রঙঘরের সন্ধানে | রূপান্তরের গল্প ২৫৬ | Rupantorer Golpo 256 | দস্যুমুক্ত সুন্দরবন | সুন্দরবনের গল্প | জীবনে ফেরার গল্প | Jibone Ferar Golpo | Sundarbaner Goppo | Story of Sundarbans | মোহসীন উল হাকিম | Mohsin Ul Hakim
রূপান্তরের গল্প ২৫৬ : ওদের ধরে চালান দিয়ে দেই ভাই? সরদারের কথা শুনে ফিরে তাকালাম। দেখি রান্নাঘর থেকে আমার জন্য এক কাপ দুধ চা নিয়ে হেঁটে আসছেন সরদার। পাশে এসে বসলেন। নৌকায় বসে তখন জেলেদের সাথে গল্প করছি। বললাম, ওদের অপরাধ কী? আর চালান করবেন কোথায়? হাসতে হাসতে একটু আগে জঙ্গল থেকে বের হওয়া কিশোরটির কাঁধে হাত রাখলেন সরদার। বললেন, জঙ্গলে রঙঘর করা তো বিশাল অপরাধ। বললাম, ওরা তো কর্মচারি। কথা বললে এদের মহাজনদের বিরুদ্ধে বলতে হবে।
সরদার বললেন, এই ছেলেটাকে আমাদের সাথে রেখে দেই ভাই। বললাম, ও তো বাঘ ভয় পায়। থাকতে পারবে আমাদের সাথে? আমরা তো বাঘের সামনে ঘুরে বেড়াই। কথাগুলো মজার ছলে বলছেন সরদার। আমিও তার কথায় তাল মিলালাম। কিশোরটির মুখে হাসি ফুটেছে। বললাম, চরদোয়ানী থেকে এখানে কী ভাবে আসছো তোমরা? সে বললো, বলেশ্বর পারি দিয়ে প্রথমে শরণখোলা। তারপর মটরসাইকেলে চড়ে জয়মনির ঘোল। সেখান থেকে দেড় মাস আগে অন্য জেলেদের সাথে বনে এসেছে তারা। এর পর আর বাড়ি ফিরেনি। মৌসুম শেষ করে উঠবে। মৌসুম শেষ হবে কবে? ছেলেটি বললো, আরও দেড় মাস। কিন্তু আমি আর থাকবো না। আপনাদের সাথে চলে যাবো।
সারা শরীরে কাঁদা। হাত পা আর শরীরের জায়গায় জায়গায় রক্ত জমে আছে। জঙ্গল থেকে বের হওয়ার সময় কাঁটায় ছিন্নভিন্ন হয়েছে দেহ। দীর্ঘ পরিশ্রমে ক্লান্ত-শ্রান্ত তিন জেলে আমার সামনে বসা। ক্ষুধায় কাতর কিশোরটি এবার শান্ত হয়ে বসেছে। ভয়ঙ্কর জঙ্গল জীবন কাটানো মানুষগুলোর শক্ত চোঁয়ালে একটু নমনীয়তা এসেছে। ক্ষীপ্র চোখগুলোতে একটু স্বস্তি দেখছি। আপাতত বড় বিপদ থেকে মুক্তি হয়েছে। স্বস্তি সেটুকুই। আমি জানি, এরা যেতে পারবে না। কারণ তিন মাসে ত্রিশ হাজার টাকার মধ্যে মাত্র দশ হাজার টাকা পেয়েছে তারা। কুড়ি হাজার বাকী আছে। চলে গেলে সেই টাকা আর পাবে না।
সুন্দরবনের মানুষদের অনেকেই বলে নিরীহ। আবার কেউ কেউ বলে হিংস্র। আমি দেখি একটু অন্য ভাবে। জন্ম থেকে এই পৃথিবীর বৈরীতা দেখা সুন্দরবনের মানুষেরা ভীষণ অসহায়। দারিদ্রের সাথে যুদ্ধ করা এই মানুষদের জিম্মি করে রাখে এক শ্রেণির লোভী মানুষ। বন-উপকূল জুড়ে তাদের একটু দুষ্টু চক্র আছে। সেই চক্র থেকে বের হওয়ার পথ পায় না এই জেলে-বাওয়ালীরা। শুধু জেলেরা নয়, সুন্দরবনের চোরা শিকারী, গাছ চোর, বিষ দস্যু আর বনদস্যুরাও এদের কাছে জিম্মি।
