আত্মসমর্পণে নাখোশ বড় সাহেবরা | রূপান্তরের গল্প ২৭৭ | Rupantorer Golpo 277 | দস্যুমুক্ত সুন্দরবন | সুন্দরবনের গল্প | জীবনে ফেরার গল্প | Jibone Ferar Golpo | Sundarbaner Goppo | Story of Sundarbans | মোহসীন উল হাকিম | Mohsin Ul Hakim
রূপান্তরের গল্প ২৭৭ : চরের হাঁটাপথগুলো এখনও পোক্ত হয়নি। বড় বড় দুর্বা ঘাসের ভেতর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতেই পথগুলো তৈরি হয়। এমন একটি পথ ধরে এগুচ্ছি। গন্তব্য খেজুর তলা। ওখানে কাল মেলা বসবে।
খেজুর তলা দুবলার চরের একটি জায়গার নাম। এখানে বন বিভাগের একটি টহল ফাঁড়ী আছে। ফাঁড়ী বলতে প্রায় ভেঙ্গে পড়া একটি পুরনো সাইক্লোন শেল্টার। আছে অনেকগুলো শুঁটকির ঘর। দুবলার চরের বড় সাহেবদের কয়েকটি ঘরও আছে এখানে।
খেজুর তলায় একটি বিশাল মাঠ আছে। সেখানেই বসে রাস মেলা। রাস পূর্ণিমার বিকালে বসে সেই মেলা। সন্ধ্যার পর শুরু হয় পূজার আনুষ্ঠানিকতা। এই পূজায় সামিল হতে সুন্দরবনের পাশের জেলাগুলো থেকে পূণ্যার্থীরা আসে। রাতে পূজা অর্চনা শেষ হয়। পরদিন সাগরে পূণ্যস্নান করে বাড়ির পথে রওনা দেয় সবাই।
রাসমেলার আয়োজনটি বেশ বড়। একদিকে প্যান্ডেলের কাজ চলছে। সেখানে হবে মূল অনুষ্ঠান। মাঠ জুড়ে অনেকগুলো দোকান করা হয়েছে। সাময়িক এই দোকান চলবে শুধু মেলার দিন। গভীর রাত পর্যন্ত চলে এই মেলা। পাওয়া যায় গ্রামীণ জিনিষপত্র।
কম দামের খেলনা থেকে শুরু করে কাপড়, ঘর সাজানোর সরঞ্জামও ওঠে এই মেলায়। প্যান্ডেলে আয়োজন করা হয় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। গত বছর যা দেখেছি তাকে অবশ্য সাংস্কৃতিক আয়োজন না বলে অপসংস্কৃতির আয়োজন বলা ভালো।
সাগর পাড় দিয়ে হাঁটা পথে এসেছি খেজুর তলায়। সাজ সাজ রব বলে যা বুঝায় পরিস্থিতি একদম তাই। খালের পাড়ে ভিড়েছে শত শত ট্রলার। দোকানিরা মালপত্র নিয়ে মেলার মাঠে পসরা সাজাচ্ছে। বেশ কয়েকটি জেনারেটর চলছে। বিকট শব্দে কান পাতা দায়।
ভালো লাগছে না। ফিরতি পথ ধরবো। ভাবলাম প্যান্ডেলের কাজ দেখে ফিরি। সেখানে দেখা হলো বড় এক ব্যবসায়ীর সাথে। সালাম বিনিময় করে ফিরবো। কিন্তু আরেক ব্যবসায়ী থামালেন আমাকে। বললেন, একটু বসে যান। ভেবেছি সৌজন্য করে বসিয়েছেন। হয়তো ধন্যবাদ দিবেন।
কেমন আছেন? উনি বললেন, ভালো আর থাকতে দিলেন কই? বললাম, খারাপ কী হলো? বললেন, এই যে দেখেন ডাকাতি হচ্ছে! বললাম, আগের বছর তো এরচেয়ে বেশি জেলে অপহরণ হয়েছে! উনি বললেন, আপনারা যা শুরু করেছেন তাতে ডাকাতি আরও বাড়বে। আগে ক্রসফায়ার ছিলো ভালো ছিলো। এখন ওরা মাথায় উঠে বসবে।
ব্যবসায়ীর কথা শুনে প্রথমে একটু উত্তেজিত হলাম। তারপর মাথা ঠান্ডা করলাম। শান্ত হয়ে বসলাম। উনি বললেন, বরিশাল RAB-এর মেজর আদনান কোনো কাজের না। বরং ওরা নাটক করছে। পুরস্কারের জন্য আদনান সাহেব দস্যুদের সারেন্ডারের নামে নাটক সাজাচ্ছেন। এক অস্ত্র বার বার দেখাচ্ছেন। বললাম, পুরো প্রক্রিয়া তো আমার চোখের সামনে ঘটছে। আমি তো তেমন কিছু দেখি না!
