রূপান্তরের গল্প ২৬০ | Rupantorer Golpo 260

জঙ্গল-সাগরে সান্ধ্য আইন | রূপান্তরের গল্প ২৬০

জঙ্গল-সাগরে সান্ধ্য আইন | রূপান্তরের গল্প ২৬০ | Rupantorer Golpo 260 | দস্যুমুক্ত সুন্দরবন | সুন্দরবনের গল্প | জীবনে ফেরার গল্প | Jibone Ferar Golpo | Sundarbaner Goppo | Story of Sundarbans | মোহসীন উল হাকিম | Mohsin Ul Hakim


রূপান্তরের গল্প ২৬০ : বড়শি খালের নিচে পড়ার আগেই টেনে নিচ্ছে মাছ। পর পর কয়েকটি তুলার ডান্ডি মাছ উঠলো। কেউ কেউ এই মাছকে বলে সাগর বেলে। মাথাটা সরু। তবে বাকীটা অনেকটাই বেলে মাছের মতো। হাত বড়শি নিয়ে বেশ বিপাকে আমি। টানের পর টান। এতো মাছ এখানে!

বড়শির আধার চিংড়ি মাছ। কিন্তু আমাদের কাছে আর চিংড়ি মাছ নাই। তাহলে মাছ ধরবো কী করে? এদিকে মাছ ধরার নেশায় পড়ে গেছি। মামুন বললো দেখতেছি ভাই।

তিনকোণা দ্বীপের দক্ষিণের খালে আমরা। লম্বায় কয়েক কিলোমিটার। চওড়া হবে প্রায় আধা কিলোমিটার। খালের দুই পাশে বড় কোনো শাখা খাল নাই। মাঝ বরাবর খাঁড়ি। বড়শি ফেলতে হয় এই খাঁড়িতে।

সুন্দরবনের পেশাদার বড়শির জেলেরা এখানে বড়শি ফেলে না। এখানে চরপাটা ছাড়া ফাঁস জাল বা বেন্দী জালও ফেলা হয় না। কারণ এই খাঁড়িতে বন্দরের পাইলট জাহাজ চলাফেরা করে। বড় নদীতে রোলিং থাকলে কখনও কখনও পর্যটকদের লঞ্চ নোঙ্গর করা হয়। আবার কোস্টগার্ডের চলাফেরাও এদিক দিয়েই চলে।

বড়শির আধার নিয়ে আমার দুশ্চিন্তা দেখে এগিয়ে এলো এক জেলে। বললো, আমাদের কাছে অনেক চিংড়ি আছে ভাই। কিন্তু সেগুলো ফেরির নৌকায় বরফে রাখা। কিছু চিংড়ি সাথে আছে। সেগুলো নরম হয়ে গেছে। ওতে কি চলবে? বললাম, মাছেরা নরম চিংড়ি বেশি ভালো খায়। একবার পঁচা চিংড়ি দিয়ে বড় জাবা মাছ ধরছিলাম।

গল্প করতে করতে নৌকা থেকে একটি থালায় করো কতোগুলো চিংড়ি মাছ দিলো জেলেরা। ধন্যবাদ জানিয়ে মাছ ধরা শুরু করলাম। সন্ধ্যার পর থেকে প্রায় দুই ঘন্টা একটানা মাছ উঠলো। তুলার ডান্ডি, বেলে, তোপসে, টেংড়া, ভোলা মাছে ভরে গেলো মাছ রাখার বালতি।

জেলেরাসহ আমরা মানুষ প্রায় কুড়ি জন। আরও কয়েকজন আসবে রাতে। ওই জেলেদের সহযোগিরা কয়েকজন আশেপাশে আছে। রাতেই এসে যোগ দিবে তারা।

ট্রলারের সাথে নৌকাগুলো বাঁধা আছে একটার পর একটা, চারপাশ দিয়ে। ভাসমান এই নৌকাগুলো দূর থেকে দেখতে অদ্ভুত সুন্দর লাগে। গায়ে গায়ে লাগানো থাকে নৌকাগুলো। একটা থেকে আরেকটাতে হেঁটে বেড়ানো যায়। একসাথে থাকলে মনে হয় একটি ভাসমান মহল্লা। নৌকাগুলোকে মনে হয় এক একটি ঘর। গ্রামের একটি ছোট বাড়িতে যা কিছু থাকে একটি নৌকাতেও সেগুলো থাকে। রান্নার চুলা, হাড়ি পাতিল, মসলা, পানি, কাঁথা-বালিশ, ওষুধ, চাল-ডালসহ কোনো কিছুই বাদ থাকে না। তবে সবকিছু থাকে পরিমিত।

