রূপান্তরের গল্প ২৭১ | Rupantorer Golpo 271

খালে খালে অপরাধী! | রূপান্তরের গল্প ২৭১

খালে খালে অপরাধী! | রূপান্তরের গল্প ২৭১ | Rupantorer Golpo 271 | দস্যুমুক্ত সুন্দরবন | সুন্দরবনের গল্প | জীবনে ফেরার গল্প | Jibone Ferar Golpo | Sundarbaner Goppo | Story of Sundarbans | মোহসীন উল হাকিম | Mohsin Ul Hakim


রূপান্তরের গল্প ২৭১ : নৌকা নাই। গেলো কোথায়? কী সর্বনাশ! এখন কী হবে? ট্রলার পর্যন্ত ফিরবো কী করে? এই জঙ্গলের ভিতর দিয়ে এতোটা পথ হাঁটতে পারবো আমি? খালে রেখে যাওয়া নৌকা না দেখে রীতিমতো ভড়কে গেলাম। সরদার বললেন, কিছু একটা ঝামেলা হইছে ভাই। নৌকা কেন থাকবে না? বললাম, যে শিকারীরা দৌড়ে পালালো এটা তাদের কাজ না তো? হতেও তো পারে যে আমাদের নৌকাগুলো চুরি করে প্রতিশোধ নিচ্ছে ওরা?

সরদার বললেন, আপনি এখানে থাকেন। আমরা ট্রলার পর্যন্ত হেঁটে যাই। সেখান থেকে আরেকটা নৌকা নিয়ে আসি। বললাম, সে না হয় হবে। কিন্তু এই নৌকা দুটি তো বের করতে হবে। এই খাল থেকে নৌকা নিয়ে ওরা বেশি দূর যেতে পারবে না। সামনে আমাদের ট্রলার আছে। আর এদিকে খাল শেষ হয়ে গেছে। বলতে বলতে সাথের এক জেলে বললো, আমরা মনে হয় রাস্তা ভুল করে এই জায়গায় আসছি।

দুই ভাগে ভাগ হয়ে দুইজন করে চারজন হাঁটা দিলো। দশ মিনিটের মধ্যে কুঁই-এর শব্দ পেলাম উজান থেকে। উজান মানে খালের আগার দিক। ওদিকে যাবো না কী ওরা এখানে আসবে? মামুনকে পাঠানো হলো। নৌকা দুটি নিয়ে এখানে আসবে তারা।

ভাবছি এইটুকু জায়গা, তবুও রাস্তা ভুল করলাম? সরদার বললেন, ভেড়ার পাল কী ভাবে চলে জানেন? সবার সামনের ভেড়া যেদিকে যাবে বাকীরাও সেইদিকে হাঁটা দেয়। আজকে আমাদের অবস্থাও তাই হলো। বললাম, সবার সামনে তো আপনি ছিলেন ভাই!

নৌকা আসলো। হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। নৌকাই এই মানুষদের রুটি-রুজি ও চলাফেরার একমাত্র মাধ্যম, তাদের এক জীবনের সম্পদ। জাল আর নৌকাকে তাই আলাদা ভাবে সমীহ করে সুন্দরবনের মানুষ। কিছু রীতি আর নিয়ম কানুন মেনে চলে। যেমন নৌকার গলুই-এ পা দেওয়া নিষেধ।

অনেকে নৌকাতে স্যান্ডেল পড়ে ওঠে না। কাউকে উঠতেও দেয় না। আবার জালসহ মাছ ধরার সরঞ্জামও বেশ যত্ন করে রাখে জেলেরা। ভুল করে কখনও জালের উপর পা রাখলে হায় হায় করে ওঠে জেলেরা। দীর্ঘদিন জঙ্গলে ঘুরতে ঘুরতে জেনেছি এসব। তাই সুন্দরবনের রীতিগুলো মেনে চলার চেষ্টা করি।

নৌকা চলছে উল্টো স্রোত ঠেলে। যেভাবে এসেছিলাম সেভাবেই বসে আছি। শেষ জোয়ারে স্রোত নরম হয়ে আসে। তাই নৌকা বেয়ে যাওয়া খুব কষ্টের না। বিশেষ করে জেলেরা এই স্রোতকে পাত্তাই দেয় না।

