কাগার আগায় ছুটলো ট্রলার | রূপান্তরের গল্প ২৬৪ | Rupantorer Golpo 264 | দস্যুমুক্ত সুন্দরবন | সুন্দরবনের গল্প | জীবনে ফেরার গল্প | Jibone Ferar Golpo | Sundarbaner Goppo | Story of Sundarbans | মোহসীন উল হাকিম | Mohsin Ul Hakim
রূপান্তরের গল্প ২৬৪ : বেলায়েত সরদারের মেজাজ খারাপ। ট্রলারটা ঠিকমতো মেরামত করতে পারেননি। অবশ্য কিছু করারও ছিলো না। সময়ের আগেই জোয়ারের পানি চলে আসলো। নদী-সাগরের এই এক সমস্যা। প্রকৃতি নিয়মে চললে সবকিছু ঠিক থাকে। একটু এদিক সেদিক হলেই বিপদ বাড়ে। ছয় ঘন্টা ধরে জোয়ার চলে।
সাধারণত খালের তীর পর্যন্ত পানি ওঠে জোয়ারের শেষ ঘণ্টায়। কিন্তু আজ প্রকৃতি সেই নিয়ম মানেনি। চার ঘন্টায় পানিতে ভরে গেছে খাল। তাই তড়িঘড়ি কাজ শেষ করা হলো। কোনো রকমে ট্রলারের ফাটল মেরামত করেছেন সরদার। পুটিং শুকানোর জন্য একটু সময় দরকার ছিলো। সম্ভব হয়নি। তার আগেই ভেসে গেছে ট্রলার।
আমরা কি নিচের দিকে যাবো? মানে সামনের ভাটায় কি দুবলার চরের দিকে আগাবো? আমার প্রশ্ন শুনে সরদার অবাক। বললেন, এতো বছর জঙ্গলে আসেন। আবহাওয়া দেখে বুঝতে পারছেন না যে সামনে বড় ঝড় আসবে? বললাম, তাহলে কী করবো আমরা? এখানেই থাকবো? নাকী অন্য কোথাও যাবো?
আমরা আছি তিনকোণা দ্বীপে, মরাখাজুরে খালে। এখান থেকে পশুর নদীর দূরত্ব খুব বেশি হলে দুই কিলোমিটার। বড় নদীর পাশে বলেই টালমাটাল আবহাওয়ার আলামত পেয়েছি আগেভাগে। গত দুই দিন ধরে জেলেরা খারাপ আবহাওয়ার কথা বলছে। কিন্তু আকাশ পরিস্কার থাকায় আমলে নেইনি। এখন বুঝতে পারছি বড় ঝড় মোকাবেলা করতে হবে আমাদের।
নেটওয়ার্ক না থাকায় এই ঝড়ের সবশেষ খবর নিতে পারছি না। এই আবহাওয়ায় আর নেটওয়ার্ক পাবো বলেও মনে হয় না। আগে জেলেদের কেউ কেউ সাথে রেডিও রাখতো। মোবাইল ফোনের যুগে এসে রেডিওর ব্যবহার আর নাই। এখানে মোবাইল ফোনের নেটওয়ার্কও নাই। তাই আবহাওয়ার সুনির্দিষ্ট খবর পাওয়ার উপায় নাই। নিজেদের নিরাপদ রাখতে হলে এখন অনেক বেশি সতর্ক থাকতে হবে।
সরদার বললেন, কোকিলমণিতে গিয়ে থাকবো। এখান থেকে ঘন্টা খানেক সময় চালালেই হবে। ওখানে বন বিভাগের অফিস আছে। কোস্টগার্ডের অফিসও আছে। কিন্তু আমি সেখানে যেতে চাই না। বিকল্প হিসাবে ঠিক করলাম কাগা বা বগা খাল। সুন্দরবনের ভিতরে এই খালগুলি অপেক্ষাকৃত নিরাপদ। সেখানে গিয়ে একটা সুবিধাজনক খাল দেখে ঢুকে পড়বো। ঝড়-বৃষ্টি না যাওয়া পর্যন্ত সেখানেই অবস্থান করবো।
গোছগাছ করে নিতে হবে। সেটা করতে গিয়ে দেখি আমাদের সবকিছুই ভেজা। মনে পড়লো, আগের রাতে পশুর নদীর চার গাঙ-এ রোলিং-এ পড়েছিলাম। কাঁথা, বালিশ, তোষক, চাদর আর আমাদের ব্যাগ-বোঁচকাগুলো বের করা হলো। কিন্তু রোদ না উঠলে এগুলো শুকাবে না। কী করবো এখন? সরদার বললেন, আপাতত কিছু করার নাই। আগামী দুই-একদিন ভেজা কাপড়েই থাকতে হবে।
