রূপান্তরের গল্প ২৫৩ | Rupantorer Golpo 253

বাঘের হুংকার : চরে বিশাল কুমির | রূপান্তরের গল্প ২৫৩

বাঘের হুংকার : চরে বিশাল কুমির | রূপান্তরের গল্প ২৫৩ | Rupantorer Golpo 253 | দস্যুমুক্ত সুন্দরবন | সুন্দরবনের গল্প | জীবনে ফেরার গল্প | Jibone Ferar Golpo | Sundarbaner Goppo | Story of Sundarbans | মোহসীন উল হাকিম | Mohsin Ul Hakim


রূপান্তরের গল্প ২৫৩ : ট্রলারের রান্নাঘর মানে বিশেষ কিছু না। ছোট্ট একটি কুঠুরি। পিছনের দিকে করা এই কুঠুরিতে আছে গ্যাসের চুলা। এর ভিতরেই সাজানো থাকে রান্নার সব সরঞ্জাম। হাঁড়ি-পাতিল থেকে শুরু করে সবকিছুই এর ভিতরে রাখা হয়। রান্নাঘরের সামনের দিকে কাঠের দরজা থাকে। ট্রলার চলমান থাকলে বন্ধ থাকে রান্নাঘর।

আরেকটি জায়গা আছে। সেটি হলো ট্রলারের স্টোর রুম। রান্নাঘরের সামনে পাটাতনের নিচে সেই স্টোর। এর ভিতরে থাকে চাল-ডালসহ রান্নার অন্য উপকরণ। বড় হাঁড়ি, বড় কড়াই, বাড়তি বাসন থাকে এর ভিতরে।

ট্রলারে তুলনামূলক জায়গা বেশি। কিন্তু নৌকায় এতো জায়গা কোথায়? অবশ্য নৌকায় রান্নাঘর বলতে আলাদা কোনো জায়গা নাই। একটি টিনের চুলা থাকে। রান্না হয় লাকড়ি দিয়ে। হাঁড়ি-পাতিলসহ বাকী সরঞ্জাম থাকে নৌকার খোলের ভিতরে।

জেলেরা চাল-ডাল রাখে বাজারের ব্যাগের ভিতর। সেই ব্যাগ আবার রাখা থাকে বড় পলিথিনের বস্তার মধ্যে। নৌকায় দুইজনের কাঁথা বালিশ থাকে। সেগুলোও রাখা হয় পলিথিনের বস্তার ভিতর। বৃষ্টি, কুয়াশা বা খালের পানিতে যেন ভিজে না যায় সেজন্য এই জঙ্গলে পলিথিনের ব্যবহার অনেক বেশি।

মোবাইল ফোন, জরুরি কাগজ-পত্র রাখা হয় প্লাস্টিকের কৌটায়। মসলা-পাতি থাকে কৌটার ভিতর। ছোট্ট একটি নৌকায় জীবন ধারনের সবকিছুই রাখার ব্যবস্থা কেমন করে জানি হয়ে যায়।

আজও আমাদের রান্না হবে বাটা মসলায়। সেই প্রস্তুতি চলছে। রান্না শেষ হতে অন্তত এক ঘন্টা লাগবে। ভাবলাম রান্না হোক। আমি মাছ ধরতে যাই।

নদীতে কেবল জোয়ার লেগেছে। মনে হয় আরেকটু সময় বড়শি বাওয়া যাবে। সেজন্য ট্রলার ছেড়ে নৌকায় উঠবো। এমন সময় সামনের পাশের একটি চরের দিকে দৃষ্টি গেলো। মোটামুটি আমার দ্বিগুন আকৃতির একটি কুমির সেখানে উঠে বসে আছে। কী ভয়ঙ্কর ব্যাপার! ভাবছি আর নৌকায় নামবো না। আবার মনে হলো, কপালে থাকলে বিপদ আসবেই।

নৌকায় বইশেল ভাইয়েরা বসা। কুমির দেখে ওরা বললো, ও এখন বিশ্রাম নিচ্ছে। ঝামেলা করবে না। আপনি নৌকায় আসেন। ভাটা শেষে জোয়ার হয়েছে। স্রোত ঘুরে গেছে উল্টো দিকে। সেই সাথে ঘুরে গেছে ট্রলার।

