শুঁটকির মালিক বড়লোকেরা | রূপান্তরের গল্প ২৮৪ | Rupantorer Golpo 284 | দস্যুমুক্ত সুন্দরবন | সুন্দরবনের গল্প | জীবনে ফেরার গল্প | Jibone Ferar Golpo | Sundarbaner Goppo | Story of Sundarbans | মোহসীন উল হাকিম | Mohsin Ul Hakim
রূপান্তরের গল্প ২৮৪ : মরণ চর থেকে জেলেদের ঘরে যাওয়ার পথ দুইটি। একটি বনের ভেতর দিয়ে। এ পথে খাল পারি দিতে হয়, কাদা-পানিতে নামতে হয়। আরেকটি পথ সাগর পাড় দিয়ে। একটু লম্বা পথ হলেও বালির ওপর দিয়ে হেঁটে যাওয়া যায়। কোথাও কাদা পার হতে হয় না। আমরা সাগর পাড় দিয়ে হেঁটে যাচ্ছি।
জোয়ার শেষ হয়ে ভাটা শুরু হয়েছে। সাগরের জেলেরা মাছ নামিয়ে দিয়ে আবার ফিরেছে সাগরে। শুঁটকির কর্মীরা সেই মাছ নিয়ে সাবাড়ে ফিরছে। শুকানোর জন্য মাছগুলো পরিস্কার করছে কেউ। কিছু মাছ আছে যেগুলো কেটে পরিস্কার করে রোদে দিতে হয়। রূপচাঁদা, ফাইসা আর বড় বড় মাছগুলো কাটতে হয়। বড় মাছের আঁশ ফেলতে হয়। এর বাইরে লইট্যা, ছুরি, চিংড়ি, গাবের দানা, খয়রা জাতীয় মাছগুলো সরাসরি রোদে শুকাতে দেয় জেলেরা।
মাছের সাথে যেসব পোকামাকড় আসে, সামুদ্রিক কাঁকড়াসহ আরও কিছু জলজ প্রাণি আসে। সেগুলো শুকিয়ে একসাথে রাখা হয়। এগুলো রাবিশ নামে পরিচিত। মাছ ও মুরগির খাবারে এই রাবিশ ব্যবহার করা হয়। যেসব মাছ ঠিকমতো শুকায় না, নানা কারণে পচে যায় সেগুলোও রাবিশে পরিণত হয়। দুবলার চরের শুঁটকি পল্লীতে রাবিশেরও দাদন হয়। জেলেরা রাবিশ প্রস্তুত করে, নাম মাত্র মূল্যে সেগুলো নিয়ে যায় রাবিশের মহাজনরা। কখনও হুট করে বৃষ্টি নামলে পুরো চরের মাছ নষ্ট হয়ে যায়। সেই মাছও রাবিশ হিসাবে কিনে নেয় ব্যবসায়ীরা।
সাগরের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় দেখলাম ঠেলাগাড়িতে করে রাবিশ পরিবহন চলছে। শুকনো রাবিশ নিয়ে যাওয়া হচ্ছে সাহেবের ডিপোতে। সেখান থেকে কার্গোতে করে নেওয়া হবে লোকালয়ে। দুবলার চরের শুঁটকির দুইটি প্রধান বাজার আছে। একটি চট্টগ্রামের আসাদগঞ্জ, আরেকটি সৈয়দপুর। জেলেরা বলেন, সৈয়দপুরে যায় অপেক্ষাকৃত ছোট ও কম মানসম্পন্ন শুঁটকিগুলো। আসাদগঞ্জে যায় সেরা শুঁটকি।
বেলায়েত সরদার, মামুন, আমি আর আমার সহযাত্রীরা এক সারিতে হাঁটছি। চলার পথে সেখানে পড়ে থাকতে দেখছি মৃত কচ্ছপ, সামুদ্রিক সাপ, কুঁচিয়াসহ বিভিন্ন জাতের সামুদ্রিক প্রাণি। এগুলো রাবিশ হিসাবেও চলে না। জেলেরা এগুলো মারতেও চায় না কিন্তু তাদের জালগুলো এমন ভাবে তৈরি যে সমুদ্রের পানিতে থাকা যেকোনো মাছ বা প্রাণি একবার জালের ভেতরে ঢুকলে আর বের হতে পারে না। উছোলের ভেতর আটকে পড়া সবকিছুই মারা যায়। কিছু কচ্ছপ বেঁচে থাকে। সেগুলোর আলাদা চোরাই বাজার আছে এখানে। জীবন্ত কচ্ছপগুলো তাই ছেড়ে না দিয়ে কেউ কেউ ডাঙ্গা পর্যন্ত নিয়ে আসে।
