হঠাৎ খুললো সরদারের রান্নাঘর | রূপান্তরের গল্প ২৪৭ | Rupantorer Golpo 247 | দস্যুমুক্ত সুন্দরবন | সুন্দরবনের গল্প | জীবনে ফেরার গল্প | Jibone Ferar Golpo | Sundarbaner Goppo | Story of Sundarbans | মোহসীন উল হাকিম | Mohsin Ul Hakim
রূপান্তরের গল্প ২৪৭ : সমানে অপহরণের ঘটনা ঘটছে। সুন্দরবনের ডাকাতরা বেশ বেপরোয়া। আলিফ বাহিনী মুক্তিপণ চাচ্ছে জনপ্রতি এক লাখ টাকা। নোয়া বাহিনী চাচ্ছে পঞ্চাশ হাজার করে। ছোট দস্যুদলগুলোও মুক্তিপণ চাচ্ছে বড় অংকে। বলা যায় নতুন করে অরাজকতা শুরু হলো।
এদিকে শুনছি জাহাঙ্গীর বাহিনী সাগরে কোপ দিতে যাবে। মানে সাগরের জেলেদের অপহরণ করবে। সাগরে যেতে পারলে বিরাট রোজগার। জেলেদের ধরে আনতে পারলে মুক্তিপণ জনপ্রতি তিন লাখ টাকা পাওয়া যায়। এই লোভ সামলানো মুশকিল। জাহাঙ্গীরের মতো দস্যুনেতা এই লোভ সামলাতে পারবে না, জানা কথা।
ছাপড়াখালী। পূর্ব সুন্দরবনের একটি খাল। সামনে চর আছে। সেখান থেকে সোজা বের হওয়া যায় সাগরে। খবর পেলাম, জাহাঙ্গীর বাহিনী অবস্থান নিয়েছে ছাপড়াখালীতে। গোন শুরু হলেই নামবে সাগরে।
বরিশাল RAB-এর মেজর আদনান কবীরও একই খবর দিলেন। দুজন মিলে ঠিক করলাম, জাহাঙ্গীরকে সাগরে যেতে দিবো না। আদনান তাঁর মতো করে কাজ শুরু করলেন। জাহাঙ্গীরের অবস্থান জানার চেষ্টা করবেন। সেখানে অভিযান চালানোর চেষ্টাও করবেন তাঁরা। এবিষয়ে আমার বেশি কিছু করার নাই।
পাথরঘাটার ট্রলার মালিক সমিতির সভাপতি মোস্তফা চৌধুরীকে ফোন দিলাম। কুয়াকাটার আনসার ভাইকে ফোন দিলাম। সুন্দরবনের পরিচিত মাছ ব্যবসায়ীদেরও ফোন দিলাম। সবাইকে জানালাম, জাহাঙ্গীর বাহিনীর সাগরে নামবে। আপনারা সতর্ক থাকবেন। ওদিকের বাজারে বাজারে মাইকিং হলো। জেলেরা সতর্ক হয়ে গেলো। গোন শুরু হলেও জেলেরা নামেনি সাগরে।
গোন শুরু হতেই জলদস্যু দলটি সাগরে নামলো। একদিন আর এক রাত মিলিয়ে একটি মাছ ধরার ট্রলারও চোখে পড়লো না। খালি হাতে ফিরতে হলো। সুন্দরবনে ফিরে খোঁজ খবর নিয়ে তারা জানতে পারলো কেন জেলেরা সাগরে নামেনি। শুনেছি, জাহাঙ্গীর আমাকে দেখে নিবে বলে হম্বিতম্বি করেছে। ওই দলের সদস্য, তার ভাগনে বাছের আমাকে বললো, আমি যেন ইদানিং সুন্দরবনে না নামি।
মাথায় জিদ চেপে গেলো। সুন্দরবনে তাহলে যেতেই হবে। এক রকমের পাগলামি বলা যায়। পরদিনই সুন্দরবনে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। বেলায়েত সরদারকে আগে থেকেই বলা ছিলো। ফোন করে তাকে নিশ্চিত করলাম।
একদিন পর সুন্দরবনের উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। এবার কোনো দস্যুদলের সাথে দেখা করতে নয়, এবার আমরা ঘুরতে যাবো।
এক সপ্তাহের প্রস্তুতি নিলাম। ট্রলার ভরে বাজার নিলাম। চিলা বাজারে গিয়ে পুরো একটি বেলা কাটালাম। ইচ্ছা করেই জানান দিলাম যে আমি সুন্দরবনে যাচ্ছি। সোর্সদের বিভ্রান্ত করে নেমে পড়লাম সেই রাতে। রাতের ভাটায় ট্রলার ভাসালাম। ছুটলাম পশুর নদী ধরে দক্ষিণে।
মরা গোন, ঢালা বা মরা গোন চলছে। সুন্দরবনে জেলেরা নাই। তাই দস্যুরা একটু অবসর সময় কাটাচ্ছে। বড় নদীতে তাদের দেখা পাওয়া যাবে না। প্রতিটি দল জেলেদের অপহরণ করে বসে আছে। মুক্তিপণ আদায় নিয়ে চলছে দেন দরবার। অন্যদিকে বন বিভাগসহ প্রশাসনের লোকজনের মাঝেও এসময় ঢিলেঢালা ভাব থাকে। তাই এবারে সুন্দরবন ঢুকতে সমস্যা হলো না।