নৌকায় এসে বসলাম। একটু সতর্ক থাকতে হবে। তাই নৌকার মাঝামাঝি জায়গায় পা গুটিয়ে বসলাম। বড়শি ফেললাম। সন্ধ্যা নেমেছে, প্রায় অন্ধকার হয়ে এসেছে। তবে এখনও চারপাশের জঙ্গল একটু আধটু দেখা যায়।

হাতে বড়শি নিয়ে মাছের টানের অপেক্ষা করছি। গল্প করছি পাশে বসা জেলেদের সাথে। দেখতে দেখতে সূতায় টান পড়লো। বেশ শক্ত টান! বড় মাছ মনে হচ্ছে। টেনে তুলতে গিয়ে সূতা লেগে হাতের তালু কেটে গেলো। তবে সেদিকে তাকানোর সসয় এখন না। আগে মাছ না কী আছে সেটা তুলে নেই।

বড়শি টানা নিয়ে আমাদের হৈ-হুল্লোড় দেখে ট্রলারের কিনারে চলে আসলেন সরদার। বললাম, আপনার আসা লাগবে না ভাই। বড় মাছ তুলতে বলছেন না? এইবার দেখেন!

যতো বড়ই হোক সুন্দরবনে বড়শিতে মাছ ধরলে এক টানে উঠাতে হয়। কারণ পানির নিচে অনেক গাছপালা পড়ে থাকে, শিকড় থাকে, গর্ত থাকে সেখানে ঢুকে পড়লে আর সেই মাছ টেনে তোলা সম্ভব না। এটা আমার জানা। তাই হাত কেটে গেলেও বড়শিতে ঢিল দেইনি।

দেখতে দেখতে উঠে আসলো মাছ। বিশাল বড় মাথাটা ভাসতেই সরদার চিৎকার করে উঠলেন। কাউইন মাছ ভাই! বিরাট বড় কাউইন মাগুর। এবার পাশে বসা কিশোর হাতে জালতি নিয়ে এগিয়ে এলো। খপ করে তাতে ভরে ফেললো মাছটি।

সবাই হাত তালি দিলো। আমরা তো মহা খুশি। বেলায়েত সরদারকে বললাম, এই যে বড় মাছ ধরলাম। রাতের খাবার নিয়ে আর নয়ছয় করতে পারবেন না। মাছটি জিঁইয়ে রাখলাম। একটি দড়িতে বেঁধে খালের মধ্যে ছেড়ে রাখা হলো। যখন খাবো তখন টাটকা টাটকা রান্না হবে।

মাছ ধরার লোভ সামলানো যায় না। তাই আবারও বড়শি ফেলে বসে রইলাম। এর মধ্যে সরদার এসে পাশে বসেছেন। বললাম, আমার হাতটা ধুতে হবে। অনেকটা কেটেছে। অ্যান্ডিসেপ্টিক জাতীয় কিছু দিতে হবে। ট্রলার থেকে একটু ডিজেল এনে ক্ষতের উপর লাগিয়ে দিলো মামুন। বললো, ওতেই কাজ হয়ে যাবে।

সরদারের হাতে বড়শি দিয়ে নৌকা ছেড়ে ট্রলারে উঠলাম। এর মধ্যে আবার বড়শিতে টান পড়লো। দেখি, বেলায়েত সরদার বেশ কসরৎ করছেন। মিনিট খানেকের মধ্যে উঠে আসলো কিছু একটা।

ভাবলাম আবার বোধ হয় কাউইন মাছই উঠলো! এরপর উঠে আসলো বিরাট বড় একটি কুঁচিয়া। সরদার তো লজ্জায় শেষ! কারণ বড়শি ফেললেই তার হাতে কুঁচিয়া ওঠে। আমি মজা করে বলি কুঁইচ্চা রাশি। টেনে তোলা হলো সেটি। সরদার বলে, ও ভাই, এটা কুঁইচ্চা না, সাতহাতি! দেখলাম বিশাল লম্বা মাছটি। দৈর্ঘ্যে নাকী সাত হাত হয় বলেই এর নাম সাতহাতি। এই অঞ্চলে কেউ খায়, কেউ খায় না। বললাম, আমরা তো খাই না ওটা, তাড়াতাড়ি ছেড়ে দেন।

