রূপান্তরের গল্প ২৫৪ | Rupantorer Golpo 254

মাছের সাথে ডিম! বেলায়েত সরদারের আজব রান্না | রূপান্তরের গল্প ২৫৪

মাছের সাথে ডিম! বেলায়েত সরদারের আজব রান্না | রূপান্তরের গল্প ২৫৪ | Rupantorer Golpo 254 | দস্যুমুক্ত সুন্দরবন | সুন্দরবনের গল্প | জীবনে ফেরার গল্প | Jibone Ferar Golpo | Sundarbaner Goppo | Story of Sundarbans | মোহসীন উল হাকিম | Mohsin Ul Hakim


রূপান্তরের গল্প ২৫৪ : পূর্ণিমার গোন চলছে। মানে পূর্ণিমার ভরা কাটাল। আকাশে চাঁদ আছে। তবে মেঘে ঢাকা। চাঁদের হিসাব করে গত রাতে অনেক জেলে নেমেছে এই বনে। বিভিন্ন ধরনের জাল নিয়ে তারা ঢুকে পড়ে সুন্দরবনে। ছড়িয়ে পড়ে খাল নদীতে। এত সপ্তাহের মতো টানা থাকে বনের ভিতরে। এই কয়দিন নৌকাই সুন্দরবনের মানুষদের কাছে ঘর-বাড়ি।

আজ দিনের ভাটায় অনেকেই নেমে এসেছে। সামনের জোয়ারে হয়তো অনেক নৌকা দেখা যাবে। খালের ভিতরে জোয়ারের পানি উঠলে হয়তো অনেকের সাথে দেখা হয়ে যাবে। সুন্দরবনে এসে জেলে ভাইদের না দেখলে কেমন জানি খালি খালি লাগে।

অনেকেই বলেন, সুন্দরবনে জেলেদের প্রবেশ বন্ধ করা উচিৎ। কিন্তু আমার কাছে মনে হয় এই জেলেরা সুন্দরবনের বাস্তুসংস্থান বা ইকোসিস্টেমের অংশ। অসংখ্য মানুষের পেট চলে। আবার সম্পদ ফেলে রেখে কী লাভ? সমস্যা হলো, অতিরিক্ত চাপ পড়ে যাচ্ছে সুন্দরবনে। শুধু মাছ শিকার করলে সমস্যা ছিলো না। সুন্দরবনে চলে আরও কয়েক রকমের অত্যাচার।

বিষ দিয়ে মাছ শিকার এখন সুন্দরবনে বহুল প্রচলিত। বন বিভাগ এবিষয়ে বেশ সচেতন। বিশেষ করে পূর্ব সুন্দরবনের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মাহমুদুল হাসান ভাইকে দেখি সারাক্ষণই দৌড়াচ্ছেন। বিষের বিরুদ্ধে বেশ সোচ্চার।

পশ্চিম সুন্দরবনের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা বশিরুল-আল মামুনও বেশ কঠোর। সুন্দরবনের সিএফ আমীর হোসাইন চৌধুরীও করিৎকর্মা মানুষ। বিষসহ নানা অপকর্মের বিরুদ্ধে তাঁদের অবস্থান পরিস্কার। কিন্তু মাঠ পর্যায়ে সেই একাগ্রতা দেখি না। অবশ্য জঙ্গল ভর্তি বনদস্যুদের দাপটে তাদের খুব বেশি কিছু করারও থাকে না।

এই যে আমরা যে অঞ্চলে আছি, পুরোটাই অভয়াশ্রম। এখানে মাছ ধরতে বন অফিসে বাড়তি টাকা দিতে হয়। তবে কেউ যদি ঘুষ না নিয়ে এই জেলেদের আসতে না দেয় তবে বনদস্যুরা গিয়ে চড়াও হবে বনরক্ষীদের উপর। সৎ বনরক্ষীদের জন্য বিষয়টি রীতিমতো উভয় সংকট।

চাত্রী খালে আমরা। জায়গাটি একটু ভিতরের দিকে। ট্রলারে সবাই গোল হয়ে বসেছি। মুড়ি মাখানো হয়েছে পেঁয়াজ, মরিচ, আদা আর সরিষার তেল দিয়ে। সাথে আছে গরম গরম দুধ চা। আশেপাশে ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক ছাড়া কোনো শব্দ নাই। বাতাস একদম পড়ে গেছে। হরিণের ডাক শুনছি না বিকাল থেকে। সম্ভবত আশেপাশে বাঘ আছে বলে বন্যপ্রাণিরা সব দূরে সরে গেছে। শুধু কুকু পাখি ডাকছে নিয়মিত বিরতি দিয়ে।