ব্যবসায়ী বললেন, আমরা সব জানি। সুন্দরবনের পাতা যতোদিন থাকবে ডাকাতি থাকবে ততোদিন। সারেন্ডার বাদ দিয়ে ক্রসফায়ার শুরু হোক। দেখবেন ডাকাতেরা দৌড়ের ওপর থাকবে। বললাম, এতো বছর তো দেখলাম। ডাকাতি কমলো কই? বন্দুক যুদ্ধে তো শতাধিক দস্যু মারা গেছে। ডাকাতি কমলো কই?
কথা ঘুরিয়ে উনি বললেন, আপনি সুন্দরবনে ট্রলারে করে আসেন কেন? স্পিডবোটে করে আমার সাথে আসবেন। অথবা কার্গোতে আসবেন। আমরা কি মেহমানদারী করি না? দেশের বড় বড় সাংবাদিকরা সবাই তো আমাদের এখানেই আসে, এখানেই থাকে। বড় বড় মাছ দিয়ে তাদের আপ্যায়ন করি।
বললাম, আপনারা তো সাইক্লোন শেল্টার দখল করে থাকেন। ওখানে আমি উঠবো না। মনে আছে সিডরের সময় অনেক জেলে ওই আশ্রয় কেন্দ্রে উঠতে পারেনি। উনি বললেন, এগুলো ঠিক না। বললাম, আমার কাছে প্রমাণ আছে। মেহের আলীর সাইক্লোন শেল্টার, মাঝের কেল্লার শেল্টার, সেলার চরের শেল্টার, খেজুর তলার শেল্টার তো জেলেরা বিপদের সময় ব্যবহার করতে পারে না। বড় ঝড় আসলে ওরা খালের ভিতরে চলে যায়।
কথা আর আগালো না। বেশ হতাশ উনারা। বললেন, চরে এসে ওই ডুলাভাঙ্গাদের সাথে থাকেন কেন? বললাম, আমি তো জেলেদের কথা মাথায় রেখে কাজ করছি। ওদের জন্যই কাজ করছি। আপনাদের এখানে এসে থাকলে বিভ্রান্ত হবো। সমস্যার আসল জায়গাটা বুঝতে পারবো না। বেলায়েত সরদাররা একটু সরে যেতেই বড় ওই ব্যবসায়ী বললেন, এরা সব রাস্তার লোকজন। ওদের সঙ্গ ছাড়েন। বললাম, এতো সহজে সুন্দরবন ছাড়ছি না। ওই গরীব জেলেদের যেদিন আপনাদের কাতারে দেখবো সেদিনই সুন্দরবন ছাড়বো।
ব্যবসায়ী আর তাদের সাঙ্গপাঙ্গরা বেশ রুষ্ঠ হলো। যেতে যেতে বললাম, কাল অনেক মেহমান আসবে। তাদের আপ্যায়নের জন্য প্রতি ঘর থেকে পাঁচ কেজি করে রূপচাঁদা মাছ দিতে বলা হয়েছে। ১ নম্বর গ্রেডের পাঁচ কেজি রূপচাঁদার দাম কতো? অতিথিদের খাওয়ানোর জন্য কতো কেজি রূপচাঁদা লাগবে? এই মাছ কেন জেলেরা দিবে?
