ঘুর্ণিঝড়ের রাত! | রূপান্তরের গল্প ২৬৫ | Rupantorer Golpo 265 | দস্যুমুক্ত সুন্দরবন | সুন্দরবনের গল্প | জীবনে ফেরার গল্প | Jibone Ferar Golpo | Sundarbaner Goppo | Story of Sundarbans | মোহসীন উল হাকিম | Mohsin Ul Hakim
রূপান্তরের গল্প ২৬৫ : মুষলধারে বৃষ্টি আমার এমনিতেই ভালো লাগে। আর সেই বৃষ্টি যদি হয় সুন্দরবনের গহীনে তাহলে তো কথাই নাই। কাগা খালের আগায় আমাদের ট্রলার আর নৌকা বহর নোঙ্গর করা। চলছে গরম গরম চাল ভাজা আর চায়ের আড্ডা। আমার জন্য বড় মগ ভর্তি দুধ চা তৈরি করলো মামুন। এই বৃষ্টি আর বাতাসের মধ্যে দাঁড়িয়ে সেই চা উপভোগ করছি।
ট্রলারের ছাউনির নিচে সবাই। গায়ের সাথে গা লাগিয়ে দাঁড়িয়ে আছি। ঘাম আর বৃষ্টির পানিতে একাকার জেলেদের শরীর। পেশীগুলো পাথরের মতো কঠিন। আমার শহুরে শরীরের সাথে লেপ্টে আছে তারা। ভালোই লাগছে। ভাবছি, কী কষ্টের জীবন!
তবুও মুখ ভর্তি হাসি। ঠকঠক করে কাঁপছে তারা। প্লাস্টিকের কাপ হাতে হাতে। চলছে কড়া চা-এ চুমুক। এই আবহাওয়ায় এক কাপ চা ওদের জীবনী শক্তি বাড়িয়ে দেয়। তবে সেই চা হতে হবে র’। একদম কড়া লিকার। কিছুক্ষণের মধ্যে কাঁপুনী থামলো। শুরু হলো গল্প।
বেলায়েত সরদার বেশ দুশ্চিন্তায় আছেন। কী একটা কারণে মামুন আর শহীদুল কাকুকে সমানে বকাঝকা করছেন। মামুনকে ডেকে জিজ্ঞেস করলাম, হইছে টা কী? সে বললো, ত্রিপল বাঁধার সময় ট্রলারের সামনের দিকে রাখা বরফের কেবিনটি মালপত্রের নিচে চাপা পড়ে গেছে। তার মানে এখন আর সেই কেবিন খোলার উপায় নাই। এই বেলায় মাছ খাওয়ার কথা ছিলো। কিন্তু আপাতত বরফের সেই কেবিন খোলার উপায় নাই।
সন্ধ্যা হয়ে গেছে। চারপাশ কেমন জানি অচেনা লাগছে। ভাটা শেষ হলেও তলানিতে নামেনি খালের পানি। কেবিন থেকে মাছ বের করতে পারছি না দেখে জেলেরা বললো মাছ ধরতে নামবে। এখন খালে জাল টানলে নাকী মাছ ডাওয়া যাবে।
অনুরোধ করলাম। চিৎকার করলাম। বললাম, এখন কেউ বনে নামবেন না। কিন্তু কথা শুনলো না কেউ। বলতে বলতে খালে নেমে পড়লো তিনজন। ঝাঁকি জাল নিয়ে কোমড় পানি ডিঙ্গিয়ে চলে গেলো সরু এক খালের মধ্যে। সরু বলতে একদম ছোট্ট একটি খাল। মাথায় টর্চলাইট বেঁধে জাল টানলো ওরা। আধা ঘন্টা পর মাছ ভর্তি একটি বাজারের ব্যাগ নিয়ে ফিরলো ট্রলারে।
বেশ কয়েকটি বড় বড় দাতিনা আর পায়রা মাছ, প্রায় পাঁচ কেজির মতো চিংড়ি আর পারশে মাছ ধরেছে জেলেরা। পারশে মাছগুলো আলাদা করে জিইয়ে রাখলো নৌকায়। এগুলো বড়শির আধার হিসাবে ব্যবহার করবে তারা। বাকী মাছগুলো নৌকায় বসে কেটে-বেছে সরদারের হাতে তুলে দিলো।
এবার বেলায়েত সরদারের মাথা ঠান্ডা হলো। মনের মতো করে একবেলা রান্না করতে না পারলে তার আবার ভালো লাগে না।
