আবারও অপহরণ! অস্থির সুন্দরবন! | রূপান্তরের গল্প ২৭৪ | Rupantorer Golpo 274 | দস্যুমুক্ত সুন্দরবন | সুন্দরবনের গল্প | জীবনে ফেরার গল্প | Jibone Ferar Golpo | Sundarbaner Goppo | Story of Sundarbans | মোহসীন উল হাকিম | Mohsin Ul Hakim
রূপান্তরের গল্প ২৭৪ : পশুর নদী ধরে ছুটছি নিচের দিকে। মানে দক্ষিণেো সাগরের দিকে। মাঝ আকাশে জ্বলজ্বল করছে ত্রয়োদশীর চাঁদ। তাই রাত হলেও চারপাশটা পরিস্কার দেখা যাচ্ছে। অবশ্য রাতের সুন্দরবনে পথ চিনতে হলে খুব বেশি আলোর প্রয়োজন হয় না। দুই পাশের সুন্দরবনকে দেখা যায় দূর থেকে। এদিকে পথ চিনে চলতে এই জঙ্গলের সারি অনুসরণ করে জেলেরা। বনস্যুরাও চলাফেরা করে একই নিয়মে। আমরা বাম পাশের জঙ্গল নজরে রেখে এগিয়ে চলছি।
নদীতে একটু রোলিং আছে। তীর ধরে গেলে একটু বেশি দুলছে ট্রলার। মাঝ নদীতে গেলে ভালো হতো। কিন্তু যাওয়ার উপায় নাই। ট্রলারের তলার ফুটো। কোনো কারণে সেখানে চিঁড় ধরলে বিপদ বাড়বে। প্রাণহানির মতো বড় দুর্ঘটনাও ঘটতে পারে। পশুর নদী এদিকে বিশাল বড়। এপাশ ওপাশ দেখা যায় না। গভীরাও বেশি। বিপদ হলে সাঁতরে কূলে যাওয়া আমার মতো সাঁতারুর কাজ না। তাই বাড়তি ঝুঁকি নিবো না।
ট্রলারের তলার ফুটো দিয়ে পানি ঢুকছে। খোল ভরে যাচ্ছে অল্প সময়ের মধ্যে। একদিকে ছপ ছপ করে পানি সেঁচা চলছে। শহীদুল কাকু আর মামুন পালা করে এ দায়িত্ব পালন করছেন। তলানিতে পানি জমতে দেওয়া যাবে না কিছুতেই। বড় নদীতে উঠে আমার হাতে সুকানি ধরিয়ে দিয়ে বেলায়েত সরদার গেছেন নিচে। ফাটা জায়গাটা সব সময় নজরে রাখতে তিনি নিজেই খোলের ভিতরে ঢুকে বসে আছেন। টর্চ হাতে ভিতরটা নজরে রেখেছেন তিনি।
দীর্ঘ অভিজ্ঞতায় সুন্দরবনের অনেক জায়গা চিনেছি। একা একা অর্ধেক সুন্দরবন চিনে ঘুরতে পারবো। তবে জোয়ার ভাটার সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে না পারলে সময় মতো গন্তব্য পৌঁছানো সম্ভব না। সেজন্য অনেক বেশি অভিজ্ঞতা থাকতে হবে। এছাড়া নিচের দিকের খাল-নদীর কোথায় কোথায় ডুবো চর আছে সেটিও জানতে হবে।
সাগরের মুখের নদী-খালগুলোতে ডুবো চরের অভাব নাই। ভাটার সময় কোনো খালের মুখে আটকা পড়লে বিপদ বাড়ে। ট্রলার ছাড়ানো যায় না। সেজন্য অপেক্ষা করতে হয় পরের জোয়ারের জন্য। অন্তত ছয় ঘন্টার জন্য আটকা পড়তে হবে। এই সময় যদি সাগর নদীর পানি উত্তাল থাকে তবে বালির চরের সাথে ধাক্কা খেয়ে পুরো ট্রলার ফেটে যেতে পারে।
ট্রলারের সুকানি ধরে দাঁড়িয়ে আমি। একাই দাঁড়িয়ে আছি। সামনে রূপের গাঙ। পশুর থেকে খালটি গেছে পূর্ব দিকে। তবে আমরা ওদিকে যাবো না। সোজা চলে যাবো। তবে এখানে একটু ঝামেলা আছে। এদিকে পশুর নদীর অনেকটা জুড়ে ভাঙ্গন চলছে কয়েক বছর ধরে। আধা জোয়ারে পানি নেমে যায়। না জানলে চরে আটকা পড়তে হয়।
