রূপান্তরের গল্প ২৭৩ | Rupantorer Golpo 273

সুন্দরবনের কাঁকড়া কাহিনী | রূপান্তরের গল্প ২৭৩

সুন্দরবনের কাঁকড়া কাহিনী | রূপান্তরের গল্প ২৭৩ | Rupantorer Golpo 273 | দস্যুমুক্ত সুন্দরবন | সুন্দরবনের গল্প | জীবনে ফেরার গল্প | Jibone Ferar Golpo | Sundarbaner Goppo | Story of Sundarbans | মোহসীন উল হাকিম | Mohsin Ul Hakim


রূপান্তরের গল্প ২৭৩ : সুন্দরবনের কাঁকড়ার মধ্যে মনে হয় আলাদা কিছু আছে। ঠিকঠাক রান্না হলে এর স্বাদ যেন সবকিছুকে ছাপিয়ে যায়। আর সেই রান্না যদি হয় সুন্দরবনের গহীনে তাহলে তো কথাই নাই। আবার বেলায়েত সরদারের হাতের রান্নার আলাদা ব্যাপার আছে। রান্নার নির্দিষ্ট কোনো রেসিপি নাই। তবুও এতো স্বাদ কী করে হয় তিনিই জানেন। সবচেয়ে মজার বিষয় হলো, কখনও মানুষ বেড়ে যায়। তখনও সবাইকে একই রান্না দিয়ে পেট পুরে খাইয়ে দিতে পারেন আমাদের সরদার। এছাড়া আবহাওয়া আর পরিবেশ পরিস্থিতির ওপরও তার রান্নার ধরণ নির্ভর করে।

ট্রলারের তলা আবার ফুটো হয়ে গেছে। তাই সরদারের মন মেজাজ ভালো না। ট্রলারের অন্য সহযোগীদের তিনি রেখেছেন বকাঝকার মধ্যে। খাওয়া শেষে আমরা রওনা দিবো। ফুটো ট্রলার নিয়ে ওই বড় নদীতে নামাটা ঝুঁকির বিষয়। কিন্তু এখন কিছু করারও নাই।

খাওয়া-দাওয়া শেষ হলো। ট্রলারের খোলের ভিতরে ঢুকে তলার ফাটলটা ভালো করে দেখে নিতে হবে। মামুন আর শহীদুল কাকু মিলে পানি সেঁচে ফেললো। তাদের সহযোগিতা করলো অন্য জেলেরা। তলার পানি ফেলার পর বেলায়েত সরদার নিজের চোখে ফাটলটা দেখলেন। একটি কাপড় দিয়ে ফুটো বন্ধ করে দিলেন। যদিও এতে কাজ হবে না। তারপরও প্রাথমিক ধাক্কার কিছুটা সামাল দেওয়া যাবে। মামুনকে বলা হলো পুরোটা সময় পা দিয়ে ফাটলটা চেপে ধরে রাখবে।

জেলেদের অনেকে নদীতে চলে গেছে। যারা তখনও ছিলো তাদের কাছ থেকে বিদায় নিবো। একটি টুকরিতে অনেকগুলো কাঁকড়া নিয়ে ট্রলারে তুলে দিলো এক জেলে। বললাম, কাঁকড়া খেলাম তো আমরা। আর লাগবে না। জেলেরা বললো, কাঁকড়া আপনার পছন্দ দেখলাম। তাই কয়টা দিলাম। পরে রান্না করে খাবেন। টুকরিটা হাতে তুলে নিলাম। সিনথেটিক সূতা দিয়ে বাঁধা। সবগুলোই বড়। ওজন না হলেও পাঁচ কেজি হবে। এই কাঁকড়ার বাজার মূল্য না হলেও পাঁচ হাজার টাকা হবে।