মাটির নোঙড়ায় মসলা বাটা চলছে। সরদারকে বললাম, আপনারা শিল-পাটা ব্যবহার করেন না কেন? বললেন, নদীর উপর বসে শিল-পাটায় মসলা বাটা যায়? একটু ঢেউ আসলেই তো উল্টায়ে যাবে সব। এছাড়া এই নোঙড়া হলো গামলার মতো। নৌকা দুললেও মসলা পড়বে না। সুন্দরবনের মানুষ প্যাকেট মসলা খায় না ভাই।
একবেলা খেলেও করলেও জেলেরা বাটা মসলাতেই রান্না করে। এছাড়া সুন্দরবনের মানুষ ঝালও বেশি খায়। তাই শুকনা মরিচ বলেন বা কাঁচা মরিচ, সবই এই নোঙড়ায় ফেলে বাটা হয়। সব মসলা যখন একসাথে হয় তখন বেশ সুঘ্রাণ ছড়ায় চারপাশে।
সুন্দরবনের জেলেরা টাটকা মাছ খায়। সেজন্য অনেক বেশি মসলা লাগে না। কিন্তু কিছু মাছ আছে যেগুলো রান্না করতে হলে মাংসের মতো মসলা ব্যবহার করতে হয়। টেংড়া, মেধ, মোচন মাছে কড়া মসলা না দিলে ভালোই লাগে না।
জানতে চাইলাম, আজকে কী কী রান্না করবেন? এতো মসলা কেন? সরদার বললেন, দাতিনা আর পায়রা মাছের স্পেশাল একটা রান্না হবে। চিংড়ি আর শাক দিয়ে হবে নরম তরকারি। আপনারা ডাল খেতে চাইলে সেটাও করে দিতে পারবো। বললাম, থাক থাক। আর আইটেম বাড়ানো লাগবে না। এই দিয়েই চলবে।
সরদার বললেন, কেমন করে চলবে? খাবো কি শুধু আমরা ট্রলারের এই কয়জন? ওই জেলেরা খাবে না? এই বৃষ্টির মধ্যে ওরা রান্না করতে পারবে? চুলা জ্বালাতে পারবে? বলেই জেলেদের মাথা গণতে লাগলেন। বহরের এমাথা ওমাথা হিসাব করে দেখলাম, মানুষ আমরা মোট ১৯জন। ঝড়-বাদলের এই সন্ধ্যায় মোটামুটি বনভোজনের পরিবেশ তৈরি হলো।
শোঁশোঁ আওয়াজ হচ্ছে। বাতাসের বাড়ছে ক্রমেই। ঝাপটায় দুলে উঠছে ট্রলার। নৌকাগুলো নিচে বলে বাতাস লাগছে না। আবার পলিথিন এমন ভাবে দেওয়া যে ভারী বৃষ্টির পানিও ভিতরে পড়ছে না। নিল রঙ এর পলিথিনের ভিতরে টিমটিম করে জ্বলছে বাতি। নৌকাগুলোতে একজন করে আছে। ঝড়-বৃষ্টি যাই আসুক নৌকা খালি রাখে না সুন্দরবনের মানুষ।
এই রাতে কী হবে কে জানে? বুঝতেই পারছি যে সাইক্লোন আঘাত করছে উপকূলে। বাতাসের বেগ দেখে মনে হচ্ছে খুব বেশি সময় নাই। জেলেরা বললো, লম্বা সময় ধরে চলবে। বাতাস এখনও বইছে উত্তর পশ্চিম দিক থেকে। পূবের বাতাস যখন শুরু হবে তখন বুঝবে পারবেন যে মূল ঝড় আমাদের উপর দিয়ে পার হচ্ছে। সাইক্লোন পার হয়ে গেলে উত্তরের বাতাস শুরু হবে। তখন বুঝবেন যে আবহাওয়া পরিস্কার।
রান্না হলো। ভাত-তরকারি একসাথে বেড়ে সবার হাতে হাতে প্লেট তুলে দিলো মামুন। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে খেয়ে নিলাম। ট্রলারে বসার জায়গা নাই। তার মধ্যে সবকিছু ভিজে আছে। আমাদের খাওয়া শেষ হলে নৌকায় থাকা জেলেদের কাছে প্লেটে করে খাবার পাঠানো হলো।
প্লেট পাঠানোর সময় বৃষ্টির পানিতে ভিজে গেলো ভাত-তরকারি। জেলেরা বললো, এটা তো বৃষ্টির পানি। লবণ পানি তো আর না। কতো অল্পে তুষ্ট মানুষগুলো!
