রূপান্তরের গল্প ২৫৫ | Rupantorer Golpo 255

জঙ্গল ফুঁড়ে বের হলো কারা? | রূপান্তরের গল্প ২৫৫

জঙ্গল ফুঁড়ে বের হলো কারা? | রূপান্তরের গল্প ২৫৫ | Rupantorer Golpo 255 | দস্যুমুক্ত সুন্দরবন | সুন্দরবনের গল্প | জীবনে ফেরার গল্প | Jibone Ferar Golpo | Sundarbaner Goppo | Story of Sundarbans | মোহসীন উল হাকিম | Mohsin Ul Hakim


রূপান্তরের গল্প ২৫৫ : সরদারের রান্নাঘরটি পিছনে। সেখান থেকে ট্রলারের সামনে যাওয়ার পথটি একটু কঠিন। ট্রলারের দুই পাশের ছয় ইঞ্চি কাঠের ওপর দিয়ে হাঁটতে হয়। ডান পাশে আবার সাইলেন্সার পাইপ বসানো। হাঁটতে গেলে হোঁচট খাই। গরম পাইপে পা পুড়েছে কয়েক বার। তাই বাম পাশ দিয়ে হেঁটে সামনে গেলাম।

গলুই-এ গিয়ে দাঁড়াতেই নজরে আসলো কিছু একটা। ভালো করে তাকিয়ে দেখি একটা নৌকা তবে এই নৌকা জেলেদের না। কারা ওরা? বনদস্যু না তো?

ছোট্ট একটি ভাঙ্গা নৌকা নিয়ে বেয়ে যাচ্ছে। বৈঠা হাতে দুইজন। মাঝের জনের বয়স কম। নৌকার খোলে ওঠা পানি ফেলছে সে। তবে খুব সতর্ক। এমন ভাবে পানি ফেলছে যাতে আওয়াজ না হয়। চলাফেরায় কেমন জানি চোর চোর ভাব।

রীতিমতো জঙ্গল ফুঁড়ে বের হলো তারা। পাশেই যে একটি জোলা খাল আছে খেয়ালই করিনি। তার ভিতর থেকে বেশ কসরৎ করে বের হলো নৌকাটি। কিন্তু এই খালে এসে পড়তেই ভ্যাবাচাকা খেলো তারা। আমাদের দেখে দ্রুত নৌকা নিয়ে খালের অন্য প্রান্তে চলে গেলো। একবার ভাবলাম যাক। কিন্তু পরক্ষণেই মনে হলো ডাক দেই।

বললাম, ও ভাই, আপনারা কারা? এদিকে আসেন! এবার নৌকার গতি আরও বাড়লো। একদম জঙ্গলের কিনারে চলে গেলো। রাতের বেলা বলে পরিস্কার দেখতে পাচ্ছি না। অবশ্য আমি না দেখলেও সঙ্গীরা ঠিকই দেখতে পায়। ওদের পালাতে দেখে এবার সরদার দিলেন ডাক। সেই ভাষা লিখা যায় না।

গড়গড় করে বেশ কিছু গালি দিয়ে শুরু হলো। চিৎকার করে ওদের থামতে বললেন সরদার। এবার কাজ হলো। নৌকা থামলো। কিন্তু কাছে আর আসে না। ভাবলাম জঙ্গলে নেমে দৌড় দেয় নাকী!

এবার পাশ থেকে একজন বললো, গুলি করলে আসবি তোরা? এই কথায় ধোঁকা খেলো ওরা। নৌকা ঘুরিয়ে সোজা এগিয়ে আসলো আমাদের দিকে। নৌকা ট্রলারে বাঁধতে বললাম। ওরা একদম জড়োসড়ো। হাত জোর করে বলছে, আমরা কিছু করিনি স্যার। কাঁকড়া ধরতে আসছি। ওরা ভেবেছে আমরা হয়তো বনদস্যু অথবা বন বিভাগের লোকজন।

ভাষা বরিশালের মতো। বাড়ি চরদোয়ানী। মানে পিরোজপুরের চরদোয়ানী। বলেশ্বর নদের ওপারে। জানতে চাইলাম, কাঁকড়ার নৌকা তো এমন হয় না ভাই। তোমরা সত্যি কথা বলো তো। কেন আসছো বনে? কী করছো?

মাঝে বসা ছেলেটি দেখি থরথর বরে কাঁপছে। বয়স ১৩-১৪ হবে। শীর্ণ দেহ। তবে হাত দুটো বেশ মজবুত। ছেলেটিকে ডেকে নিলাম। বুঝতে পারছি ভয় পেয়েছে। কিন্তু আমাদের দেখে থরথর করে কাঁপার মতো ভয় তো ওর পাওয়ার কথা না!

