রূপান্তরের গল্প ২৬৭ | Rupantorer Golpo 267

শিকারে গেছে তিন জেলে | রূপান্তরের গল্প ২৬৭

শিকারে গেছে তিন জেলে | রূপান্তরের গল্প ২৬৭ | Rupantorer Golpo 267 | দস্যুমুক্ত সুন্দরবন | সুন্দরবনের গল্প | জীবনে ফেরার গল্প | Jibone Ferar Golpo | Sundarbaner Goppo | Story of Sundarbans | মোহসীন উল হাকিম | Mohsin Ul Hakim


রূপান্তরের গল্প ২৬৭ : দম বন্ধ করা গরম। অথচ নভেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে একটু ঠান্ডা পড়ার কথা। এসময় অন্তত একটি নিম্নচাপ আসে। ঝড়-বৃষ্টি হয়ে শীত নামে। কিন্তু কোথায় শীত? এক জেলে বললো, উত্তরা বাতাস হচ্ছে। রোদের কারণে এখন গরম লাগছে। কিন্তু সন্ধ্যায় ঠান্ডা পড়বে। গরম লাগলেও সময়টি বেশ উপভোগ করছি। কারণ দুই দিন পর একটু শুকনা কাপড় পড়েছি। এই রোদে দিনের মধ্যে আমাদের কাঁথা-বালিশও শুকিয়ে যাবে মনে হচ্ছে। গত রাতে ঘুম হয়নি। আজ রাতে লম্বা ঘুম দিবো।

অবসাদে ভরা আমাদের শরীর। সবার সাথে মিলেমিশে চলছি। গল্প করছি, আড্ডা দিচ্ছি। কিন্তু শরীর আর সায় দিচ্ছে না। বিষয়টি বেলায়েত সরদার ঠিক বুঝেছেন। মামুনকে ডেকে একটা চাদর বিছিয়ে আমার শোয়ার ব্যবস্থা করতে বলেছেন। সকালে নেড়ে দেওয়া কিছু কাপড় শুকিয়েছে। কিন্তু বালিশ শুকায়নি। মামুন একটা শুকনা বালিশের জন্য অপেক্ষা করছে। বললাম, এখন আর ঘুমাবো না। জেলেরা মাছ ধরতে যাবে। তাদের সাথে যাবো।

এখানে গরম লাগার আরেকটা কারণ আছে। বাতাস পাচ্ছি না। খালের আগায় বাতাস আসে না। সরদারকে বললাম, এই জায়গা ছেড়ে বড় খালে চলেন। মামুন আর শহীদুল কাকুকে বললাম, শুকাতে দেওয়া তোষক, বালিশ, কাঁথা আর কাপড়গুলো তুলে ফেলো। ওদিকে ইঞ্জিন রুমে ঢুকে সরদার সবকিছু চেক করে নিলেন।

আমাদের গোছগাছ করতে দেখে জেলেরাও গোছগাছ শুরু করলো। ওরাও আমাদের সাথে সাথে থাকবে। সবকিছু গুছিয়ে মামুন ইঞ্জিন চালু করতে যাচ্ছে। এসময় এক জেলে এসে বললো, আরেকটু পরে গেলে হয় না? জানতে চাইলাম, তোমাদের কোনো কাজ আছে এখানে? সে বললো, কাজ নাই। তবে কয়েকজন জঙ্গলের ভিতরে গেছে। ওরা আসলে একসাথে গেলে ভালো হয়। বললাম, ঠিক আছে। আসুক ওরা।

ভাটার পানি নামছে। অর্ধেক ভাটা হয়ে গেছে। জঙ্গল থেকে নেমে আসা পানির স্রোত থেমে গেছে। সরু খালগুলো থেকে এখনও পানি নামছে। তবে সেই স্রোতও ক্ষীণ হয়ে এসেছে। মূল খালের পানি নেমে গেছে অনেকটা। দুই পাশে চর জেগেছে। সেখানে মাড স্কিপাররা হেঁটে বেড়াচ্ছে। হাঁটু পানি থেকে কাদায় লাফিয়ে পড়ছে। আবার বুকে ভর দিয়ে গড়িয়ে নেমে যাচ্ছে পানিতে। দুটি মাড স্কিপার দেখছি বেশ যুদ্ধংদেহী। মারামারি করছে। মুখোমুখি ধাক্কা দিচ্ছে। গায়ে গতরে বেশ বড়। পাখনাগুলো খাড়া করা বলে আরও বড় মনে হচ্ছে। মাড স্কিপারের মনে হয় একাধিক জাত আছে। স্থানীয় ভাষায় চেউয়া বলে অনেকে। কেউ বলে খাওয়া যায়। আবার অনেকে বলে, এগুলো খায় না।