বাঘের ডাক শোনার পর থেকে বুকটা দুরুদুরু করছে। এসময় দূরে একটু আলো দেখলাম। সম্ভবত জেলে নৌকা। আমাদের দেখেই আলো নিভিয়ে দিয়েছে তারা। তবে ওদিক থেকে কথাবার্তার শব্দ আসছে।

আমাদের সাথে থাকা জেলে ভাই বোধ হয় চিনতে পেরেছেন ওদের। হাঁক দিলেন। মানে চিৎকার করে জানান দিলেন যে তিনি এখানে আছেন। প্রথমে একটু ইতস্তত করছিলো ওই নৌকার জেলেরা। ট্রলার দেখে ভেবেছে বনদস্যু অথবা বন বিভাগের ট্রলার। অভয় দিলাম সবাই মিলে। তারপর একটি নৌকা এগিয়ে এলো। এটিও বড়শির নৌকা।

ট্রলারের সাথে ভিড়লো নৌকাটি। ওই জেলের নাম রবীন্দ্র। বাড়ি সাতক্ষীরার ওদিকে। আমার অনেক পুরনো পরিচিত। মধ্য সুন্দরবনে অনেক বার দেখা হয়েছে। আমাকে দেখে বিরাট একটা হাসি দিলো। অন্ধকারে দাঁতগুলো স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। বললাম, এতো দূরে আসছো তোমরা? রবীন্দ্র বললো, মাছ যেখানে আমরাও সেখানে। কথা বলতে গিয়ে জানলাম, এরা সবাই এক মহাজনের জেলে।

রবীন্দ্র ফিরে গেলো। কয়েক মিনিটের মধ্যে ফিরে আসলো আরও কয়েকটি নৌকা নিয়ে। এদের কেউ বড়শির জেলে, কেউ মাছ ধরে জাল দিয়ে। তাদের সাথে আরেকটি টাবুরে নৌকা আছে। একটু বড়সড়। ভরের নৌকা। এদিকের জেলেরা বলে ফেরির নৌকা। ঘুরে ঘুরে জেলেদের কাছ থেকে মাছ সংগ্রহ করে এই নৌকা।

ওরা বেশ ভয় পেয়েছিলো। অপরিচিত হলে কাছেই আসতো না। সবকিছু জেনে এখানে এসেছে ঠিকই। কিন্তু ফেরির নৌকার লোকজন নিজেদের একটু আড়াল করে রেখেছে। সামনে আসছে না। ভালো করে তাকিয়ে দেখি এরাও আমার পরিচিত লোকজন। অভয়াশ্রম বলে আড়ষ্ঠ তারা। বললাম, ভয়ের কিছু নাই। আপনারা ট্রলারে আসেন। মুড়ি আর চা খেয়ে আপনাদের মাছগুলো তুলে নেন।

সামনে এগিয়ে গেলো মামুন। পাটাতনের কাঠগুলো তুললো। খুললো বরফের কেবিন। বইশেলের মাছগুলো ওরা মেপে নিচ্ছে। একটু দূরে বসে মাছ মাপা দেখছি। দাড়িপাল্লা আর বাটখারাগুলো মনে হয় বহু বছর আগের। প্রতি পাল্লায় ওজনে ঠকানো হচ্ছে জেলেদের। তার মধ্যে আবার কাঁচা ওজন ও পাকা ওজনের হেরফের আছে। নৌকায় বসে এসব তদারকি করছে মুহুরি সাহেব। বড় মহাজনরা সচরাচর নিজেরা সুন্দরবনে আসে না। এই মুহুরিই তাদের প্রতিনিধি।

মাপ চলছে। বড় মাছগুলো হাতে নিয়ে মুহুরি বলছে, সব নরম হয়ে গেছে। আড়তে এর কোনো দাম হবে না। জেলে বললো, ওই মাছ তো কেবল উঠালাম। বিকাল বেলা ধরে এনে বরফে দিলাম। নরম হলো কী করে? বলেই এগিয়ে গেলো। মাছটি নিয়ে টিপ দিয়ে দেখিয়ে দিলো যে মাছ টাটকা আছে। কানের ভিতর, মুখের ভিতরে তখনও কাঁচা রক্ত।

মুহুরি মাছের দর কমানোর অপচেষ্টা করছে। আমি বললাম, ওজনে তো মেরে দিচ্ছেন এমনিতেই। দামও দিবেন ইচ্ছা মতো। আবার টাটকা মাছকে নরম মাছ বানানোর চেষ্টা করছেন কেন?

