রূপান্তরের গল্প ২৭৮ | Rupantorer Golpo 278

রক্তচোষারা চোখের সামনে | রূপান্তরের গল্প ২৭৮

রক্তচোষারা চোখের সামনে | রূপান্তরের গল্প ২৭৮ | Rupantorer Golpo 278 | দস্যুমুক্ত সুন্দরবন | সুন্দরবনের গল্প | জীবনে ফেরার গল্প | Jibone Ferar Golpo | Sundarbaner Goppo | Story of Sundarbans | মোহসীন উল হাকিম | Mohsin Ul Hakim


রূপান্তরের গল্প ২৭৮ : বিশাল বড় চাঁদ মাঝ আকাশে। জোয়ারে থৈ থৈ করছে সাগর-নদী-খাল। পানি উঠে গেছে জঙ্গলে। দুবলার চরেও পানি উঠেছে। গভীর রাতে মাছ আর শুঁটকিগুলো সরাতে ব্যস্ত সবাই। ছপাৎ ছপাৎ করে হাঁটছে মানুষ।

কুয়াশা পড়ছে। বেড়েছে উত্তরের বাতাস। ক্লান্ত শরীরে জেঁকে বসেছে শীতে। বন্যা জোয়ারে খালের পানিকে জীবন্ত মনে হচ্ছে। নৌকা দুলছে। মোটা কম্বলের ভিতরে শরীর ঢুকিয়ে চিৎ হয়ে শুয়ে আছি।

রাস পূর্ণিমার চাঁদ পশ্চিমে হেলে গেছে। শুরু হয়েছে ভাটা। সাগর থেকে মাছ নিয়ে আসা ট্রলারগুলোর ইঞ্জিন চালু হচ্ছে। একটার পর একটা ট্রলার বের হচ্ছে ছোট্ট এই খাল থেকে। আঁকাবাঁকা পথ পেরিয়ে এগুলো চলে যাবে আলোর কোলে। সেখান থেকে কেউ মেহের আলীর খাল ধরে সাগরে বেরুবে। কেউ পশ্চিমে পশুর নদীতে উঠবে। সেখান থেকে ভাটার টানে নেমে যাবে সাগরে। একটানা কেউ চলবে দুই ঘন্টা। কেউ ছয় ঘন্টার পথ পেরিয়ে যার যার জালে পৌঁছাবে।

আধা ঘন্টার মধ্যে খালি হয়ে গেলো খাল। এখন সরসর করে পারি নামার শব্দ ছাড়া আর কোনো শব্দ নাই। দূর থেকে মাইকে চলছে নানা ভাষার গান। মাইক হাতে চিৎকার করছে অনেকে।
মধ্য রাতে বিকট শব্দ খান খান করে ফেলছে সুন্দরবনের নিরবতাকে।

এতো শব্দের মধ্যেও চোখ বুঁজে আসলো। গভীর ঘুমে তলিয়ে গেলাম। দুবলার চর কিংবা সুন্দরবনে অসংখ্য রাত কেটেছে। কিন্তু এমন অস্বস্তির রাত কখনও আসেনি। নৌকায় আমরা দুইজন। সরদারসহ অন্যরা যে যার মতো করে ঘুমিয়েছে শুঁটকি পল্লীর ঘরে ঘরে।

ঘুম ভাঙ্গলো ভোরবেলা। উঠে দেখি নৌকার চুলা জ্বলছে। চায়ের পাতিল চড়ানো। আমাকে উঠতে দেখে এক কিশোর এসে নৌকায় উঠলো। ভাটা শেষে জোয়ার লেগেছে। কিন্তু পানি এখনও নৌকা পর্যন্ত আসেনি।

কাদা ভেঙ্গে ছেলেটি এসে নৌকার পাশে দাঁড়ালো। চা বানিয়ে প্লাস্টিকের গ্লাসে ঢেলে হাতে তুলে দিলো। বললো, সবাই সাগর পাড়ে গেছে। ওদিকে পূণ্যার্থীরা স্নান সেরে বাড়ির পথ ধরবে।

