লাল পতাকা! | রূপান্তরের গল্প ২৬৬ | Rupantorer Golpo 266 | দস্যুমুক্ত সুন্দরবন | সুন্দরবনের গল্প | জীবনে ফেরার গল্প | Jibone Ferar Golpo | Sundarbaner Goppo | Story of Sundarbans | মোহসীন উল হাকিম | Mohsin Ul Hakim
রূপান্তরের গল্প ২৬৬ : সকাল সাতটা বাজেনি। তবুও মনে হচ্ছে বেলা হয়ে গেছে। চারপাশ ঝলসে যাচ্ছে আলোয়। সূর্য উঠেছে দুই দিন পর। পরিস্কার আকাশ। সুন্দরবনটাকে এখন কী যে সুন্দর লাগছে! কড়া রোদ পড়েছে জঙ্গলে ওপর। বৃষ্টিতে পুরো বন মনে হলো নতুন করে প্রাণ পেয়েছে।
আমাদের ট্রলারের চেহারা দেখে মনে হচ্ছে কোনো বাসা বাড়ির ছাদ। ত্রিপল নামিয়ে ভেজা কাঁথা-বালিশগুলো চড়ানো হয়েছে ছাদে। কাপড়গুলো নেড়ে দেওয়া দুই পাশ দিয়ে। আর ভেজা ব্যাগগুলো রাখা হয়েছে ডেক-এর উপর। যে রোদ উঠেছে তাতে এক বেলায় সবকিছুই শুকিয়ে যাবে মনে হচ্ছে।
সাত সকালে আমার লুঙ্গি আর গামছা শুকাতে দেয় মামুন। আধা ঘন্টার মধ্যে সেগুলো শুকিয়ে গেলো। পুরো একদিন পর শুকনা কাপড় পড়লাম। বিস্কিটের সাথে এক কাপ গরম চা এনে হাতে ধরিয়ে দিলো শহীদুল কাকু। আরাম পেয়ে বসলো শরীরটা। হেলান দিয়ে বসে পড়লাম ট্রলারের গলুইয়ে। ওদিকে জেলেরাও তাদের ভেজা কাপড়গুলো নেড়ে দিয়েছে শুকানোর জন্য।
জোয়ার শেষ হয়ে ভাটা লেগেছে। জঙ্গলের ভিতর থেকে সরসর করে নামছে পানি। সাথে নামছে ভাঙ্গা গাছের ডাল পাতা। কাদা মেশানো পানি। জোয়ারের সময় জঙ্গলের ভিতরে উঠে পড়া পানিগুলো নামছে। ঘোলা হয়ে গেছে খালের পানি। আমরা আছি কাগা-বগা খালের আগায়।
বইশেলদের মনে শান্তি নাই। কারণ ঘোলা পানিতে মাছে বড়শি খাবে না। তাই সকালের খ্যাওন দেয়নি তারা। নদী-খালের পানি পরিস্কার হতে একটু সময় লাগবে। অন্তত দুই দিন। সে পর্যন্ত কাজ নাই। কিন্তু সময় তো কাটাতে হবে। পুরো দুই দিন বসে বসে কী করবে তারা?
ওরা বললো, ঝাঁকি জাল দিয়ে মাছ ধরবে। সাথে বরফ আছে। মাছ যা পাবে সব রেখে দিবে। মহাজনের ফেরির নৌকা আসলে তাতে তুলে দিবে। একদম বসে থাকার চেয়ে কিছু মাছ ধরতে পারলে হাত খরচটা উঠবে। কপালে বড় কোনো মাছ পড়ে গেলে চালানও উঠে যেতে পারে। সেই সুযোগ সুন্দরবনে আছে। কারণ বড় মাছগুলো এখানে ছোট মাছ খেতে আসে সরু খালগুলোতে।
সুন্দরবনের ভিতরে এরকম কাজবিহীন সময়ে জেলেরা কিছু অপকর্ম করে। আর কিছু না হলেও পাখি শিকার করে। সাথে শিকারের সরঞ্জাম থাকলে হরিণও ধরে বসে তাদের কেউ কেউ। সুন্দরবনের মানুষদের ছোট বেলা থেকেই শিকারের অভ্যাস থাকে।
অপরাধ প্রবণতা কমবেশি এদিকের মানুষের মধ্যে আছে। তবে বড়শি আর কাঁকড়ার জেলেদের মধ্যে শিকারের প্রবণতা বেশি। সুন্দরবনের অপরাধ জগতে বন্যপ্রাণি শিকার ডাল-ভাতের মতো। বিশেষ করে দস্যু কবলিত এই গহীন বনে শিকারীদের ধরবে কে?
