আপন করে নিলো দুবলার চর | রূপান্তরের গল্প ২৮২ | Rupantorer Golpo 282 | দস্যুমুক্ত সুন্দরবন | সুন্দরবনের গল্প | জীবনে ফেরার গল্প | Jibone Ferar Golpo | Sundarbaner Goppo | Story of Sundarbans | মোহসীন উল হাকিম | Mohsin Ul Hakim
রূপান্তরের গল্প ২৮২ : শত শত ট্রলার ঢুকেছে খালে। তীর ধরে সেগুলো নোঙ্গর করা। কিছু ট্রলার আটকে আছে মাঝ খালে। অন্যগগুলো না সরলে আর ভিড়তে পারবে না সেগুলো। তাই খালের মাঝখানে নোঙ্গর করে মাছ নামাচ্ছে তারা।
টনকে টন মাছ ধোয়া পানি। কুচকুচে কালো হয়ে গেছে। সেখানেই বুক পানিতে নেমে মাছ নামাচ্ছে শুঁটকি শ্রমিকরা। আমরা ছোট নৌকায়। আঁকা বাঁকা খালের সরু পথ ধরে চলতে সমস্যা হচ্ছে না।
জেলে পল্লীতে ব্যস্ততার সীমা নাই। মাছ আসছে। সেগুলো নামানো, ধুয়ে পরিস্কার করা, বেয়ে নিয়ে ঘর পর্যন্ত যাওয়া হলো তাদের প্রথম কাজ। তারপর আরেক দল মানুষ মাছগুলো নিয়ে নেড়ে দেয় চালনে। গভীর রাতেই কাজটি করে ফেলে। কারণ জমা করে রাখলে পচন ধরবে মাছে। রাতের বেলা রোদ থাকে না ঠিক। তবে নেড়ে দেওয়া মাছে বাতাস লাগে বলে সেগুলো তাজা থাকে।
দিনে একটানা রোদ পড়ে এখানে। সাথে থাকে উত্তরের শুষ্ক বাতাস। কয়েক দিনের রোদে শুকিয়ে যায় মাছ। শুঁটকি খাই না আমি। তবে দুবলার চরের শুঁটকির যে স্বাদ হবে তা বুঝতে পারি। এছাড়া মান নিয়ে প্রশ্ন নাই এই শুঁটকির। যারা দেখেশুনে শুঁটকি খান তারা দোকান থেকে বেছে দুবলার চরের শুঁটকি কেনেন। চট্টগ্রামের বড় বাজারগুলোতে দেখেছি। সেখানে এটি রাবালীর চরের শুঁটকি নামে পরিচিত, দাম একটু বেশি।
মানুষের ব্যস্ততা দেখতে দেখতে পৌঁছে গেলাম গন্তব্যে। পাড়ে শক্ত করে বাঁধা হলো নৌকা। উঠতে যাবো। এসময় সরদার বললেন, রাতের খাওয়াটা খেয়ে নামেন ভাই। বললাম, রাতের খাবার হবে এই রাতে? বললেন, হবে না মানে? বলেই নৌকায় রাখা রূপচাঁদা মাছগুলো দেখালেন।
ট্রলার থেকে নৌকায় নামার সময় তরুণ দা বেশ কয়েকটি রূপচাঁদা মাছ দিয়েছেন। খেয়াল করিনি। কিন্তু এই রাতে কাঁচা মাছ দিয়ে করবো কী? কথা বলা শেষ হয়নি। তার আগেই মাছগুলো নিয়ে বসে পড়লেন সরদার। কাটাকুটি শেষে ভাজা হবে পেয়াঁজ মরিচ দিয়ে।
সুন্দরবনের জেলেদের নৌকায় সাধারণত বটি থাকে না। থাকে দা। একটি দা দিয়ে তারা তাবৎ কাজ সারেন। লবণ পানিতে ভিজতে ভিজতে তাতে মরিচা পড়ে যায়। তবুও দা দিয়েই চলে কাটাকুটির কাজ। নৌকার দা-এ ধার নাই। জং ধরা। তাই দিয়েই মাছ কাটছেন সরদার। আর বকছেন আলী আজমকে। নৌকায় একটা পরিস্কার দা রাখবে না? গল্প করছি আমরা। এসময় সামনে এসে দাঁড়ালেন গফুর কাকা।
