সুন্দরবনের বৈশেল জীবন | রূপান্তরের গল্প ২৫১ | Rupantorer Golpo 251 | দস্যুমুক্ত সুন্দরবন | সুন্দরবনের গল্প | জীবনে ফেরার গল্প | Jibone Ferar Golpo | Sundarbaner Goppo | Story of Sundarbans | মোহসীন উল হাকিম | Mohsin Ul Hakim
রূপান্তরের গল্প ২৫১ : বাঘের আক্রমণে সন্তান হারানো বাবাকে নিয়ে বের হয়েছি। উঠেছি তার নৌকায়। ট্রলার রেখে যাবো ছোট খালের ভিতর। ডিঙ্গি নৌকা বেয়ে আমরা যাবো বইশেলদের সাথে, বড়শি তুলতে।
ঘসিয়াঙ্গাড়ীর দোয়ার বড়শির খ্যাওন দেওয়া আছে, দাওন বড়শি। বড়শিগুলো একটু পর তুলবে বইশেলরা। এই বেলা তাদের সাথেই থাকবো।
ট্রলারের সহযাত্রীদের ট্রলারে থাকতে বলাম। সবাইকে সতর্ক থাকতে বললাম। বললাম, সুন্দরবনের এই অঞ্চলে কোনো রকম ঝুঁকি নেওয়া যাবে না। এক সহযাত্রী বললেন, এই খালে বাতাস নাই। বললাম, ট্রলার চালিয়ে চাত্রীর দোয়ার এসে দাঁড়াবেন। ওখানে বাতাস পাবেন। তবে গাছের আড়ালে থাকবেন। দূর থেকে যেন দেখা না যায়।
আবহাওয়া ভালো নয়। তাই এই বেলা ঘসিয়াঙ্গাড়ীতেই থাকবো। বইশেলদের মাছ ধরা দেখবো। কাঁকড়ার নৌকা পেলে তাদের সাথে কাঁকড়া ধরবো। পরের ভাটিতে নিজেরা ঝাঁকি জাল দিয়ে চিংড়ি মাছ আর পারশে মাছ ধরবো। তবে তার আগে এই বড়শির জেলেদের সাথে কাটাবো কয়েক ঘন্টা।
নৌকায় উঠেছি আমি আর বেলায়েত সরদার। সাথে নিয়েছি খাবার পানি ও শুকনা খাবার। বেশি দেরি হলে নৌকাতেই ভাত রান্না হবে, সেই প্রস্তুতিও রাখা আছে। কপালে থাকলে টাটকা মাছ দিয়ে ভাত খাবো। আসার সময় টর্চ লাইট আর ছাতা নিতে ভুলে গেছি। এই ভুল আমি প্রায়ই করি। সরদারের কাছে ছোট টর্চ আছে। সেটা দিয়ে কাজ চালাবো যদি সন্ধ্যা হয়।
নৌকার সামনে আর পিছনে বৈঠা নিয়ে বসেছে বাবা ও ছেলে। মাঝখানে বসেছি আমি আর সরদার। এই খালের নাম চাত্রী। কিনার ধরে দক্ষিণে এগুচ্ছি। ঘসিয়াঙ্গাড়ী খালের সাথে চাত্রীর যে মোহনা আছে সেই দোয়ায় দাওন বড়শি ফেলা আছে। আমরা যাচ্ছি সেখানে।
বড়শির জেলেরা শরণখোলার মানুষ। কথা বলেন বরিশালের ভাষায়। তাদের সাথে তাল মিলিয়ে বেলায়েত সরদারও কথা বলছেন একই ভাষায়। শুনতে বেশ লাগে।
গত কয়েক ঘন্টায় জেলেদের সাথে বেশ ভাব জমেছে। এবার মন খুলে কথা বলছে তারা। বলতে বলতে নৌকার খোলে রাখা আগের খ্যাওনের মাছগুলো দেখালো। বেশ বড় একটি পাঙ্গাস মাছ ধরা পড়েছে। আছে বেশ কয়েকটি বড় বড় কাউইন মাছ। আর আছে দুটি বড় বড় ইলশে তাইড়েল। দশ কেজির মতো ঘাগড়া টেংড়া আছে, তার সাথে আছে আরও নানা জাতের মাছ।
বললাম বরফ আনেননি? মাছগুলো তো নষ্ট হবে! বড়শির জেলে বললেন, মহাজনের ভরের নৌকা আসার কথা। কিন্তু আপনাদের দেখে মনে হয় আর কাছে আসেনি। এই বেলায় মাছগুলো বরফে রাখতে না পারলে নষ্ট হয়ে যাবে। বললাম, আপনারা তো নৌকায় বরফ রাখতে পারেন। জেলে ভাই বললেন, মহাজনে করফ রাখতে দেয় না। সরদার বললেন, বরফ রাখতে দিলে তো জেলেরা স্বাধীন হয়ে যাবে। জেলেদের টান দিয়ে রাখার জন্য তাদের নৌকায় বরফ দেয় না। কেবিন করা থাকে ভরের নৌকায়।
জেলে ভাই বললো, নিজেরা মাছ সুরক্ষিত রাখতে পারলে আমরা যদি মাছগুলো সরিয়ে ফেলি? যদি মহাজনকে না দিয়ে নিজেদের মতো করে বিক্রি করি?