হাড়বাড়িয়া ফরেস্ট অফিস থেকে কেউ সিগন্যাল দিলো। তবে তাড়া দিলো না। আমরা ট্রলার ঘুরিয়ে ফরেস্ট অফিসের দিকে ফিরলাম। কাভাকাছি আসতেই আমাদের চলে যেতে বললেন বনরক্ষী। সম্ভবত আমাদের ট্রলারটি চিনতে পেরেছেন তিনি।
পশুরের পূর্ব পাশ দিয়ে নেমে যাচ্ছি। সরদার সুকানিতে দাঁড়ানো। মামুন ব্যস্ত রান্নাঘরে। দখিনা বাতাসের কারণে চুলা জ্বালাতে সমস্যা হচ্ছে। তাই বাতাসের দিকে একটি কাঁথা বেঁধে দিলো সে।
ট্রলারের ডেক-এ বসে চা খাচ্ছি। চায়ের সাথে একটু মুড়ি নিলাম। সরদার বললেন, ও ভাই, খিদা লাগছে বলবেন না? বলেই ট্রলারটি ঢুকিয়ে দিলেন ছোট একটি খালে। কিছুটা ভিতরে গিয়ে সুবিধাজনক একটি জায়গা খুঁজে বের করলাম। একটি কেওড়া গাছের সাথে বেঁধে রাখলাম ট্রলার। এখানে বাতাস কম।
রাত বাজে তিনটার মতো। কী খাবো এখন? সরদার বললেন, খিচুরি রান্না হবে। সাথে থাকবে মরিচ ভর্তা আর ডিম ভাজি। ঝটপট রান্নাঘর থেকে হাঁড়ি পাতিল বের করা হলো। মামুন এখন মহা ব্যস্ত। হাঁড়ি পাতিলগুলো খালের পানিতে ধুয়ে নিলো। তারপর ড্রামে করে আনা পানি নিলো। চাল ডাল মিশিয়ে ধুয়ে নিলো মিঠা পানি দিয়ে।
অনেক কাজ। পেঁয়াজ, মরিচ, আদা, রসুন কেটে নিলো। তারপর নোংড়া নিয়ে বসে পড়লেন সরদার। বাটার কাজটি করা হয় নোংড়া দিয়ে। মাটির তৈরি বাটির মতো পাত্রকে এদিকে নোংড়া বলে। কাঠের তৈরি হাতল দিয়ে বাটা হয় মসলা। সুন্দরবনে আসলে আমরা বাটা মসলা দিয়ে রান্না করি।
পরিকল্পনা ছিলো সবজি খিচুরি খাবো। ট্রলারের স্টোর রুম থেকে বাজারের ব্যাগ বের করতে বললাম। কিন্তু সেখানে এতো রকমের জিনিষপত্র যে কোথায় কী আছে খুঁজে পাওয়া গেলো না। তাই সামনে থাকা কয়েক পদের শাক ধুয়ে খিচুরিতে দিয়ে দিলেন সরদার। বললেন, আজকে আমরা খাবো শাক খিচুরি। বললাম, তাতে কোনো সমস্যা নাই। ডিম কি পাওয়া গেলো? বললেন, কালকের আগে এই স্টোর রুম থেকে কিছুই বের করা যাবে না। আজকে যা আছে তাই খেতে হবে।
সরদারের ট্রলারের স্টোর রুম বলতে সেই অর্থে কোনো ঘর না। রান্নাঘরের পাশে পাটাতন খুললে নিচে যে জায়গাটুকু আছে সেটিই স্টোর রুম। ট্রলারগুলোর নিচে অনেক জায়গা থাকে। আর সরদার তো নিজেই উনার ট্রলারের ডিজাইনার। বানিয়ে নিয়েছেন নিজের মতো করে।
শাক খিচুরি রান্না হলো। ডিম খুঁজে পেলাম না। হাতের কাছে শুকনা মরিচ ছিলো। সরিষার তেল দিয়ে সেগুলো কড়া করে ভাজা হলো। পেঁয়াজ, লবণ, তেল আর ভাজা মরিচ দিয়ে বানানো হলো ঝাল ভর্তা। ক্ষুধা পেটে গরম খিচুরির সাথে সেই ঝাল ভর্তার তুলনা হয় না।
ভরপেট খেয়ে আবার ট্রলার ছাড়লাম। ভাটা এখনও তিন ঘন্টা আছে। শেষ ভাটা পর্যন্ত একটানা চলবো। চার গাঙ পার হয়ে বিরতি নিবো। শিবসা আর পশুর নদী যেখানে একসাথে মিশেছে সেই জায়গাটিকে জেলেরা বলে চার গাঙ। জাহাজীরা বলেন আকরাম পয়েন্ট।
ট্রলার এবার আমি চালাচ্ছি। পূর্ব পাশের জঙ্গল থেকে একটু দূর দিয়ে চলবো আমরা। এদিকে বড় সুমন বাহিনী নামে একটি দস্যুদল আছে। তাদের সাথে পরিচয় হয়নি, দেখা হয়নি, কথাও হয়নি। তাই ঝুঁকি নিবো না। নদীর পশ্চিম পাশে যাবো না কারণ ওদিকটায় জাহাঙ্গীর বাহিনী থাকতে পারে।
চরাপূঁটিয়ার প্রথম খাল পার হলাম। তারপর প্রায় এক ঘন্টা পার হলো দ্বিতীয় খাল পার হতে। তার পর ছোট ছোট অনেকগুলো খাল পড়লো বাম পাশে। সামনে বয়া দেখা যাচ্ছে। ঘসিয়াঙ্গাড়ী খালের মুখ ওখানে।
বেলায়েত সরদার ঘুম দিবেন। মামুন এসে পাশে বসলো। সুকানি অর্থাৎ হালটি তার হাতে দিলাম। বললাম, জঙ্গলের কাছাকাছি যাবে না। গুলির রেঞ্জ এর দূর দিয়ে চালাও। বলেই সরদারের পাশে গিয়ে শুয়ে পড়লাম।