পাশে ভিড়ানো ফেরির নৌকায় বসা মুহুরি। আমার প্রশ্নের উত্তর দিলো না। জানতে চাইলাম মাছের দর সম্পর্কে। এড়িয়ে গেলেন। বললেন, মাছের দাম সম্পর্কে মহাজন জানে। বললাম, মহাজন কোথায় থাকেন? উত্তর নাই।

মাছ তোলা হলো। এবার ফেরির নৌকাটি ফিরে যাবে। কোথায় যাবে? এতো তাড়া কীসের? জানতে পারলাম, ওরা যাবে কোকিলমনি খালে। ওখানে কোথাও রাখা আছে বড় ট্রলার। মাছগুলো সেই ট্রলারে তোলা হবে। কালকেই ট্রলার চলে যাবে মংলা বা খুলনার মাছের আড়তে। গল্পে গল্পে জানলাম, অভয়াশ্রম হলেও এই অঞ্চলের কোনো খাল খালি নাই। প্রতিটি খালে জেলেরা আছে। মাছ ধরা চলে সারা বছর। নিষিদ্ধ জায়গা বা নিষিদ্ধ সময় এখানে মানা হয় না।

এই অঞ্চলের যে দস্যুদলটি আছে তার নাম- সুমন বাহিনী। বড় সুমন নামে পরিচিত এই দস্যুদল। যার প্রধান জামাল শরীফ। শুনেছি বেশ বড়সড় দস্যুবাহিনী এটি। পশুর নদীর পূর্ব দিকে আমরা যেখানে আছি তার আশেপাশেই থাকে। অবশ্য স্থায়ী কোনো জায়গা নাই ওদের। নৌকা বা ট্রলারে ভাসমান অবস্থায় থাকে। জায়গা বদলায় প্রতি রাতে। আমি অপেক্ষায় আছি যদি যাওয়া আসার পথে দস্যুদের সাথে দেখা হয় তবে ভালোই হবে।

মাছ নিয়ে ফেরির নৌকা চলে গেলো। থেকে গেলো জেলে নৌকাগুলো। সরদার বললেন, এই যে লোকজন দাওয়াত দিয়ে আনেন ভাই, ওদের রান্না তো করা হয়নি। জেলেরা বললো, তারা আগেই খেয়ে ফেলেছে। বিকাল থাকতে থাকতে রাতের খাবার খেয়ে নেয় জেলেরা। সন্ধ্যার পর থেকে পরদিন সকাল পর্যন্ত রান্না হয় না, আলো জ্বালে না তারা বনদস্যু ও বনরক্ষীদের ভয়ে। বললাম, রাতে এখানেই থাকেন। আবহাওয়া ভালো না। রান্না যা হইছে তা দিয়ে মিলেঝিলে খেয়ে নিবো।

সরদার এবার আমার ওপর চড়াও হলেন। বললেন, মিলেঝিলে খাবেন ঠিক আছে। কিন্তু দশ জনের খাবার ত্রিশ জন মিলে খাবেন কী করে? বললাম, সে আপনি জানেন।

রান্নাঘরে ফিরে গেলেন সরদার। পিছে পিছে হেঁটে গেলাম। তরকারির কড়াই দেখিয়ে সরদার বললেন, কাউইন মাছ তো পুরোটা রান্না করিনি। তাহলে কিরাম করে সবাইকে খাওয়াই? বলতে বলতে রান্নাঘরের সামনে বসে পড়লেন। দুই ডজন ডিম সেদ্ধ করতে দিলেন। আলু কেটে ফালি ফালি করে একই পাতিলে তুলে দিলেন।

নতুন করে কিছু মসলা বাটা হলো। আধা ঘন্টা পর ডিম আর আলু নামিয়ে ছিলে ফেললাম সবাই মিলে। ভাবছিলাম নতুন তরকারি হবে। কিস্তু সরদার আলাদা তরকারি করবেন না। ছোট একটি কড়াই নিয়ে মসলা দিলেন। আরও কিছু মসলা নিয়ে তেল দিয়ে নাড়াচাড়া দিলেন। এরপর সেদ্ধ ডিম আর আলু চড়িয়ে দিলেন।

পাঁচ মিনিট এভাবে চললো। ভাজ ভাজা হলো ডিম আর আলু। তারপর ওই পাতিল নামিয়ে তুলে দিলেন কাউইন মাছের কড়াই। একটু গরম দিয়ে তার মধ্যে ঢেলে দিলেন আলু আর ডিম। ঢাকনাটা দিয়ে অল্প আঁচে রাখা হলো। তারপর আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, এবার পারলে আরও কিছু মেহমান ডাকেন। এবার চল্লিশ জনকে খাওয়াতে পারবো!

সবকিছু ঘটলো ৪৫ মিনিটের মধ্যে। চোখের সামনে। তরকারির মধ্যে তরকারি দিয়ে ডিম মাছের ঝোল হলো। সরদার বললেন, কীরাম হলো ভাই? এখন যে ডিম খাবে সেও মাছের স্বাদ পাবে। যে মাছ খাবে সে পাবে ডিমের স্বাদ। আমি তাকিয়ে রইলাম। উঠতে উঠতে বললাম, দেখি আরও কয়টা জেলে নৌকা পাই কী না!

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top