শক্ত হাতে নৌকা বাওয়া মানুষগুলোর জন্য মায়া হয়। আবার রাগও হয় যখন দেখি তারাই সুন্দরবনের ক্ষতি করছে। এরা সব দোষ বন বিভাগের ঘাড়ে দেয়। কিন্তু নিজেরাও যে নিয়ম ভাঙ্গে, বনের ক্ষতি করে সেই বোধ আছে সামান্যই।

জেলেরা বলে সুন্দরবনের কিছু ধর্ম আছে। ধর্ম মানে সুন্দরবনের কিছু নিয়মের কথা বলে তারা। আবার সেই জেলেরা বলে, নিয়ম যে মানবে না তাকে বিপদে পড়তে হয়। অনেকে বলে, সুন্দরবন মায়ের মতো। আমি বলি, তাই যদি হয় তাহলে এর ওপর এতো অত্যাচার কেন? জেলেরা বলে, জঙ্গলকে অসম্মান করলে তার ক্ষতি হবেই হবে। শিকারীরা বলে তাদেরও নাকী ধর্ম আছে। অর্থাৎ তারাও কিছু নিয়ম মেনে চলে।

শুরুর দিকে খুব অবাক লাগতো। এদিকের মানুষের কাছে সুন্দরবনের গল্প শুনতাম। বাঘ-কুমিরের গল্প শুনে শিহরিত হতাম। আবার মাছের ঝাঁক ধরে মহা আনন্দে বাড়ি ফেরার গল্পও কম শুনিনি। শুনেছি বনের ভিতরে কী করে বুনো শুয়োর তাড়া করে। আবার কখনও বেঙ্গল টাইগার সামনে পড়েও মুখ ফিরিয়ে হাঁটা দেয়ার গল্প শুনি।

বাঘের আক্রমণের গল্প কতো শুনেছি তার হিসাব দেওয়া সম্ভব না। সুন্দরবনের মানুষদের কাছে এই বন্যপ্রাণিরা যেন নিতান্তই স্বাভাবিক বিষয়। অস্বাভাবিক যা আছে তা হলো বনদস্যুদের অত্যাচার-নির্যাতন।

সুন্দরবনের দস্যুরা কি নিয়মিত শিকার করে? এই প্রশ্ন নিয়ে ঘুরেছি কয়েক বছর। কেউ বলেছেন প্রতিদিন তারা হরিণ মারে। কেউ বলে শিকার করা তাদের নেশা না। প্রয়োজনে শিকার করে।

কোনো কোনো দস্যুদল নাকী বাঘও শিকার করে। বাঘের চামড়ার অর্ডার পেলে শিকারীরা দস্যুদের সাথে যোগাযোগ করে। শহর থেকে শিকারী আসে। বনদস্যুদের দলে ভিড়ে যায়, দস্যুদের অস্ত্র-গুলি নিয়ে নেমে পড়ে বাঘ শিকারের অভিযানে। শিকার হয়ে গেলে কিছু টাকা দিয়ে ফিরে যায় শিকারী।

একবার এক দস্যুনেতা বলছিলো, মংলার এক শিকারী এসে টানা এক মাস ছিলো তাদের সাথে। সুন্দরবনের নিশানখালী থেকে শেখের খালের মাঝামাঝি এলাকা থেকে শিকার করে ফিরে যায় সে। যাওয়ার সময় পঞ্চাশ হাজার টাকা দিয়ে যায়। তার কাছে জানতে চেয়েছিলাম, ওই শিকারী কতো টাকা পেলো সেবার? উত্তরে দস্যুনেতা বললো, পাঁচ লাখের চুক্তি ছিলো শহরের কোন সাহেবের সাথে। সেই সাহেবের সাথে নাকী বিদেশি ক্রেতাদের যোগাযোগ। এতো কিছু জানা যায় না।

মধ্য সুন্দরবনের বেলমারি খালের ভিতরে বসে সেই দস্যুনেতার সাথে অনেক গল্প হয়েছে। পুরো একটা রাত একসাথে ছিলাম। আজকের এই ডিঙ্গি নৌকার চেয়ে ছোট ছিলো সেই নৌকাটি। শীতকাল বলে মোটা কম্বল দিয়ে মোড়ানো ছিলো সেই নৌকার ভিতরটা। সারা রাত গল্পে গল্পে শিকারের অনেক কাহিনী শুনেছি।