মাছ-কাঁকড়া শিকার সুন্দরবন উপকূলের মানুষদের কাছে বৈধ রোজগারের পথ। চোরা শিকারীরাও বনের হরিণ মেরে পেট চালায়। এই শিকার অবৈধ। আবার এই শিকারীরা মাঝে মাঝে নিজেরাই শিকারে পরিণত হয়। সুন্দরবনের বাঘ আর কুমিরের আক্রমণে মৃত্যু এখানে স্বাভাবিক বিষয়। তবুও পেট চালাতে আসতে হয়। জীবন বাজি রাখা এখানে নৈমিত্তিক বিষয়। বেঁচে থাকতে হবে। তাই বৈধ মাছ শিকারী বা অবৈধ হরিণ শিকারীরা সতর্ক থাকে। জীবন রক্ষার বাকী দায়িত্ব ছেড়ে দেয় সৃষ্টিকর্তার ওপর। যে যার ধর্ম মতো কিছু নিয়ম-কানুনও মেনে চলে।
সুন্দরবনের জেলেদের নৌকায় লাল কাপড়ের টুকরো দেখি। কেউ পতাকার মতো করে বেঁধে রাখে। কেউ গলুইয়ে ঝুলিয়ে রাখে। আবার কেউ কৌটার মধ্যে রেখে দেয়। পাশের নৌকাগুলোতেও দেখছি সেই লাল কাপড়। গত রাতে বৃষ্টি ছিলো! পলিথিন দিয়ে ঢাকা ছিলো বলে দেখতে পাইনি।
জেলে বহরের প্রতিটি নৌকায় পতাকার মতো উড়ছে লাল কাপড়ের টুকরা। জেলেরা বলে, নোয়াপাড়ার পীর সাহেবের পড়ে দেওয়া এই রুমাল তাদের জীবন বাঁচায়। বাঘ-কুমির, বনদস্যু আর বৈরী প্রকৃতি থেকে বাঁচতে প্রায় প্রত্যেকে এই রুমাল নিয়ে আসে।
সুন্দরবনে আরও কিছু রীতি প্রচলিত আছে। যেমন বন বা সাগরে জেলেরা পাকা কলা আনে না। শুক্রবারে নৌকা ছেড়ে জঙ্গলের মাটিতে নামলে অঘটন ঘটে। সেই বিশ্বাস থেকে কেউ কেউ সপ্তাহের এই দিনে নৌকায় থাকে। বনের ভিতরে নামে না।
জেলেরা বলে, শুক্রবারে বনে ঢুকলে অবশ্যই কোনো না কোনো বিপদ হবে। বাঘে খাওয়ার ঘটনাগুলো নাকী বেশির ভাগই শুক্রবারে ঘটে। পীর সাহেবের দেওয়া লাল কাপড় তাদের জ্বিন-ভুতের হাত থেকেও রক্ষা করে বলে বিশ্বাস করে বেশির ভাগ জেলে।
সনাতন ধর্মাবলম্বীরা বনে প্রবেশের সময় বনবিবির পূজা করে। ধর্মের অন্য রীতিও মেনে চলে অনেকে। সুরক্ষিত থাকতে যে যার সৃষ্টিকর্তার ওপর অবিচল আস্থা রাখে। সুন্দরবনের মানুষদের মধ্যে মুসলিম, সনাতন ও খৃষ্টান ধর্মের মানুষদের দেখেছি। অসাধারণ, অনন্য সম্প্রীতির পরিবেশ এখানে। প্রত্যেকে প্রত্যেকের ধর্ম পালন করে। সবাই সবাইকে সম্মান করে, সহযোগিতা করে।
একবার রমজান মাসের সন্ধ্যায় আমাদের ট্রলারের পাশে এসে ভিড়লো একটি কাঁকড়ার নৌকা। দুজনের একজন মুসলমান, আরেকজন সনাতন ধর্মের। ইফতারের সময় খাবার পানি, ভাত বেড়ে এগিয়ে দিলেন সনাতন ধর্মের মানুষটি। সাতক্ষীরা সুন্দরবনের খাশিটানা খালে আমরা যাত্রা বিরতি নিয়েছিলাম।
নৌকার আরেক পাশে বসে তিনি নিজের ধর্মীয় আচার পালন করলেন। প্রার্থণা শেষে দুজন একাসাথে বসে খাবার খেলেন। তারপর আবার চলে গেলেন কাঁকড়ার দাওন তুলতে। এদিকে সম্প্রীতির কোনো অভাব নাই। মাঝে মাঝে মনে হয় এই উদাহরণ তুলে ধরি তথাকথিত শিক্ষিত মানুষদের সামনে। যারা মানুষে মানুষে বিভেদ তৈরি করে, যারা বিভেদ লালন করে তারা এই সম্প্রীতি দেখলে নিশ্চয়ই লজ্জা পাবে।