সাগর পাড়ে দেখা আলী আজম, বাদশা, জাহাঙ্গীরসহ আরও কয়েক জনের সাথে। তারা আমাদের সাথে দেখা করতে এই পথে এগুচ্ছিলো। একটি মৃত কচ্ছপের পাশে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে এগিয়ে আসে আলী আজম। বলে, চরের পশ্চিম পাশের ওই জঙ্গলে এখনও কিছু কচ্ছপ বাঁধা আছে। সুযোগ মতো সেগুলো নিয়ে যাওয়া হবে। জানতে চাইলাম, এগুলো কোথায় বিক্রি হয়? বললো, পাইকগাছার ওইদিকে বিক্রি হয়। কিছু অসাধু জেলে আছে তারা এগুলো চুরি করে নিয়ে যায়। একবার ট্রলার ভর্তি কচ্ছপ নিয়ে যেতে পারলে বিরাট লাভ হয় তাদের।
জানতে চাইলাম, পথে চেক হয় না? আলী আজম বললো, সবকিছু সেট করা থাকে। আর চোরাই জিনিষ নেওয়া হয় রাতের অন্ধকারে। শিবসা নদী দিয়ে কোনো ভাবে খালে ঢুকে পড়লে আর ধরার উপায় থাকে না। শীতকালে রাতে কুয়াশা থাকে। কিচ্ছু দেখা যায় না। এরকম রাত দেখেই এসব নেওয়া হয়। সরদার বললেন, হাঁটেন ভাই। সন্ধ্যা হওয়ার আগে একটু নিউমার্কেট ঘুরে আসি।
চরের সমুদ্র পাড় থেকে শুঁটকি পল্লীতে ঢোকার পথে পড়ে একটি বড় মাছের ঘর। আল আমিন কাটারীর শুঁটকির ঘর নামে পরিচিত এই ঘর। এখানে যে মাছগুলো টানানো থাকে সেগুলো দেখলে ভিমড়ি খেতে হয়। বিশাল বিশাল লাক্ষা, ভেটকী, জাবা, ভোল, সাগর শোল, সাগর বাইম মাছের মেলা। সুন্দর করে কেটেছেঁটে শুকাতে দেয় কর্মীরা। এই মাছগুলো সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে। অনেক দামী মাছ। শুঁটকি যাদের প্রিয় তারা এই মাছগুলো খুঁজে নেয়। কক্সবাজার ও চট্টগ্রামের শুঁটকির বাজারে এই মাছগুলো দেখেছি কিন্তু কখনও দাম জিজ্ঞেস করা হয়নি। দুবলার চরে যারা বড় মাছ পায় তাদের কাছে থেকে শুঁটকি ব্যবসায়ী আল আমিন কিনে নেন। তারপর শুকিয়ে বিক্রি করেন ব্যাপারীদের কাছে।
ছুরি, লইট্যা, চিংড়ি আর অন্য মাছের শুঁটকির ঘরগুলোতে বেশ কয়েকজন কর্মচারী থাকে। সাবাড় মালিকের সাথে তারা পাঁচ মাসের বেতনের চুক্তি নিয়ে আসে। যারা ডাঙ্গায় কাজ করে তাদের বেতন মাসে নূন্যতম তিন হাজার করে মৌসুমে ১৫ হাজার চাকা। সর্বোচ্চ মাসে ১২ হাজার করে মৌসুমে ৬০ হাজার টাকা। কাজের ধরণ অনুযায়ী বেতন নির্ধারিত হয়। সাগরে যারা মাছ ধরতে যায় তাদের বেতন বেশ ভালো। মাসে ২০ থেকে ৫০ হাজার পর্যন্ত বেতন হয়। সবচেয়ে বেশি বেতন পায় ট্রলারের মাঝিরা। এদের কারও বেতন লাখ টাকা পর্যন্তও হয়।
মালিক আর কর্মচারীদের মাঝখানে আরেক শ্রেণির মানুষ আসে এই দুবলার চরে। বেলায়েত সরদার বা আলী আজমের মতো প্রান্তিক মানুষেরা কখনও আসে কর্মচারি হিসাবে। কখনও কিছু পুঁজি হলে তারা হয়ে যায় ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী। এদিকের ভাষায় তাদের বলে ডুলাভাঙ্গা ব্যবসায়ী। এদের পুঁজি তিন হাজার থেকে সর্বোচ্চ কুড়ি হাজার পর্যন্ত হয়। মৌসুম জুড়ে অল্প দামের মাছগুলো বেচাকেনা করে। জেলেরা অল্প দামে মাছ দিয়ে তাদের সহযোগিতা করে। রুহুল আমি নামে পাইকগাছার এক তরুন আছে। এবছর সে ১২০০ টাকা পুঁজি নিয়ে এসেছে ব্যবসা করতে। দুবলার চরে একটি বিষয় সবচেয়ে ভালো লাগে। সেটি হলো এখানে সাধারণত চুরি হয় না।
