রূপান্তরের গল্প ২৭২ | Rupantorer Golpo 272

বাঘ আর মানুষ, বাঘ বনাম মানুষ | রূপান্তরের গল্প ২৭২

বাঘ আর মানুষ, বাঘ বনাম মানুষ | রূপান্তরের গল্প ২৭২ | Rupantorer Golpo 272 | দস্যুমুক্ত সুন্দরবন | সুন্দরবনের গল্প | জীবনে ফেরার গল্প | Jibone Ferar Golpo | Sundarbaner Goppo | Story of Sundarbans | মোহসীন উল হাকিম | Mohsin Ul Hakim


রূপান্তরের গল্প ২৭২ : একটানা ঝিঁঝি পোকা ডাকছে। তার সাথে তাল মিলিয়ে জ্বলছে জোনাকি পোকা। কাছে বা দূর থেকে মাঝে মাঝে ভেসে আসছে হরিণের ডাক। নাম না জানা পাখির ডাকও শুনছি মাঝে মাঝে। এর মধ্যে চলছে আমাদের আড্ডা। ট্রলারটি নোঙ্গর করেছি লইট্যাখালী ঢুকতেই যে তিন মোহনা আছে সেখানে। চারপাশে এসে নৌকা বেঁধেছে জেলেরা। অনেকেই পরিচিত। অনেকের সাথে প্রথম দেখা।

চা খেতে খেতে আড্ডা চলছিলো। এসময় এক জেলে এসে বললো ব্রিজ খেলবেন ভাই? বললাম, আমি রাজি। চলেন বসে পড়ি। কার্ড খেলার মধ্যে ইন্টারন্যাশনাল ব্রিজ বেশ কৌশলী খেলা। ধারণা ছিলো শহরের শিক্ষিত মানুষেরাই বুঝি এসব খেলেন। কিন্তু এই গহীন বনে পড়াশোনা না জানা জেলেদের খেলা দেখে অবাক হলাম। প্রথমে চারজন মিলে বসেছিলাম। তবে কিছুক্ষণের মধ্যে আমাদের চারপাশ ঘিরে বসলো অন্যরা। প্রতিযোগিতা অন্য পর্যায় চলে গেছে। জেলেরা সবাই আমার সমর্থক। তারা ভাবতে পারেনি আমিও ভালো খেলি।

কাপের পর কাপ চা আসছে রান্নাঘর থেকে। ওদিকে বেলায়েত সরদার বসেছেন রান্নায়। তাঁকে সহযোগিতা করছেন শহীদুল কাকা। কী রান্না হচ্ছে জানি না। তবে ট্রলারের পেছনে রান্নাঘর যে পুরো ব্যস্ত তা টের পাচ্ছি। বেলায়েত সরদারের হাঁকডাকে সরগরম আমাদের ছোট্ট রান্নাঘরটি। সেখানেও জেলেরা ভীগ করেছে। সরদার কী যেন একটা নতুন আইটেম বানাচ্ছে। সবাই মিলে দেখছে সেই রান্না।

কুকু পাখি ডাকছে। তার মানে ভাটা শেষে জোয়ার লেগেছে। আমাদের ট্রলারের খোল একটু পর পর পানিতে ভরে যাচ্ছে। মামুন আর শহীদুল কাকা পানি ফেলানোর দায়িত্ব পালন করছেন একটু পর পর। চিন্তা ছিলো রাতের ভাটায় ট্রলার সারানোর কাজে নামবেন সরদার। কিন্তু লইট্যাখালী খালের ভিতরে সেরকম সুবিধাজনক জায়গা কম। এই রাতে মাটিতে নামাও ঝুঁকিপূর্ণ। বাঘের আনাগোণা খুব বেশি।

জেলেরা বললো, লইট্যাখালীর নিচে রূপের গাঙ নামে আরেকটি খাল আছে। এই দুই খালের জঙ্গলে জেলেরা সহজে নামে না। খুব প্রয়োজন না পড়লে মাটিতে পা দেয় না। এইখানে বাঘের হাতে মানুষের মৃত্যুর অসংখ্য ঘটনা আছে। রূপের গাঙ-এর ভাড়ানী দিয়ে যাওয়া যায় দুবলার চরের আলোর কোল। সেখান থেকে মেহের আলীর খাল চলে গেছে সাগরে। ফুলঝুরির ভাড়ানী ধরে যাওয়া যায় দুবলার চরের অফিস কেল্লায়।

এর মধ্যে বেলায়েত সরদার এসে যোগ দিলেন আড্ডায়। বললেন, এই অঞ্চলে যতো বাঘের তাড়া খাইছি ভাই ততোবার আপনি সুন্দরবনেও আসেননি। নড়েচড়ে বসলাম। বাঘের গল্প শুরু হয়ে গেছে। এবার আড্ডা জমবে। বাঘের গল্প শুনতে কার না ভালো লাগে?