প্রান্তিক মানুষগুলোর মন যে অনেক বড় তার প্রমাণ প্রায়ই পাই। নদী-সাগর থেকে ধরা সবচেয়ে বড় মাছটি তারা উপহার হিসাবে দিয়ে দিতে পারে। এই যে কাঁকড়াগুলো উপহার হিসাবে দিতে চাচ্ছে তার দাম দিয়ে এদের এক সপ্তাহের বাজার খরচ হয়ে যায়। কী বিশাল মন তাদের। ধন্যবাদ জানালাম। তারপর কাঁকড়াগুলো ফেরত দিলাম। ওদের নৌকায় নেমে খোলের ভিতর থেকে কেজি খানেক ছোট কাঁকড়া নিলাম।

ধন্যবাদ দিয়ে ফিরে আসলাম ট্রলারে। কাঁকড়া শিকারীদের ওই নৌকায় দশ কেজি চালের একটি ব্যাগ উঠিয়ে দিলাম। খাবার পানির বোতল দিলাম। সরদার কিছু শুকনা খাবার তুলে দিলেন ওদের নৌকায়। সুন্দরবনের জেলেরা মন থেকে কিছু দিলে তার বিনিময়ে কিছু চায় না। টাকা দিলে মন খারাপ করে। তাই বিনিময় প্রথার মধ্য দিয়ে তাদের কাছে থেকে নেওয়া মাছ বা কাঁকড়ার দাম দেওয়ার চেষ্টা করি। এছাড়া টাকা দিয়ে এই টাটকা-তাজা পণ্যের মূল্য পরিশোধ করা সম্ভব না।

ট্রলারের ইঞ্জিন চালু করতে গেছেন বেলায়েত সরদার। কিন্তু কোনো কারণে যান্ত্রিক সমস্যা দেখা দিয়েছে। স্টার্ট হতে হতে হচ্ছে না। একটি হ্যান্ডেল ঘুরিয়ে ইঞ্জিন চালু করতে হয়। বেশ পরিশ্রমের। সরদার রীতিমতো ঘেমে গেছেন। এরপর মামুন এসেও কয়েক বার চেষ্টা করলো। কিন্তু কাজ হচ্ছে না। তেলের লাইনে বাতাস ঢুকে গেছে। ঠিকঠাক করে রওনা হবো আমরা।

কাঁকড়ার জেলেরা যারা ছিলো তারাও সহযোগিতা করছে। এই জঙ্গলে এটি একটি দারুণ ভালো লাগার বিষয়। সবাই সবাইকে সহযোগিতা করে। কাউকে বিপদে ফেলে রেখে কেউ চলে যায় না। হয় সমাধান করে, অথবা সমাধানের একটি পথ তৈরি করে। কখনও নষ্ট হয়ে যাওয়া কোনো পার্টস দিয়ে সহযোগিতা করে। তেল-মবিল দিয়ে সহযোগিতা করে। সমাধান না হলে ট্রলার বা নৌকাটি সাথে করে বেঁধে নিয়ে যাওয়া এখানকার দৈনন্দিন ঘটনা। যা কিছু হোক, বিপন্ন কাউকে ফেলে রেখে যাবে না তারা।

ইঞ্জিন সারাইয়ের কাজ চলছে। আমার কোনো কাজ নাই। তাই জেলেদের নৌকায় গিয়ে উঠলাম। চুলা জ্বালালো তারা। চা তুললো। গল্পে গল্পে নতুন করে জানলাম সুন্দরবনের কাঁকড়ার হালচাল। লইট্যাখালী খালের ভিতরে এখন যে কয়টি নৌকা আছে, সবগুলোই কাঁকড়ার নৌকা। মানে কাঁকড়া শিকারীদের নৌকা। সুন্দরবনে নির্দিষ্ট নিয়ম মেনে কাঁকড়া আহরণ করে জেলেরা। এজন্য অনুমতি নিতে হয়। বৈধ জায়গায়, বৈধ সময়ে কাঁকড়া ধরে আবার ফিরে যেতে হয়।