মাড স্কিপারগুলো বেশ বর্ণিল। সূর্যের আলো পড়ে চকচক করছে। কাঁদার উপর দিয়ে দৌড়াদৌড়ি করছে ছোট ছোট কাঁকড়া। দৌড় দিয়ে গাছে উঠে পড়ছে তারা। খালের পানিতে হাজার হাজার পারশে মাছের পোণা ঘুরে বেড়াচ্ছে। জোয়ারের সময় এই পোণা মাছ খেতে খালে ঢোকে বড় মাছগুলো। এদিকে গাছে গাছে মাছরাঙ্গা পাখি বসা। একটু পর পর পানিতে ছো মারছে তারা। আমরা এতোগুলো মানুষ এখানে আছি সেদিকে কারও খেয়াল নাই।

এই সফরের শুরু থেকে বেলায়েত সরদার রান্নাঘর থেকে উঠতে পারছেন না। প্রতি বেলায় অন্তত কুড়ি জনের রান্না হচ্ছে। ট্রলারের রান্নাঘর তাই সারা দিন ব্যস্ত।

যদিও তিনবেলা খাওয়া হচ্ছে না। তবে দুই বেলার ভাত তরকারি রান্না করতে গিয়ে সময় পাচ্ছেন না সরদার। বসলাম রান্নাঘরের সামনে। এখানে একটু ছায়া আছে। তপ্ত আবহাওয়ায় এখানে বসে একটু আরাম লাগলো। সরদার আমার দিকে তাকালেন। উনি বুঝে গেছেন কী চাইছি আমি। সাথে সাথে মামুনকে ডেকে বললেন, ও মামুন, দেখ ভাই কী চাচ্ছে?

পাশে এসে দাঁড়ালো মামুন। কানে কানে বললাম, এক কাপ চা খাওয়াতে পারো? সেও ফিসফিস করে বললো, লিকার কি একটু কড়া দিবো? আমাদের মজা করতে দেখে বেলায়েত সরদার বললেন, এই গরমে আপনার চা না খেলে হয় না? বললাম, চা না খাই, কিছু একটা খেতে হবে। শরীরটা কড়া হয়ে গেছে। সরদার বললেন, তাহলে একটা কাজ করি, লেবুর শরবত বানায়ে দেই? সত্যি বলতে এই মুহুর্তে লেবুর শরবতই সেরা পানীয়। জগ ভর্তি করে শরবত বানালেন বেলায়েত সরদার। চুমুক দিয়ে বুঝলাম শরীরে পানিশূণ্যতা চলছে।

এক ঘন্টা পেরিয়ে গেলো। কিন্তু বনের ভিতরে যাওয়া জেলেরা ফিরছে না। ওরা কেন গেলো? কেনই বা এতো দেরি হচ্ছে? জেলেদের একজনকে ডেকে জিজ্ঞেস করলাম। কিছু বলতে পারলো না। এদিকে আর কিছুক্ষণের মধ্যে ট্রলার আটকে যাবে কাদায়। ভাটা আছে আর মাত্র ঘন্টা খানেক। এখানে আটকে গেলে বের হতে আমাদের অন্তত দুই ঘন্টা অপেক্ষা করতে হবে। আপাতত আর আটকে থাকতে চাই না। কিন্তু জেলেদের জঙ্গলের ভিতরে রেখে বেরও হতে পারছি না।

ট্রলার ছাড়লাম না। তবে লগি দিয়ে বেয়ে সামনে এগিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। ধীরে ধীরে এগিয়ে সামনের কোনো বড় খালে নোঙ্গর করবো। আমাদের সাথে সাথে নৌকাগুলোও রওনা হবে। কিন্তু তাদের মধ্যে একজন বললো, সে পরে যাবে। একটি নৌকা নিয়ে এখানেই থাকবে সে। জঙ্গলের ভিতর থেকে ওরা ফিরে আসুকক। ওদের নিয়ে রওনা দিবে। ভাবছি কী এমন জরুরি প্রয়োজন পড়লো তাদের? বনের ভিতরে যাওয়া নিরাপদ না।

