অবাক জনপদ- দুবলার চর | রূপান্তরের গল্প ২৭৫ | Rupantorer Golpo 275 | দস্যুমুক্ত সুন্দরবন | সুন্দরবনের গল্প | জীবনে ফেরার গল্প | Jibone Ferar Golpo | Sundarbaner Goppo | Story of Sundarbans | মোহসীন উল হাকিম | Mohsin Ul Hakim
রূপান্তরের গল্প ২৭৫ : মরণ চরের ঠোঁটায় নেমে হাঁটা দিলাম। যাবো সাগর পাড় ধরে শুঁটকি পল্লীর ভিতরে। নিউমার্কেট নামে একটি বাজার আছে সেখানে। সকালের নাস্তা সেখানেই সারবো।
অদ্ভুত এক লোকালয়- দুবলার চর। সুন্দরবনের শেষ প্রান্তের এই জনপদটি অস্থায়ী। যদিও হাজার হাজার ঘর আর মানুষ দেখে তা বুঝার উপায় নাই।
অর্ধেক জোয়ার হয়ে গেছে। পানি বাড়ছে। লবণ পানিতে পা ভিজিয়ে হাঁটতে মন্দ লাগছে না। কিছুক্ষণ পর পর মৃত কচ্ছপ, মৃত সাপ আর জানা-অজানা মাছ পড়ে আছে। একটি মৃত ডলফিনও দেখলাম সেখানে।
সামুদ্রিক কচ্ছপগুলো জালে আটকা পড়ে মারা যায়। এটি অপরাধ। কিন্তু এখানে এসব দেখার কেউ নাই। সম্ভবত জেলেরাও সচেতন না। সামুদ্রিক প্রাণিগুলোকে বাঁচিয়ে মাছ ধরার বিষয়ে কোনো প্রচারণাও দেখি না।
সাগর থেকে মাছ নিয়ে কূলে ভিড়েছে অনেকগুলো ট্রলার। নামানো হচ্ছে মাছ। টুকরিতে করে সেগুলো ধুচ্ছে জেলেরা। তারপর কাঁধে-মাথায় করে মাছ নেওয়া হচ্ছে সাবাড়ে। সাবাড় মানে যেখানে মাছ শুকানো হয়। দুবলার চরে কতোগুলো সাবাড় আছে জানি না, সংখ্যায় কয়েক হাজার হবে। প্রতিটি সাবাড়ে অন্তত ১৫ জন কর্মী থাকে। পাঁচ মাসের বেতন চুক্তিতে তারা কাজ করতে আসে সুন্দরবনে।
কাছে গেলাম। কোমড় সমান পানিতে নেমে কাজ করা জেলদের সাথে কথা বললাম। ওরা বললো, কচ্ছপগুলো ইচ্ছা করে ধরে না তারা। জালে আটকা পড়ে মারা যায়। একই ভাবে মারা পড়ে ডলফিন, কয়েক প্রজাতির সাপসহ লবণ পানির পোকা মাকড়। বেন্দি জালে কী ধরা পড়বে কেউ জানে না।
কচ্ছপ বা ডলফিনগুলোকে ছেড়ে দিতে পারেন না? জেলেরা বললো, জীবিত থাকলে ছাড়ি। কিন্তু বেন্দি জালের মধ্যে পড়লে আর বাঁচার সুযোগ থাকে না। পাশ থেকে এক সাবাড় মালিক বললেন, এগুলো নিয়ে এতো কথা বলার দরকার নাই। তোমরা কাজ করো। আমি তাঁকে বললাম, কথা না হয় নাই বললো ওরা। কিন্তু এই যে প্রাণিগুলো মারা যাচ্ছে, এগুলো তো মারার কথা না। নিয়ম নাই।
আমার পরিচয় জানতে চাইলেন সেই শুঁটকি ব্যবসায়ী। বললেন, কতো বড় বড় অনিয়ম চলে এখানে। সেগুলো নিয়ে কথা বলেন আপনারা। সাংবাদিক পরিচয় শুনে একটু ভয় পেলেন। এড়িয়র গেলেন। হাঁটা দিলেন। পাশে পাশে হাঁটলাম আমরাও। বললাম, সমুদ্রের এই প্রাণিগুলো না বাঁচলে আপনারা বাঁচবেন? উনি আরও জোরে হাঁটা দিলেন।
আজ চাঁদের চতুর্দশী। তাই জোয়ারে পানির ফেঁপে ওঠার মধ্যে তেজ আছে। স্রোত আর ঢেউ দুটোই বেশি। গোন চলছে। জেলেদের ব্যস্ততার শেষ নাই। মৃত কচ্ছপ আর সাপগুলোকে পাশ কাটিয়ে হাঁটছি আমরা। চর ধরে পড়ে থাকা এক রকমের সাপ দেখছি। মাথাটা ছোট, পেটটা একটু প্রশস্ত। সরদার বললেন, এগুলো কেরেল সাপ। এখানকর পানিতে অ্যাভেইলেবল। জাল ফেললেই ওঠে।