এদিক দিয়ে যাওয়া আসার সময় প্রায়ই দেখি চরে আটকে আছে ট্রলার। একবার একটি পর্যটকবাহী লঞ্চও আটকা পড়েছিলো এখানে। সরানো যায়নি। পরে অন্য লঞ্চ এনে পর্যটকদের নিয়ে যাওয়া হয়। ঝুঁকিগুলো জানা না থাকলে উপকূলে পথ চলা খুব কঠিন।
রূপের গাঙ এমনিতে খুব সুন্দর একটি খাল। তবে এখানে বাঘের চাপ খুব বেশি। এখানে মাছ অনেক। জেলেরাও আসে মাছ আর কাঁকড়া ধরতে। কিন্তু সহজে এখানকার জঙ্গলে নামে না। এখানে তারা আসে যায় বনের ভিতরের খাল আর ভারানী দিয়ে।
চলতে চলতে ডুবো চরে আমাদের ট্রলারের তলা ঠেকে যাচ্ছে। শুরুতে টের পাইনি। ভিতর থেকে চিৎকার করে মাঝ নদীতে যেতে বললেন সরদার। সুকানি ঘুরিয়ে পশ্চিমে নিলাম ট্রলার। চরে ঠেকতে ঠেকতে কোনো রকমে খাঁড়িতে গিয়ে পড়লাম।
এটুকু সময়ের মধ্যে তলার ফুটোটা বড় হয়ে গেছে। নতুন করে চিঁড় ধরেছে সেখানে। বালির সাথে ধাক্কা খেয়ে ফাটলটা বড় হয়েছে। সাথে সাথে একটি কাঁথা নিয়ে সেখানে চেপে ধরলেন সরদার। পা দিয়ে চাপ দিয়ে রেখে অন্যদের বকাঝকা করলেন। আমাকে কিছু বলতে পারছেন না বলে অন্যদের একটি বেশি বেশি বকছেন তিনি। বিপদের সময় মাথা একটু গরম থাকে। ফাটা ট্রলার নিয়ে পশুর নদীর মোহনাতে চলাফেরা করাটা বেশে ঝুঁকির।
ভাটার টান ছিলো বলে বেশি সময় লাগেনি। দেখতে দেখতে চলে এসেছি দুবলার চরের পশ্চিম প্রান্তে। এখানে যে চরটি আছে তার নাম মরণ চর। মরণ চরের পশ্চিম আর দক্ষিণে ভাঙ্গণ লেগেছে। সেখানে পৌঁছাতেও ডুবো চরের কারণে বেশ বেগ পেতে হয়।
বেলায়েত সরদার এসে সুকানি ধরলেন। হিসাব করে মরণ চরের একপাশে উঠিয়ে দিলেন ট্রলার। রাতে এখানেই থাকবো। এই ভাটা যখন শেষ হবে তখন ট্রলার থাকবে পুরোপুরি ডাঙ্গার ওপর। বেশ কায়দা করে ট্রলারটি রাখা হলো। বেলায়েত সরদারের কেরামতি দেখলাম আরেক বার।
শুঁটকির মৌসুম চলছে দুবলার চরে। এখানে অনেকগুলো ট্রলার রাখা। এখানে একটি বাজার আছে, নিউমার্কেট নামে পরিচিত। সেখানে ওয়ার্কসপ আছে, ট্রলার সারানোর যাবতীয় সরঞ্জাম পাওয়া যায়। লাফ দিয়ে নেমে পড়লেন সরদার। ঘন্টা খানেকের মধ্যে পুটিংসহ ট্রলারের ফুটো সারানোর জিনিষপত্র নিয়ে আসলেন।
সাধারণত ডাঙ্গায় বাধিয়ে নৌকা বা ট্রলার সারানোর কাজ করেন জেলেরা। আমরাও একবার চেষ্টা করেছি। কিন্তু ভালো মতো ফেটে যাওয়া অংশ মেরামত করা যায়নি। তাই আসার পথে ফেটেছে আবার।
এই রাতে পুরোদমে কাজ চলবে। মানে সারা রাত কারও ঘুম হবে না। এরই মধ্যে যন্ত্রপাতি গুছিয়ে নিয়েছেন শহীদুল কাকু আর মামুন। আরও দুই থেকে তিন ঘন্টার মধ্যে ভাটার পানি নামবে। ট্রলারে বসে সে পর্যন্ত আড্ডা হবে।