দুবলার চরের এই প্রবীন জেলে আমাকে ভীষণ ভালোবাসেন। বললেন, আপনাদের নিয়ে একটু দুশ্চিন্তায় ছিলাম। সাগরের যেখানে গেলেন সেই ফেয়ারওয়ের বয়া এলাকায় দস্যুরা বেশি যায়। বললাম, ডাকাতরা তো সব আমার চেনা। কাকা হাসতে হাসতে বললেন, আপনাকে আমরা ভালোবাসি। ডাকাতেরাও আপনাকে পছন্দ করে। কিন্তু এখানকার বড় বড় রক্তচোষারা আপনার ক্ষতি করতে পারে! বললাম, আমি অন্যায় কিছু করছি না কাকা। শুধু দোয়া করবেন।
বেলায়েত সরদার বললেন, ও গফুর কাকা, এসব পিতলা আলাপ বাদ দেন! ঘরে ভাত রান্না করা আছে কী না দেখেন! থাকলে তিনজনের ভাত পাঠান। কাকা বললেন, ডালও রান্না করা আছে। পাঠিয়ে দিচ্ছি। বলে হাঁটা দিলেন তিনি।
কিছুক্ষণের মধ্যে ভাত আর ডাল নিয়ে হাজির হলো কাকার ছেলে হারুন গাজী। তরতাজা রূপচাঁদা মাছ ভাজার সাথে ঠান্ডা ভাত খেতে খারাপ লাগবে না। সাথে ডাল আছে। একটু গরম করে নিলেই হবে।
সারাদিন বেশ ধকল গেছে। সাগরের অভিজ্ঞতাটুকু মাথায় ঘুরছে। সেই সাথে মাথাটাও ঘুরছে। সারাদিন রোলিং এর মধ্যে থাকাটা সহজ না। মনের শক্তি দিয়ে টিকে গেছি আজ। খাওয়া দাওয়া শেষ করে আর নামলাম না। শরীর সায় দিচ্ছে না। উত্তরা বাতাস বেড়েছে। তাই শীতের প্রকোপও বেশি। কম্বলের ভেতর ঢুকে পড়লাম। কয়েক মিনিটের মধ্যে হারিয়ে গেলাম ঘুমের জগতে।
ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠলাম। আজ চর থেকে বিদায় নিবো। চলে যাবো সরদারের ট্রলারে। সুন্দরবন থেকে আজই বিদায় নিবো ভাবছি। ঘুম ভাঙ্গলেও উঠতে ইচ্ছা করছে না। আলসেমি পেয়ে বসেছে। শীতের সকালে কম্বল মুড়ি দিয়ে শুয়ে থাকতে ভালো লাগছে খুব। তবু্ও উঠে বসলাম।
চোখ ডলতে ডলতে তাকিয়ে দেখি তীরে সেই প্রবীন মানুষটি বসা। গত তিন দিন ধরে দেখছি, সাত সকালে এখানে এসে বসে থাকেন তিনি। শীত একটু বেশি পড়েছে। তাই গায়ে একটি ছালা মুড়িয়ে বসে আছেন তিনি। আমাকে দেখেই হাসি দিলেন। বললেন, আর কয়দিন থাকবেন কাকা? বললাম, আজ চলে যাবো।
নড়ে চড়ে বসলেন তিনি। আমি উঠতেই নৌকায় উঠে আসলেন। বালিশ আর কম্বল গুছিয়ে নিলেন। হাসিমুখে উঠে গেলেন। চলে গেলেন ঘরের দিকে। পেছন থেকে হাসতে হাসতে সরদার বললেন, ও ভাই, কাহিনী বুঝছেন? গত তিন রাত আপনি যে কম্বল আর বালিশে শুইছেন সেগুলো ওই কাকার। বললাম, তাহলে উনার রাত কী কাটলো? শীত পড়েছে তো!