কেউ বলছেন এই সাপের বিষ নাই। কেউ আবার বলে অনেক বিষ। আমার জানা মতে সামুদ্রিক এই সাপ বিষধর। সহজে কামড়ায় না। জাল থেকে হাত দিয়ে সাপ ছাড়ায় জেলেরা। কখনও কামড়ায়। কিন্তু মানুষ নাকী মরে না।
বললাম, এগুলো ড্রাই বাইট করে বেশির ভাগ সময়। মানে কামড় দিলেও সহজে বিষ ঢালে না। তাই বেঁচে যায় মানুষ। তবে কখনও বিষ ঢাললে হাসপাতালে যাওয়ার আগেই মারা যাবে মানুষ। এক প্রবীণ জেলে বললেন, কেরেল সাপেরর কামড়ে অনেক জেলে মারা গেছে। প্রতি বছরই মরে। এই চরে কেউটে সাপ আর কেরেল সাপের কামড়ে অনেক জেলের মৃত্য হয়েছে।
হাঁটতে হাঁটতে সাগর পাড় থেকে ঢুকে পড়লাম শুঁটকি পল্লীর ভিতর। সোজা গিয়ে উঠলাম নিউমার্কেটে। একটি ছোট রেস্তোঁরায় বসে নাস্তা করলাম। তারপর চা খেয়ে এমাথা ওমাথা চক্কর দিলাম। কিছু প্রয়োজনীয় জিনিষপত্র কিনলাম। ফোনে চার্য দিতে হবে। তবে সেজন্য অপেক্ষা করতে হবে সন্ধ্যা পর্যন্ত। এদিকে কিছু সৌর বিদ্যুতের ব্যবস্থা আছে। তবে সন্ধ্যায় জেনারেটর চালাোন হয়।
নিউমার্কেটের পরিস্থিতি থমথমে। সবার মধ্যে আগের রাতে জেলে অপহরণের ঘটনার প্রভাব পড়েছে। অন্যদিকে রাসমেলা নিয়ে ব্যস্ততা বেড়েছে। কাল রাসমেলা। পূণ্যার্থীরা আসবে, পর্যটকরা আসবে। দূর সুন্দরবনের এই চর ভরে যাবে মানুষে মানুষে। রাসমেলায় আসবেন স্থানীয় প্রশাসনের কর্মকর্তারা। মেলার প্রধান অতিথি হয়ে আসবেন দেশের মৎস্য মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী।
নিউমার্কেট থেকে হেঁটে গেলাম পশ্চিমের বোয়ালিয়ার ঠোঁটায়। এদিকে সবচেয়ে প্রান্তিক জেলেদের বসবাস। খুলনার পাইকগাছা, সাতক্ষীরার আশাশুনি আর বাগেরহাটের মংলা-রামপালের জেলেরা এখানে বসতি করে।
দুবলার চরে আসলে এদিকটাতেই থাকি। প্রান্তিক জেলেদের সাথে মিশতে ভালো লাগে। ওরা অনেক আপন করে নেয়। দারিদ্রের তাড়না আছে। অভাবের সংসার, টানাপোড়েনের জীবন তাদের। কিন্তু ওদের বেশির ভাগের মনটা আকাশের সমান।
মংলা থেকে আসা আলী আজম নামের একজন ক্ষুদ্র মাছ ব্যবসায়ীর সাথে পরিচয় হলো। কয়েকজন মিলে মাছের ব্যবসা করেন। সামান্য পূঁজি নিয়ে চলে তাদের ব্যবসা। গল্পে গল্পে জানলাম, জালে আটকা পড়া জাটকা ইলিশ, নিষিদ্ধ শাপলা পাতা মাছের ব্যবসা তাদের। কম দামে এসব কিনে নিয়ে আড়তে বিক্রি করে তারা। সুন্দরবনের ভিতর দিয়ে চুরি করে চলাফেরা করে। সুন্দরবনের চোরা রাস্তাগুলো চেনা ওদের।
দুপুরে রান্না হলো আলী আজমের ট্রলারে। মাঝারি সাইজের একটি মোচন মাছ কোত্থেকে জানি নিয়ে আসলো। একজন কাটতে বসলো। আর সরদার এই ঘর সেই ঘর থেকে তেল-মসলা নিয়ে এসে রান্না চড়ালো।