সুন্দরবনে ভুত দেখে ভয় পাওয়া মানুষদের কাছে গল্প শুনেছি। শুনেছি গুণীনরা বাঘকে বশ করতে পারে। আগে গুণীনদের কদর ছিলো। শুনেছি মন্ত্র দিয়ে তারা বাঘকে বশ করতে পারে।
কয়েক জন গুণীনের সাথে পরিচয় আছে। কিন্তু এখন তারা আর বনে আসেন না। বাঘ বশের কাজও ছেড়ে দিয়েছেন অনেক আগেই। বনজীবীদের মধ্যে প্রবীণরা বলেন, গুণীনরা বাঘকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। কিন্তু আজকালের তরুণরা তা বিশ্বাস করে না। আমারও বিশ্বাস হয় না। তবুও একবার একজন গুণীনের সাথে সুন্দরবনে আসতে চাই। দেখতে চাই কী করেন তাঁরা!
সুন্দরবন রহস্যময়। যেখানে আমাদের জানা শেষ হয়। সেখান থেকেই শুরু রহস্য জগতের। অপরূপ সুন্দরবনের রহস্যময় বিষয়গুলোর পেছনে ছুটতে ইচ্ছা করে। কিন্তু আমি কাজ করছি বনদস্যুদের নিয়ে। সেই কাজে বার বার বনে আসি। অনেক কিছু দেখি চারপাশে। অনেক বিষয়ে গভীর ভাবে জানতে ইচ্ছা করে। কিন্তু বনদস্যুদের সাথে দৌড়াতে গিয়ে বনজীবিদের জীবন আর সুন্দরবনের রহস্যগুলোর পেছনে হাঁটা হচ্ছে না।
রোদের তাপ আরও বেড়েছে। আকাশে মেঘ নাই বলে সূর্যের উত্তাপে পুরো শরীর পুড়ে যাচ্ছে। নৌকার ওপর একটি চাদর টানিয়ে দিলো একজন। ঝিরিঝিরি বাতাস এখন দারুণ ভালো লাগছে।
জেলেদের সাথে লম্বা সময় ধরে গল্প করলাম। এর মধ্যে সকালের নাস্তা হলো। পাতলা খিচুরি আর মরিচ পোড়া। সবাই মিলে খেয়ে নিলাম। আরও ঘন্টা এখানেই থাকবো। একজন জেলে ভাই আদা দিয়ে র’ চা বানিয়ে আনলো। একজন আনলো শুকনা সুপারি দিয়ে পান। আরেক জেলে বের করলো পাতার বিড়ি। এক রাতে আমাদের মধ্যে বন্ধুত্ব হয়ে গেছে।
জেলেরা বললো, সুন্দরবন ঘুরে দেখাবে। নানা রকমের মাছ খাওয়াবে। আমি বললাম, আগে সুন্দরবনটা দস্যুমুক্ত হোক। ওরা বললো, সুন্দরবন কোনোদিন ডাকাত মুক্ত হবে না। সারা দেশের প্রশাসন নামালেও পারবে না। বললাম, দায়িত্বশীলরা চেষ্টা করছেন। কিন্তু সুন্দরবনে সেই পরিবেশ আসেনি এখনও। তাই আপনারা বিশ্বাস করছেন না। জেলেরা বললো, সুন্দরবনে যতোদিন গাছের পাতা আছে, ততোদিন ডাকাত থাকবে।
আমি হাসলাম। মনে মনে বললাম, দেখা যাক। পীর সাহেবের পড়ে দেওয়া লাল রুমালে যাদের বিশ্বাস। সুন্দরবনের দস্যুতা নিয়ে তাদের বিশ্বাস সহজে সহজে বদলাবে না। না বদলাক, আমি আমার কাজ চালিয়ে যাবো। আমি জানি সুন্দরবন দস্যুমুক্ত হবে। সে পর্যন্ত আমার দম নেওয়ার সময় নাই।
(২০১৬ সালের ঘটনাপ্রবাহ। সুন্দরবন)