গল্প করতে করতে নৌকার ছোট ছেলেটি বললো, কাল যদি আমাদের সাথে যান তো নিজের চোখে দেখতে পারবেন আমাদের খুটি। অন্য দুইজন তাকে ধমক দিলো। আসলে ছোট ছেলেটি এতো সব জটিলতা না বুঝেই আমাকে তাদের রঙ ঘরে যেতে বলেছে। এই জঙ্গলে আসা, বাঘের রাজ্যে থাকা, এসব নিয়েই তার দুশ্চিন্তা। কোথায় এসেছে, এই কাজ বৈধ কী না এসব নিয়ে তার কোনো ধারণাও নাই। সহযাত্রীদের বকা খেয়ে ছেলেটি চুপ করলো। কিন্তু আমি মনে মনে ঠিক করলাম, যা হবার হবে, কাল সকালে আমরা যাবো সেই শুঁটকির ঘরে।
বেলায়েত সরদারের সাথে চোখে চোখে কথা হলো। উনি ঠিক বুঝেছেন যে বাঘ থাকুক আর যাই থাকুক, কাল সকালে জঙ্গলে নামতেই হবে। তবুও শেষ চেষ্টা হিসাবে আমাকে বললেন, কাল আমাদের দুবলার চরের ওদিকে যেতে হবে। ওই অঞ্চলের জেলেরা আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে। বললাম, কাল এদের শুঁটকির ঘরটি দেখেই রওনা দিবো।
খুটি সম্পর্কে সুন্দরবনের বাইরের মানুষদের কোনো ধারণাই নাই। বন উপকূলের লোকালয়ে মাছ শুকানোর ঘরগুলোতে কাঠ পুড়িয়ে চিংড়ি শুকানোর রীতি পুরনো। আগে এমনিতেই প্রচুর মাছ হতো। কিন্তু বরফের ব্যবস্থা তেমন ছিলো না। শুঁটকির চাহিদাও ছিলো আগে থেকেই। লোকালয়ের রঙঘরগুলো তাই প্রায় বছর জুড়েই সরগরম থাকে। সাধারণত এলাকার ক্ষমতাবানরা এই রঙঘরগুলোর মালিক। তারাই নির্দিষ্ট জেলেদের মহাজন।
জঙ্গল থেকে মাছ নিয়ে সরাসরি রঙঘরে দেয় জেলেরা। ঘরের মধ্যেই মাছ শুকানোর পুরো কাজ করা হয়। বর্ষার সময় হলেও মাছ শুকাতে সমস্যা হয় না। কারণ পুরো কাজটি চলে গাছ পুড়িয়ে, আগুন দিয়ে। খুটি থেকে শুঁটকির পেটিগুলো সোজা চলে যায় দেশের বিভিন্ন আড়তে। বেশির ভাগ শুঁটকি যায় চট্টগ্রামের আসাদগঞ্জে। বেশ বড় আর পুরনো ব্যবসা এটি। কিন্তু এর সাথে জড়িয়ে আছে সুন্দরবনের অনেক অপরাধ। এর সাথে জড়িয়ে আছে জীবন বিনাসী বিষ। বেশির ভাগ চিংড়িই ধরা হয় সুন্দরবনের খাল থেকে, বিষ দিয়ে।
খুটি সম্পর্কে আরেকটু বিস্তারিত বললে ভালো হয়। খুটিগুলো হয় মাচার মতো। অনেকে বলে রঙ ঘর। মোটা মোটা কাঁচা গাছ কেটে খুঁটি বসানো হয়। তারপর মাঝারি গাছ দিয়ে মাচার মতো করা হয়। তার ওপর বসানো হয় চিকন গাছ। সুন্দরবনের কাঁচা গাছ এই কাজের জন্য উপযুক্ত। মাচা করে মাছ শুকানোর জন্য প্রয়োজন হয় শুকনা কাঠ। অনেক কাঠ লাগে। কারণ ২৪ ঘন্টা মাচার নিচে আগুন জ্বলে। জ্বলে মাসের পর মাস।
উপকূল জুড়ে সুন্দরবন সংলগ্ন লোকালয়ে জায়গায় জায়গায় আছে এরকম অসংখ্য রঙ ঘর। ঘর মালিকরা অবশ্য বলেন, জঙ্গলের কাঠে হাত দেন না তাঁরা। আর আমরা দেখি সব জ্বালানীই আসে সুন্দরবন থেকে। উপকূল জুড়ে রঙ ঘর নিয়ে আমাদের ধারণা কম। বন বিভাগের কর্তারা বলেন, তাঁরা জানেন কিন্তু বনের বাইরে হওয়ার কারণে তাঁরা তেমন কিছু করতে পারেন না। জিজ্ঞেস করলে তাঁরা এড়িয়ে যান। বলেন, স্থানীয় প্রশাসনের সহযোগিতা না পেলে এটা বন্ধ করা যাবে না। উনাদের বলি, ঠিক আছে। কিন্তু সুন্দরবনের ভিতরে অভয়াশ্রমে মাছ শিকার হচ্ছে? এছাড়া সবাই জানে যে এই জেলেরা বিষ দিয়ে মাছ ধরে। সেটিও ঠেকাতে পারেন না?