সরদার বললেন, ওই যে ছালা গায়ে দেওয়া! তিন রাত কাকা ওই ছালা গায়ে দিয়ে ঘুম দিছে। বললাম, উনার কাছ থেকে জোর করে আনছেন কম্বল আর বালিশ? বলতে বলতে ওই কাকা ফিরে আসলেন। মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বললেন, আমি নিজেই দিছি কাকা। আপনি আমাদের মেহমান না? কী বলবো বুঝতে পারছি না।
সরদার বললেন, আপনি চলে যাবেন আজকে আমাকে তো বলেননি। বললাম, এই যে এখন জানালাম! সরদার বললেন, তাহলে ব্যস্ত ওঠেন। একটু বিরক্ত তিনি। বললেন, ট্রলার তো ওই মরণ চরে উঠানো। ভাটা চলে। সামনের জোয়ারেও ট্রলার নামবে বলে মনে হয় না। পূর্ণিমার জোয়ারে চরে তুলছিলাম ট্রলার। তখন পানি বেশি ছিলো।
আজ চলছে রাস পূর্ণিমার তৃতীয়া। দিনের জোয়ারে পানি কম উঠবে। রাতে যখন বন্যা জোয়ার হবে তখন নামতে পারে ট্রলার। বললাম, টেনশন করবেন না। রাতে সবাই মিলে ধাক্কা দিয়ে নামানো যাবে। না পারলে অন্য কারও ট্রলার নিয়ে মংলা ফিরবো।
গত কয়েক দিন বেশ ভালো কেটেছে। গহীন বনের জেলেদের কারবার, সাইক্লোন, শিকারীদের তান্ডব দেখে এসে রাসমেলা দেখলাম। মানুষের ভীড় আর উচ্চ শব্দে সুন্দরবনের কষ্ট পাওয়া দেখলাম। স্ত্রী সন্তানের সামনে মহাজনের হাতে এক জেলেকে অসম্মানীত হতে দেখলাম। সবকিছুর মধ্যে নতুন যেটি দেখলাম সেটি হলো, আমার প্রতি সাধারণ জেলেদের ভালোবাসা। জলদস্যুদের আত্মসমর্পণে আমার কাজটিকে সমর্থন করছেন তাঁরা। মানে বড় সাহেবরা বিপক্ষে থাকলেও সাধারণ জেলেরা পক্ষে আছেন।।
এখন যাবো আলোর কোলের মরণ চরে। ভেবেছিলাম নৌকা বয়ে চলে যাবো। কিন্তু ভাটা থাকায় তা সম্ভব না। নৌকাটিও কাদায় আটকে গেছে। খালের পানি তলানিতে। এখন ওদিকে যেতে হলে হেঁটে খাল পার হতে হবে। অথবা সাগর পাড় দিয়ে হাঁটতে হবে লম্বা পথ।
কাপড় গুছিয়ে ব্যাগে ভরলাম। সেগুলো নিয়ে এক কিশোর রওনা দিলো ট্রলারের দিকে। সেখানে মামুন আর শহীদুল কাকু আছেন। ওখানে যাওয়ার আগে একটু নিউমার্কেট ঘুরতে গেলাম। প্রয়োজনীয় কিছু জিনিষপত্র কিনে সাগর পাড়ের পথ ধরলাম।
মরণ চরের দিকে হাঁটছি। দেখছি সাগর পাড়ের জেলেরা আমার দিকে ঘুরে ঘুরে তাকাচ্ছে। কেউ দূর থেকে সালাম দিচ্ছে। কেউ একটু এগিয়ে এসে কুশল বিনিময় করছে। এটি সম্ভবত সেদিন এক জেলেকে মহাজনের নির্যাতনের হাত থেকে বাঁচানোর ফলালফল।
সাহেবরা যতো অন্যায় করুক এখানে তাদের বিরুদ্ধে টু শব্দও উচ্চারণ করে না কেউ। এখানে সেই রীতি নাই। মহাজন যা বলবে তা না শুনলে চর ছাড়তে হবে। এদিক সেদিকক হলে মারপিট চলে। বিচার বসে, জরিমানা হয়। প্রান্তিক এই মানুষদের কাছে জরিমানা দেওয়ার মতো বড় চাপ আর হয় না। তার চেয়ে বাড়তি কিছু পিটুনি পিঠে নিতে রাজি তারা।
আত্মসম্মান নিয়ে বেঁচে থাকার কথা এই জেলেরা চিন্তাও করে না। সেদিনের ঘটনাটি সেখানেই ধাক্কা দিয়েছে। পরিবারকে দেওয়া এক টুকরি চিংড়ি মাছ কেড়ে নেওয়ার ঘটনাটি আমাকে নাড়া দিয়েছিলো। তারপর আমি যা করেছি, তা নাড়া দিয়েছে দুবলার চরের জেলেদের। সেজন্যই আজ ভিন্ন চোখে তারা দেখছে আমাকে।
সালাম আর কুশল বিনিময় করে এগিয়ে গেলাম। মরণ চরের ঠোঁটায় তখন একটি মাত্র ট্রলার। আমাদের অর্থাৎ বেলায়েত সরদারের ট্রলার। চরের ওপর উঠানো ট্রলারটিকে দেখতে অন্য রকম লাগছে।
