অন্ধকারে ফিরবো কী করে? | রূপান্তরের গল্প ২৮১ | Rupantorer Golpo 281 | দস্যুমুক্ত সুন্দরবন | সুন্দরবনের গল্প | জীবনে ফেরার গল্প | Jibone Ferar Golpo | Sundarbaner Goppo | Story of Sundarbans | মোহসীন উল হাকিম | Mohsin Ul Hakim
রূপান্তরের গল্প ২৮১ : ঘটঘট খটখট শব্দে চলছে আমাদের ট্রলার। বিকট শব্দে কান ঝালাপালা। অথৈ সাগরে অন্ধকারে বসে ঘন্টার পর ঘন্টা সেই শব্দ বড় যন্ত্রণার। কিন্তু কী আর করা! ইঞ্জিন বন্ধ করে তো আর আগানো যাবে না!
পুরো আকাশ অন্ধকার। কুয়াশার ভেতর দিয়ে একটি মাত্র তারা দেখা যাচ্ছে, তাও ঝাপসা। জেলেরা বললো, ওটা তারা না। স্যাটেলাইট। রোজ সন্ধ্যার পর ওটা দেখা যায়। নদী-সাগরে অন্ধকার রাতেও চারপাশ কিছুটা দেখা যায়। দেখা যায় বলতে শুধু অবয়বটা বুঝা যায়। অভিজ্ঞরা তাদের ধারণা থেকে বুঝতে পারেন। সেই অনুযায়ী পথ চলেন। এই সাগরে চলতে গিয়ে এখন সেই আশাটুকুও দেখছি না। ট্রলারের মাঝি ঠিক দিকে চলছেন কী না বুঝতে পারছি না।
পাশেই বসা ছিলেন বেলায়েত সরদার। বললাম, আমাদের পথ কি ঠিক আছে ভাই? উনি বললেন, এখনও ঠিকঠাক যাচ্ছি। জানতে চাইলাম, কী করে বুঝলেন? উনি বললেন, আকাশ দেখে এখন দিক ঠিক করা যাবে না। তাই বাতাস দেখে বুঝতে পারছি। বললাম, বাতাস দেখেন কী করে? সরদার বললেন, চলেন আপনাকে দেখাই।
উঠে সামনের দিকে গেলাম। যদিও ট্রলার চলছে বেশ গতিতে। রোলিং-এ দুলছেও। সতর্কতার সাথে এগিয়ে গেলাম। মাফলারটা খুললাম। গলুই-এ দাঁড়ালাম আহ্নি বরাবর। সরদার বললেন, বাতাস লাগে? বললাম, লাগে তো। ঠান্ডা বাতাস। সরদার বললেন, মুখের কোন জায়গায় বাতাস লাগছে? বললাম, বরাবর মুখে লাগছে, ঠান্ডা বাতাস। ঠান্ডা মানে হলো উত্তরা বাতাস। কিন্তু খেয়াল করে দেখেন, বাতাস আপনার নাকের কোন দিকে লাগছে? আরও ভালো করে খেয়াল করলাম এবার। বললাম, নাকের বাম দিকে। সরদার বললেন, তার মানে ট্রলারের দিক সোজা উত্তরে না, একটি পূব দিকে।
শুরুতে জটিল মনে হচ্ছিলো। তবে এখন বুঝতে পারছি। বাতাস যদি উত্তর থেকে হয় তবে নাক বরাবর বাতাস লাগা মানে উত্তরে যাচ্ছি। বাম গালে বাতাস লাগা মানে যাচ্ছি উত্তর পূর্ব দিকে। বাম গালে বাতাস লাগা মানে ট্রলারের মুখ উত্তর পশ্চিমে। অন্ধকার আর কুয়াশাচ্ছন্ন রাতে সাগরে পথ চলার এই একটাই নিয়ম। অবশ্য এর সাথে পানির স্রোতের দিকও দেখতে হয়। পুরো বিষয়টি বেশ জটিল।