ভরের নৌকাকে অনেকে ফেরির নৌকা বলে। সাধারণত এক মহাজনের কয়েকজন করে জেলে থাকে। প্রতি ভাটায় মাছ ধরে তারা নির্দিষ্ট জায়গায় অপেক্ষা করে। মাছ বেছে রাখে। ভরের নৌকা ঘুরে ঘুরে জেলেদের কাছ থেকে মাছ মেপে নেয়। কোনো জায়গায় এই নৌকা হয় হাতে বাওয়া টাবুরে নৌকা। কোনো মহাজন ব্যবহার করে ইঞ্জিন চালিত ট্রলার।
বললাম, তাহলে মহাজনেই সব নিয়ন্ত্রণ করে? সায় দিলো ওই জেলে। বললো, তিন হাজার টাকা দাদন নিলাম এক মহাজনের কাছ থেকে। এই মাছ তো তাদেরই দিতে হবে। জানতে চাইলাম, দাম কেমন? বললো, আমার মহাজন মোটামুটি ভালো দাম দেয়। বললাম, এই বড় পাঙ্গাস মাছের ওজন তো কমপক্ষে ১২ কেজি হবে। এর দাম কতো দিবে? বললো, কাঁচা কেজিতে মাপ হবে। মানে এই পাঙ্গাস পাল্লায় তুললে যদি ১২ কেজি হয়, তাহলে মহাজনে ওজন ধরবে ১০ কেজি। প্রতি কেজির দাম হবে আশি টাকা।
এই পাঙ্গাসের কেজি আশি টাকা? ওরা বললো, ইলশে তাইড়েল মাছগুলোর দাম একটু বেশি দিবে। কাউইন মাছগুলোর কোয়ালিটি ভালো থাকবে না। এগুলোর দাম কম হবে।
জানতে চাইলাম, ঘাগড়া টেংড়ার কেজি কতো? বইশেল বললেন, ওই মাছের কোনো দাম নাই। খুব বেশি হলে কুড়ি বা পঁচিশ টাকা কেজি ধরবে। এসব শুনলে মাথা আর কাজ করে না। শুরুতে বাঘে খাওয়ার গল্প, তারপর এই বঞ্চনার গল্প, কষ্টের উপর কষ্ট, ঠিক নিতে পারছি না।
আধা ঘন্টার মধ্যে পৌঁছে গেছি ঘসিয়াঙ্গাড়ীর দোয়ায়। পূ্র্ব সুন্দরবনের মাঝামাঝি একটি জায়গায়। তিন খালের মোহনা হলেও দেখলে মনে হয় বিশাল এক জলা। পশ্চিমে পশুর নদী থেকে বড় খালটি চলে গেছে পূর্ব-দক্ষিণে। উত্তর থেকে মাঝারি খাল ‘চাত্রী’ এসে মিশেছে ঘসিয়াঙ্গাড়ীর দোয়ায়। জায়গাটি রীতিমতো বন্য। সুন্দরবনের সবগুলো অনুসঙ্গ এখানে স্পষ্ট।
চরাপুঁটিয়ার দুই নম্বর খালের দক্ষিণে পশুর নদী থেকে শুরু ঘসিয়াঙ্গাড়ী খাল। তারপর আঁকাবাঁকা পথ ধরে খালটি গেছে পূর্ব দিকে। কয়েকটি বাঁক নিয়ে এরপর নেমেছে দক্ষিণে। মিশেছে সেলা নদীতে।
ওই মোহনায় বিশাল এক চর আছে, যার নাম টিয়ার চর। ওখান থেকে পশ্চিমে চলে গেছে কোকিলমনি খাল। তিনকোণা দ্বীপের পাশ দিয়ে আবার মিশেছে পশুর নদীতে। মধ্য সুন্দরবনের এই বড় খালগুলো অভয়াশ্রম। তাই এই অঞ্চলে প্রকাশ্যে কেউ চলাফেরা করে না। আমাদেরও আসার নিয়ম নাই। তবে বনদস্যুদের নিয়ে কাজ করতে গিয়ে আসা হয়, আসতে হয়।