চর ধরে ঝাঁকি জাল নিয়ে হাঁটছে কিছু মানুষ। শেষ ভাটায় জাল ফেললে কিছু মাছ হয়। আমাদের শহীদুণদল কাকা আর মামুনও দেখি জাল খেওয়াচ্ছে। কাছে গেলাম। দেখি ব্যাগ ভর্তি চিংড়ি আর পারশে মাছ। মামুন বললো,রগত তিন দিন তারা ট্রলারে রান্না করে খাচ্ছে। নিজেরা মাছ ধরছে ভাটায় ভাটায়। বললাম, আমরা চলর আসছি। আর চিন্তা নাই।
এখানেও সারি সারি শুঁটকির ঘর। জেলেরা ব্যস্ত মাছ শুকানোর কাজে। চরের ঠোঁটায় দুটি দোকান আছে। এদিকের জেলেরা এই দোকান থেকে প্রয়োজনীয় বাজার-সদা করে। একটি দোকানে বসলাম নাস্তা করার জন্য।
পরোটা বানাচ্ছে একজন। সাথে আছে ডাল আর ডিম। কিছু মিষ্টি আছে। সেগুলো ঢাকা মশারি দিয়ে। চারপাশে হাজার হাজার মাছি। দেখতে দেখতে একটি মাছি এসে পড়লো আমার চায়ের কাপে। অন্য কোথাও হলে এতো মাছি দেখে উঠে পড়তাম।
চা ফেলতে যাবো। কিন্তু সরদার এসে দুই আঙ্গুল দিয়ে চায়ের মাছিটা সরালেন। বললেন, চুমুক দেন ভাই। দুবলার চরের মাছিতে কোনো জীবাণু থাকে না। এক দুই সেকেন্ড ভাবলাম। তারপর দিলাম চুমুক। মাছির কথা ভুলতে পারলাম না। ভাবলাম নিশ্চয়ই পেটে সমস্যা হবে।
চা-নাস্তা সেরে ট্রলারে ফিরবো। খালে একটু পর জোয়ারের পানি ঢুকবে। সেই পানিতে গোসল করবো। তারপর ট্রলারে উঠবো। কিন্তু দোকানদার উঠতে দিলেন না। বললেন, আপনার জন্য একটু চিংড়ি মাছ রাখছিলাম ভাই। পাশের ঘরে বরফে রাখা। কী বলবো? না করলাম। বললাম, খেতে ইচ্ছা করলে চেয়ে নিবো।
পাশের দোকানের মালিক এসে বসলেন। বললেন, আপনাকে তাজা মাছ খাওয়াবো ভাই। প্রথম জোয়ারে জাল খেওয়াবো। এখন বড় বড় ভাঙ্গন মাছ পাওয়া যাচ্ছে। মরণ চরের জেলেদের সাথে গল্পে বসলাম।
কিছুক্ষণ পর জাল নিয়ে গেলার খালের পাড়ে। জোয়ারের পানি ঢুকছে। সাগরের পানির চাপ পড়েছে বড় নদী পশুরে। ফুলছে পশুর নদীর পানি। তার ধাক্কা এসে লাগছে খালের ভেতর। আধা ঘন্টায় পানি বেড়েছে প্রায় এক হাত।
এক পাশ থেকে জাল ফেলানো শুরু হলো। বড় ফাঁসের ঝাঁকি জাল। সাগরের দিক থেকে খ্যাও দেওয়া হলো। মাছ নাই। এবার আমাদের একটু দূরে সরতে বললেন ওই দোকানদার। বললেন, আমাদের কথা শুনে মাছ ভিড়ছে না। একটু দূরে সরে দাঁড়ালাম।
এবার পুরো শিকারীর কায়দায় জাল মাছ ধরতে নামলেন। বেশিক্ষণ সময় লাগলো না। প্রায় দুই কেজি ওজনের একটি ভাঙ্গন মাছ! মাছসহ জাল নিয়ে এগিয়ে এলেন তিনি। ট্রলারের কাছে বসে সেটি বের করে দিলেন। বললেন, আপনার জন্য এই মাছটা দিলাম ভাই। দুপুরে রান্না করে খাবেন।
দিন যাচ্ছে। রহস্যময় সুন্দরবনের সুন্দর আর অসুন্দরগুলো দেখছি। সুন্দরবনের মানুষদের চ্যালেঞ্জিং জীবন দেখছি। সেই জীবন সম্ভবত দেশের সবচেয়ে অবহেলার জীবন।
জীবনে টানাপোড়েনের শেষ নাই। প্রত্যেকেই চড়া সূদের ঋণে জর্জরিত। মামলা-হামলা বা অপহরণ, সবকিছুই যায় তাদের পিঠের ওপর দিয়ে। তবুও কতো বিশাল মন তাদের। শীতের সকালে পানিতে নেমে মাছ ধরে দেয় দেশের কোন অঞ্চলের মানুষ? সারা দেশ তো ঘুরলাম। এমন আতিথেয়তা আর কোথাও পাইনি।
(২০১৬ সালের নভেম্বর মাসের ঘটনা)