আমাদের দেখে পালালো কারা? | রূপান্তরের গল্প ২৬৯ | Rupantorer Golpo 269 | দস্যুমুক্ত সুন্দরবন | সুন্দরবনের গল্প | জীবনে ফেরার গল্প | Jibone Ferar Golpo | Sundarbaner Goppo | Story of Sundarbans | মোহসীন উল হাকিম | Mohsin Ul Hakim
রূপান্তরের গল্প ২৬৯ : একে একে ডিঙ্গি নৌকায় উঠে পড়লাম। খাবার পানি, হাল্কা খাবার আর চায়ের সরঞ্জাম তোলা হলো। সঙ্গী হলেন বেলায়েত সরদার, মামুন আর কয়েকজন জেলে। সকালে বনের ভিতরে শিকারে যাওয়া ওই তিন জেলে যেতে চাইছে না। জোর করে তাদের নিলাম।
মানুষ বেশি বলে আরেকটি নৌকা নিলাম সাথে। শহীদুল কাকাকে রেখে গেলাম ট্রলারে। দুপুরের রান্না করবেন। ভেজা কাঁথা-বালিশ আর কাপড়গুলো নেড়ে দিবেন তিনি। এই রোদে সবকিছু না শুকালে রাতে ঘুমাতে কষ্ট হবে। এমনিতে ট্রলারে প্রচুর কাজ। তাকে সহযোগিতা করবেন জেলে ভাইরা।
ভাটা শেষে জোয়ার লেগেছে ঘন্টা খানেক হলো। পানির চাপ বেশি। শেষ জোয়ারে বনের ভিতরে পানি উঠবে। তার আগেই অভিযান শেষ করে ফিরতে হবে। শিকারে যাওয়া তিব জেলে বললো, জঙ্গলে নামার পর আধা ঘন্টা হাটলেই ফাঁদ ফেলার জায়গায় পৌঁছানো যাবে। ফিরে আসতে খুব বেশি সময় লাগবে না।
নৌকা ছাড়লো। সুজন স্রোতে এগিয়ে চললো নৌকা। সুজন স্রোত মানে স্রোতের অনুকূলে যাচ্ছি। নৌকা চলছে সরসর করে, বেশ দ্রুত গতিতে। নৌকার ঠিক মাঝখানে বসা আমি। ডিঙ্গি নৌকায় বসতে হয় ভারসাম্য রেখে। বেশ সতর্ক থাকতে হয়। তা না হলে নৌকা উল্টে যাওয়ার শংকা থাকে। বৈঠা বেয়ে কয়েক মিনিটের মধ্যে পৌঁছে গেলাম কাগা আর বগা খালের দোয়ায়। সেখান থেকে আরেকটু খালের আগার দিকে গিয়ে নোঙ্গর করবো।
আজ চাঁদের ত্রয়োদশী। রাস পূর্ণিমা সামনে। রাস পূজা হবে দুবলার চরে। বিভিন্ন এলাকা থেকে আসবে সনাতন ধর্মের লাখ লাখ পূণ্যার্থী। এসময় বেশ বড়সড় মেলা হয় সেখানে। তাতে যোগ দিবে দেশ বিদেশের আরও লাখ খানেক বিভিন্ন ধর্মের মানুষ। এক সাথে সুন্দরবন আর রাসমেলা দেখতে আসা মানুষদেরও মেলা বসে দুবলার চরে।
মালে উঠতে হবে। পায়ে রাবারের সারা জুতা পড়বো। সুন্দরবনে কাঁকড়ার জেলেরা ওই জুতা পড়ে। ছোটবেলায় স্কুল ড্রেসের সাথে এই পিটি সু পড়তাম। এখন দেশের আর কোথাও এটি দেখা যায় না। কিন্তু সুন্দরবনে আছে। জঙ্গলে হাঁটে যারা তাদের এটি পড়তে দেখি। কাঁকড়ার জেলে আর মৌয়ালদের বহরে এই রাবারে জুতা থাকে। সাথের জেলেদের কাছেও আছে। কিন্তু পায়ের সাথে মিললো না। কী আর করা। খালি পায়ে নামতে হবে।
মালে নামা মানে জঙ্গলে নামা। সুন্দরবনের জেলেরা সুন্দরবনকে বাদা বা মাল বলেও ডাকে। নামার সময় বলে বাদায় যাচ্ছি বা মালে যাচ্ছি। তো আজ আমরাও মালে নামবো।