কাঁকড়ার কারবার বেশ লাভজনক। তবে চ্যালেঞ্জও আছে। সবচেয়ে বড় কাজ হলো ধরার পর কাঁকড়াগুলোকে বাঁচিয়ে রাখতে হয়। জীবিত অবস্থায় সুস্থ্য আর অক্ষত কাঁকড়া নিয়ে আড়তে ফিরতে না পারলে সেই চালানের কোনো দামই পাওয়া যায় না। দ্রুতগামী কোনো নৌযানের অনুমতি দেয় না বন বিভাগ। দূর সুন্দরবনে নৌকা বেয়ে আসতে হয় তাদের। আবার কাঁকড়া নিয়ে নৌকা বেয়ে ফিরতে হয় লোকালয়ে। ট্রলারে করে কাঁকড়া পরিবহন এখানে নিষেধ। নিষিদ্ধ হলেও বন বিভাগের চোখ এড়িয়ে ও ম্যানেজ করে ট্রলারে করেই বেশির ভাগ কাঁকড়া সুন্দরবন থেকে লোকালয়ে নেওয়া হয়।

অবৈধ কাঁকড়া আহরণ বন্ধে বন বিভাগ বেশ কঠোর। তবুও বৈধ পদ্ধদির পাশাপাশি সুন্দরবনে অবৈধ ভাবেও চলে এই কারবার। চলবে না কেন? এক সময়ের ছোট পরিসরের কাঁকড়ার বাজার এখন ফুলে ফেঁপে বিশাল আকার ধারণ করেছে। এক সময় শুধু গ্রেড এর কাঁকড়ার বাজার ছিলো বন উপকূলে। রপ্তানী পণ্য বলে এর ভালো দাম পাওয়া যায়। তবে গ্রেড বিহীন অর্থাৎ ছোট কাঁকড়া ছিলো এক রকম মূল্যহীন। তাই জেলেরা গ্রেড ছাড়া কাঁকড়া ধরতো না। কিন্তু এখন কোনো রকম বাছ বিচার করে না জেলেরা।

সুন্দরবনে কাঁকড়া বেশ সুস্বাদু। মাড ক্র্যাব নামে পরিচিত সারাবিশ্বে। এই কাঁকড়া শিকারের বৈধ সরঞ্জাম হলো, দোন-দড়ি। সাধারণত কুচিয়ার টোপ ব্যবহার করে বড়শির মতো এ পদ্ধতিতে কাঁকড়া ধরেন জেলেরা। এজন্য নির্দিষ্ট সময়ে পাস-পার্মিট নিয়ে বনের নির্দিষ্ট খাল-নদীতে যাওয়ার অনুমতি নিতে হয়। অনেক আগে থেকে এভাবেই চলছে। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে চাহিদা বাড়তে থাকে। রপ্তানী পণ্য হিসেবে কাঁকড়ার বাজারও চড়তে থাকে। পাশাপাশি স্থানীয় চাহিদাও বাড়তে থাকে সমান তালে।

চাহিদা পূরণের জন্য এরপর চারো বা আটোন নামের এক ধরণের ফাঁদ দিয়ে সুন্দরবনে কাঁকড়া শিকার শুরু করে জেলেরা। বাঁশ দিয়ে তৈরী এই ফাঁদ সুন্দরবনে নিয়ে আসেন কক্সবাজারের চকোরিয়া থেকে আসা এক জেলে। সঙ্গত কারণে তাঁর নাম বলছি না। অনেক বেশী কাঁকড়া ধরার জন্য এই চারো বা আটোন পদ্ধতি অনেক বেশী কার্যকর। তবে বন বিভাগ এই পদ্ধতিতে কাঁকড়া ধরার অনুমতি দেয় না, এটি অবৈধ। তারপরও চুরি করে সুন্দরবনজুড়ে চলে এই অবৈধ কাজ।

সুস্বাদু খাবার হলেও আমাদের খাদ্যাভ্যাসে কাঁকড়া সেভাবে নাই। সুন্দরবনে আসার আগে কাঁকড়া খাইনি কখনও। রুচি হয়নি। এটি আমাদের ধর্ম অনুসারে হালাল নাকী হারাম, সেবিষয়েও বিভ্রান্তি ছিলো। শহরের বড় বড় রেস্তোঁরায় কাঁকড়ার নানা রকমের রান্না হয়। খাওয়া হয়নি কখনও। বিভ্রান্তি কাটে সুন্দরবনে কাজ করতে গিয়ে।