কাছে ডেকে বসালাম ছেলেটিকে। বাকী দুইজন নৌকাতেই আছে। ছেলেটির পিঠে হাত রাখলাম। খুব মায়া হচ্ছে। কিছু জিজ্ঞেস করলে উত্তর দিচ্ছে না। বাকীদের দিকে তাকিয়ে বললাম, কী হয়েছে ওর? নৌকার একজন বললো, সেই ভোর বেলা দুইটা খাইছি। তারপর আর খাওয়া হয়নি। তার ওপর পাইছে ভয়।

কীসের ভয়? আমাদের কেন ভয় পাবে তোমরা? আমরা ডাকাতও না, ফরেস্টও না। তাহলে ভয় কেন? বেলায়েত সরদারকে বললাম, নতুন তিনজন যোগ হয়েছে ভাই। আগে ওদের খাবার দিয়ে দেন। সারাদিন কিছু খায়নি এরা।

পিছনে তাকিয়ে দেখি হাতে ভাতের থালা নিয়ে এগিয়ে আসছে মামুন। ডিম আর মাছের যৌথ তরকারি দিয়ে প্রথমে এই অতিথিদের আপ্যায়ন করা হবে। সরদার বললেন, ওরা আগে টেস্ট করুক ভাই।

পেট পুরে ভাত খেলো তিনজন। ক্ষুধার্ত সন্দেহ নাই। কিন্তু তারা কেন বনে এসেছে এই প্রশ্নের উত্তর পাইনি এখনও। যেহেতু অভয়াশ্রম তাই যে কেউ এখানে এসে বন বিভাগের তাড়া খেতে পারে। আবার বনদস্যুরাও ভয়ের কারণ হতে পারে।

ভাত খাওয়ার পর তাদের চা দিতে বললাম। পাশে বসে আবারও জানতে চাইলাম তাদের বনে আসার কারণ। কী কারণে পালিয়ে বেড়াচ্ছে তারা সেটিও জানা দরকার। আমার মনে হচ্ছে এরা শিকারী বা গাছ চোর। তবে মনের কথা মনেই রাখলাম।

ভাত খাওয়ার পর একটু নরম হলো তারা। বললো, বনের ভিতরে খুটি আছে। খুটি মানে যেখানে আগুন জ্বালিয়ে চিংড়ি মাছের শুঁটকি করা হয়। বনের ভিতরে শুঁটকি করার এই প্রক্রিয়া বড় ধরনের অপরাধ। তার মধ্যে এটি অভয়াশ্রম। খুটিকে সুন্দরবনের কোথাও কোথাও রঙ ঘরও বলে।

তার মানে এরা শিকারী বা গাছ চোরদের চেয়েই বড় অপরাধ করে। এরাই খালে খালে বিষ দিয়ে মাছ ধরে! কথায় কথায় জানলাম, এই অঞ্চলে বেশ কয়েকটি খুটি আছে। তাদের খুটিতে কাজ করে মোট ১৬ জন। এরা প্রায় সবাই আশেপাশের খালে মাছ ধরে।

প্রথমে বিষের কথা অস্বীকার করলেও পরে খোলামেলা কথা বললো তারা। জানালো, ওরা তিনজন মাছ ধরতে যায় না, সার্বক্ষণিক খুটিতে থাকে। জেলেরা মাছ পৌঁছে দেয়। তারপর চিংড়িগুলো পরিস্কার করা থেকে শুকিয়ে চটের বন্তায় ঢোকানো পর্যন্ত তাদের কাজ। তিন মাসের চুক্তিতে এসেছে। জনপ্রতি তারা টাকা পাবে ত্রিশ হাজার করে। মহাজনের বাড়ি কোথায় জানতে চাইলাম। ওরা উত্তর দিলো না।

এরপর জানলাম কেন তারা ভয় পেয়ে পালাচ্ছে! বললো, বিপদটি কয়েকদিন আগে থেকে শুরু হয়েছে। একটা বাঘ নাকী পাগলের মতো ছুটোছুটি করছে।

একজন বললো, মরা গোন-এ জেলেরা সবাই বাড়ি চলে যায়। ওরা তিনজন থেকে যায়। খুটিতে পঞ্চাশ পেটির বেশি শুকানো চিংড়ি আছে। অনেকগুলো চিংড়ি আগুনে শুকানোর কাজ চলছে। কাজগুলো তাদের করতে হয়। জঙ্গল ছেড়ে বের হওয়ার উপায় নাই। বাড়ি যাবে না এই চৃক্তিতেই এসেছে তারা।