সরদারের কাছে জানতে চাইলাম এখন উত্তরের বাতাস হচ্ছে বলে দিক বুঝতে পারছি। কিন্তু বাতাস তো অন্য দিক থেকেও আসতে পারে। সরদার বললেন, অন্য দিক থেকে হলে সেই বাতাস এতো ঠান্ডা হবে না। একদিক থেকে একটানা বইবে না। সবচেয়ে বড় কথা বাতাস একটু গরম হবে। সাগর থেকে আসা বাতাসে একটু হিট থাকে। সরদার বললেন, একটু পূর্ব দিকে সরে যাচ্ছি আমরা। চিৎকার করে মাঝিকে বললেন, একটি বাম দিকে যাও।
পেছনে দাঁড়িয়ে আমাকে শক্ত করে ধরে রেখেছে একজন। বয়স কম। বললো, সাগরে আসতে আসতে আমাদের অভিজ্ঞতা হয়ে গেছে ভাই। চোখ বন্ধ করে খ্যাওনে চলে যাই। আবার জাল থেকে ফিরেও আসি। যদি খুব বেশি সমস্যা হয় তাহলে অপেক্ষা করি। পাশ দিয়ে কোনো ট্রলার গেলে তার পিছে পিছে টান দেই। কুয়াশা থাকুক আর যাই থাকুক, চোখে না দেখলেও ট্রলারের শব্দ শোনা যায়। কান খাড়া করে টানা চললে কোথাও না কোথায় গিয়ে ঠেকা যায়।
মোবাইল ফোনে চার্য নাই। থাকলে ম্যাপ দেখে পথ চলা যেতো। সরদার বললেন, আমাদের ব্রেইনের ভিতরে জিপিএস লাগানো আছে ভাই। চিন্তা করেন না। বললাম, চিন্তা তো আপনাদের মাথায় দিয়ে রাখছি। কূলে ভিড়লে ভালো। না ভিড়লে আরও ভালো। আবার সাগরে ফিরবো। শুধু জ্বালানী তেল না ফুরালেই হয়। তরুন দা বললেন, ট্রলারে খুব বেশি তেল নাই। কোনো মতে আলোর কোলে পৌঁছাতে পারবো। সবাই মিলে হেসে উঠলাম।
প্রায় চার ঘন্টা হয়ে গেলো। মোটামুটি একই পরিবেশ চারপাশে, কুয়াশা আর অন্ধকার। মাঝে মাঝে দূর থেকে অন্য ট্রলারের শব্দ পাচ্ছি। জোয়ারের সাথে চলায় গতি পাচ্ছি আমরা। তবে উল্টো দিক থেকে আসা উত্তরা বাতাসে একটু কষ্ট হচ্ছে। জ্যাকেট, মাফলার, কানটুপি পড়েও যেন শীত কাটাতে পারছি না। একটু চা হলে ভালো হতো।
ট্রলারের সহযোগী ছেলেটি বললো, এই বাতাসে চুলা জ্বালানো মুশকিল। সরদার সাহেব ছোট করে একটা গালি দিলেন। বললেন, চল দেখি চুলা জ্বলে কী না! ও তো জ্বলবেই, চুলার বাপ শুদ্ধা জ্বলবে। বলেই উঠে গেলেন। টিনের তৈরি চুলাটি নিয়ে আসলো ছেলেটি। এরপর ট্রলারের পাটাতনের দুইটি তক্তা তুলে খোলের ভিতরে নামলেন সরদার। চুলা রেখে আগুন ধরালেন। তিন-চার মিনিটের মধ্যে জ্বললো চুলা। চায়ের পানি তোলা হলো। গ্লাস ভর্তি করে গরম দুধ চা এনে দিলো ছেলেটি। গলুই-এ বসে চায়ে চুমুক দিচ্ছি। ভাবছি, এ কেমন জীবন বেছে নিলাম আমি!
