রূপান্তরের গল্প ২৬৮ | Rupantorer Golpo 268

হরিণ ধরার ফাঁদ- ‘ডোয়া’ আর ‘ছিটকে’ | রূপান্তরের গল্প ২৬৮

হরিণ ধরার ফাঁদ- ‘ডোয়া’ আর ‘ছিটকে’ | রূপান্তরের গল্প ২৬৮ | Rupantorer Golpo 268 | দস্যুমুক্ত সুন্দরবন | সুন্দরবনের গল্প | জীবনে ফেরার গল্প | Jibone Ferar Golpo | Sundarbaner Goppo | Story of Sundarbans | মোহসীন উল হাকিম | Mohsin Ul Hakim


রূপান্তরের গল্প ২৬৮ : হরিণ শিকার সুন্দরবনে সাধারণ ব্যাপার। অহরহই ঘটে। একটা সময় সাধারণ জেলেদের মধ্যে শিকারের প্রবণতা ছিলো খুব বেশি। তবে সময়ের সাথে সাথে সেটি কমেছে। ক্রেতারা সতর্ক। আবার বন্যপ্রাণি আইনটি সংশোধন হয়েছে বলে অনেকেই শিকার থেকে সরে এসেছে। শিকার আর বন্যপ্রাণি বেচাকেনা আগের মতো সহজ নাই।

সুন্দরবনের শিকারীদের অনেককেই চিনি। পরিচিতদের প্রায় সবাই এই পেশা ছেড়ে দিয়েছে। শখের শিকারীরা সুন্দরবনে যায় না বললেই চলে। তবে পেশাদার হরিণ শিকারীরা সুযোগ পেলেই বনে ঢুকে পড়ে। কিছু স্থায়ী ক্রেতা আছে। তাদের কাছে গোপনে পৌঁছে যায় হরিণের মাংস।

বনদস্যুদের ডেরায় হরিণ শিকার আরও সাধারণ বিষয়। প্রতিদিনের খাবারের চাহিদা মিটাতে শিকার করতে হয়। প্রতিটি দস্যুদলে এক বা একাধিক পাকা শিকারী থাকে। দস্যুদলে তাদের কদর অন্য পর্যায়ে। আবার বনদস্যুরা ভয় পায়, এড়িয়ে চলে শিকারীদের।

দস্যুরা প্রশাসনকেও পরোয়া করে না। তাহলে শিকারীদের কেন ভয় পায়? দীর্ঘ অভিজ্ঞতায় যা বুঝেছি তা হলো, শিকারীদের বন্দুকের নিশানা ভালো। তারা জঙ্গলে চলতে পারে নিঃশব্দে। কাউকে কিছু বুঝতে না দিয়ে একজন পাকা শিকারী হামলা চালাতে পারে যেকোনো বন্দস্যুদের আস্তানায়। অন্যদিকে দস্যুদের বেশির ভাগ সদস্যই বন্দুক চালানোয় পারদর্শী না। তাই শিকারীদের সাথে সুসম্পর্ক রাখে বনদস্যুরা।

মংলার মিন্টু শিকারী ছিলো রাজু বাহিনীর প্রধান রাজু’র বন্ধু। নিবিড় সম্পর্ক ছিলো তাদের মধ্যে। সুন্দরবনে নিয়মিত যাতায়াত করতো মিন্টু। সবাই জানে যে সে শিকার করে। শুধু হরিণ না। বাঘ শিকারের অভিযোগও ছিলো তার বিরুদ্ধে। তার পরও সুন্দরবনে তার নির্বিঘ্ন যাওয়া আসা ছিলো।

একবার মিন্টু শিকারীর সাথে গল্পে বসেছিলাম। সে বলতো, জঙ্গলে নামার পর একটি হরিণ শিকার করতে তার সময় লাগে বড়জোর আধা ঘন্টা। তার কাছে স্থানীয় প্রভাবশালীরা হরিণের মাংস নিতো। তাদের মাধ্যমে দেশের অনেক হোমড়া চোমড়ার কাছে উপহার হিসাবে পৌঁছে যেতো সুন্দরবনের হরিণের মাংস।

