অত্যাচার-অনাচারে বিপন্ন উপকূল, খবর রাখে না কেউ! | রূপান্তরের গল্প ২৭৬ | Rupantorer Golpo 276 | দস্যুমুক্ত সুন্দরবন | সুন্দরবনের গল্প | জীবনে ফেরার গল্প | Jibone Ferar Golpo | Sundarbaner Goppo | Story of Sundarbans | মোহসীন উল হাকিম | Mohsin Ul Hakim
রূপান্তরের গল্প ২৭৬ : সাগরের তীর ধরে নোঙ্গর করেছে শত শত ট্রলার। মাছের ট্রলার না। রাস পূজায় অংশ নিতে এসেছে তারা। কাল রাস মেলা। লাখো মানুষের ভীড় হবে দুবলার চরে।
শেষ ভাটা বলে ট্রলারগুলো একদম তীরে ভিড়তে পারেনি। তাই হাঁটু বা কোমড় পানিতে নেমে তীর্থ যাত্রীরা হেঁটে চরে উঠছে। নারী ও শিশুদের নামতে একটু কষ্ট হচ্ছে। তবুও ট্রলারে আর বসতে রাজি না।
বছরে একবারই তাদের এখানে আসার সুযোগ হয়। কেউ রাতে রওনা দিয়েছে, কেউ ভোর বেলায়। অসংখ্য ট্রলার আর লঞ্চ এখনও পথে আছে। সন্ধ্যা হতে হতে এই চরে পা ফেলানোর জায়গা থাকবে না। অথচ সকালে যখন আসি তখন এই জায়গাটি ছিলো প্রায় মানুষ শূণ্য।
আমার সাথে হাঁটছে আলী আজম আর বাদশা নামের এক যুবক। দুবলার চরের বিভিন্ন বিষয়ে বলছে তারা। শুনছি মন দিয়ে। তবে মাথার ভিতরে ঘুরছে সাগর পাড়ে পড়ে থাকা সামুদ্রিক প্রাণিগুলোর কথা। বিশেষ করে বিশাল বিশাল মরা কচ্ছপগুলোর কথা ভুলতে পারছি না। জানতে চাইলাম, একটি তিমি নাকী ভেসে এসেছে এখানে?
কেউ বলছে পূর্ব দিকে, কেউ বলছে পশ্চিমে। মৃত তিমি মাছটি ঠিক কোথায় উঠেছে বুঝতে পারছি না। এক জেলে বললো, তিমি মাছটি জীবিত ছিলো। জোয়ারে ভেসে এসে আটকে গেছিলো চরে। তবে ভাটায় আবার নেমে গেছে।
হাঁটতে হাঁটতে বিকাল হলো। সমুদ্র সৈকতে এখন আর দাঁড়ানোর জায়গা নাই। মানুষে মানুষ সয়লাব পুরো দুবলার চর। ট্রলার থেকে নেমে এক রকমমের দিশেহারা সবাই। বিশেষ করে পর্যটকরা কোথায় যাবে কী করবে ঠিক বুঝতে পারছেন না। আপাতত সৈকতে দাঁড়িয়ে ছবি তুলছেন। কেউ রাস পূজার মন্দির খুঁজছেন। কেউ খুঁজছেন শুঁটকির দোকান। শুধু জেলেদের স্বজনরা ট্রলার থেকে নেমে সোজা চলে যাচ্ছেন ঘরে ঘরে।
সঙ্গে থাকা মাছ ব্যবসায়ী আলী আজমকে বললাম, এই ভিড় ভালো লাগছে না। নিরিবিলি কোথাও চলেন। পাশ থেকে বাদশা বললো, আজ, কাল আর পরশু এখানে কোনো নিরিবিলি জায়গা পাবেন না ভাই। কী যেন একটু ভেবে আলী আজম বললেন, একটা জিনিষ দেখাবো চলেন।