ছেলেটি মুখ খুললো এবার। বললো, গত কাল সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখে একটা ‘হিয়াল’ আসছিলো ওখানে। জানতে চাইলাম হিয়াল কী? পাশ থেকে সরদার বললেন, হিয়াল চিনেন না ভাই? এদিকের লোকজন বাঘকে শিয়াল বা হিয়াল বলে। নতুন বিষয় জানলাম।

ছেলেটি বললো, বাঘ এসেছিলো সেখানে বুঝলাম কী করে? চার পাশের মাটিতে নিশানা। প্রস্রাব করতে মাচা থেকে নামছি। নামতেই দেখি ওর পায়ের ছাপ। ভয়ে ঠেলে উপর উঠে গেছি।

জানতে পারলাম, ওরা গাছের ওপর মাচা করে থাকে। অন্যদিকে সারাদিনের পরিশ্রান্ত শরীর। শুলেই ঘুম আসে। তাই মামা এসে ঘুরে আবার চলেও গেছে, কিন্তু ওরা টের পায়নি। ছেলেটি বললো, আরও দুই দিন আগে থেকে একটি বাঘ ডাকছে আশেপাশে। সব মিলিয়ে পেয়েছি। আজ দুপুরের দিকে বাঘটি আবারও আসে আমাদের খুটিতে।

পাশের জন বললো, আগের দিনই আমরা বাঘের ভয়ে মাচায় উঠে বসছি। আর নামিনি। কিন্তু মামা দেখি সরে না, ঘুরে ঘুরে আসে। নেমে পালাতেও পারি না। কিন্তু এভাবে থাকলে তো না খেয়ে মরবো। অন্য জেলেরা থাকলে একটা কথা ছিলো। সবাই মিলে তাড়াতে পারতাম। কিন্তু মরা গোনে জেলেদের পাবো কই? তাই ঝুঁকি নিয়ে আজ নেমে পড়ছি। পাশের খালে রাখা এই নৌকা নিয়ে পলান দিছি।

জানতে চাইলাম, এই জায়গা থেকে ওই খুটি কতো দূর? হেঁটে যাওয়া যাবে? এরা বললো, আমরা হাঁটলে এক ঘন্টার বেশি সময় লাগবে। আপনারা তিন ঘন্টায়ও পৌঁছাতে পারবেন না। মাঝে অনেকগুলো খাল আছে। কাঁদা কোমড় সমান। তবে ভরা জোয়ারের সময় নৌকা নিয়ে ঢুকলে অর্ধেক পথ খাল ধরে যেতে পারবেন। তারপর হাঁটতে হবে। এতো কষ্ট আপনারা করতে পারবেন না।

মনে মনে ভাবছিলাম যে রাতে ওদের রেখে দিবো। কাল সকালে ওই মাছ শুকানোর খুটিতে যাবো। যতো কষ্টই হোক জঙ্গলের ভয়ঙ্কর এই ধ্বংসযজ্ঞ কেমন করে চলে তা দেখতে হবে। সরদারকে বললাম পরিকল্পনার কথা।

সচরাচর আমার যেকোনো ইচ্ছাকেই গুরুত্ব দেন তিনি। তবে এবার বললেন, ওই পর্যন্ত গেলে আপনাকে আর নেওয়া যাবে না ভাই। যাবেক কোনো রকমে। কিন্তু ফিরতে পারবেন না। হয়রান হয়ে যাবেন।

সরদার বললেন, এদিকে বাঘের আনাগোনা আছে। সেটা তো বলা লাগবে না। সন্ধ্যার সময় ডাক দিলো। তো মামায় ধাওয়া দিলে দৌড়ে পালাতে পারবেন? বললাম, দেখেন চিন্তা করে। আমি যেতে চাই। যাওয়ার রাস্তা বের করেন।

অবৈধ ও ভয়াবহ ক্ষতিকর অপকর্মটি নিয়ে অনেক শুনেছি। জঙ্গলের বাইরে শুঁটকির ঘর দেখেছি। কিন্তু জঙ্গলের রঙ ঘর দেখা হয়নি। বনের ভিতরে, অভয়াশ্রমে অবাধে চলছে এই বন ধ্বংসকারী কাজ। জঙ্গলের ভিতরের রঙ ঘর কখনও দেখার সুযোগ হয়নি। এবার না দেখে ফিরবো না।

(ঘটনাটি ২০১৬ সালের শেষ দিকের)

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top