দস্যুনেতা রাজুর সাথে সম্পর্ক থাকায় মিন্টু শিকারীকে বনরক্ষীরা কিছু বলতে পারতো না। জনশ্রুতি ছিলো যে আইন শৃঙ্খলা বাহিনী ধরলেও তাকে আটকে রাখতে পারতো না। পরবর্তীতে নিরুদ্দেশ হয়ে যায় এই শিকারী। আর খুঁজে পাওয়া যায়নি। শুনেছি খুলনায় বসবাস করেন সুন্দরবনের এক বড় মহাজনের বাড়ি থেকে ফেরার পথে নিরুদ্দেশ হয় মিন্টু। সুন্দরবনের হরিণ-বাঘ শিকারীদের নিয়ে অনেক গল্প শুনি। বিচিত্র জীবন তাদের।

আমরা আছি পূর্ব সুন্দরবনে। নিম্নচাপ চলে গেছে গত রাতে। আকাশ এখন পরিস্কার। বাতাস বইছে উত্তর থেকে। সূর্যের উত্তাপ বেশি হলেও হাল্কা বাতাস বেশ স্বস্তি দিচ্ছে। গেলো রাতে কয়েকটি জেলে নৌকা ছিলো সাথে। ঝড়-বৃষ্টি একসাথর মোকাবেলা করেছি আমরা।

সাত সকালে তিন জেলে শিকারে গেছে আমাদের কাউকে কিছু না জানিয়ে। ওদের বলেছি হরিণ ধরার ফাঁদ তুলে আনতে। একটু তাড়া থাকলেও শিকারীদের ফিরে না আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করবো। কাছাকাছি একটি নৌকা রেখে এসেছি তাদের নিয়ে আসার জন্য।

ঘন্টা খানেক পর নৌকাটি আসলো। শিকারে যাওয়া তিনজনকে ডেকে ট্রলারে তুললাম। বেশি বেশি বকাঝকা করলাম। ওরা বললো, ভুল হয়ে গেছে। এরপর নেমে গেলাম ওই নৌকায়। ফাঁদগুলো বের করতে বললাম। ওরা নৌকার পাটাতনের নিচ থেকে একটা ছোট বস্তা বের করলো। বস্তা খুলে দেখি একগুচ্ছ নাইলনের দড়ি।

এগুলো তো শুধু দড়ি! হরিণ ধরার ডোয়া কোথায়? ওরা বললো, এগুলোই তো ডোয়া, মানে হরিণ ধরার ফাঁদ। দড়িগুলো হাতে তুলে নিলাম। গুছিয়ে রাখা দড়িগুলোই তাহলে ডোয়া? জেলেদের বললাম, আমাকে একটু বোঝান তো!

একটু পর পর ফাঁস। দড়ির এক মাথা থেকে আরেক মাথা কয়েকশ’ মিটার হবে। এর মধ্যে প্রায় তিনশ’ ফাঁস। বললাম, ডোয়া কোথায় পেলেন আপনারা?

সুন্দরবনে যারা হরিণ শিকার করে তারা ফাঁদ বহন করে না। জালের সাথে দড়ি নিয়ে আসে। তারপর অবসর সময়ে বনের ভিতর বসে ফাঁস তৈরি করে। কয়েক ঘন্টায় বানিয়ে ফেলে হরিণ ধরার ফাঁদ-ডোয়া। তারপর শিকারে নামে। দড়িতে আটকা পড়ে হরিণ। শিকার শেষে ফিরে যাওয়ার সময় ফাঁদগুলো বস্তায় ভরে জঙ্গলের ভিতর রেখে যায়। বেশির ভাগ সময় মাটি খুঁড়ে পুঁতে ফেলে বস্তাটি। খাল ও বড় কোনো গাছকে নিশানা করে তারা ফিরে যায়। জঙ্গলের বিভিন্ন জায়গায় ফাঁদ রাখা থাকে। সময় সুযোগ পেলেই তারা শিকারে নামে।

‘ছিটকে’ নামে আরেক ধরণের ফাঁদ আছে। তাতে দড়ি লাগে মাত্র এক টুকরা। সুন্দরবনে হরিণের চলাফেরার পথ হিসাব করে ছিটকে ফাঁদ পাতে শিকারীরা। ডোয়া যেমন লম্বা জায়গা জুড়ে পাতা হয়। এটি তেমন না। মাঝারি আকারের গাছ কেটে তার সাথে কয়েক টুকরো চিকন গাছের ডাল দিয়ে তৈরি করা হয় ছিটকে ফাঁদ।