উত্তরের অপেক্ষা না করে বিদায় নিলাম। হাঁটা দিলাম। ফিরবো আলোর কোলে। খেজুর তলা থেকে যেতে আধা ঘন্টার মতো লাগবে। যাওয়ার পথে বেশ খানিকটা পথ জঙ্গলের ভিতর দিয়ে হাঁটতে হবে। টর্চ হাতে এক সারিতে হাঁটা দিলাম।
দূর থেকে মাইকে গানের শব্দ পাচ্ছি। সাগর পাড়ে পৌঁছে দেখি, হাজার হাজার ট্রলার আর লঞ্চ নোঙ্গর করা। মাইক আর সাউন্ড বক্সে বিকট শব্দে গান বাজছে। সুন্দরবনে এই শব্দ বড়ই বেমানান। সাগর পাড় ধরে মানুষ হাঁটছে। হাজার হাজার মানুষ। প্রতিটি লঞ্চে জেনারেটর চলছে বিকট শব্দে।
পা ব্যাথা করছে। হয়রান লাগছে। সেই সকাল থেকে হাঁটছি। সরদার বললেন, তাড়াতাড়ি ঘরে চলেন ভাই। রান্না করতে হবে। তার আগে নগদ টাকায় বাজার করতে হবে। বললাম, আমরা ট্রলারে ফিরবো না? সেখানে তো বাজার সদা আছে।
সরদার বললেন, ট্রলার আছে ওই মরণ চরের ঠোঁটায়। সেখানে হাজার হাজার মানুষ। সবগুলো ট্রলারে মাইক বাজাচ্ছে। রাতে ঘুমাতে পারবেন না।
দুবলার চর নারী বিহীন এক বসতি। কিন্তু এই রাতে প্রতিটি ঘরে নারী আর শিশুদের ভীড়। সবাই এসেছে স্বজনদের সঙ্গে দেখা করতে। জেলেদের ঘরে ঘরে আনন্দ। গোন চলছে। মাছের অভাব নাই। বড় বড় মাছ রান্না হচ্ছে।
সঙ্গে হাঁটছেন বেলায়েত সরদার। বললেন, শুধু বড় মাছ না ভাই। কেউ রান্না করছে কচ্ছপ। কেউ আবার রান্না করছে হরিণ। এই ডামাডোলের মধ্যে কেউ কারও দিকে খেয়াল করছে না। সাগর আর খালের কোনো কোনো ট্রলারেও হরিণ রান্না হচ্ছে।
এসব কথা আগেই শুনেছি। বিশ্বাস করিনি। কিন্তু এই সফরে হরিণ শিকারের বিষয়টি নিজের চোখে দেখলাম। বিশ্বাস না করে উপায় আছে? রাসমেলার অসংখ্য যাত্রী বেড়াতে আসে। সুন্দরবন দেখতে আসে। কিন্তু লাখো মানুষের ভীড় দেখে তাদের রাসমেলা সম্পর্কে ধারণা পাল্টে যায়। আমার কাছে মনে হয় দুবলার চরে রাসমেলা না থাকাই ভালো। সুন্দরবনের প্রাণবৈচিত্রের জন্য বিশাল এই সশব্দ জণসমাগম মোটেই সুখের না। পূজা হোক। পূণ্যার্থীরা আসুক। জেলেদের মধ্যে সনাতন ধর্মের মানুষ ধর্ম পালন করুক, পূণ্যস্নান হোক। ঘটা করে যে মেলা এতো বছর ধরে হয়ে আসছে তার খুব বেশি প্রয়োজন আছে বলে মনে হয় না।
রাতে একটি দেশি হাঁস কিনলাম। সরদার বেশ ঝাল ঝাল করে রান্না করলেন। নিউমার্কেট থেকে চুঁইঝাল আনা হলো। গরম ভাতের সাথে ঝাল ঝাল হাঁসের ঝোল দিয়ে রাতের খাবার। সেই স্বাদ কখনও ভুলবো না।
সরদারের রান্নার হাত এমনিতেই ভালো। কিন্তু আজকের রান্নাটা অন্য পর্যায়ের হয়েছে। সরদারকে জিজ্ঞেস করলাম, এতো স্বাদ কেন ভাই? উনি বললেন, দুপুর থেকে কতো কিলোমিটা হাঁটছেন বলতে পারেন? ক্ষুধা লাগছে বেশি। তাই খাবার বেশি স্বাদ লাগছে। বলেই সেই হাসি দিলেন। বললেন, চন্ডি কাকারা আপনার জন্য অপেক্ষা করছে। কীর্তন শোনাবে। শ্রান্ত শরীরটা আর উঠতে চাইছে না। বললাম, আজ না হয় থাক। পায়ের ব্যাথাটা বেড়েছে।
অনেক রাত পর্যন্ত গল্প করলাম জেলেদের সাথে। ঘুমাবো আলী আজমের নৌকায়। পাশের খালে নোঙ্গর করা নৌকাটি বেশ সুন্দর করে গোছানো। মোটা কম্বল দিয়ে আমার জন্য শোয়ার ব্যবস্থা করা। শুয়ে পড়লাম। চোখে রাজ্যের ঘুম।
আকাশে রাস পূর্ণিমার চাঁদ উঠেছে। খালের পানি বাড়ছে। নৌকা ভাসছে সেই লবণ জলের উপর। সাগর থেকে মাছ নিয়ে ফিরছে ট্রলারগুলো। ওই রাতেই পানিতে নেমে মাছ নামাচ্ছে মানুষ। এই শীতের মধ্যে কোমড় পানিতে নেমে কাজ করছে জেলেরা। কী কষ্টের জীবন!
(২০১৬ সালের ঘটনা। ছবিটি একটি নৌকার ভেতরে তোলা)