কোত্থেকে কী হলো বুঝলাম না। বাজারের খরচ দিতে চাইলাম। হাসি দিয়ে সরদার বললেন, আমি তো নগদ টাকায় বাজার করলাম ভাই। টাকা লাগবে না। বললাম, নগদ বাজারে তো নগদ টাকা লাগে। সরদার বললেন, এটা সুন্দরবন ভাই। এখানে নগদ টাকার বাজার মানে বিনা পয়সার বাজার।
মাছটার ওজন হবে প্রায় পাঁচ কেজি। ওটার দাম কতো নিলো? জানতে চাইলাম সরদারের কাছে। উনি বললেন, চলেন তাহলে। কেমন করে বাজার করি দেখাই।
একটু হেঁটে গিয়ে ঢুকলাম এক জেলের ঘরে। দেখি উঠান ভর্তি মোচন মাছ। গেলো রাতে তাদের জালে ১১০টি মোচন মাছ ধরা পড়েছে। ওজন ৫ থেকে ১৫ কেজি। এখান থেকেই খাওয়ার জন্য একটি মাছ নিয়ে গেছেন সরদার।
দুবলার চরের জেলেদের মধ্যে দিয়ে খাওয়ার রীতি আছে। বেশি মাছ পেলে তারা কিছু মাছ প্রতিবেশিদের খাওয়ার জন্য দেয়। বললাম, এই তাহলে আপনার নগদ টাকার বাজার? সরদার বললেন, তেল, মসলাও তো এক একজনের ঘর থেকে নিলাম। শুধু চালটা ছিলো আলী আজমের নৌকায়।
অদ্ভুত জনপদের অদ্ভুত জীবন। দুবলার চরে আসি আরও কয়েক বছর আগে থেকে। কিন্তু সেভাবে এই মানুষগুলোর সাথে সময় কাটানো হয়নি। সিদ্ধান্ত নিলাম দুই দিন থেকে যাবো। জেলেরা বললো, রাসের যাত্রীরা আসবে আজ। সকালে লোকালয় থেকে শত শত ট্রলার ছেড়েছে। অনেকগুলো লঞ্চও আসবে।
দুবলার চরের রাসমেলায় আগেও এসেছি। গত বছর মানে ২০১৫ সালের রাস পূর্ণিমাতেও এই চরেই ছিলাম। সেবার এখান থেকে দস্যুদল মাস্টার বাহিনীর সাথে দেখা করতে গেছি।
গত এক বছরে বেশ কয়েকটি দস্যুদল আত্মসমর্পণ করেছে। এখন বড় দলগুলোর মধ্যে জাহাঙ্গীর বাহিনী, নোয়া বাহিনী আর আলিফ বাহিনী অন্যতম। আরও বেশ কয়েকটি মাঝারি ও ছোট দস্যুদল আছে। কিছু দল নতুন করে তৈরিও হচ্ছে। নোয়া বাহিনী গত রাতে সাগর থেকে কয়েকজন জেলেকে অপহরণ করেছে। অন্য দলগুলোও বেশ জ্বালাচ্ছে।
একটা বিষয় খেয়াল করলাম। এক বছরে বনদস্যুদের আত্মসমর্পণ নিয়ে অনেক কাজ হলেও সেই খবর এই দুবলার চরে সেভাবে আসেনি। বেশির ভাগ জেলে এবিষয়ে কিছুই জানে না।
যাদের জন্য এতো বছরের চেষ্টা। যাদের জন্য জীবন বিপন্ন হয়েছে বার বার। তারা কিছুই জানে না! সারাদিন অনেকের সাথে কথা বললাম। সুন্দরবনে যে দস্যুদের আত্মসমর্পণ চলছে এবিষয়ে ধারণাও নাই তাদের।
এদিকে বড় সাহেবরা বনদস্যুদের আত্মসমর্পণের বিরোধীতা করছেন। বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছেন। প্রশাসন চুপচাপ। বনরক্ষীরাও আছেন তাঁদের মতো। এখন জেলেরাও যদি দস্যুমুক্ত সুন্দরবন গড়ার চেষ্টার কথা না জানেন তাহলে কী করে চলবে?
দুপুরের রান্না হলো। খাওয়া দাওয়া সেরে নিলাম। মোচন মাছের ভুনা, ঝাল ভর্তা আর ভাত। ক্ষুধা পেটে বেশ উপভোগ করলাম। এরপর বের হলাম। সাগর পাড়ে যাবো। সেখানে নাকী একটি মৃত তিমি মাছ ভেসে এসেছে।
(ছবি: আলোর কোল, দুবলার চর | ২০১৬ সালের ঘটনা)