শুকনা ঘাস-পাতা দিয়ে ঢেকে রাখা হয় জায়গাটি। দড়িগুলো দেখা যায় না। হরিণদের আকৃষ্ট করার জন্য শিকারীরা কেওড়ার ডাল-পাতা ফেলে রাখে। জায়গা মতো পা পড়লে তীব্র বেগে উঠে যায় দড়ির ফাঁস। ঝুলে পড়ে শিকার। শুধু হরিণ না, বন্য শুকর বা বাঘও এতে আটকা পড়তে পারে। কখনও কখনও মদনটাকের মতো বড় পাখিও ধরা পড়ে যায় ছিটকে ফাঁদে।

জেলেরা ডোয়া ফেলেছিলো বনে। এখানে কেওড়া বন আছে বলে হরিণের চলাফেরা বেশি। শিকারীরা বললো, ফিরে গিয়ে তারা একটা হরিণ পেয়েছে। তবে ছেড়ে দিয়ে এসেছে। আমি বিশ্বাস করিনি। বললাম, ওখানে যেতে চাই। দেখতে চাই সত্যি সত্যি সবটুকু ফাঁদ তোমরা তুলেছো কী না!

ট্রলারের সহযাত্রীরা একটু দুশ্চিন্তায় পড়ে গেলো। বললাম, দুশ্চিন্তা করো না। এদিকটা তো কেওড়া বাগানে ভরা। জঙ্গলের ভিতরটা তো পরিস্কার থাকার কথা। বেলায়েত সরদার এসে বসলেন। বললেন, চলেন ভাই। অভিযান একটা চালায়ে আসি। এই জেলেদের কথা আমারও বিশ্বাস হচ্ছে না।

এবার ভয় পেয়ে গেলো ওই জেলে শিকারীরা। নিজে থেকেই বললো যে ভিতরে আরও ফাঁদ আছে। তবে সেগুলো তাদের না। কোনো শিকারী চক্রের ডোয়া হবে। দুই একদিনের মধ্যে রাস পূর্ণিমা। এসময় দুবলার চরে রাস পূজা হয়, মেলাও হয়। তাতে যোগ দিতে আসে লাখ লাখ মানুষ। শুনেছি এসময় হরিণ শিকার বেগে যায়। মেলার কয়েক দিন আগে শিকারীরা ঢুকে পড়ে বনে। মাছ-কাঁকড়া শিকারের অনুমতি নিয়ে তারা হরিণ শিকার করে। শুনেছি, এসময় পূর্ব সুন্দরবনের এদিকটাতে শিকার বেশি হয়।

দুবলার চরে আজ আর যাওয়া হবে না। বনের ভিতরে নামার সিদ্ধান্ত নিলাম। ট্রলার রাখবো এখানেই। ডিঙ্গি নৌকা নিয়ে রওনা দিবো। তবে তার আগে একটু খাওয়া দাওয়া করে নিতে হবে। বনের ভিতরে কয় ঘন্টা থাকবো আমরা তা নিশ্চিত না।

রাতের ভাতে পানি দেওয়া ছিলো। মানে পান্তা ভাত আছে রান্নাঘরে। শুকনা মরিচ পোড়ানো হলো। পেঁয়াজ কেটে দিলো মামুন। চুলায় গরম পানি তুললেন শহীদুল কাকা। ভরপেট খাওয়ার মতো পান্তা নাই। তবে যা আছে তাই দিয়ে চলে যাবে। সকালে পান্তা ভাত খাবার হিসাবে বেশ ভালো।

দুধ চা খেয়ে নিলাম। নৌকা তৈরি। তাতে হাল্কা খাবার আর চায়ের সরঞ্জাম তোলা হলো। মনে হয় আজ সারাদিন জঙ্গলের ভিতরেই কাটবে। মনে হচ্ছে ভীতিকর এক অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হতে যাচ্ছি আমরা!

ছবি: রাশেদুল আরেফিন
ঘটনা: নভেম্বর ২০১৬

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top