এই জীবন নিয়ে কোনো খেদ নাই। আফসোস নাই। বরং শহরের ওই আয়েশের জীবনের চেয়ে এই জীবনে বৈচিত্র বেশি। মানুষের জন্য কিছু কাজ করার আগ্রহ থেকেই এদিকে কাজ করতে আসা।
বন উপকূলের জেলেদের দস্যুতা থেকে মুক্তি দেওয়ার পথ খুঁজতে খুঁজতে এ পর্যন্ত এসেছি। এখানে যাদের বসবাস তাদের জীবন অনেক কঠিন। তবে একটু কাজ করলে ঘুরে যেতে পারে তাদের জীবন। দস্যুমুক্তির সাথে সাথে দাদন আর সূদের কারবারীদের একটু নিয়ন্ত্রণ করা গেলে এই জেলেরাই হবে গাড়ি বাড়ির মালিক। জেলেরা স্বচ্ছল হলে দেশের লাভ। ওরা স্বচ্ছল হলে সুন্দরবনের ওপর চাপ কমবে।
বনদস্যুদের নিয়ন্ত্রণের কাজ অবশ্য শুরু হয়ে গেছে। অভিযানের পাশাপাশি চলছে আত্মসমর্পণের উদ্যোগ। ২০১৬ সালের মে মাস থেকে নভেম্বর পর্যন্ত সাতটি দস্যুদল আত্মসমর্পণ করেছে। আরও অনেকগুলো দস্যুবাহিনী আছে সুন্দরবনে। তারাও একে একে এগিয়ে আসছে। স্বেচ্ছায় আত্মসমর্পণ করা দস্যুরা তাদের অবৈধ অস্ত্রশস্ত্র জমা দিচ্ছে। আমার বিশ্বাস, এভাবেই একদিন সুন্দরবন দস্যুমুক্ত হবে।
সরদার দিয়ে সুকানিতে দাঁড়ালেন। আমাকেও গলুই থেকে সরে যেতে বললেন। উঠে ট্রলারের মাঝামাছি জায়গায় বসলাম। ওরা বলছে, আমরা নাকী সুন্দরবনের কাছাকাছি চলে আসছি। এখন আছি মেহের আলীর খালের মুখ বরাবর সাগরে। এখানে যেখানে সেখানে ডুবোচর আছে। সেই চরগুলো সম্পর্কে আবার বেলায়েত সরদারের অভিজ্ঞতা বেশি।
ট্রলারের গতি কমে গেলো। সুকানিতে দাঁড়িয়েছেন বেলায়েত সরদার। সামনে একটি লগি হাতে দাঁড়িয়েছে এজন। লগি ফেলে ফেলে পানির গভীরতা মাপছে সে। তার সাথে তাল মিলিয়ে চলছে ট্রলার। এখানে সঠিক খাঁড়িটি ধরে এগুতে হয়।
মেহের আলীর খালের মুখ পর্যন্ত আসার বিষয়টি একটু জটিল। তবে খালের মুখে পৌঁছে গেলে আর সমস্যা থাকে না। একটু একটু করে এগিয়ে পৌঁছে গেলাম মেহের আলীর খালে। পেছন থেকে চিৎকার করে ডাক দিলেন সরদার। বললেন, ও ভাই, আমরা জঙ্গলে চলে আসছি! আর চিন্তা নাই!
জঙ্গলে আসলে আর চিন্তা থাকে না। কারণ এখানকার খাল-নদী আমাদের চেনা। হাজার হাজার শুঁটকির ঘর। হাজার হাজার মানুষ। খাল ভর্তি নৌকা আর ট্রলার।
দুবলার চরের চারপাশের নদী, খাল আর সাগর যেন কতো দিনের চেনা এক জনপদ। জোয়ার হচ্ছে, পানি বেড়েছে, স্রোতও অনুকূলে। মিনিট চল্লিশের মধ্যে পৌঁছে গেলাম আলোর কোলে। সেখানে এসে ভিড়েছে আরও কয়েকশ’ ট্রলার। সবাই সাগর থেকে মাছ এনেছে। রাত এখন প্রায় ১১টা।
এখানেই নামবে মাছ। আর আমরা চলে যাবো শুঁটকি পল্লীর ভেতরে। ছোট খালটি ধরে ঢুকতে হবে। সেজন্য আগে থেকেই আলী আজমের নৌকাটি এনে রাখা। আমরা ভিড়তেই এগিয়ে আসলো সেই নৌকা। ট্রলার থেকে নেমে নৌকায় উঠলাম। আলোর কোল থেকে যে খালটি ভিতরে ঢুকে গেছে সেই খাল ধরে চলে গেলাম আগের জায়গায়, যেখানে নোঙ্গর করা থাকে নৌকাটি। সেখানেই রাতের ঘুম দিচ্ছি আমি।
(২০১৬ সলের ঘটনা)