ট্রলারসহ বাকী নৌকাগুলো নিয়ে আমরা রওনা হলাম। খুবই ধীর গতিতে এগুচ্ছি। জায়গায় জায়গায় তলা ঠেকে যাচ্ছে। জেলেরা নেমে তখন ঠেলা দিচ্ছে। চারপাশে শুনশান নিরবতা। এর মধ্যে জঙ্গলের ভিতর থেকে মানুষের কথাবার্তার শব্দ পেলাম।

কান খাড়া করলাম। বললাম, ওরা মনে হয় আমাদের থেকে বেশি দূরে না। সরদার বললেন, অনেক দূরে। জঙ্গলে কথার শব্দ অনেক দূর থেকে পাওয়া যায়। কুঁই দিয়ে আমাদের অবস্থান জানান দিলাম। ওরা পাল্টা কুঁই দিলো। সেখানেই দাঁড়িয়ে পড়লাম। মিনিট দশের মধ্যে খালের পাশে এসে দাঁড়ালো তিনজন জেলে।

সারা গায়ে কাদা। গাল ভরা হাসি দিয়ে বললো, আপনারা চলে যাচ্ছেন? বললাম, আপনারা গেলেন কই? ভাটা হয়ে গেছে। এখানে আটকে থাকলে চলবে? জোয়ার আসলে বড় নদীতে যাবো। পশুর এখন ঠান্ডা। জোয়ারের মধ্যে নামবো নিচের দিকে। দুবলার চরে যাবো। ওরা এদিক ওদিক তাকিয়ে কিছু একটা বললো। সাথের জেলেরা দেখি হাসছে। বললাম, সমস্যাটা কোথায়? আপনারা যাবেন না? ওদের আকারে ইঙ্গিতে বলা কথার অর্থ বুঝতে পারছি না।

এবার মামুন এসে কানে কানে বললো, ওরা শিকারে গেছিলো ভাই। ফাঁদ পেতে রেখে আসছে। এই ভাটা শেষে যখন জোয়ার আসবে, তখন আবার জঙ্গলে যাবে।

মেজাজটা অনেক খারাপ হলো। কিন্তু বুঝতে দিলাম না। জেলেদের বললাম, এই জঙ্গলই আপনাদের পেটের ভাত জোগায়। এখানে এসে এই অন্যায়টা না করলে হয় না? একজন বললো, এমনিতে আমরা শিকার করি না ভাই। ভাবলাম আপনাকে একটা হরিণ খাওয়াই। বললাম, এমনিতে শিকার করেন না বললেন। তাহলে ডোয়া (হরিণ ধরার ফাঁদ) আসলো কোত্থেকে?

বেলায়েত সরদার বোঝেন আমাকে। জেলেদের তিনি বললেন, আমরা সামনে গিয়ে বগা-কাগা খালের দোয়ায় থাকবো। তোরা এখনই ফেরত যাবি। ডোয়া তুলে আবার ফিরবি আধা ঘন্টার মধ্যে। এক মিনিট দেরি হলে ফরেস্টের হাতে ধরায়ে দিবো। তোরা আকাম করার আর সময় পাস না! আমার হয়ে বেলায়েত সরদার ইচ্ছামতো বকাঝকা করলেন। ওই তিনজন আবার ঢুকে পড়লো বনের ভিতর।

ট্রলার ঠেলে এগিয়ে গেলাম। বগা খালের দোয়ায় নোঙ্গর করতে গিয়ে দেখি এখানেও পানি কমে গেছে। আমাদের আরও একটু এগিয়ে গিয়ে দাঁড়াতে হবে। কাগা খালে পানি আছে। সেখানেই যাবো।

এখানে দুইটি নৌকা রেখে রওনা দিবো। ইঞ্জিন চালিয়ে আধা ঘন্টার মতো চালিয়ে গভীর জায়গা দেখে নোঙ্গর করবো। এই সন্ধ্যায় আমরা রওনা দিবো। যাবো দুবলার চর।

(ছবি: কাগা খাল। ঘটনা ২০১৬ সালের)

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top