বেলায়েত সরদারের সাথে চর থেকে কয়েকজন এসেছেন। অনেকে আমাদের আসার খবর পেয়েছে। ওই রাতে তারাও চলে এসেছে দেখা করতে। খানিকটা পানি ভেঙ্গে সবাই এসে উঠলো ট্রলারে। কী আর করা। রান্নাঘর খোলা হলো। চাল ভাজা হবে। তারপর হবে চা।
পানি নামার সাথে সাথে কাজ শুরু হলো। নিচে কাঠ দিয়ে উঁচু করে রাখা হয়েছে ট্রলার। রাতে ভাসা অবস্থায় এমন ভাবে কাঠ দেওয়া হয় যাতে পানি নামার সাথে সাথে পুরো ট্রলারটি মাটি থেকে এক ফুট উপরে থাকে। অনেক হিসাব করে কাজগুলো করতে হয়। মাথায় এতোকিছু কাজ করে না। মাঝে মাঝে মনে হয়, অনেক কিছু জেনে গেছি। আবার মনে হয়, কিছুই জানি না। অদ্ভুত রহস্যে ঘেরা এই বন উপকূল।
সুন্দরবনে চলাফেরা করছি অনেক বছর হলো। বনদস্যুদের সাথে দেখা করতে এসেছি বার বার। আগে থেকে ঠিক করা সময় অনুযায়ী রওনা দেওয়া, সঠিক সময়ে গন্তব্যে পৌঁছানো বেশ কঠিন কাজ। বন উপকূলের পরিবেশের চরিত্র সম্পর্কে খুব ভালো না জানলে সেটি সম্ভবও না। আবার পথঘাটও চিনতে হবে।
সবকিছু ঠিক করে রওনা দিলেও চরে আটকে যেতে পারে ট্রলার। ইঞ্জিন বিকল হতে পারে। তলা ফুটো হতে পারে। এতো সব অনিশ্চয়তা নিয়ে চলাফেরার মধ্যে দুশ্চিন্তা আছে, উৎকণ্ঠাও আছে। আবার সব বাধা পেরিয়ে গন্তব্যে পৌঁছানোর মধ্যে আছে সন্তুষ্টি, আনন্দ।
ট্রলার সারাতে ভোর হয়ে গেলো। ওদিকে প্রায় আধা জোয়ার হয়ে গেছে। ট্রলারের নিচে পানি চলে আসবে আধা ঘন্টার মধ্যে। ট্রলার মেরামত শেষে সবাই ট্রলারে উঠে আসলো। বেলায়েত সরদার বললেন, এবার মজবুত ভাবে ফাটা বন্ধ করছি ভাই। আর ফাটবে না। সাগরের তুফান বাড়ি দিলেও ট্রলারের কিছু হবে না। বললাম, তাহলে চলেন মান্দারবাড়িয়া যাই। সবাই হেসে উঠলো। মান্দারবাড়িয়া কী এখানে ভাই? সে তো অনেক দূরের পথ। সাগর দিয়ে যেতে হবে।
যাই হোক। আর সমস্যা হবে না। এখন মন চাইলে পশুর নদী পার হতে পারবো। চাইলে সাগরেও যাওয়া যাবে। কিন্তু কাল চতুর্দশী। রাস পূর্ণিমা পরশু। সে রাতে রাস পূজা হবে, মেলাও হবে। সাগরের বুকের এই দুবলার চরে আসবে লাখ লাখ পূণ্যার্থী ও পর্যটক। মেলা দেখে ফিরবো আমরা।
খালে ঢুকেছে জোয়ার। পরিস্কার পানিতে নেমে গোসল সেরে নিলো সরদার, মামুন ও শহীদুল কাকু। রান্নাঘরে চুলা জ্বালালাম। পানি গরম করে লিকার করে দিলাম সবার জন্য। কাজ সেরে এক কাপ চা তাদের উজ্জীবিত করবে।
সূর্য ওঠার আগেই পূর্ব আকাশে আলো ফুটেছে। দেখতে দেখতে উঠলো সূর্য। কুয়াশা পড়েছে বেশ। দূরের কিছু দেখা যাচ্ছে না। তবে কাছের সব কিছুই পরিস্কার দেখছি। চারপাশের শুনশান নীরবতা ভেঙ্গে ভেসে আসছে মানুষের কথা। কিছুক্ষণের মধ্যে মসজিদে ফজরের আজান হলো।