চাত্রীর খালে তখন ভরা জোয়ার। সরসর করে বইছে পানি। তার সাথে যোগ হয়েছে এলোমেলো বাতাস। আকাশে মেঘ থাকলেও চাঁদের দেখা পেলাম। মেঘের আড়ালে যাচ্ছে আসছে চাঁদ। সম্ভবত দ্বাদশী আজ। আর দুই দিন পরেই পূর্ণিমা। সবাইকে ডেকে একসাথে করলেন সরদার। বললেন, সবাই খেয়ে নাও। রাতে বৃষ্টি আসতে পারে।
খেতে বসেছি। এসময় কুকু পাখি ডেকে উঠলো। মানে জোয়ার শেষে ভাটা শুরু হলো। ভাটা চলবে আগামী ছয় ঘন্টা। পানি নেমে যাবে খালের তলানীতে। এখন বাজে রাত নয়টা। ভাটা শেষে আবার জোয়ার শুরু হবে। সকাল নয়টার দিকে ভরা জোয়ার থাকবে। বললাম, তারপর যে ভাটা শুরু হবে সেই ভাটায় আমরা ট্রলার ছেড়ে নেমে যাবো। কথাটি বললাম অন্যদের একটু বিভ্রান্ত করার জন্য। আমি যে কাল শেষ জোয়ারে জঙ্গলের ওই সরু খালে ঢুকবো নৌকা নিয়ে সেকথা কাউকে বললাম না। বললে, রাতেই শুঁটকির ঘরের এই তিনজন নৌকা নিয়ে সরে পড়বে।
এদিকে বেলায়েত সরদার বুঝে গেছেন আমি কাল নামবোই নামবো। তাই সকালের নাস্তা হিসাবে ভাত রান্না করে তাতে পানি দিলেন। পান্তা ভাতের সাথে কিছু একটা মিলিয়ে সকালের নাস্তা হবে। তারপর আমরা রওনা দিবো সুন্দরবনের ভিতর। সরদার শুধু কানে কানে বললেন, নৌকা যতদূর যায় সে পর্যন্ত গিয়ে আমাদের অনেকটা পথ হাঁটতে হবে, পারবেন তো? বললাম, পারবো তো! উনি আবার বললেন, শুধু গেলেই হবে না। ফিরতেও হবে। বললাম, সেটাও জানি। সরদার হতাশ! বললেন, তাইলে শুয়ে পড়েন তাড়াতাড়ি।
ঘুম ভালোই হচ্ছিলো। এরপর বৃষ্টি এলো। উঠে দেখি রাত তিনটা বাজে। তখন সার ভাটি, মানে শেষ ভাটি। পানি একদম খালের তলানিতে। জোয়ার ভাটার মাঝামাঝি সময় সুন্দরবনে বৃষ্টি নামে। সেই প্রস্তুতি ছিলো। আগে থেকেই পলিথিন আর ত্রিপল দিয়ে ঢাকা ছিলো ট্রলার। উঠে দেখি নৌকগুলোও ঢাকা পলিথিনে।
ভাবলাম আর ঘুমানো না। বেলায়েত সরদারকে ডেকে তুললাম। আমার হাঁকডাক শুনে সহযাত্রীরাও জেগে উঠলো। চোখ ডলতে ডলতে সরদার উঠে বসলেন। বললেন, আপনাকে নিয়ে আর পারলাম না ভাই। বললাম, আর ঘন্টা দুই পর আমাদের বের হতে হবে। রঙঘর দেখতে যাবো না? সরদার বললেন, এতো ভয় দেখালাম, তারপরও আপনি যাবেনই? হাসলাম আমি। সরদার বললেন, কী আর করা! এই চোর ডাকাতদের পিছনে ঘুরতে ঘুরতে আপনি কেমন জানি হয়ে গেছেন ভাই। আমাদেরও একটু ঘুমাতে দেন না, নিজেও ঘুমান না। আমি বললাম, আপনাকে আরও দুই ঘন্টা সময় দিলাম, ঘুমান।