একটা সময় ছিলো যখন দুবলার চরের শুঁটকির মৌসুম শুরুর এক দুই মাস আগেই মানুষ আসতো এই অঞ্চলে। তারপর চলতো গাছ কাটার মহাযজ্ঞ। চরের সাময়িক বসতির ঘর-বাড়ি আর জালের জন্য বড় বড় নোঙ্গর বানানো হতো গাছ দিয়ে। সেজন্য সবচেয়ে বেশি কাটা পড়তো সুন্দরী গাছ। হাজার হাজার বড় গাছ কেটে জেলে আর শুঁটকির সাবাড় মালিকদের কাছে বিক্রি করতো কয়েকটি চক্র। গাছ কাটার নিয়ম ছিলো না। অপকর্ম চলতো বনরক্ষীদের চোখের সামনে।

বড় বড় তিনটি গাছ দিয়ে তৈরি হয় এক একটি নোঙ্গর। একটি জাল ফেলতে দুইটি করে নোঙ্গর লাগে। সাগরে যে হাজার হাজার জাল পড়ে তার সবগুলোতেই যদি এই কাঠের নোঙ্গর ব্যবহার করা হয় তবে কতো হাজার গাছ লাগতে পারে অনুমান করা যায়। এবিষয়ে ২০০০ সালের আগে পরের ইতিহাস যতোটুকু জেনেছি তা বেশ হতাশাজনক। ২০০৯ সালের পর থেকে নিজের চোখে দেখছি সুন্দরবনকে। দেখছি জেলে বাওয়ালী আর মাওয়ালীদের জীবন যাপন। দেখেছি দুবলার চরের শুঁটকি পল্লীর জীবন।

বন ও বন্যপ্রাণি রক্ষায় নতুন করে আইন হয়েছে। সচেতনতাও বেড়েছে। বন বিভাগ চেষ্টা করছে সুন্দরবনের ওপর অত্যাচার কমাতে। কিন্তু বনদস্যুদের দাপট আর প্রতিষ্ঠানের অভ্যন্তরীণ নানা সংকটে তা সম্ভব হচ্ছে না। মন্দের ভালো হলো যে গাছ কাটার ঘটনা আগের চেয়ে কমেছে। ইদানিং সাগরের জেলেরা কাঠের নোঙ্গর ব্যবহার করা কমিয়েছে। লোহার নোঙ্গরের প্রচলন শুরু হয়েছে। একই সাথে শুঁটকি পল্লী গড়ে তুলতে তারা লোকালয় থেকে বাঁশ-কাঠ নিয়ে আসছে। বনের ওপর চাপ কমেছে খানিকটা।

কম-বেশি কুড়ি বছর আগের গল্প বলছিলেন কয়রার এক প্রবীণ জেলে। কার্তিক-অগ্রহায়ন মাস। বিভিন্ন জায়গা থেকে সুন্দরবনের এই এলাকায় গাছ কাটতো মানুষ। তখন বাঘের চাপ ছিলো অনেক বেশি। বাদায় নামলে প্রতিদিনই কেউ না কেউ পড়তো। মানে জঙ্গলে পা রাখলেই বাঘের আক্রমণে মরতো। তখন প্রতিদিন সংখ্যার হিসাব হতো। যেদিন মানুষ কম পড়তো সেদিন নিজেদের ভাগ্যবান মনে করতো মানুষ।

সুন্দরবনের যে অঞ্চলে আমরা আছি এই অঞ্চল জুড়ে সেবার একদিনে নাকী ৬০ জনের বেশি মানুষ বাঘের আক্রমণের শিকার হয়। তথ্য প্রমাণ আমার হাতে নাই। তবে এই গল্প আগে পরে শুনেছি প্রত্যক্ষদর্শীদের মুখে। জেলেরা বলে, বাঘের চাপের বিবেচনায় এরকম আরেকটি জায়গা আছে সুন্দরবনে। সেটি হলো উত্তর তালপট্টি।