আল আমিন কাটারীর শুঁটকির ঘর থেকে বের হয়ে গেলাম নিউমার্কেট। ঠিক মাঝখানে একটি ঘর আছে। সমিতির ঘর নামে পরিচিত। জেলেদের একটি সমিতি আছে। নেতারা বসেন, বিচার আচার করেন। সাধারণত দুবলার চরে জায়গা পাওয়া না পাওয়া, সাগরে জালের খ্যাওন ফেলার জায়গা নিয়ে ঝামেলা হয়। সমিতি সালিশ করে সমাধান দেয়। সমিতির নামে চাঁদা ওঠে। তবে সেই টাকা কোথায় খরচ হয় কেউ জানে না। কেউ জিজ্ঞেসও করে না।
বেলায়েত সরদার বললেন, সমিতিতে আমি কোনো টাকা দেই না ভাই। আমরা ডুলা ভাঙ্গারা কেউই চাঁদা দেই না। এমনিতেই আমাদের পুঁজি নাই। তার ওপর এই সমিতি আমাদের কোনো কাজেও আসে না। ধরেন একজন স্ট্রোক করলো, বা সাপে কামড়ালো। তাকে শহরে নিতে হবে না? বললাম, নিতে হবে এবং দ্রুততম সময়ের মধ্যে নিতে হবে। সরদার বললেন, সেই খরচ সমিতির দেওয়া উচিৎ না? একটা ট্রলার দুবলা থেকে উঠবে, তার তো একটা খরচ আছে। সেই খরচ জেলেদেরই করতে হয়। তাহলে সমিতি থেকে লাভ কী? সমিতি চলে সাহেবদের কথায়। গরীবের কথায় এখানে কিছু হয় না।
নিউমার্কেটে চায়ের দোকানে বসে আড্ডা দিলাম। দুবলার চর, সুন্দরবন আর সাগরে বিশাল কর্মযজ্ঞ নিয়ে জানার চেষ্টা করলাম। জেলেরা এক একজন এক এক রকমের কথা বলেন। তবে বঞ্চনার কথাগুলো ঘুরেফিরে আসে। এর মধ্যে কম-বেশি আমার সম্পর্কে জেনেছে সবাই। মহাজনদের বিশ্বস্ত লোকজন চায়ের দোকানে এসে আমাদের গল্প শুনছে। কেউ কেউ সাহেবদের নিয়ে ভালো ভালো কথা বলছে।
একজনকে বললাম, ২০০৯ সালের যে সাইক্লোন হয়, সিডর নাম, সেই ঝড়ে এখানে কতোজন জেলে মারা গেছিলো জানেন? লোকটি বললো, কয়েক হাজার মানুষ মরেছে। সরকারি হিসাবে এতো জনের কথা বলেন না। কিন্তু আমাদের সামনেই অনেক লাশ ভেসে গেছে। লোকটির কাছে জানতে চাইলাম, এই চরে যে সাইক্লোন শেল্টার আছে সেখানে জেলেরা আশ্রয় নিতে পারছে? সে বললো, অনেক জেলে আশ্রয় নিয়েছে। পাশ থেকে অন্য জেলেরা বললো, মিথ্যা কথা! একজনকেও শেল্টারে উঠতে দেয়নি ওরা। এখানকার আশ্রয়কেন্দ্রগুলো ওরাই দখল করে রাখে। সেখানে পা রাখার ক্ষমতা আমাদের নাই।
ঝগড়া বেধে গেলো। পরিবেশ একটু অন্যরকম। কাকে কী বলবো বুঝতে পারছি না। এই জায়গা সম্পর্কে খুব ভালো ধারণা নাই। তাই হুট করে কারও পক্ষ নিয়ে কথা বলা ঠিক হবে না। বললাম, আপনারা ঝগড়া করবেন না। সাইক্লোন শেল্টার হলো বিপদের সময় আশ্রয় নেওয়ার জায়গা। সেখানে যে কেউ ঢুকতে পারে। এগুলো দখলে রাখা মহা অন্যায়। বন বিভাগের দায়িত্ব এই শেল্টারগুলো দখলমুক্ত করা।
আরেক জেলে বললো, বন বিভাগ তো তাদের কথায় ওঠে বসে। ওই যে মেহের আলীর চরে সে শেল্টার আছে, সেখানে একটা পুকুর আছে। অনেকগুলো নারকেল গাছ আছে। আছে আরও ফলের গাছ। সেখানে বনরক্ষীরা হাতও দিতে পারে না। বললো, খেজুরতলায় সারা বছরের জন্য ঘর করে রাখছে সাহেবরা। শুঁটকির মৌসুম শেষ হলে আমরা ঘর গুটিয়ে নিয়ে যাই। ওদের ঘরগুলো কিন্তু থেকেই যায়। কেউ কিছু বলে না। বিষয়টি জটিল। সরদারকে বললাম, বোয়ালিয়ার ঠোঁটার দিকে চলেন। তরুন দা, গফুর কাকা, মাইজে কাকা, চন্ডি কাকাদের সাথে আড্ডা দিবো। যাওয়ার সময় একটু শেভ করতে হবে। উঠে হাