উথাল পাথাল পশুর নদী | রূপান্তরের গল্প ২৫৮ | Rupantorer Golpo 258 | দস্যুমুক্ত সুন্দরবন | সুন্দরবনের গল্প | জীবনে ফেরার গল্প | Jibone Ferar Golpo | Sundarbaner Goppo | Story of Sundarbans | মোহসীন উল হাকিম | Mohsin Ul Hakim
রূপান্তরের গল্প ২৫৮ : নিজের শরীরটাকে টেনে নেওয়ার শক্তিটুকুও নাই। বার বার পানি খাচ্ছি। কিন্তু শুকিয়ে যাওয়া গলা ভিজছে না। পিপাসা মিটছে না কিছুতেই। মনে হচ্ছে ভিতর থেকে সমস্ত প্রাণশক্তি হারিয়ে গেছে। গত কয়েক ঘন্টার জঙ্গল ভ্রমণ ছিলো বিভীষিকাময়।
নৌকার উপর কোনো রকমে উঠে দাঁড়ালাম। সবাই মিলে কাঁধে করে আমাকে টেনে তুললো ট্রলারে। উঠেই কাঠের তক্তা দিয়ে তৈরি পাটাতনের ওপর শুয়ে পড়লাম। বড় বড় শ্বাস নিচ্ছি। ভাবছি জীবনটা বেঁচেছে কোনো রকমে।
শরীরের বিভিন্ন জায়গায় জ্বালা করছে। রক্ত জমেছে। কিন্তু কাঁদায় ঢেকে গেছে ক্ষতগুলো। ঘাম আর কাঁদা মিলে বিশ্রী এক অবস্থা। এতোক্ষণ উত্তেজনায় টের পাইনি। এর মধ্যে খাল থেকে পানি তুলে পায়ে ঢেলে দিলো মামুন।
শোয়া থেকে এক লাফে বসে পড়লাম। লবণ পানি লেগে দুই পায়ের কেটে যাওয়া জায়গাগুলোর জ্বালা আরও বেড়ে গেছে। আমার অবস্থা দেখে মামুন রীতিমতো অপ্রস্তুত। নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করছি। এসময় বেলায়েত সরদার বললেন, ও ভাই, আপনি ওঠেন। ভালো করে কাঁদা ধুয়ে নেন। পায়ের তালুর কাঁটাগুলো বের করতে হবে।
আমি খুব ক্লান্ত। ক্ষুধাও লেগেছে। একটু বিশ্রাম নিতে চাচ্ছিলাম। সরদারকে বললাম, কাঁটাগুলো পরে বের করলে হয় না? সরদার বললেন, ভেঙ্গে যাওয়া কাঁটাগুলোকে সময় দিলেই মাথায় চরে বসবে। মানে চামড়ার নিচে থেকে যাওয়া হেঁতাল কাঁটা আরও ভিতরে ঢুকে পড়বে। তখন কিন্তু অপারেশন করা লাগবেনে।
কথা না বাড়িয়ে দ্রুত হাত পা ধুয়ে নিলাম। ট্রলারের গলুই-এ গিয়ে বসলাম। সেফটি পিন নিয়ে কাজে বসে পড়লেন সরদার।
একে একে ১২টি কাঁটা বের করা হলো। সবগুলো হেঁতাল কাঁটা। এক জায়গায় কাঠের টুকরো ঢুকে আছে। সেটা বের করা যাচ্ছে না। সরদার বললেন, বড় করে শ্বাস নেন ভাই। দমটা বন্ধ করে রাখেন যতোক্ষণ পারেন। আমি দেখি কী করা যায়। বললাম, ব্যাথা পাবো না? আমার চারপাশে গোল হয়ে দাঁড়ানো অন্যরা। হাসছে। বললাম, ব্যাথাই তো লাগবে। ভয় পাওয়া যাবে না। আপনি হাত চালান।
শক্ত হাতে পায়ের তালুতে চাপ দিয়ে ধরলো মামুন। এক হাতে আমার পা ধরে আরেকটা চাপ দিলেন সরদার। জানটা বেরিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু কিছু করার নাই। কয়েক সেকেন্ড ভয়ঙ্কর ব্যাথা পেলাম। সেফটি পিন দিয়ে কাঠের টুকরোটিও বের করা হলো।
ভিতর থেকে অ্যান্টিসেপটিক নিয়ে আসলো একজন। গরম পানি মিশিয়ে পায়ের তালু ধুয়ে নিলাম। বোতলে করে স্যালাইন মিলিয়ে দিলো মামুন। বললো, একটু চুমুক দেন ভাই। আপাতত স্যালাইন লাগবে আপনার। বললাম, ক্ষুধা লাগছে। রান্না হইছে ট্রলারে?