হাতমুখ ধুয়ে চা খেলাম। সেই কালো রঙ এর র’ চা। কড়া লিকারের মধ্যে একগাদা চিনি দেওয়া। কুয়ার পানি দিয়ে বানানো চা। একটু লবণ লবণ। একটা বিস্কিট মুখে দিলাম। সেটিও নরম হয়ে গেছে। নৌকা বরাবর তীরে বসে আছেন এক বৃদ্ধ। চোখে চোখ পড়তেই সালাম দিলেন। মিষ্টি একটা হাসি দিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, আপনি কি আজকেই চলে যাবেন কাকা? বললাম, তা তো ঠিক করিনি। মনে হলো হতাশ হলেন। চা-বিস্কিট এগিয়ে দিলাম।

লুঙ্গি আর গেঞ্জি পড়ে নেমে পড়লাম। গায়ে একটা জ্যাকেট জড়িয়ে হাঁটা দিলাম। সাগর পাড়ে যেতে আধা ঘন্টা সময় লাগবে। তবে এই খাল হেঁটে পার হলে মাত্র দশ মিনিটে পৌঁছাতে পারবো। ভাবলাম খাল পার হবো। কিন্তু একজনকে পার হতে দেখে আর সাহস হলো না।

প্রায় কোমড় সমান কাদা। মাছ ধোয়া হয় বলে পানি-কাদা সবই কালো হয়ে আছে। শীতের সকাল হলেও যেতাম। কিন্তু কাদার নিচে মাছের কাঁটা, মৃত সাপ আর পোকা মাকড়। পায়ে কাঁটা ফুটলে বিপদ বাড়বে। তার চেয়ে আধা ঘন্টা হাঁটা ভালো।

শুঁটকির ঘরগুলোর ভেতর দিয়ে হাঁটা দিলাম। লুঙ্গি, জ্যাকেট আর মাফলার পড়েছি বলে আমাকে আর শহরের মানুষ মনে হচ্ছে না। সমুদ্রের পাড়ে গিয়ে সবার সাথে মিশে গেলাম।

অর্ধেক জোয়ার হয়ে গেছে। পূণ্যস্নান সেরে বাড়ি থেকে আসা স্বজনরা অপেক্ষা করছে। সাগর থেকে ফিরছে মাছ ধরার ট্রলার। গোন এর সময়। তাই পূজা বা মেলা নিয়ে তাদের খুব বেশি মাথা ব্যাথা নাই। জাল টানা, মাছ ধরে চরে ফিরতে ব্যস্ত সবাই। তীরে এসে মাছ নামাবে তারা। স্বজনদদের বিদায় দিয়ে আবার ফিরবে সাগরে।

রাসমেলায় আসা মানুষ ফিরে যাবে আজ। সকাল থেকে একটার পর একটা লঞ্চ আর ট্রলার ছেড়ে যাচ্ছে। শীতের সকাল। সারা রাত শিশির পড়েছে। ট্রলারে শিশির ভেজা কাকের মতো জবুথবু হয়ে বসা মানুষ। নারীর আঁচলের নাচে বসে থরথর করে কাঁপছে শিশুরা। সামনে লম্বা নতী পথ। এখন রওনা দিলেও বাড়ি পৌঁছাতে কারও কারও অনেক রাত হবে। জোয়ার ভাটার হিসাব না মিললে আগামী সকালও হয়ে যেতে পারে।

চর খালি হয়ে যাবে আজ। ভালো লাগছে। অত্যাচার থেকে রক্ষা পাবে সুন্দরবন। ভাবছি, এতো ঘটা করে এই মেলার কি খুব প্রয়োজন আছে? কেউ বলে দুবলার চরের জেলেদের জন্য এই মেলার আয়োজন করা হয়। দেশ-বিদেশ থেকে দর্শনার্থীরা আসে। কিন্তু জেলেদের মেলা দেখার সময় কই? ভরা পূর্ণিমার সময় তাদের তো নাওয়া খাওয়ারও সময় থাকে না!