সুন্দরবনের জলদস্যু-বনদস্যু, শিকারী, গাছ চোর, বিষদস্যু অথবা সাধারণ জেলে, সবাই এই অঞ্চলে আসে, থাকে। তবে বড় খাল দিয়ে চললে তাদের কাউকেই দেখা যায় না। দিনের আলোতে তারা সচরাচর বড় খালে ওঠে না। চলাফেরা করে ভিতরের ছোট ছোট খাল আর ভাড়ানী ধরে।
বনদস্যুদের নিয়ে কাজ করতে গিয়ে আমারও কমবেশি এই চোরা পথগুলো চেনা হয়েছে। চোর-ডাকাতদের পিছু নিতে গিয়ে তাদের পথগুলো ধরে চলি, গহীন সুন্দরবনের এই সরু খাল ধরে ট্রলার নিয়ে চলাফেরা করা সহজ না।
জোয়ার-ভাটার সঙ্গে হিসাব মিলিয়ে চলতে হয় সুনির্দিষ্ট কিছু খাল ধরে। একটু ভুল হলেই বিপদে পড়তে হয়। আর কিছু না হলেও সময় অনুযায়ী কোনো কাজ করা যায় না তখন। দস্যুদের সাথে দেখা করতে গেলে সঠিক সময়ে সঠিক খালে উপস্থিত থাকতে হয়।
সময় মতো পৌঁছানো বিরাট চ্যালেঞ্জ। না পারলে পুরো সফর ভেস্তে যাবে। কারণ নেটওয়ার্কবিহীন এই অঞ্চলে সময় মতো আমাদের না পেলে দস্যুরা অপেক্ষা করবে না, আস্থা হারাবে।
এবারের সফর অবশ্য এসব নিয়ে দুশ্চিন্তা করার সফর না। এবার এসেছি একটু বিশ্রাম নিতে, মাথা থেকে চাপ নামাতে। যদিও বাঘের আক্রমণে সন্তান হারা এক বাবার কষ্টের কথাগুলো বিমর্ষ করেছে। আসলে অনাদিকাল থেকে এটাই বন উপকূলের মানুষের সামনে বাস্তবতা।
পেটের টানে মৃত্যুঝুঁকি নিয়ে জঙ্গল করা এই মানুষদের খুব বেশি কিছু করারও নাই। বিকল্প কর্মসংস্থানের কথা আমরা বলি। কিন্তু মাঠের বাস্তবতা ওই কথার মধ্যেই সীমাবদ্ধ। সুন্দরবনের মানুষেরা জঙ্গলকেই তাদের জীবিকার উৎস হিসাবে জানে।
পড়াশোনা না করা বিশাল জনগোষ্ঠীকে বিকল্প কাজের সুযোগ করে দেওয়াও খুব সহজ না। আবার তারা যদি কাজের জন্য শহরে পাড়ি জমায় তাহলে শহরগুলোতেও চাপ বাড়বে। সব মিলিয়ে জটিল সমীকরণটি মেলানো সহজ কাজ না।
সুন্দরবনে মাছ-কাঁকড়া ধরে যে পরিবারগুলো চলে তাদের জীবন অতি জটিল অর্থনৈতিক চক্রের মধ্যে ফেঁসে আছে। দুই-তিন হাজার টাকাও তাদের পূঁজিতে থাকে না। সূদে নেওয়া ঋণের জের আছে, আছে এনজিও’র ঋণের কিস্তির চাপ। পুঁজি গড়া যায় না কিছুতেই, গড়তে দেওয়াও হয় না।
জঙ্গলের কিনারে চলে আসলাম। এখান থেকে ফেলা হয়েছে বড়শি। গাছের সাথে বাঁধা এক প্রান্ত। আর অন্যপাশ এখান থেকে অন্তত আধা কিলোমিটার দূরে। প্রায় তিনশ বড়শি আছে এই দাওনে।