সবার আগে নিচে নামলেন বেলায়েত সরদার। নৌকা ভিড়িয়ে বসে আছি আমরা। কয়েক মিনিটের মধ্যে সরদার ফিরলেন। বললেন, আশেপাশে লাইন ক্লিয়ার। বলেই আমাকে নামতে বললেন। নৌকা দুটো বাঁধা হলো গড়ান গাছের সাথে।
টুপ টুপ করে নেমে পড়লো জেলেরা। আমি নামলাম সবার পরে। হাতে একটি গড়ানের ডাল কেটে লাটি বানিয়ে দিলো মামুন। সেই লাটিতে ভর করে হাঁটা দিলাম। সবার আগে একজন জেলে। তারপর আরও দুইজন। তার পিছনে বেলায়েত সরদার। এর পর আমি। আমার পাশে পাশে হাঁটছে মামুন। তার হাতে একটি দা।
আমার পিছনে আরও দুইজন জেলে। সবার সাথে তাল মিলিয়ে হাঁটছি। কষ্ট হলেও দমে যাই না কখনও। শরীরে কুলায় না। কিন্তু মনের শক্তি আমার কারও থেকে কম না। তাই যায়গায় জায়গায় উরু পর্যন্ত কাদায় দেবে গেলেও উঠে দাঁড়াচ্ছি। আমাদের গন্তব্য আরও গভীরে। কিছু একটা আবিষ্কার না করে ফিরবো না আজ।
নিম্নচাপের কারণে গেলো রাতের জোয়ারে পানি ছিলো অতিরিক্ত। এদিকের উঁচু জঙ্গলেও পানি উঠেছে। কিছু দূর এসে বুঝলাম ভরা জোয়ারেও পানি ওঠে না এখানে। তাই গেলো রাতের পানি যে কাদা তৈরি করেছে তা হাঁটার পথকে অনেক বেশি কঠিন করে ফেলেছে।
শক্ত মাটির উপর হাল্কা কাদার প্রলেপ। পা দিতেই পিছলে যাচ্ছে। হাঁটতে গিয়ে এলোপাথারী পা ঢুকে যাচ্ছে শুলোর ভিতর। ভীষণ ব্যাথা পাচ্ছি। এখানে জঙ্গল অবশ্য বেশ পরিস্কার। জেলেরা বললো আর দশ মিনিট পর সেই কেওড়া বাগান শুরু।
আরও দশ মিনিট হাঁটলাম। এরপর আরও দশ মিনিট গেলো। জিজ্ঞেস করলাম, কোথায় সেই কেওড়া বাগান? সরদার ঘুরে দাঁড়ালেন। বললেন, জঙ্গলের হিসাব বোঝেন না? লোকে বলবে, ওই যে দেখা যায় ওমুক খাল। তারপর সেখানে যেতে সময় লাগে কয়েক ঘন্টা। এবারও তাই হবে। জেলেদের কাছে জানতে চাইলাম, আর কতোক্ষণ ভাই? ওরা বললো, ওই তো, দেখা যাচ্ছে।
হাসতে হাসতে শেষ। সরদার বললেন, ও ভাই। ওদের কথা বিশ্বাস করবেন না। ওরা সময়ের হিসাব জানে না। বললাম, অসুবিধা নাই। হাঁটেন।
কিছুদূর এগিয়ে চোখে পড়লো কেওড়া বাগান। একটার পর একটা বড় বড় কেওড়া গাছ। অন্য গাছ এখানে খুব কম। জায়গাটি রীতিমতো নৈস্বর্গিক। অসাধারণ বলতে বোধ হয় এমন জায়গাকেই বুঝায়। সুন্দরবনের এমন সৌন্দর্য খালে বসে দেখার উপায় নাই।
একটু দম নিয়ে আবার হাঁটা দিলাম। এবার সামনে সরদার। তারপর আমি। আমার পিছনে মামুন। তারপর অন্যরা। হাল্কা কাদার উপর মানুষের পায়ের ছাপ দেখে এগুচ্ছি আমরা। এদিকে কাদার উপর হাজার হাজার হরিণের পায়ের ছাপ। কয়েকটি কেওড়া গাছ পেরিয়ে দেখি বাঘের পায়ের ছাপ। অবশ্য সেগুলো বেশ পুরনো বলে জানালো জেলেরা।
বাঘের পায়ের ছাপ নতুন হোক বা পুরাতন। দেখলেআ গা ছমছম করে। আবার অনেকে একসাথে থাকলে বাঘের ভয় করে না। সবাই মিলে সতর্ক থাকলেই হয়। জেলেদের সবার হাতে দা আছে। আমার হাতে আছে গড়ানের কচা মানে গড়ানের লাঠি। সরদারও হাতে একটি দা রেখেছেন। মামুনের হাতেও দা। বাঘ আসলে ভয় পাওয়ার কিছু নাই।