হাঁটতে হাঁটতে কাহিল হয়ে গেছি। সেই সকাল থেকে দুই পায়ের উপর আছি। বললাম, আর কতোদূর? আলী আজম বললেন, আর দশ মিনিটের পথ। আলোর কোলের পূর্ব দিকের খাল পর্যন্ত যেতে হবে। তারপর ছোট্ট একটা খাল পারি দিলেই সেই জায়গা।
সরু খালটির এ পাশে জেলেদের বসতি। ওই পাশে ঘন বন। কেওড়া, গড়ান আর গেওয়া গাছ ভরা। খাল পেরুলাম কাদা ভেঙ্গে। কী দেখাবে তারা বিঝতে পারছি না। তবে এতো দূর থেকে যখন নিয়ে এসেছে তখন নিশ্চয়ই এমন কিছু দেখাবে যা দেখলে আমার ভালো লাগবে।
বনের ভিতরে ঢুকে চোখ আমার আকাশে উঠলো। গাছের গোঁড়ায় গোঁড়ায় কচ্ছপ। সবগুলো জীবিত। সবগুলো বিশাল আকৃতির। আমাদের দেখে জায়গায় ছুটোছু্টি শুরু করলো। মনে হলো বনের ভিতরে ঝড় বয়ে গেছে।
কচ্ছপগুলো দড়ি দিয়ে বাঁধা। এক পায়ের সাথে বাঁধা দড়ির এক প্রান্ত। আরেক পাশ গাছের সাথে। এখানে প্রতিটি গাছের গোঁড়ায় এক বা একাধিক কচ্ছপ বেঁধে রাখা। জানতে চাইলাম বিষয়টা কী?
আলী আজম বললো, এটাই তো বিষয়। সাগর পাড়ে যে কচ্ছপগুলো দেখলেন সেগুলো জালেই মরে গেছে। এই কচ্ছপগুলোও জালে আটকেছিলো। জীবিত অবস্থায় ট্রলারের খোলের ভিতরে রাখে। তারপর নিয়ে আসে চরে। নিষিদ্ধ হলেও এই কচ্ছপ কেনা-বেচা নিয়ে খুব বেশি চাপ নাই এদিকে। সবকিছু ম্যানেজ করা যায় এখানে।
বাদশা বললো, পুরো মৌসুম জুড়েই সাগরের এই কচ্ছপ বিক্রি হয়। চরেও কিছু মানুষ খায়। তবে বেশির ভাগ কচ্ছপ চলে যায় লোকালয়ে। এক একটির ওজন মণ ছাড়িয়ে যায়। এখানে একটি কচ্ছপ বিক্রি হয় এক থেকে তিন হাজার টাকায়। লোকালয়ে নিতে পারলে একটির দাম পাঁচ থেকে দশ হাজারও হয়। জানতে চাইলাম, কে করে এই কারবার? ওরা কোনো উত্তর দিলো না।
আমার ফোনে চার্য নাই। তাই ছবিও তুলতে পারলাম না। নিউজ করার মতো এমন একটা বিষয়! ছবি না থাকলে নিউজ করবো কী করে? সঙ্গীরা বললো, কাল সকালে এসে ছবি করবেন। এখন চলেন। বলতে বলতে খালের ওপাশ থেকে হাঁক দিলো লোকজন, কারা ওরা? আলী আজম বললো, মেহমান আসছে। পছন্দ করে নিবে। ওপাশের লোকটি বললো, মেহমান হোক। কিন্তু তাকে এখানে আনা ঠিক হলো? খুব বিরক্ত সে। বাদশা বললো, চলেন ভাই। কাল আবার আসবো।
ওই বন থেকে বের হলাম। ছোট খালটি পেরিয়ে ওপাশে উঠলাম। কচ্ছপের কারবারীদের চিনতে পারলাম না। ওরাও চিনেনি আমাকে। দাঁড়া করিয়ে বললো, কাঠা (কচ্ছপ) নিবেন না? বললাম, নিবো তো। দাম কতো রাখবেন? বললো, এক মণের ওপরের কাঠা একটা তিন হাজার দিবেন। ত্রিশ কেজির ওপর মাংস হবে। ট্রলারের সবাই মিলে খেতে পারবেন। বললাম, টাকা আনিনি। পরে আসবো। দ্রুত ওই জায়গা ছাড়লাম।