সবাই সবার দিকে তাকাচ্ছে। ট্রলারে রেখে যাওয়া অন্যদের দিকে তাকিয়ে রান্নার খবর জানতে চাইলো মামুন। ওরা বললো, রান্নার কথা তো বলে যাননি! ক্ষেপে গেলেন সরদার। বকাঝকা করতে করতে উঠে গেলেন রান্নাঘরের দিকে। পিছে পিছনে হেঁটে গেলাম। রান্নাঘরের সামনে আমাদের শোয়ার জায়গায় উঠে বসলাম। বেলায়েত সরদারকে বললাম, ভাটা তো অর্ধেক হয়ে গেলো। এখন রান্না করবেন নাকী রওনা দিবেন?
খালের মাঝখানে নোঙ্গর করা আমাদের ট্রলার। তীব্র গতিতে নামছে পানি। ত্রয়োদশীর গোন। পানির স্রোতে নোঙ্গর উঠে যায় যায় অবস্থা। বললাম, রওনা দিয়ে যেতে যেতে যেতে রান্না করা যায় না? বললেন, বড় নদীতে যাওয়ার আগ পর্যন্ত রান্না করা যাবে। নদীর যা অবস্থা! পশুরে গিয়ে রান্নাঘর খোলা রাখা যাবে না। এখন প্রচুর রোলিং হচ্ছে।
ইঞ্জিন চালু হলো। সাথের নৌকাগুলো ছেড়ে দিলাম। ওরা স্রোতের সাথে তাল মিলিয়ে রওনা দিলো ভাটিতে। ট্রলার ছাড়লাম। হাল ধরে দাঁড়ালাম আমি। বেলায়েত সরদার আর মামুন মিলে রান্নার কাজ শুরু করলেন। বললাম, কী রান্না করবেন ভাই? সরদার বললেন, দেখা যাক।
নৌকাগুলোকে পাশ কাটিয়ে গেলাম। কয়েক মিনিটে পৌঁছে গেলাম। চাত্রী’র দোয়ায়। খাল ধরে দক্ষিণে আরও পনেরো মিনিট চললাম। ঘসিয়াঙ্গাড়ীর দোয়ায় এসে একটু দম নিলাম। সামনে কয়েকটি নৌকা দেখা যায়।
আমাদের দেখে দ্রুত ছোট খালের ভিতরে ঢুকে পড়লো ওরা। ভাবলাম একটু ধাওয়া করি। কিন্তু হাতে সময় নাই। আরও আড়াই ঘন্টা ভাটা আছে। সময়টা কাজে লাগাতে হবে। এর মধ্যে যতোদূর নামা যায় নামবো।
ঘসিয়াঙ্গাড়ীর দোয়া থেকে পশ্চিমে ঘুরলাম। মানে পশুর নদীটা এদিকেই। তিন বাঁক পার হয়ে পৌঁছালাম পশুর নদীর মুখে। ভাটার স্রোতে বেশ গতি পেয়েছে ট্রলার। শুরু থেকে মাত্র ৪৫ মিনিট সময় লাগলো। এর মধ্যেই রান্না শেষ করে ফেললেন সরদার। খিচুরির সাথে ডিম মিলিয়ে সেই খাবার প্লেটে করে এগিয়ে দিলো মামুন। বললাম, পশুরে উঠে একসাথে খাবো।
সরদার বললেন, পশুরে উঠে একসাথে খাবেন? পারবেন খেতে? ওই যে দেখেন, নদী কেমন গরম হয়ে আছে। ঢেউ দেখছেন? তাকিয়ে দেখি বিশাল বিশাল ঢেউ। সাধারণ কেউ হলে ভয় পেয়ে যাবে। আমি ভয় পাচ্ছি না। কিন্তু এটুকু বুঝি, ওখানে গেলে সোজা হয়ে বসতেও পারবো না। খাওয়া দাওয়া করা দূরের কথা। সেখানেই বিরতি নিলাম। একটি কেওড়া গাছের সাথে ট্রলার বেঁধে দুপুরের খাওয়া সেরে নিলাম।