কী বিপদের কথা! কিন্তু করবোই বা কী? আবহাওয়া এমন চেহারা নিবে তা তো বুঝিনি। বুঝলে ওই রাতে বড় নদীতে উঠতাম না। মামুন এসে কানে কানে বললো, ইঞ্জিন রুমের কাঁথা-বালিশগুলো শুকনা আছে। সেগুলো বের করে বাতাসে মেলে রাখা হলো।
চিৎকার চলছে। সরদারের মাথা এখনও গরম। ভয়ে মামুন আর শহীদুল কাকু গিয়ে ইঞ্জিন রুমে ঢুকেছে। একজন খোলের ভিতরে জমা পানি ফেলছে। আরেকজন ইঞ্জিন পরিস্কার করছে। ট্রলারের তলার ফাটল ভালো ভাবে মেরামত না করা পর্যন্ত সরদার ঠান্ডা হবে না। সত্যি বলতে এই নদী-সাগরে ফুটো ট্রলার নিয়ে বড় নদীতে নামা যায় না।
দুপুর ১২টা বাজে। ভরা জোয়ার। পানি উঠে গেছে জঙ্গলের ভিতর। আশেপাশে কিছু পাখি দেখছি। অন্য কোনো বন্যপ্রাণির অস্তিত্ব নাই। জঙ্গলের ভিতর হারিয়ে গেছে তারা। মনে একটা প্রশ্ন আগে থেকেই ছিলো। জোয়ারের সময় বন্যপ্রাণিরা কোথায় থাকে?
বাঘগুলো কি পানিতে ভিজে দাঁড়িয়ে থাকে? এক জেলে বললেন, বনের ভিতরে কিছু উঁচু জায়গা আছে। মাঝে মাঝে খোলা মাঠ আছে। ভরা জোয়ারে হরিণেরা সেখানে যায়। কিন্তু জলোচ্ছাস হলে বা ভরা জোছনার জোয়ারের সময় পানির মধ্যেই দাঁড়িয়ে থাকে হরিণ-শুকররা। এসময় সবচেয়ে আরামে থাকে বানররা। বাঘ কোথায় গিয়ে আশ্রয় নেয় কেউ বলতে পারে না।
প্রবীণ এক জেলে বললেন, ঝড় বা জলোচ্ছাসের সময় বন্যপ্রাণিরা মিলেঝিলে থাকে। তখন নাকী কেউ কাউকে আক্রমণ করে না। সত্যি তাই ঘটে কী না জানি না। তবে সুন্দরবনের মানুষদের কাছে এসব গল্প শুনতে ভালো লাগে।
গল্পে গল্পে সময় ভালোই কাটছিলো। কিন্তু সরদার এসে বাধ সাধলেন। বললেন, এখানে বসে কি তুফান খাবেন ভাই? ওই যে দেখেন, বৃষ্টি শুরু হয়ে গেছে। পূর্ব আকাশে কালো মেঘ। দূরে বৃষ্টি হচ্ছে। শেষ জোয়ারে বৃষ্টি ভয়ের না। তবে ঝড় আসলে জলোচ্ছাসের ভয় থাকে।
ট্রলার ছাড়লো। বড় নদী থেকে যতোটা সম্ভব দূরে সরে যেতে হবে। ঝড় জলোচ্ছাস থেকে সুরক্ষিত থাকতে হবে। সেজন্য ছোট খাল খুঁজবো। তবে তার আগে যাবো কাগা খালে।
তিনকোণা দ্বীপের দক্ষিণে আমরা। কোকিলমণি অর্থাৎ পূর্ব দিকে এ খালের শেষ প্রান্তে গিয়ে উত্তরে যেতে হবে। কোকিলমণির দোয়া হয়ে ঢুকে পড়লাম কাগা খালে। খাল এখানে বেশ বড়। তবে আরও এগিয়ে গেলে দুই পাশে ছোট ছোট খাল পড়বে। পানি আর বাতাসের চাপ থেকে রক্ষা পাবো। কিন্তু ভারী বৃষ্টি নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছি।
বেশ লম্বা সময় ধরে চলছি। দুই পাশের খালগুলোতে ডিঙ্গি নৌকা নোঙ্গর করা। বড়শির জেলে, কাঁকড়ার জেলে আর চরপাটার জেলেরা এসে আশ্রয় নিচ্ছে ছোট খালে। অন্য সময় হলে আমাদের দেখে পালাতো তারা। বৈরি আবহাওয়া বলে ভয় পেলো না। ওরা জানে, আমরাও বিপদে পড়ে ঢুকেছি খালে। এছাড়া বৈরী পরিবেশে বন বিভাগ বা কোস্টগার্ড টহলে বের হয় না, ওরা ভালো করেই জানে।