হাঁটতে হাঁটতে মরণ চরের ঠোঁটায় পৌঁছে গেছি। ওদিকে একটু জটলা হচ্ছে। এগিয়ে গেলাম। একটু দূরে দাঁড়িয়ে বুঝার চেষ্টা করছি। সাগর থেকে আসা এক জেলের গলায় গামছা দিয়ে টেনে নিচ্ছে একজন। অকথ্য ভাষায় গালি চলছে। লোকটি হাতজোড় করে মাফ চাচ্ছে।

দাঁড়াতে বললাম ওদের। আমাকে বকা দিয়ে আরও জোরে সোরে টান দিলো। গলায় গামছা দিয়ে হ্যাঁচকা টান। বালির ওপর পড়ে গেলো লোকটি। এবার চিৎকার করে দাঁড়াতে বললাম। আসলে লুঙ্গি পড়ে থাকায় আমাকে আমলে নেয়নি অত্যাচার করা লোকটি। চিৎকার শুনে দাঁড়ালো সে। তবে গলার গামছাটি ধরে থাকলো। বললাম, উনাকে ছাড়েন আগে। কী হয়েছে বলেন!

একগাদা গালি দিয়ে জেলেকে সম্মোধন করলো সে। এবার নিজের হাতে গামছাটি কেড়ে নিলাম। জেলে ভাইয়ের গলা থেকে গামছাটি খুলে ফেললাম। বললাম, কী করেছেন আপনি? জেলে ভাই হাতজোড় করে বললো, কয়টা মাছ দিছিলাম বৌ-বাচ্চাকে, বাড়িতে নিয়ে যাওয়ার জন্য। বললাম, এটা কেমন অপরাধ?

পাশে দাঁড়ানো লোকটি বললো, চিংড়ি মাছ কি ওর বাপের? বললাম, কতোগুলো চিংড়ি? আরেক জনের হাতে একটা টুকরিতে রাখা মাছ। মনে হয় তিন থেকে চার কেজি হবে। বললাম, দেশ থেকে পরিবারের লোকজন আসছে। তাদের একটু মাছ দিবে না? আমার শক্ত অবস্থান দেখে সবাই একটু ভড়কে গেলো। শুধু বললো, মহাজনের থেকে এই জেলে চিংড়ি মাছের দাদন নিয়েছে। তার জালের সব চিংড়ি দিতে হবে। এটাই চুক্তি। আমরা চাকরি করি। অর্ডার পালন করি।

কিছুক্ষণের মধ্যে মাফলার পড়া আরেকজন আসলো। এক মহাজনের মুহুরি তিনি। আমাকে দেখেই চিনলেন। জানতে চাইলেন, কী হইছে ভাই? বললাম, আমিও তো সেটাই জানতে চাচ্ছি। কয়টা চিংড়ি মাছ বাড়িতে খেতে দিয়েছে এই জেলে। আপনার লোকজন তাকে মারধোর করে মাছগুলো কেড়ে নিলো? মেলা থেকে ফিরে যাচ্ছে তার বৌ-বাচ্চা। সাথে একটু মাছ দিয়েছে খাওয়ার জন্য। ওদের সামনে মাছগুলো কেড়ে নিলো, মারলো! কেমন হলো এটা?

মুহুরি সাহেব তার লোকজদের বেশ বকাঝকা করলেন। তারপর মাছগুলো ডিপোতে নিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দিলেন। ওই জেলেকে বললেন, সাংবাদিক ভাই ছিলো বলে বেঁচে গেলা তুমি। এরকম কাজ আর করবে না!

মাথাটা হুট করেই গরম হয়ে গেলো। বললাম, মাছ কেন নিয়ে যাচ্ছেন আপনারা? মুহুরি সাহেব বললেন, এই মাছের হিসাব দিতে হবে ভাই। বললাম, মাছের দাম কতো? আমি দিয়ে দিচ্ছি। উনি বললেন, তাকে মাছ দেওয়ার ব্যবস্থা করে দিবো ভাই। মাছ নিয়ে চোখের আড়ালে চলে গেলো তারা। ওই জেলেকে নিয়ে এগিয়ে গেলাম তার ট্রলারের দিকে। দেখি ট্রলার ভর্তি মাছ। শুধু চিংড়িই আছে কয়েক মণ। লইট্যা, ছুরিসহ আরও নানা জাতের মাছে বোঝাই তার ট্রলার। বললাম, এতো মাছের মধ্যে থেকে ওইটুকু মাছ ওরা নিতে দিলো না? সে বললো, আপনি দাদা চলে যান। তা না হলে আরও চাপ আসবে আমার ওপর। এমনিতেই মাছের দাম নাই। এখন জরিমানা করে বসলে আমার আর যাওয়ার জায়গা থাকবে না।