আমি কিন্তু বাঘ খুঁজছি না। কী খুঁজছি ওরা জানে। শিকারী দলটি মনে হচ্ছে আমাদের ভুল পথে নেওয়ার চেষ্টা করছে। সরদারকে ইশারা করতেই বুঝেছেন, জায়গা মতো যেতে হবে, ওদের পথ দেখানোর ওপর ভরসা করা যাবে না।
প্রায় চল্লিশ মিনিট হাঁটলাম। কিছুই নজরে আসলো না। শুধু জানি যে অসংখ্য হরিণ আছে এখানে। কিন্তু আমাদের আসতে দেখে কেউ দাঁড়াচ্ছে না। দূর থেকে দেখেই সরে পড়ছে। নিজেকে মুগলির মতো লাগছে। আমি কাউকে দেখছি না। কিন্তু অনুভব করছি যে অনেকেই আমাকে দেখছে।
হাত তুলে দাঁড়ালেন বেলায়েত সরদার। আমরাও দাঁড়িয়ে পড়লাম। কী যেন বুঝতে পেরেছেন তিনি। শিকারে যাওয়া তিন জেলেদের ডাক দিয়ে বললেন, তোরা তো সবগুলো ডোয়া তুলিসনি। ওরা বললো, এগুলো অন্য পার্টির ডোয়া। আমাদের না।
একটু দূরে পেতে রাখা দড়ির ফাঁদগুলো দেখলাম। বললাম, এই ফাঁদ যারই হোক। এখনই এটা তুলে ফেলবেন। সরদার বললেন, এদের বিচার আপনি পরে করবেন ভাই। আগে ডোয়াটা তুলি। ফিরে ওদের বিচার করবেন ভাই। ওরা বার,বার অস্বীকার করছে। মিন্তু আমার ঠিক বিশ্বাস হয়নি। মনে হচ্ছে এই ফাঁদগুলোও তাদেরই পাতা। সরতার বললেন, চলেন আগে ডোয়াটা তুলে ফেলি।
একটার পর একটা ফাঁস। নৌকায় যেটুকু ফাঁদ দেখলাম এখানে তার কয়েক গুন বেশি আছে। ডোয়া খুলতে খুলতে একটা বিষয় পরিস্কার হলো। এই দড়িগুলো অন্য রকম। আগেরটার মতো না। তার মানে এই ফাঁদ আমাদের সাথে থাকা জেলেদের না। অন্য কারও। সরদার বললেন, এই ডোয়া আরও অনেক দূর পর্যন্ত গেছে। তুলতে না হলেও দুই ঘন্টা সময় লাগবে। বললাম, ফাঁদ এভাবে রেখে যাবো না ভাই। যতো দেরিই হোক তুলে ফেলতে হবে।
একটু দূর থেকে মানুষের কথার আওয়াজ পাচ্ছি। ওরা দ্রুত হেঁটে বা দৌড়ে পালাচ্ছে। মনে হয় শিকারীরা এদিকেই ছিলো। আমাদের দেখে পালিয়ে গেলো। পিছনে ছুটলো আমাদের লোকজন।
চিৎকার করে ওদের থামালাম। বললাম, ওরা মানুষ কয়েকজন। সাথে অস্ত্র থাকতে পারে। খামোখা বিপদ বাড়ানো যাবে না। বরং এখানে ওরা কী অপকর্ম করছে দেখি। বলতে বলতে চারপাশে ছড়িয়ে গেলো সঙ্গীরা। দাঁড়িয়ে রইলাম আমি আর মামুন।
টিনের চুলায় ভাতের পাতিল। আগুন জ্বলছে। পাশে আরেকটি হাঁড়ি মাটিতে রাখা। ঢাকনা দেওয়া। পলিথিনের প্যাকেটে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে লবণ, মসলা, পেঁয়াজ, মরিচ। বাজারে কিনতে পাওয়া যায় এমন কয়কটি মাছ মাংসের মসলার ছেঁড়া প্যাকেট পড়ে আছে চুলার পাশে। একটি ছোট বস্তায় আধা মণের মতো চাল আছে। আর আছে দুই ড্রাম পানি।
আমাদের আসতে দেখে যারা পালিয়ে গেলো তারা অবশ্যই অপরাধী। শিকারী হতে পারে। আবার গাছ চোরও হতে পারে। যারাই হোক, তারা অপকর্ম করতে এসেছে, সন্দেহ নাই।
(২০১৬ সালের মধ্য নভেম্বরের ঘটনা)