তারপর ট্রলারের সবকিছু শক্ত করে বেঁধে ফেললো ওরা। হাঁড়ি পাতিল থেকে শুরু করে সবকিছু ভিতরে নিয়ে রাখলো। আমরা ট্রলার ছাড়লাম। সূর্য পশ্চিমে হেলে গেছে। আমরা পশুর নদীর উল্টোদিকে জঙ্গলটা আবছা দেখা যাচ্ছে। দূর থেকেও চেনা যাচ্ছে জায়গাটি।
পাশাখালী খাল ঘসিয়াঙ্গাড়ীর উল্টো দিকে। মাস্টার বাহিনী সেখান থেকে আত্মসমর্পণ করেছিলো। এখনও নাটা জাহাঙ্গীর ও নোয়া বাহিনীর দস্যুরা মাঝে মাঝে ওখানে আসে। কয়েকদিন থাকে। বিশ্রাম নিয়ে আবার চলেও যায়। মধ্য সুন্দরবনের বড় দস্যুদলগুলোর জন্য নিরাপদ জায়গা পাশাখালী।
ও ভাই যাবেন নাকী? বললাম, যাওয়ার ইচ্ছা ছিলো। কিন্তু এতো বড় বড় ঢেউ পারি দিয়ে যাওয়া যাবে না। ঝুঁকি হয়ে যাবে। সরদার বলেন, ভয় পাচ্ছেন ভাই? বললাম, ঝুঁকি নিতে রাজি আমি। কিন্তু বিনা কারণে ঝুঁকি নিবো না। আমাদের ওদিয়ে যাওয়ার আপাতত কোনো প্রয়োজন নাই। তাই এই গরম নদী পারি দিবো না এখন।
পশুরে উঠতেই ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি তৈরি হলো। এমন সময় যেকোনো খাল আর নদীর সংযোগস্থলে রোলিং থাকে। একটু কম বা বেশি হয়। কিন্তু এই মুহুর্তে যে পরিস্থিতি দেখছি তাতে আমরা যেকোনো সময় ডুবে যেতে পারি। বেলায়েত সরদার একটু বেখেয়াল ছিলেন। তাই একটি বিপদেই পড়লাম মনে হচ্ছে।
শক্ত করে ধরে বসেছি। আমাদের ট্রলার একবার ঢেউয়ের মাথায় যাচ্ছে। এরপর আবার চলে যাচ্ছে পানির নিচে। হুট করে এই পরিস্থিতির মুখে পড়লাম। সামাল দিতে দিতে সময় লাগলো প্রায় দশ মিনিট। এর মধ্যে পুরো ট্রলার ভিজে গেছে পানিতে।
এখনও গলুইটা ডুবছে আর ভাসছে। দখিণা বাতাস বেশ জোরেসোরে বইছে। অন্যদিকে ভাটার স্রোত নামছে উত্তর থেকে। বিপরীতমুখি স্রোত আর বাতাসের সংঘর্ষে রোলিং হচ্ছে, পরিস্থিতি অনেকটা নিয়ন্ত্রণের বাইরে। আগে বুঝলে এসময় বের হতাম না। জোয়ারে আবার নদীর পরিস্থিতি এমন থাকবে না।
বেশ কসরৎ করে ট্রলার নিয়ন্ত্রণে আনলেন বেলায়েত সরদার। আসলে নদীতে ঢুকে পড়লে আর ফিরে যাওয়ার উপায় থাকে না। ফিরে যেতে গেলে একই বিপদ পাড়ি দিতে হয়। তার চেয়ে এগিয়ে যাওয়া ভালো। আরও প্রায় দশ মিনিট পর পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসলো। আমরা এগিয়ে যাচ্ছি দক্ষিণে।
ট্রলার নিয়ে একদম জঙ্গলের কিনারে চলে আসলাম। ঢেউ এখানে একটু কম। তবে একদম বন ঘেঁষে চলতে গেলে নতুন বিপদ হতে পারে। পানির নিচে থাকা গাছের সাথে ধাক্কা খেতে পারে ট্রলার। সরদার বললেন, সেরকম ঝামেলা হলে নেমে জঙ্গলে উঠে বসে থাকবো ভাই। এখন নদীর মাঝখানে যাওয়া যাবে না।