রাত গভীর হলো। বৃষ্টির চাপ আরও বাড়লো, বড় বড় ফোঁটা। মনে হচ্ছে বৃষ্টির ফোঁটায় সবকিছু ভেঙ্গে পড়বে। এই মুহুর্তে কিছু করারও নাই। মামুন বললো, মজবুত করে ত্রিপল বেঁধেছে সে। ট্রলার ভাঙ্গবে কিন্তু ত্রিপল ছুটবে না।
ওদিকে ট্রলারের খোলে পানি জমছে। একটু পর পর শহীদুল কাকু পানি ফেলছেন। সরদার, আমি আর অন্য সহযাত্রীরা ব্রিজ-এর উপর বসা। ছাদ চুঁয়ে পানি পড়ছে। সামনে কাঁচ দিয়ে ঘেরা। বাতাসের চাপে একটা কাঁচ গেলো ভেঙ্গে। ট্রলারের এই জায়গাটি একটু শুকনা ছিলো। পানিতে ভিজে গেলো।
কী করবো এখন? সরদার বললেন, কী আর করবেন? সারা রাত ভিজতে হবে! বললাম, আপনারা পারলে আমিও পারবো। এক জেলে বললো, বেশি সমস্যা হলে আমাদের নৌকায় চলেন মামা। বললাম, লাগবে না মামা। এখানেই থাকা যাবে। গায়ের ভেজা কাপড় শুকানো নিয়ে টেনশন করছি না। আমাদের সবকিছুই পানিতে ভিজে গেছে। কাঁথা বালিশ একটাও শুকনা নাই। সবশেষ এই জায়গাটুকু ছিলো সেটাও ভিজে গেলো।
ভেঙ্গে যাওয়া কাঁচের জানালা দিয়ে এখনও পানি ঢুকছে। ডেক-এর উপর বিছানো তোষক আর বালিশও ভিজেছে। পুরো একবেলা রোদ পেলেও শুকাবে না। জেলেরা বললো, রাতের মধ্যে এই তুফান চলে যাবে। সকাল থেকে ভালো রোদ পাওয়া যাবে। আর কালকে যে রোদ উঠবে তা দিয়ে এক বেলায় সব শুকিয়ে যাবে। ভাবছি সেই সময় পর্যন্ত টিকে থাকতে হবে! কষ্ট হলেও পারবো। না পেরে উপায় নাই।
খাওয়া দাওয়া শেষে জেলেরা ফিরে গেলো নৌকায়। ওই বৃষ্টির মধ্যেই নেমে পড়লো বড়শি গোছানোর কাজে। আধার গেঁথে তৈরি থাকবে। ঝড়-বৃষ্টি কমলেই বড়শির খ্যাওন দিবে বড় খালে। জেলেরা বললো, কাল রোদ উঠলে মাছ হতে পারে।
এই মানুষগুলোর পুরো জীবন মাছ মাছ করে কাটে। জীবনের পুরোটাই দিয়ে দেয় বনে জঙ্গলে। মাছও পায়। কিন্তু এতো দামি সম্পদ আহরণ করলেও তাদের ভাগ্যের পরিবর্তন হয় না। বারো ভূতে সব খেয়ে ফেলে।
অন্ধকারের মধ্যে তীব্র গতিতে বইছে ঝড়। একটানা ভারী বৃষ্টি হচ্ছে সেই সন্ধ্যা থেকে। এখন মধ্যরাত। জেলেরা ভিজছে গহীন এই বনের ভিতরে। এখানে বাঘ-কুমিরে মানুষ টেনে নেয়। লবণ পানির এই জগতে মিশে যায় জেলেদের ঘাম। চোখের পানি শুকিয়েছে আগেই। মাঝে মাঝেই রক্ত ঝরে। মানুষ হয়ে যায় বাঘ-কুমিরের খাবার। জঙ্গলে আসলে ডাকাতে ধরে। মারপিট খেতে হয়। সূদে ধার নিয়ে দিতে হয় মুক্তিপণ।
আমিও ভিজছি জেলেদের সাথে। সবাই ভিজে একাকার। জানি না আবার কখন শুকনা কাপড় পড়তে পারবো। একটা শুকনা বালিশে মাথা রাখার জন্য শরীর মন ব্যাকুল! কিন্তু সুযোগ হচ্ছে না। শরীর জুড়ে ভর করেছে ঘুম।
ডেক-এর উপর পা ঝুলিয়ে বসে আছি। ঝড় বাদলের মধ্যে জেলেদের ব্যস্ততা দেখছি। বৃষ্টিতে ভেজা মানুষগুলোর প্রাণশক্তি দেখছি। ওদিকে এদের মহাজনেরা নিশ্চয়ই শুকনা খাটে, শুকনা বালিশে আয়েশ করে শুয়ে আছে।
উপকূলে সাত নম্বর বিপদ সংকেত চলছে। একটি সাইক্লোন অতিক্রম করছে সুন্দরবনের ওপর দিয়ে। ছোট খালে ছিলাম বলে টের পাইনি সেই ঘুর্লিঝড়ের তান্ডব। প্রতিটি সাইক্লোনের একটা নাম থাকে। সেটাও জানতে পারিনি।