আকাশের অবস্থা ভালো না। পানির চাপও একটু বেশি। তার মধ্যে গোন শুরু হচ্ছে আজ। তাই স্রোতের চাপও বেশি। নৌকা বেয়ে বড়শি তোলা বেশ কঠিন কাজ। অবশ্য আমরা থাকায় আজকে কাজটি একটু সহজ। সামনে পিছনে বৈঠা হাতে নৌকা নিয়ন্ত্রণ করছি আমি ও সরদার। উনারা শুধু বড়শি তুলছেন।
মাছ পাইনি এখনও। একটার পর একটি বড়শি উঠছে। প্রতিটি বড়শি এটুকু সময়ের মধ্যে সুন্দর করে গুছিয়ে রাখছেন উনারা। হাত দুটো কাজ করছে মেশিনের মতো। পুরোটা সময় পানির দিকে নজর দিয়ে রেখেছি। কখন মাছ উঠবে! দারুণ লাগে এসব দেখতে। আরেকটু এগুতেই ওরা বললো, মাছ আছে। মানে পরের বড়শিতে মাছ!
হাতে জালতি নিয়ে ঝুঁকে পড়লো বইশেল। টুপ করে মাছটি তুলে ফেললো। বিশাল এক দাতিনা মাছ। ওজন প্রায় কেজি খানেক হবে। নৌকার খোলে মাছ রেখে এগুতে থাকলাম। এবার একটার পর একটা মাছ উঠছে। শেষ মাথায় যেতে যেতে ধরা পড়লো কয়েকটি ইলশে তাইড়েল মাছ। একটা কাউইন মাছ উঠলো প্রায় পাঁচ কেজি ওজনের। ঘাগড়া টেংড়া, ভোলা, তুলার ডান্ডি আর কেজি সাইজের পাঙ্গাস মাছ উঠলো প্রায় আধা মণের মতো। সব মিলিয়ে মণ খানেক মাছ উঠলো বড়শিতে।
বড়শির জেলেকে বললাম, এই মাছগুলো সরাসরি আড়তে নিতে পারেন না? বললেন, আমি আড়তে নিলে মাছ ধরবে কে? এখান থেকে মংলা বা শরণখোলা যেতে আমার প্রায় দুই জোয়ার লাগে। দুই জোয়ার মানে পুরো একদিন। বললাম, তাহলে নিজেরা বরফ আনবেন। মাছগুলো বড়ফের বাক্সে রাখবেন। মাছ ভরলে নিজেরা গিয়ে বিক্রি করবেন।
ওরা বললো, পুঁজি থাকলে চেষ্টা করতাম। কিন্তু ধার দেনা শোধ করেই কূল পাই না। তাই দাদন নেওয়াই লাগে। এছাড়া এই অঞ্চল তো অভয়াশ্রম। ঢোকা নিষেধ। একা একা আসতে গেলে ফরেস্টও ধরবে, ডাকাতেও ছাড় দিবে না। এগুলো ম্যানেজ করে মহাজন। সুন্দরবনের বৈধ অঞ্চলে মাছ কম, জেলে বেশি। ওদিকে গেলে চালানও ওঠে না।
ভালো মাছ হলো। কিন্তু এই অবস্থায় বরফে না দিলে মান নষ্ট হয়ে যাবে। মাছ একটু বাসী হলে দামও পড়ে যাবে। সরদার বললেন, ট্রলারে আমাদের বরফ আছে। ভরের নৌকা না আসলে তার ভিতরে রাখা যাবে।
বড়শি তুলে ফিরতি পথ ধরলাম। ট্রলারে যাবো। গোসল করতে হবে। একটু বিশ্রাম নিতে হবে। আকাশের যা অবস্থা তাতে আজকে বড় নদীতে বের হতে পারবো বলে মনে হয় না।
ছবি: সাম্প্রতিক ছবি। সুন্দরবনের বড়শির জেলে।