আদাচাই ফরেস্ট অফিস ছিলো দস্যুদের নিরাপদ অবস্থানের ব্যবস্থা। বনরক্ষীরা ছিলো তাদের বন্ধুর মতো। অপকর্ম একসাথে না করলেও বনদস্যুদের সব ধরনের সহযোগিতা করতো তারা। আমি নিজেও সেই দৃশ্য একাধিকবার দেখেছি ২০১১-২০১৩ সালের মধ্যে। যাই হোক, গল্পে ফিরি।

দস্যুনেতা বলছিলেন, আদাচাই থেকে ভোরবেলা ট্রলার চালিয়ে নিচের দিকে গিয়ে শেখের খালে ঢুকলাম। ট্রলারের সবাই ঘুম। এর মধ্যে আরেক দস্যু হারুনকে নিয়ে শিকারে নামলাম। ভাবলাম অন্যরা ঘুম থেকে ওঠার আগেই একটা হরিণ মেরে নিয়ে আসি। ওখানে হরিণের অভাব নাই। বাঘেরও অভাব নাই। তাই একটু বাড়তি সতর্ক থাকা লাগে।

জানতে চাইলাম, অস্ত্র ছিলো কোনটা? দস্যু সরদার বললেন, দোনলা বন্দুকের ভিতরে দুটি গুলি ছিলো। আর সাথে ছিলো আরও কয়েকটি গুলি। বেছে বেছে তাজা গুলি নিয়েই নামলাম। কেওড়া গাছে উঠে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতেই দুটি হরিণ আসলো। একটি শিঙ্গেল, বিশাল বড় মর্দা হরিণ। তাক করে বন্দুকের বাম দিকের ঘোড়ায় দিলাম টান। কিন্তু ফুটলো না। ডানেরটা টান দিলাম। তাও ফুটলো না গুলি। এবার গুলি বদলে নতুন গুলি ঢুকালাম। এবার গুলি হলো কিন্তু হরিণের গায়ে লাগলো না।

দস্যুনেতা বলছিলো, সুন্দরবনে রহস্যের শেষ নাই ভাই। ভালো বন্দুক, তাজা গুলি সাথে। আবার আমার হাতও পাকা শিকারীর হাত। সামনেই হরিণ। কিন্তু মারতে পারলাম না। বললাম, তাতে রহস্যের কী দেখলেন? সে বললো, ওটা হরিণ ছিলো না ভাই, অন্য কিছু ছিলো। অলৌকিক বা অশরীরি কিছু হবে। মানে সেটি হরিণ ছিলো না। জ্বিন-ভুত হবে। পরবর্তীতে সেই দস্যুনেতার মৃত্যু হয় এনকাউন্টারে। তার কিছুদিন আগে সে বলেছিলো, মৃত্যুর ছায়া তাকে ঘিরে ধরেছে।

সুন্দরবনে এসে নিত্য নতুন অভিজ্ঞতা হচ্ছে। এই যে নৌকা বেয়ে যাচ্ছি যেকোনো সময় মৃত্যু হওয়াটা অস্বাভাবিক কিছু না। দুই পাশের জঙ্গল এতো কাছে যে বাঘ চাইলেই লাফ দিয়ে আমাদের আক্রমণ করতে পারে। আবার পানিতে যে কুমির আছে সে চাইলে উল্টে দিতে পারে নৌকা। জঙ্গলে সাপখোপের অভাব নাই। এতো কিছুর মধ্যেও মানুষ বেঁচে থাকে সেটিও দারুণ একটা ব্যাপার। আবার মানুষের বেহিসাবী অত্যাচার সহ্য করেও যে বনটা টিকে আছে তাও এক অনন্য বিষয়।

নৌকা চলছে। মাঝখানে বসে এলোমেলো ভাবনাগুলো ভাবছি। মনে হচ্ছে মানুষ আর সুন্দরবনের মধ্যকার সম্পর্কটি অন্য রকম। তারা বিশ্বাস করে, সুন্দরবন তাদের খাবারের উৎস। আবার তারাই অত্যাচার করে। বন রক্ষা করে জীবন যাপনের ধারও ধারে না কেউ কেউ। তবুও চলে প্রকৃতি আর মানুষের সমান্তরাল যাত্রা। আমরা যারা বাইরে থেকে সুন্দরবনকে দেখি তারা এর কিছুই জানি না।

আরেক বাঁক ঘুরতেই আমাদের ট্রলার নজরে আসলো। ভিজে যাওয়া কাঁথা বালিশগুলো দড়িতে বাঁদা। সারাদিনের রোদে মনে হয় শুকিয়ে গেছে। দুপুর গড়িয়ে গেলেও রোদের তাপ আছে এখনও। তাই নৌকাগুলোতে ছাউনি দিয়ে বিশ্রাম নিচ্ছে জেলেরা।