হাসতে হাসতে বিছানা ছাড়লেন সরদার। মামুনকে ডেকে আনলেন রান্নাঘরের কাছে। বললেন, এই রাতে কি খালি মুখে বসে থাকবো? চুলা জ্বালা। কড়াই-এ চাল ভাজতে শুরু কর। আমি পেঁয়াজ রসুন কাটতে বসি। বলেই কাজে নেমে গেলেন তাঁরা। মিনিট পনেরোর মধ্যে গরম গরম চাল ভাজা প্রস্তুত। আরও দশ মিনিটের মধ্যে তৈরি হলো চা। দুধ চা আর ঝাল ঝাল গরম চাল ভাজার সাথে দুধ চায়ের তুলনা হয় না। টিপটিপ বৃষ্টি হচ্ছে, এলোমেলো বাতাস বইছে। মেঘের ভিতর থেকে উঁকি দিচ্ছে দ্বাদশীর চাঁদ।
ভোর পাঁচটার দিকে সবাইকে ডেকে তুললাম। ততোক্ষণে বৃষ্টি থেমেছে। কিন্তু বেড়েছে বাইড়ে পোকার উৎপাত। বৃষ্টি হলে এই পোকারা কাঁদা থেকে ঝাঁক বেঁধে উড়ে আসে। শুধু তাই না। ওদের মনে হয় আমার রক্ত খুব পছন্দ। অন্যদের না কামড়ালেও আমাকে ছাড়ে না। মিনিপ্যাক শ্যাম্পু বের করে গায়ে মাখলাম। এই পোকার হাত থেকে বাঁচতে হলে সুগন্ধিযুক্ত কিছু মাখতে হয়।
গত রাতে জঙ্গল থেকে বের হওয়া তিনজন দেখি বেঘোরে ঘুমাচ্ছে। ডেকে তুললাম তাদের। সবাইকে নিয়ে একসাথে বসে পান্তা ভাত খেলাম। আরেক কাপ চা খেয়েই নামবো। এর মধ্যে কিছু শুকনা খাবার, পানি গুছিয়ে গামছায় বেঁধে নিলো মামুন। জঙ্গলে ঢুকবো আমরা কয়েকজন। আমাদের দলে থাকবেন বেলায়েত সরদার, মামুন, ওই তিনজন জেলে। বাকীদের রেখে যাবো এখানে। নেটওয়ার্ক নাই এদিকে। তাই আমরা না ফেরা পর্যন্ত জায়গা বদল করতে না করলাম।
আজকে চাঁদের ত্রয়োদশী। জোয়ারের পানির চাপ আগের চেয়ে বেশি। অর্ধেক জোয়ারেই জঙ্গল সমান পানি হয়ে গেছে। মনে হচ্ছে বনের ভিতরে বেশ খানিকটা পথ নৌকায় করে যেতে পারবো। সবাইকে নিয়ে নৌকায় উঠলাম। সাথে দা আর কয়েকটি লাঠিও নেওয়া হলো। সাথে তো আর কিছু নাই। বাঘে তাড়ালে আমাদের নিজেদের বাঁচাতে হবে তো! সরদার বললেন, ও ভাই চলেন তো! মামা টামা আসলে আমি দেখবানে।
নৌকার মাঝখানে আমি বসেছি। সামনে পিছনে দুইজন বৈঠা বাইছে। মাঝখানে আমি। পাশেই বসেছেন সরদার। হাতে দা নিয়ে বেশ ভাব নিয়ে বসেছেন। আর একটানা কথা বলছেন। কারণ এই যাত্রায় সবাইকে গল্পে গল্পে জমিয়ে রাখতে হবে। প্রচুর কথা বলতে হবে। আওয়াজ করতে হবে। যাতে আশেপাশে বাঘ থাকলেও ভয়ে কাছে না আসে।
খাল থেকে বনের ভিতরের সেই অতি সরু খালের ভিতরে ঢুকে পড়লাম। জোলা খাল যাকে বলে। একদম মাটির সাথে মিলানো। জোয়ারের পানি ভরেছে বলে ভেসে ভেসে এগুতে পারছি। ভাবনা নাই। কারণ পানি এখন বাড়তেই থাকবে। অনেকটা পথ এভাবে যেতে পারবো। সমস্যা হলো আমরা পথ চিনি না। খুটির জেলেরা আমাদের ভুল পথে নিতে পারে। এই অপরাধের চিহ্ন তারা আমাদের দেখাতে চাইবে না।