জেলেরা বেশির ভাহ বিড়ি-সিগারেটে অভ্যস্ত। তবে নেশা বেশি পানের। পান সুপারি ছাড়া জেলেদের কোনো নৌকা দেখি না। এক সপ্তাহের জন্য বনে আসা জেলেদের চালডাল ফুরালেও পান সুপারি ফুরায় না। যদি কোনো কারণে পান-সুপারির ঘাটতি হয় তবে ওরা পাগল হয়ে যায়।

সুন্দরবনে নামার সময় অন্তত এক বিড়া পান আর কিছু কাঁচা সুপারি নিতে ভুলি না। পান পেলে জেলেরা যে কী খুশি হয়! দেখতে ভালো লাগে। গত রাতে চাত্রীর খালে অর্ধেকটা শেষ হয়েছে। এই রাতে বাকীটা শেষ হবে। আমাদের ট্রলারে এক শহীদুল কাকু ছাড়া আর কেউ পান খায় না। তাই নিজের জন্য রেখে বাকী পানগুলো জেলেদের দিয়ে দিলাম। ভীষণ খুশি তারা। হিসাব করে চলা ভাসমান সংসারে একটু সাচ্ছন্দ আনতে পারলে ভালো লাগে।

পানের দুশ্চিন্তা গেলো। জানতে চাইলাম, চালডাল আছে তো? বলতেই ট্রলারের স্টোর থেকে চালের বস্তা বের করা হলো। সবাইকে প্রয়োজন মতো চাল তুলে নিলো। আমাদের ট্রলারে বাড়তি খাবার থাকে সব সময়।

সন্ধ্যা থেকে অনেকগুলো মাছ ধরেছি। সেগুলো নিয়ে কোটাবাছা শুরু করলো জেলেরা। ওদিকে ত্রিশ জনের রান্নার প্রস্তুতি নিচ্ছেন সরদার। দুটি হাঁস ছিলো। তার সাথে একটি মোরগও মিলাতে হবে। সরদার বললেন, সবাই মিলে খাবো। কম কম খেলে হবে কী করে ভাই? বললাম, কোনো অসুবিধা নাই। সবগুলো হাঁস মুরগি প্রয়োজনে রান্না করে ফেলেন।

রান্না শুরু হলো জোরেসোরে। আজ হবে হাস-মুরগি মিলানো তরকারি। জেলেরা বললো, তাদের নৌকায় তারা ভাত রান্না করবে। সাথে কেওড়া দিয়ে হবে মাছের ঝোল। একজন দেখি ডালিতে করে কেওড়া ধুতে বসেছে।

জঙ্গলে রাতে খাওয়া দাওয়ার রীতি নাই। শুধু জেলেরা না। বনের বাসিন্দারা প্রায় সকলেই দুই বেলা ভাত খায়। সকালে ও বিকালে। সন্ধ্যা হয়ে গেলে জারি হয়ে যায় সান্ধ্য আইন।

সূর্য ডোবার আগেই জেলেরা খেয়ে নেয়। তারপর ঢুকে পড়ে সরু খালে। যতোটা সম্ভব ভিতরে ঢুকে পড়ে। যাতে বনদস্যুরা তাদের দেখতে না পায়। খালের মাথায় লুকিয়ে থাকা সময়টা তাদের দুর্বিসহ।

আমার আপনার পক্ষে ওই পরিশে থাকা সহজ না। আর জঙ্গলের ভিতরে, খালের মাথায় বাতাস থাকে না। অন্ধকার হলেও আলো জ্বালানোর নিয়ম নাই। বেড়েপোকা কামড়ায়। বাঘের ঝুঁকি থাকে প্রতি মুহুর্তে। জেলেরা বলে, এই বাদায় যদি বাঘ, কুমির আর সাপেরা আক্রমণ করতো তাহলে প্রতিদিন কয়েকশ’ লাশ পড়তো। বন্যপ্রাণিরা বিনা কারণে আক্রমণ করে না। ক্ষুধা না লাগলে বাঘ কাউকে মারতে আসে না।

বাঘ কুমিরের গল্প শুনতে ভালো লালে। জঙ্গলে বসে সেই গল্প শুনে বিমোহিত হই। কিন্তু সেই পরিস্থিতির সাথে বসবাস করা মানুষদের কাছে এগুলো বিভীষিকা ছাড়া আর কিছু না। আজ সকালে জঙ্গলের ভিতরে আমরা যে সময় কাটিয়েছে সেটিও ছিলো ভয়ঙ্কর। সুন্দরবনের জেলেরা এই বিপদের জীবন কাটায় বছরের পর বছর। কী করবে? পেট চালানো লাগবে না?

