্মসমর্পণ করতে বলছে। তবে তাদের প্রতি কড়া নির্দেশ, সাংবাদিকের সাথে যোগাযোগ করা যাবে না। এই মোশাররফ এক সময় RAB-এর সোর্স ছিলো। তার বিষয়ে তাই বাড়তি সতর্ক হতে হবে। এই দলে ছোট সুমন নামের আরেক দস্যু আছে। বাড়ি জয়মনিরঘোল।
এরপর মাস খানেক মোশাররফের সাথে আর যোগাযোগ হয়নি। তবে মংলা’র সোর্সদের সাথে যোগাযোগ আছে। শেষ যেবার কথা হয় তখন তাদের বলেছিলাম, সারেন্ডার করো আর না করো বিপদে পড়ো না। কিন্তু ওরা আমার কথা শোনেনি।
কিছুদিন পর সোর্সদের মাধ্যমে আত্মসমর্পণ করার জন্য সুন্দরবন ছাড়ে এই বাহিনী। কিন্তু কথা অনুযায়ী কাজ হয়নি। আত্মসমর্পণের কথা বলে তাদের বিরুদ্ধে মামলা দিয়েছে। আসলে সেই সোর্স তাদের সাথে প্রতারণা করেছে।
ভেবেছিলাম ছয়টি বনদস্যু দলের আত্মসমর্পণের পর সামনের কাজগুলো আরও সহজ হবে। কিন্তু বাস্তবতা পুরোই উল্টো। এখন মনে হচ্ছে পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে গেছে। এই জটিলতায় নিজে ঝুঁকিতে পড়তে পারি। রক্তাক্ত হতে পারে সুন্দরবন। কী করবো এখন সিদ্ধান্ত নিতে পারছি না।
ফোন দিলাম বেলায়েত সরদারকে। বললাম, ট্রলার প্রস্তুত করেন। মাথা জ্যাম হয়ে গেছে। সরদার বললেন, চলে আসেন ভাই।
(ছবি: সুন্দরবনের একটি চর)