ট্রলারে পৌঁছেই পানি খেলাম। চা নিয়ে হাজির হলেন শহীদুল কাকু। তারপর গোসল সেরে ভাত খেতে বসলাম। খেতে বসে বুঝলাম, ক্ষুধা লেগেছে অনেক। উত্তেজনায় ক্ষুধার কথা ভুলেই গেছিলাম।

বন্যা জোয়ার এখন। খালের পানি ফুঁসে উঠেছে, তবে স্রোত থেমেছে। কিছুক্ষণ এমনই থাকবে। তারপর ঘুরবে স্রোত। চারপাশ থেকে পানি নামবে সাগরের দিকে। সেই স্রোতের সাথে সাথে ট্রলার চালাবো। প্রথমে যাবো কোকিলমনি ফরেস্ট অফিস। সেখান থেকে রওনা দিয়ে যাবো দুবলার চর।

কাগা খালের জেলে ভাইদের সঙ্গে লম্বা সময় কেটেছে। তাদের সবাইকে বিদায় দিলাম। হরিণ ধরার ফাঁদগুলো কেটে পানিতে ফেললাম। তারপর ছাড়লো ট্রলার। শীতকাল বলে বাতাস বইছে উত্তর থেকে। স্রোতও বইছে উত্তর থেকে দক্ষিণে। তাই খালের পানি একদম পুকুরের মতো ঠান্ডা। সুকানিতে দাঁড়িয়ে ট্রলার চালাচ্ছেন বেলায়েত সরদার। আমি বসলাম সামনের দিকে। বিকালের আলোতে সুন্দরবনের খাল-নদীর অপার সৌন্দর্যে ভরে ওঠে।

কাগা খাল ধরে প্রায় এক ঘন্টা চললাম। কোকিলমনির দোয়ায় আসার আগেই দেখলাম অনেকগুলো নৌকা। সবগুলোই কাঁকড়ার নৌকা। রাসমেলার আগে অনেক শিকারী নামে সুন্দরবনে। তাদের বেশির ভাগই বনে ঢোকে কাঁকড়া ধরার অনুমতি নিয়ে।

কোকিলমনি ফরেস্ট অফিসে গিয়ে পৌঁছালাম আরও আধা ঘন্টা পর। অফিসে উঠে বনরক্ষীদের বিস্তারিত জানালাম। এক কাপ লাল চা খেয়ে আবারও ছাড়লাম ট্রলার। বনরক্ষীরা বললেন, কাল সকালেই কাগা খালের ওই অঞ্চলে অভিযান চালাবেন তাঁরা।

তিনকোণা দ্বীপের দক্ষিণের খাল ধরে নেমে যাচ্ছি আমরা। পশুরে উঠতে উঠতে সূর্য হেলে গেছে পশ্চিমে। উল্টো পাশে ডুবছে সূর্য। দারুণ সুন্দর সেই দৃশ্য। আরেক কাপ চা আসলো। ঠান্ডা নদী ধরে এগিয়ে যাচ্ছি আমরা। নদীতে বেশ স্রোত। গোন-এর সময় বলে পানির চাপ একটি বেশি। সেই চাপ আর স্রোতে বেশ দ্রুত গতিতে চলছে আমাদের ট্রলার।

সন্ধ্যা নেমে গেছে। চাঁদ উঠবে আরও ঘন্টা দুই পর। অফিস খাল নামের বিশাল এক খালের মুখ পারি দিলাম। সেখানে একটু উথাল পাথাল ঢেউ খেয়ে উঠলাম উল্টো পাশে। সরদার বললেন, ট্রলারের তলাটা আবার ফুটো হয়েছে। কী বিপদের কথা!

আরেকটু এগিয়ে বাম পাশে একটি খাল আছে যার নাম লইট্যাখালী। সোজা গিয়ে ঢুকলাম সেখানে। পুরো খাল জুড়ে টিপটিপ করে আলো জ্বলছে। নৌকাগুলোতে জ্বলছে কেরোসিনের বাতি। আর খালের দুই পাশ জুড়ে জ্বলছে হাজার হাজার জোনাকি। নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে হয়। এমন স্বর্গীয় দৃশ্য দেখার কপাল সবার থাকে না।

(২০১৬ সালের কথা)

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top