উপকূলের মানুষদের চাহিদা মিটিয়ে তাই রপ্তানী পণ্য হিসেবেই এটি বহুল পরিচিত। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে কাঁকড়ার চাহিদা বাড়তে থাকে। আগে শুধু গ্রেড হিসেবে নির্দিষ্ট ওজনের জীবিত কাঁকড়া রপ্তানী হতো। সেগুলোর চড়া দামও পেতো জেলে-ব্যবসায়ীরা। তখন গ্রেড এর নিচের কাঁকড়ার দাম ছিলো না তেমন, চাহিদাও ছিলো না।

গত এক-দেড় দশকে কাঁকড়ার চাহিদা বেড়েছে কয়েক গুন। উপকূল জুড়ে এখন নন-গ্রেড অর্থাৎ ছোট কাঁকড়ারও অনেক চাহিদা। এখন অনেকেই চিংড়ি ছেড়ে কাঁকড়া চাষে নেমেছেন। বন থেকে ধরা ছোট কাঁকড়াগুলো কম দামে কিনে নেন তাঁরা। এরপর মোটা তাজা করে আবার বিক্রি করেন।

এরপর কাঁকড়ার নতুন আরেকটি চাহিদার জায়গা তৈরি হয়েছে। সেটি হলো, সফট শেল ক্র্যাব প্রক্রিয়াজাত ও রপ্তানীকারক প্রতিষ্ঠান। শুধু সাতক্ষীরার শ্যামনগরেই এ ধরণের অন্তত সাতটি বড় প্রকল্প গড়ে উঠেছে, যাদের বক্স এর সংখ্যা এক লাখ থেকে সাড়ে ছয় লাখ বা তারও বেশী। এই খামারগুলোতে বড় বিনিয়োগ করেছেন উদ্যোক্তারা। ঘের বা জলায় এক রকমের বাক্সের ভিতরে কাঁকড়া রাখা হয়। খাবার দাবার দেওয়া হয়। তারপর খোলস ছাড়লেই তুলে নিয়ে ফ্রিজিং করা হয়। শক্ত খোলস থাকে না বলে এটির নাম- সফট শেল ক্র্যাব।

যতটুকু জেনেছি, এক্ষেত্রে ত্রিশ গ্রাম থেকে দেড়শ গ্রাম ওজনের কাঁকড়া হলেই চলে। খোলস পাল্টানোর সময় নরম কাঁকড়াটিকে তুলে ফ্রিজে রাখা হয়। পশ্চিম উপকূলের শুধু শ্যামনগর উপজেলার সফট ক্র্যাব প্রকল্পগুলোতে বাক্সের সংখ্যা সব মিলিয়ে বিশ লাখের কম নয়। অর্থাৎ একবারে বিশ লাখ কাঁকড়া প্রয়োজন এই কয়টি খামারে। বন উপকূল জুড়ে আরও কতোগুলো সফটশেল খামার আছে জানা নাই।

ভাবছি, সফট ক্র্যাব এর প্রজেক্ট, জীবিত কাঁকড়া রপ্তানী, স্থানীয় ঘেরে মোটা-তাজা করণ আর স্থানীয় খাবারের চাহিদা পূরণ করতে কত লাখ কাঁকড়ার প্রয়োজন? সেই হিসাবটি ধারণা করে বলতে পারছি না। তবে সেটি যে অনেক বড় সংখ্যার তা অনুমান করাই যায়। আর এই চাহিদা মূলত সুন্দরবনকেই পূরণ করতে হচ্ছে, এটুকু নিশ্চিত। এবিষয়ে লিখলে বা বললে কাঁকড়ার ব্যবসার সাথে জড়িতরা মন খারাপ করেন। অনেকে রাগ করেন।

অনেকেই বলার চেষ্টা করেন যে আমার এই কথাগুলো উপকূলের দরিদ্র মানুষদের বিপদের কারণ হচ্ছে। আমি বলি, সোনার ডিম পাড়া হাঁসের মতো করে সুন্দরবনকে পুরোপুরি খেয়ে ফেললে তো এই মানুষরাই বিপন্ন হবে। অপরিকল্পিত আর বেহিসাবী কাঁকড়া তুলে ফেললে সুন্দরবনের প্রাণবৈচিত্রও হারাবে ভারসাম্য। সুন্দরবন হারিয়ে গেলে তখন কী হবে আমাদের?