হাঁস আর মুরগি জবাই করে পালক ছাড়ানো হলো। কেটেকুটে পরিস্কার করতে সময় লাগলো মাত্র আধা ঘন্টা। সবাই মিলে হাত লাগালে কোনো কাজই কঠিন না। মাংস কেটে ধুয়ে নিলেন বেলায়েদ সরদার। এই কাজটি তিনি নিজ হাতে করেন। বলেন, মাছ বা মাংস ঠিকমতো পরিস্কার না হলে রান্না ভালো হয় না।

মাছ ধুতে হয় যতোক্ষণ আঁষটে গন্ধটা না যায় ততোক্ষণ। কিন্তু মাংস নাকী বেশি সময় ধুতে হয় না, সরদার বলেন এ কথা। তবে ধোয়ার কাজটা অন্য কাউকে দিয়ে শান্তি পান না সরদার। আমারও ভরসা সরদারের হাতেই।

ওদিকে ট্রলারের রান্নাঘরের সামনে মসলা বেটে প্রস্তুত রাখা। পেঁয়াজ, রশুন, আদাসহ সবকিছু রেডি। বাজারের ব্যাগের ভিতর থেকে চুঁইঝাল বের করা হলো। তার মানে চুঁইঝাল দিয়ে হবে হাঁ-মুরগির মিলানো ঝোল। সাথে থাকবে পাকা কেওড়া দিয়ে মাছের ভুনা। অবশ্য ভুনা হবে না ঝোল হবে সেটা এখনও বলা যাচ্ছে না। জেলেরা যা রাঁধবে সেটাই খাবো আজ।

গল্প আর রান্না একসাথে চলছে। আকাশে চাঁদ মাঝে মাঝে ঢেকে যাচ্ছে মেঘে। জোয়ার প্রায় শেষের দিকে। পানিতে টইটস্বুর খাল। কেওড়া গাছগুলো অর্ধেক ডুবে গেছে পানিতে। সেখানে রুছো মাছগুলো গাছের পোকা ধরে খাচ্ছে। মাঝে মাঝে পাঙ্গাস মাছ লেজের বাড়ি দিচ্ছে ওদিকেই। জেলেরা বলে, ভাদ্র-আশ্বিন মাসে কেওড়া পাকে। পাঙ্গাস মাছগুলো কেওড়া খেতে খালের তীরে আসে। এই মৌসুমে জোয়ারে যখন পানি বাড়ে তখন মাছের এমন খেলা দেখা যায়।

এই মাছ বড়শিতে ধরা যায় না? জেলেরা বললো, আপনি পারবেন না। তবে চরপাটা জালে এই মাছ ধরা পড়ে। ভোর রাতে মাছ তুলবো। বললাম, আপনাদের মাছ ধরা দেখবো। আমাকে নিয়ে যাবেন।

রাত এগারোটা। দূর থেকে টর্চ দিয়ে কেউ ইশারা দিচ্ছে। জেলেরা সবাই নড়েচড়ে বসলো। ভয় পেয়ে গেলো। বললাম, ভয় কীসের? এদিকে ডাকাত আসে? একজন বললো, ডাকাত কোথায় আসবে কেউ বলতে পারে?

সবাইকে আশ্বস্ত করলাম। বললাম, আমাদের কাছে ডাকাতরা আসবে না। আপনারা নিশ্চিন্তে থাকেন। টর্চ দিয়ে পাল্টা ইশারা দিলাম। এই ইশারার অর্থ তেমন কিছু না। ওরা যারাই হোক, পাল্টা ইশারা পেলে বুঝবে আমরা ভয় পাইনি। যখন বুঝবে ভয় পাইনি তখন ওরা উল্টো ভয় পায়। ঝামেলায় জড়াতে চায় না। কিন্তু যদি পাল্টা টর্চের ইশারা না দেই তবে ওরা ভাববে ভয় পেয়েছি।

রাতের বেলা দূর থেকে জেলেদের মতিগতি বুঝতে পারে বনদস্যুরা। ওরা দস্যু কী না জানি না। তবে মতিগতি দেখে মনে হচ্ছে দস্যু ওরা। ওদের কারণে পুরো সুন্দরবনে চলে সান্ধ্য আইন। সুন্দরবনে যতোদিন ওরা থাকবে ততোদিন সন্ধ্যার পর আলো জ্বালানোর উপায় নাই।

বনদস্যুরা একে একে আত্মসমর্পণ করছে। এখনও বেশ কয়েকটি দস্যুদল সন্ত্রস্ত করে রেখেছে উপকূল। আশা করছি ২০১৭ সালের মধ্যে আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে সুন্দরবরন দস্যুমুক্ত হবে। তখন উঠে যাবে সান্ধ্য আইন। শুধু সুন্দরবন না। পুরো বঙ্গোপসাগরের জেলেরা মন খুলে ঘুরে বেড়াবে। রাতে আলো জ্বলবে তাদের বহরে।

(২০১৬ সালের শেষ দিকের ঘটনা)

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top