বাম পাশে কাগা, বগা, ইন্দুরকানি, সিন্দুরকৌটা খাল পড়লো। ভাবলাম ঢুকে আবার অপেক্ষা করবো। কিন্তু সরদার বললেন, ডাকাতের দল এদিকে থাকতে পারে। দেখা হলে ঝামেলা বাড়বে। তারচেয়ে আমরা এগিয়ে যাই। যতোক্ষণ দিনের আলো পাবো ততোক্ষণ চলি। তারপর না হয় কোনো একটা খালে ঢুকে পড়বো। বললাম, তাহলে আর দাঁড়ানোর দরকার নাই। একটানে চলেন দুবলার চরে যাই।
হঠাৎ করে রোলিং একটু কমে আসলো। মামুন এসে বললো সবকিছু ভিজে গেছে। নদীর পানি উঠে গেছে ট্রলারে। বিছানা, বালিশ, কাঁথা, চাদর, আমাদের ব্যাগবোঁচকা সব ভিজে একাকার। নতুন বিপদের মধ্যে পড়লাম।
যেটুকু সময় রোদ আছে তাতে কাঁথা বালিশ শুকাবে না। রাতে থাকবো কী করে? মামুনকে বললাম, ভেজা জিনিষগুলো বের করো। মামুন বললো, কয়টা জিনিষ বের করবো ভাই? সবই তো ভিজে গেছে। বেলায়েত সরদার হেসে উঠলেন। সেই বিখ্যাত হাসি! বললেন, কীরাম হলো ভাই? বললাম, খুব ভালো হলো। বলেই সবাই একসাথে হেসে উঠলাম। মামুনের দিকে তাকাতেই বললো, আর বলা লাগবে না ভাই। চা বানাতে বসছি এখন।
এখন রান্নাঘর খুলিস না মামুন। সামনে চার গাঙ। মানে সামনে পশুর আর শিবসা নদীর মিলনস্থল। দখিনা বাতাস না কমলে ওই জায়গা আমরা পারি দিতে পারবো না। পশুরের পূর্ব ধারে আমরা। বরাবর পশ্চিমে ইলশেমারী খাল। তারপরও শেষ হয়েছে জঙ্গল। ওপাশ থেকে শিবসা নেমেছে, মিশেছে পশুরের সাথে। তারপর পশুর নামেই নদী নেমেছে সাগরে। এই চার গাঙ-এ আসলে এমনিতেই রোলিং-এ পড়ি। ভয় পাচ্ছি। না জানি কী হয়!
ঘন্টা খানেক চলার পর পড়লাম চার গাঙ-এ। বামে চলে গেছে কোকিলমনি খাল। এর দক্ষিণে তিনকোণা দ্বীপ। আরও দক্ষিণে গেলে মরা খাজুরে খাল। তবে পশুর ধরে আমরা এগুতে পারবো না। হুট করে ট্রলার ঘুরিয়ে দিলেন বেলায়েত সরদার। কোকিলমনি খালের ভিতর দিয়ে আমরা ঘন্টা খানেক চলবো। তারপর একটি কাটা খাল আছে। সেই খাল পারি দিয়ে উঠবো মরাখাজুরে খালে। সেই খাল ধরে আবার উঠবো পশুর নদীতে। বেশ ঘোরা পথ হলেও উপায় নাই। মৃত্যুঝুঁকি নেওয়া যাবে না। পশুর এখানে এতো বিশাল যে এপাশ থেকে ওপাশ পরিস্কার দেখা যায় না। ট্রলার ডুবলে বাঁচবো কী করে?
শেষ বিকালের রোদ। খুব ভালো লাগছে এখন। খালটি বড় হলেও রোলিং নাই। মামুনের হাতে সুকানি দিয়ে সরদার দিলেন ঘুম। মামুনের হাত থেকে হালটি নিয়ে দাঁড়ালাম আমি। এক কাপ চা-এর জন্য ছটফট করছি। আজকে কতোদূর এগুতে পারবো জানি না। নদী ঠান্ডা না হলে বিরতি নিবো এদিকেই। কোকিলমনি ফরেস্ট অফিস বা মরাখাজুরে খালেও রাত কাটাতে পারি। খালটি অসম্ভব সুন্দর।