লাভজনক ব্যবসা কাঁকড়ার জোগান দিতে মরিয়া ব্যবসায়ীরা। সেই চাহিদা পূরণে ব্যস্ত জেলেরা। সেজন্য শুধু বৈধ পদ্ধতিতে, বৈধ জায়গায়, অনুমোদিত সময়ে কাঁকড়া ধরলে তো চলবে না। অন্যদিকে এই চাপ নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছে বন বিভাগ। কিন্তু কোনো বাধাই এদের আটকাতে পারবে বলে মনে করি না।

বৈধ পদ্ধতি অর্থাৎ দোন-দড়ি দিয়ে কাঁকড়া ধরে খুব কম জেলে। বন বিভাগ বা সংশ্লিষ্টদের দেখানোর জন্য কিছু বৈধ সরঞ্জাম দেখায় তারা। চুরি করে অবৈধ পদ্ধতি চারো বা আটোন দিয়েই কাঁকড়া ধরে তারা। আর সুযোগ বুঝে নিষিদ্ধ এলাকাগুলোতেও চলে এ অপকর্ম।

কাঁকড়া ধরার আরেকটি অবৈধ পদ্ধতি আছে। সেটি হলো আড়া কল। অসাধু জেলেরা বনের ভেতরে উঠে এই পদ্ধতিতে কাঁকড়া ধরে। বিশেষ করে প্রজনন মৌসুমে বেশী চলে এই অপকর্ম। প্রজননের সময় কাঁকড়া ধরা নিষেধ। কিন্তু সে সময়ও চুরি করে কাঁকড়া ধরে জেলেরা। সাগরের জালেও এসময় মারা পড়ে ডিমওয়ালা কাঁকড়াগুলো।

সুন্দরবনের কাঁকড়া বাঁচাতে ইঞ্জিনচালিত ট্রলারে পরিবহন করতে দেয় না বন বিভাগ। কিন্তু চুরি করে এখনও বন থেকে কাঁকড়া আনা হয় ট্রলারে করে। বন বিভাগ প্রায়ই এমন কাঁকড়াবাহী ট্রলার আটক করে। কিন্তু এত বড় সুন্দরবনের কয়দিক তাঁরা পাহাড়া দিবেন?

শুধু একটি উপজেলা শ্যামনগরেই যদি প্রতি মাসে ত্রিশ থেকে পঞ্চাশ লাখ কাঁকড়ার চাহিদা থাকে, তবে বাকী উপকূলের চাহিদা কতো হতে পারে? ধারণা করে এই হিসাব বলার সুযোগ নাই। তবে চাহিদাটি যে বিশাল, তা যে কেউ অনুমান করতে পারবেন।

সুন্দরবনের কাঁকড়ার ওপর চলছে নিরব অথচ ভয়ঙ্কর চাপ। হ্যাচারিতে কাঁকড়ার প্রজননের চেষ্টা চলছে। আমার জানা মতে সেটিও সফল হয়নি এখনও। ফলে সুন্দরবনকেই যোগান দিতে হচ্ছে এই চাহিদা। অবশ্য উপকূলের অন্য এলাকা থেকেও কিছু কাঁকড়া আসে শুনেছি। তবে সেই সংখ্যা বা পরিমান নিয়ে প্রশ্ন আছে।

এবার ভিন্ন প্রসঙ্গ, তবে সুন্দরবনের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রসঙ্গ। সেটি হলো, পরিবেশ বিপর্যয়। ছোট-মাঝারি-বড় কাঁকড়াগুলো ধরা হচ্ছে নিষিদ্ধ পদ্ধতি- চারো বা আটোন এর মাধ্যমে। পশ্চিম সুন্দরবনের একটি স্টেশনের অন্তর্গত সুন্দরবনে এক হাজারেরও বেশী নৌকা যায় কাঁকড়া ধরতে। মাসে দুই দফা তারা কাঁকড়া ধরে বনের ভিতর থেকে।