পাশ থেকে অন্যরা বললো, সামনে ওর আরও বিপদ আছে। আপনি তো আর চরে থাকবেন না। ওর খবরই আছে! ওদিকে তাড়া দিচ্ছে ফিরতি পথ ধরা ট্রলারের মাঝি। দেরি হয়ে যাচ্ছে। উজান ঠেলে যেতে হবে বলে বেশ বিরক্ত তিনি। বাচ্চাটার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো লোকটি। চোখে পানি। স্ত্রীর চোখের দিকে তাকাতে পারছে না। স্ত্রীরও চোখে পানি। আমি সহ্য করতে পারছি না। এই দৃশ্য সহ্য করা যায় না।

মন খারাপ হলো। ভীষণ মন খারাপ। বুঝতে পারছি না ঠিক কী ঘটলো চোখের সামনে। এতোক্ষণে দুবলার চরের দর্শনার্থীরা প্রায় সবাই চলে গেছে। কয়েকটি লঞ্চ নোঙ্গর করা দূরে। ওরাও ফিরবে আজ। সমুদ্রের পাড় থেকে হেঁটে নিউমার্কেটে গেলাম। চা-বিস্কিট খেয়ে সরদারের খোঁজে বের হলাম। খুঁজতে খুঁজতে গিয়ে হাজির হলাম গফুর কাকা নামের এক জেলের ঘরে। সেখানে সকালের রান্না তুলেছেন সরদার।

বড় বড় চাকা চিংড়ি দিয়ে তরকারি রান্না হয়েছে। সরদার বললেন, ভাতটা হলেই খেতে পারবেন ভাই। শশা দিয়ে চিংড়ির রান্নাটি বেশ লোভনীয়। কিন্তু চিংড়ি আর খেতে ইচ্ছা করছে না। গফুর কাকার সাথে পরিচয় হয় আগের বছর। ওদিকে গেলে বেশ যত্ন করেন।

একটু আগে দেখে আসা ঘটনাটি বললাম। কাকা বললেন, আমরা জেলেরা জিম্মি হয়ে আছি। চারপাশে রক্তচোষা। দেখতে মানুষের মতো। কিন্তু হায়েনার চেয়ে হিংস্র তারা। পুঁজি থাকলেও এই চরে দাদন ছাড়া আসার উপায় নাই। সূদের মহাজন আর দাদনের মহাজন সবকিছু নিয়ে যায়। বাকী যা থাকে সেটুকুও টান দেয় সুন্দরবনের ডাকাতেরা।

বললাম, ডাকাতগুলো আত্মসমর্পণ করছে। ডাকাত না থাকলে আপনাদের উপকার হবে না? কাকা বললেন, উপকার তো হবেই। জঙ্গলের ডাকাত সরাবেন। কিন্তু ডাঙ্গার ডাকাত তো ভয়ঙ্কর। ওই রক্তচোষাদের কথায় প্রশাসন ওঠে বসে। জেলেদের ওপর যে অত্যাচার হয় তার বিচার তো দূরের কথা, আমার তো মন খুলে তা কাউকে বলতেও পারি না। কেউ আসেও না শুনতে। কতো সাংবাদিক আসে এখানে। কেউ তো জেলেদের কথা লেখে না!

সাগর পাড়ের ওই জেলের কথা মনে পড়ছে। স্ত্রী সন্তানকে একটু মাছ দিতে পারলো না সে। গফুর কাকাকে বললাম, আমি ওই লোকটির বাড়িতে পাঁচ কেজি চিংড়ি মাছ পাঠাতে চাই। ব্যবস্থা করতে পারবেন? কাকা বললেন, ওর বিপদ আর বাড়িয়েন না কাকা। খেতে বসেন।

বললাম, চিংড়ির কেজি কতো এখানে? পাশ থেকে একজন বললো, এসব কথা জিজ্ঞেস করেন না ভাই। আমরাও বিপদে পড়বো!

(ছবিটি সাম্প্রতিক। ঘটনা ২০১৬ সালের)

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top