একটু পর পর জোরেসোরে কাশি দিচ্ছেন সরদার। এটা নাকী বাঘ তাড়ানোর কৌশল। ঘন্টা দেড় এভাবেই চললাম। জোয়ার শেষ হতে এখনও এক ঘন্টা বাকী। তাই একটু রয়ে সয়ে এগুচ্ছি আমরা। নৌকা আটকে যাওয়ার পর একটু বিরতি নিলাম। নৌকায় লম্বালম্বি বসেছি। তবে সবাই বাইরের দিকে ঘুরে বসা। একটু কষ্ট হচ্ছে। কিন্তু চারপাশে খেয়াল রাখার জন্য এছাড়া আর উপায় নাই।
আধা ঘন্টার বিরতি নিয়ে আবার নৌকা বাওয়া শুরু। পুরো পথে আরও বেশ কয়েকটি ছোট খাল অতিক্রম করলাম। একটি বাইন গাছের গোঁড়ায় থামার ইশারা করলো একজন। যতোদূর মনে হচ্ছে, জেলেরা সঠিক পথ দেখাচ্ছে। ভরসা করলাম। সবাই মিলে নেমে পড়লাম জঙ্গলে। সামনে কঠিন পথ।
সবার সামনে রঙঘরের একজন জেলে। সেই পথ দেখাচ্ছে। তারপর বেলায়েত সরদার। তারপর আমি। আমার পিছনে ওই কিশোর। সবার পিছনে মামুন। জঙ্গলে চলার নিয়ম এমনই। সারিবদ্ধ ভাবে হাঁটতে হয়। শুনেছি বাঘ নাকী পিছনের জনকে টার্গেট করে। তাই মামুনকে একটু বেশি সতর্ক থাকতে হবে। আধা ঘন্টার মতো হাঁটলাম। তারপর শুরু হলো কঠিন এক পথ।
জঙ্গলের এদিকটাতে জোয়ারের পানি উঠে গেছে। কাঁদা প্রায় হাঁটু পর্যন্ত। এর মধ্যে জায়গায় জায়গায় জমাট বাঁধা হরগজা গাছ। এর ভিতর দিয়ে হাঁটলে পা ক্ষতবিক্ষত হবেই। কিছু করার নাই। হরগজার ঝোপ পার হয়ে পড়লো হেঁতালের ঝোপ। চারপাশে শুকনো হেঁতাল কাঁটা ছড়িয়ে আছে। মাঝে মাঝে নাম জানা কাঁটা গাছের মুখোমুখিও হলাম। সরদার একবার সামনে দেখেন, একবার পিছনে ফিরে আমাকে দেখেন। এরপর বললেন, আমার ঘাড়ে এক মণ ওজন তুলে দিলেন। তাও তো আপনি সাথে হেঁটে পারছেন না।
জঙ্গলে হাঁটার সময় সরদারের কাঁধে ওজন চড়াতে হয়। তা না হলে তাঁর হাঁটার গতির সাথে তাল মিলাতে পারি না। আজ তেমন কিছু নেইনি। তবে ব্যাগের মধ্যে ক্যামেরা, কয়েক বোতল পানি আছে। সরদার আমার সেই ব্যাগ কাঁধে নিয়ে যে গতিতে হাঁটছেন তার সাথে তাল মিলাতে পারছি না। হাঁপিয়ে উঠেছি। বার বার পড়ে যাচ্ছি। পিছন থেকে কিশোরটি আমাকে ধরছে। এক সময় কানে কানে বললো, আর বেশি দূর নাই। সামনেই আমাদের রঙঘর।
আরও প্রায় আধা ঘন্টা পর মানুষের পায়ের ছাপ পেলাম। বুঝতে পারলাম জায়গা মতো চলে এসেছি। সারিবদ্ধ ভাবে হাঁটতে হাঁটতে পৌঁছে গেলাম। লোকালয়ের রঙঘর দেখেছি। জঙ্গলের রঙঘর বা খুটি এই প্রথম নিজের চোখে দেখছি। আগের দিন এখান থেকে পালিয়ে গেছে ওই তিন জেলে। এখনও মাচাগুলোর নিজে জ্বলছে পোড়া কাঠ। মাচার উপর সারি সারি চিংড়ি মাছ। সুন্দরবনের চাকা চিংড়ি শুকানো হচ্ছে এখানে।
(ঘটনাগুলো ২০১৬ সালের শেষের দিকের। সুন্দরবনের চাত্রী এলাকা)