চা খেতে খেতে দেখি মরণ চরের ঠোঁটায় ভীড় জমেছে। চরের জেলে সমিতির নেতারা কথা বলছেন জেলেদের সাথে। কী একটা বিষয় নিয়ে বেশ হই-হুল্লোড় চলছে। আমাকে দেখে দূর থেকে সালাম দিলেন উনারা। দেখি শহীদ মল্লিক নামের রামপালের জেলে এগিয়ে আসছেন। বললেন, পশ্চিম সুন্দরবন থেকে কয়েকজন জেলেকে অপহরণ করেছে দস্যু বাহিনী। গেলো রাতে এই ঘটনা ঘটেছে। সকালে ফোন দিয়ে মুক্তিপণ চেয়েছে দস্যুরা। জন প্রতি তিন লাখ করে টাকা চায় ওরা।
ওদের সাথে কথা বলে যা জানলাম তা হলো, সুন্দরবনের নোয়া বাহিনী নামের দস্যুদলটি এই অপকর্ম করেছে। নোয়া মিয়া অনেক পুরনো দস্যু। আগে রাজু বাহিনীর সদস্য ছিলো সে। এরপর আত্মগোপণে চলে যায়। তিন বছর আগে আবারও দস্যুতায় নামে।
গেলো বছর মানে ২০১৫ সালে দলের মধ্যে বিদ্রোহ হয়। কয়েকজন মিলে দখলে নেয় অস্ত্র-গুলি। প্রাণ নিয়ে সেবার পালিয়ে যায় নোয়া মিয়া। তৈরি হয় নতুন দস্যুদল মাস্টার বাহিনী। এরপর আবারও অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে দস্যুতায় নামে নোয়া মিয়া।
মাস্টার বাহিনী আত্মসমর্পণের সময় যে অস্ত্রগুলো জমা দেয় সেগুলো মূলত নোয়া মিয়ার থেকে কেড়ে নেওয়া অস্ত্র। মাস্টার বাহিনীর আত্মসমর্পণের আগে ও পরে তার সাথে কথা হয়েছে। মজনু বাহিনীর আত্মসমর্পণের সময়ও কথা হয়েছে কয়েক দফা। সে আত্মসমর্পণের কথা বলে কিন্তু সেই অনুযায়ী কাজ করছে না। বরং অস্ত্রশস্ত্র বাড়িয়ে দস্যুতা বাড়ানোর চেষ্টা করছে।
দস্যুনেতা নোয়া মিয়া কিছুদিন আগে আরেক দস্যুদল জাহাঙ্গীর বাহিনীর আস্তানায় আক্রমণ করে। শুনেছি তখন জাহাঙ্গীরের স্ত্রী-সন্তান ছিলো সেখানে। তাই পালিয়ে যায় জাহাঙ্গীর। নোয়া মিয়া তাদের একটি ট্রলার ও কয়েকটি ফেলে যাওয়া অস্ত্র দখলে নেয়। সেই থেকে জাহাঙ্গীর বাহিনীর সাথে নোয়া বাহিনীর রেষারেষি চলছে। যেকোনো সময় আরেকটি রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ ঘটে যেতে পারে।
জেলেরা বেশ হতাশ। এতোগুলো দস্যুদল আত্মসমর্পণ করার পরও অপহরণের ঘটনা ঘটছে? তাহলে কী লাভ হলো এসব করে? জেলেরা বেশ বিষন্ন। কেউ কেউ অসন্তুষ্ট, উত্তেজিত। চেহারাগুলো খেয়াল করে বুঝার চেষ্টা করছি।
অপহরণের ঘটনা ঘটেছে। এটা সত্য। সুন্দরবনে দস্যুরা আছে যখন তখন তো অপহরণ আর চাঁদাবাজি থাকবেই। খেয়াল করে দেখলাম, বড় মহাজনদের কাছের লোকগুলো উত্তেজিত। তারা বলছে, এই সারেন্ডার হলো নাটক। তাদের থামানোর চেষ্টা করছেন শহীদ মল্লিক। তিনি পুরনো জেলে। তার একটি ট্রলার থেকেও জেলে অপহরণ করেছে দস্যুরা। এসব নিয়ে বেশ কানাঘুষা চলছে দুবলার চরের জেলে-মহাজনদের মধ্যে।
আপাতত চরেই থাকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। মরণ চরের ঠোঁটায় নোঙ্গর করলাম ট্রলার। বেশ কয়েকটি কাপড় ভিজে আছে এখনও। সেগুলো বের করে রোদে দিলো মামুন।
(ছবি: মরণ চরে আমাদের ট্রলার। শুকানো হচ্ছে ভেজা কাপড়। নভেম্বর ২০১৬)