কাগা খাল থেকে পড়লাম বগা খালে। দুই খালের মোহনা থেকে পূর্ব দিকের খালে ঢুকলো ট্রলার। এদিক দিয়ে অন খালে বেরুনো যায় না। আমরা শেষ দিকে গিয়ে নোঙ্গর করবো।
সুন্দরবনে কাগা নামে তিনটি খাল চিনি। পশুরের পূর্বে এই খালের নাম কাগা। আরেকটু দক্ষিণে হংসরাজ নদীর ভাটিতে কাগা নামে আরেকটি মাঝারি খাল আছে। আরেকটু পশ্চিমে আড়পাঙ্গাসিয়া নদীতে কাগা দোবেকী নামে আরেকটি খাল আছে। সেখানে কোস্টগার্ডের পোস্ট আছে। বাটলো নামের একটি নদী আছে সেখানে। অভয়াশ্রম হলেও মাছে ভরপুর সেই নদীতে ফাঁস জাল দিয়ে বড় মাছ ধরে জেলেরা।
বর্ষায় মাঝে মাঝে মেধ মাছের ঝাঁক ধরা পড়ে। সেই লোভে জেলেরা ওই নদী সারা বছর দখলে রাখে। পশ্চিমের বড় দস্যুদল জাহাঙ্গীর বাহিনী এই অঞ্চল নিয়ন্ত্রণ করে। জাহাঙ্গীরের বিশ্বস্ত মহাজনেরা ব্যবসা করে পশ্চিম সুন্দরবনের ওই অঞ্চলে। আমরা যেদিকে আছি, মানে পশুরের পূর্ব দিকের খাল-নদী নিয়ন্ত্রণ করে বড় সুমন বাহিনী।
খালের আগায় পৌঁছে গেছি। দূর থেকে জেলেদের দৌড়ঝাঁপ দেখতে পাচ্ছি। অনেকগুলো নৌকা গায়ের সাথে গায়ে বাঁধা ছিলো। এখন সবাই ছড়িয়ে গেছে। খুব ভয় পেলে যা হয়। কাছে গিয়ে দেখি নৌকা রেখে জঙ্গলে উঠে গেছে অনেকে।
ট্রলার থামালাম। হাঁকডাক দিয়ে জেলেদের ভয় কাটানোর চেষ্টা করলাম। নৌকায় যারা ছিলো তাদের ভয় কেটেছে। কিন্তু জঙ্গলে পালিয়ে যাওয়া জেলেরা ফিরছে না। ওরা এতো ভয় পেলো কেন?
কয়েকটি দস্যুদল আত্মসমর্পণ করেছে। কিন্তু জেলেরা বলে, ডাকাত কমলেও ডাকাতি কমেনি। বরং টুকরো টুকরো হয়ে জেলেদের ওপর অত্যাচার করছে দস্যুদলগুলো। তার মানে বিপদ কমেনি এখনও।
আধা ঘন্টার মধ্যে জড়ো হলো জেলেরা। নৌকাগুলো বেয়ে ট্রলারের চারপাশে বেঁধে ফেললো। দারুণ এক পরিবেশ। এদিকে দুপুর গড়িয়ে গেছে। তিনটার মতো বাজে। অর্ধেক ভাটা হলো। কিন্তু খালে পানির চাপ কমেনি।
জেলেরা তাদের নৌকাগুলো আগা-গোঁড়া পলিথিন দিয়ে ঢেকে ফেলেছে। এদিকে ট্রলারের ভিতর থেকে ত্রিপল বের করেছে মামুন। শহীদুল কাকুকে সাথে নিয়ে সেই ত্রিপল টানালো মামুন। বড় ঝড়ে টিকে থাকতে হবে। তাই শক্ত করে ত্রিপল বাঁধা হলো। আগা মাথা ঢেকে গেলো আমাদের ট্রলার।
রান্নাঘরের দরজা খুলে বসলেন বেলায়েত সরদার। ভাত রান্না হবে পরে। তার আগে চুলায় কড়াই তুলে চাল ভেজে নিলাম। রশুন, পেঁয়াজ, লবণ আর কাঁচা মরিচ দিয়ে মাখানো হলো। ক্ষুধা পেটে সেই চাল ভাজা অমৃতের মতো লাগছে। নৌকা থেকে জেলেদের ডেকে আনলাম। এদিকে বৃষ্টি শুরু হলো। বড় বড় ফোঁটায় অঝর বৃষ্টিতে বদলে গেলো চারপাশ।
বিকাল হওয়ার আগেই সন্ধ্যা নামলো। মেঘ-বৃষ্টি আর ঝড়ো বাতাসে দুলছে পুরো সুন্দরবন। সাথে দুলছি আমরা। বাতাসের ঝাপটায় মাঝে মাঝে গায়ে এসর পড়ছে বৃষ্টির ছিটা।
(২০১৬ সালের শেষ দিকের ঘটনা)