কোনো রকমে বড়শি ছাড়িয়ে ট্রলারে এসে বসলেন সরদার। আবার বসলাম আমি। মাছের নেশা বলে কথা! চুপচাপ বসে আছি। চারপাশে কোন শব্দ নাই। শুধু পানি বয়ে যাওয়ার শব্দ।

ওদিকে সরদারের রান্নাঘরে খুটখাট শব্দ চলছে, কথাবার্তা চলছে নিচু স্বরে। হাতে বড়শির সূতা ধরে আছি ঠিক। কিন্তু দৃষ্টি ওই কুমিরের দিকে। ভাবছি, সে পানিতে নামলেই নৌকার সবাইকে নিয়ে ট্রলারে উঠে যাবো। ঝিঁঝি পোকা ডাকছে। বাকী সব নিরব!

হুম… হুমমম…. দুই দফা ডেকে উঠলো বাঘ। ভিতরে আর কিছু নাই। এমনিতে কুমিরের আতঙ্কে আছি। তার মধ্যে আরা ডাকছে বাঘ। ডাকছে খুব কাছে থেকে। দূরত্ব আধা কিলোমিটারের বেশি হবে না। কান খাড়া করে বুঝার চেষ্টা করছি। এর মধ্যে তৃতীয় বার ডাক দিয়ে উঠলো মামা। হুমমমমম শব্দটি মনে হলো মাটি ফুঁড়ে বের হলো। পিলে চমকানো বলতে যা বুঝায় ঠিক তাই হলো।

পর পর তিন বার ডাকলো সুন্দরবনের বাঘ। বুকের ভিতরটা কেঁপে উঠলো। দ্রুত বড়শি গুটিয়ে ট্রলারে উঠে পড়লাম ট্রলারে। আমার ভয় পাওয়া দেখে হাসতে হাসতে শেষ বেলায়েত সরদার। রান্নাঘর থেকে উঁকি দিয়ে বললেন, ও ভাই, ভয় পাইছেন? বললাম, বাঘের ডাক শুনলে ভিতরে কিছু থাকে? ভয় পাবো না?

সরদার বললেন, বাঘে ডাকলো আধা কিলোমিটার দূরে। তাতেই ভয় পেলেন? সামনে পড়লে করবেন কী? বললাম, এই জঙ্গলে যখন থেকে আসা শুরু করেছি তখন থেকেই আমার টার্গেট, বাঘের সামনে পড়া যাবে না। সুন্দরবনের ভিতরে আমার বাঘ দেখার দরকার নাই। বরং আমি বাঘ এড়িয়ে চলি। খুব দেখতে ইচ্ছা করলে চিড়িয়াখানায় গিয়ে দেখবো। সরদার বললেন, হাজার হাজার মানুষ সুন্দরবনে আসে বাঘ দেখতে। বললাম, আমার অতো সাহস নাই ভাই। আমি যে কাজে এসেছি সেই কাজটিই মন দিয়ে করতে চাই।

হাত বড়শি নিয়ে তখনও নৌকার গলুই-এ বসা মামুন। পাশে দাঁড়ানো বড়শির জেলে আর তার ছোট ছেলেটা। লোকটির চোখ মনে হলো জ্বলছে। ছটফট করছে মানুষটি।

মাত্র কয়দিন আগে এখানেই তার বড় ছেলেটাকে বাঘে ধরেছিলো। কিছু বললাম না। কী বলবো বুঝতে পারছি না। বাঘের ডাকে প্রথমে ভয় পেয়েছি। তারপর বেশ মজা লাগলো। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সন্তান হারা বাবার দিকে তাকিয়ে পুরো পরিবেশটি শোকের পরিবেশে পরিণত হলো।

প্রসঙ্গ পাল্টে ফেললাম। মামুনকে বললাম, মাছ ধরা হইছে, এবার ওঠো। ঝাল করে মুড়ি মাখাও

ছবি: রূপের গাঙ, সুন্দরবন

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top