এবার শুরু করলেন সরদার। বললেন, একবার সুন্দরবনের ভেদাখালী খাল ধরে যাচ্ছি। একটা বাইন গাছের গোঁড়ায় ট্রলার ধরা হলো। গাছের পেছনে হুদো বনের ভেতর কিছু একটা আছে। হরিণ মনে করে আগায়ে গেলো একজন। গলুই-এ বসে চিৎকার করে বললো, বাআআআ।

বাঘ দেখলে নাকী কেউ বাঘ বলে চিৎকারও দিতে পারে না। ভয় আর আতঙ্ক এমন ভাবে চেপে বসে যে গলা দিয়ে শব্দ বের হয় না। নিজের এমন অভিজ্ঞতা হয়নি এখনও। এমন অভিজ্ঞতা না হোক।

জোয়ার হচ্ছে। বাড়ছে পানি। পূর্ব আকাশে মনে হলো আগুন লেগেছে। চাঁদ উঠছে। আজ সম্ভবত চতুর্দশী। রাস পূর্ণিমা কাল। জেলেরা গোছগাছ করছে। এই জোয়ারে বেরিয়ে যাবে যে যার মতো। ট্রলারে বসে গল্প চলছে এখনও। সরদার বললেন, বাঘের হাত থেকে বাঁচার জন্য এক সময় গুণীন নিয়ে আসতাম আমরা। ওরা কুফরি কালাম দিয়ে বাঘকে বশ করতে পারতো।

গুণীনদের নিয়ে অনেক গল্প শুনেছি। তারা মন্ত্র পড়ে বাঘের মুখে খিলান দিতো। মানে মন্ত্রে অবশ হয়ে যেতো মহাপরাক্রমশালী বাঘ। গড়ান ও গোলপাতা কাটতে যখন বাওয়ালীরা আসতো, তারা গুণীন ভাড়া করে আনতো। এখন গড়ান গাছ কাটার অনুমতি নাই। গোলপাতা কাটার অনুমতি দেওয়া হয়। কিন্তু আগের মতো চাহিদা না থাকায় গোলপাতা সংগ্রহও কমে গেছে। এছাড়া বাঘের চাপও কমে গেছে বলে কদর কমেছে গুণীনদের।

বেলায়েত সরদারকে বললাম, গুণীনরা কি বেঁচে আছে এখনও? বললেন, অনেকেই বেঁচে আছে। তবে তারা এই পেশা ছেড়েছেন। এছাড়া অনেক গুণীনকে বাঘেই খেয়েছে। আগের প্রজন্মের মানুষ ছিলো খাঁটি। তাই তাদের মন্ত্র কাজ করতো। এখন আর মন্ত্র কাজ করে না মনে হয় ভাই। মনে মনে ঠিক করলাম, বনদস্যুদের নিয়ে কাজ শেষ হলে বাঘ আর গুণীনদের নিয়ে কিছু কাজ করবো।

কলকল করে বইছে স্রোত। পানি বাড়ছে। পূর্ব আকাশে উঁকি দিয়েছে চাঁদ। সে এক অভাবনীয় দৃশ্য। রাত গভীর হলো। চাঁদ উঠলো মাঝ আকাশে। সরদার বললেন, খেয়ে নেন ভাই। এই জোয়ারে আমরাও রওনা দিবো। বললাম, ফাটা ট্রলার নিয়ে রওনা দিবেন? বললেন, পানি সেঁচতে সেঁচতে আগাবো। এখানে ট্রলার ডক করতে পারবো না। সকালের ভাটায় মরণ চরে গিয়ে ভিড়বো। সেখানেই সারাবো ট্রলার।

সবাই মিলে বসে পড়লাম। সাদামাটা খাবার ভেবে বসেছি। কিন্তু খেতে বসে দেখি কাঁকড়ার ভুনা। ঝাল করে করা কাঁকড়া ভুনার সাথে ছিলো গরম ডাল, গরম ভাত।

(২০১৬ সালের ঘটনা প্রবাহ)

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top