দুই পাশে ছাপড়া ঘর। মাঝখানে যে হাঁটা পথটি তৈরি হয়েছে সেখানেও আজ পানি উঠবে। রাস পূর্ণিমার রাতে পানি সবচেয়ে বেশি বাড়ে। বন্যা জোয়ার হয়। তাই শুঁটকিসহ অন্য জিনিষপত্র ঘাস থেকে তুলে উঁচি জায়গায় রাখছে সবাই। যেতে যেতে বাদশা বললো, ওখানে কয়েকশ কচ্ছপ আছে। আজ রাত আর কাল দিনের মধ্যে সবগুলো বিক্রি হয়ে যাবে। রাসমেলায় আসা ট্রলারগুলোর যাত্রীরাই এর কাস্টোমার।
জানতে চাইলাম, এরা নাকী হরিণও খায়? ওরা বললো, চরে হরিণের মাংসও আছে। শুধু অর্ডার দিবেন। পাঁচশ টাকা কেজি পড়বে। বললাম, বাহ! সবকিছুই পাওয়া যায় দেখছি! ওরা বললো, মেলার সময় অর্ধেক মানুষ হরিণ আর কচ্ছপের মাংস খায়। মাছ খায় খুব কম। বেড়াতে আসা লোকজনেরা আসে এ মাথায়। কথা বললেই খালি হরিণের মাংস খোঁজে। শিকারীরা আগে থেকেই বনে নামে।
ভাবছি হচ্ছে এসব? সুন্দরবনের প্রাণবৈচিত্র নিয়ে এতো এতো সংবাদ হয়! কিন্তু এই খবরগুলো তো আসে না! রাসমেলা নিয়ে সংবাদ হয়। সাংবাদিকরা প্রতি বছরই আসেন। কিন্তু এদিকে চলা অনাচারগুলো নিয়ে সংবাদ দেখি না। দুবলার চরের শুঁটকি পল্লীর ভিতর দিয়ে হাঁটছি আর ভাবছি, এই বনটাকে কৌশলে ঢেকে রাখা হয়। ভিতরের খবর তাই বের হয় না। সাংবাদিকরাও এতো দূরে এসে হুট করে এসব বুঝে উঠতে পারে না। কেউ করুক আর না করুক। আমি করবো। তার আগে বনদস্যুদের আত্মসমর্পণ করানোর কাজগুলো শেষ করতে হবে।
সন্ধ্যা নামলো। মাগরিবের আযান হচ্ছে। এখানে বেশ কয়েকটি অস্থায়ী মসজিদ আছে। অন্যদিকে রাস পূজার জন্য বড় মন্ডপ হয়েছে খেজুর তলায়। সনাতন ধর্মের মানুষদের ঘরে ঘরে আছে ছোট মন্ডপ। সেখান থেকে ভেসে আসছে ঘন্টার শব্দ। এখানে মুসলমান ও সনাতন ধর্মের মানুষের বাস। সবাই যার যার মতো ধর্ম পালন করে।
সূর্য ডুবলো। ঘরে ঘরে জ্বললো কেরোসিনের বাতি। কিছু ঘরে জ্বলছে সৌর বিদ্যুতের বাতি। দূর থেকে ভেসে আসছে জেনারেটরের শব্দ। চারপাশের শুঁটকির ঘরগুলো গমগম করছে। এলাকা থেকে জেলেদের স্ত্রী সন্তানরা এসেছে। সে এক বিরাট আনন্দের বিষয়। দুবলার চরে নারীরা আসে রাস পূজার সময়। বাকী সময় সুন্দরবনের এই শুঁটকি পল্লী থাকে নারী শূণ্য।
(ঘটনা: ২০১৬। অবশ্য পরবর্তীতে বন বিভাগ সতর্ক হয়েছে। জেলেরাও সচেতন হয়েছে।
ছবি: দুবলার চর | সুন্দরবন)