প্রতিটি নৌকায় দুইজন থাকেন। এক একটি নৌকায় চারো থাকে অন্তত দুইশ। বড় নৌকায় থাকে সাড়ে চারশ পর্যন্ত। সর্বনিম্ন দুইশ ধরে সেই হিসেবের সঙ্গে নৌকার সংখ্যা যোগ দিলে হিসাব দাঁড়ায় দুই লাখ। প্রতি পক্ষে অর্থাৎ একটি গোনে এই দুই লাখ চারো বসানোর জন্য একটি করে খুঁটি প্রয়োজন হয়। এই খুঁটি তো আর এলাকা থেকে নিয়ে যায় না জেলেরা!

এজন্য ছোট গড়ান বা সুন্দরী গাছের প্রয়োজন হয়। সেই হিসাবে প্রতি পনেরো দিনে শুধু পশ্চিম সুন্দরবনে কাঁকড়ার চারো স্থাপনের জন্য দুই লাখ গড়ান গাছ কাটা পড়ছে? হিসাবটি একটু এদিক সেদিক হতে পারে, তবে উড়িয়ে দেওয়া সম্ভব নয়। এই হিসাব করলে পুরো সুন্দরবনে কতগুলো ছোট গড়ান বা সুন্দরী গাছ কাটা পড়ছে তার হিসাব অনুমান করতে পারেনন? হিসাবটি ভয়াবহ, সুন্দরবনের জন্য এটি বিশাল দুর্যোগ। উপরে তুলে ধরা হিসাবকে চুড়ান্ত বলছি না। তবে বাস্তবতার সঙ্গে এর অনেক বেশি অমিল হবে বলেও মনে করি না।

এর বাইরে কাঁকড়া ধরতে গিয়ে অবৈধ শিকারসহ নানা ধরণের অপকর্মে জড়িয়ে পড়ে সুন্দরবনের মানুষেরা। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে যারা কাঁকড়া আহরণ করে তারা যদি পর্যাপ্ত দাম পেতো তাও নিজেকে সান্তনা দিতে পারতাম। সেটা তো আর হয় না। হলে জেলেদের চেহারা এমন থাকে না। সুন্দরবনের মাছ-কাঁকড়ার লাভের বড় অংশ চলে যায় মহাজনদের পকেটে। বনদস্যুদের সাথে নিবিড় সম্পর্ক রেখে এই ব্যবসা পরিচালনা করেন প্রত্যেক ব্যবসায়ী। কেউ শুধু চাঁদা দিয়ে চলেন। কেউ পুরো দুষ্টুচক্রের সাথে জড়িত। সুন্দরবনে দস্যু থাকায় এই দুষ্টু চক্রের ব্যবসা বেশ রমরমা। তাই তারা কিছুতেই চায় না সুন্দরবন দস্যুমুক্ত হোক।

বনদস্যুদের নিয়ে কাজ করতে গিয়ে অনেক কিছুই দেখছি। সাংবাদিক হিসাবে অনেক বিষয়ে কাজ করার আছে। কিন্তু একসাথে অনেকগুলো কাজ আমি করতে পারি না। তাই আপাতত দস্যুমুক্ত সুন্দরবনের যে সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে সেটি অব্যাহত রাখতে চাই। কখনও সফল হলে অন্য বিষয় নিয়ে কাজ করা যাবে।

চা খাচ্ছি আর গল্প করছি কাঁকড়ার জেলেদের সাথে। অর্ধেক ভাটা হয়ে গেছে। এর মধ্যে ইঞ্জিনও চালু হলো। বেলায়েত সরদার ডাক দিলেন। চা খেয়ে জেলেদের বিদায় দিলাম। ট্রলার ছাড়লো। লইট্যাখালী খালের ভিতরটা পরিস্কার দেখতে পাচ্ছি। রাসের চাঁদ মাঝ আকাশ থেকে পশ্চিমে হেলে পড়েছে। এই আলো থাকতে থাকতে পশুর নদী ধরে আমরা পৌঁছে যেতে চাই দুবলার চরে।

(ঘটনা: সুন্দরবন ২০১৬)

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top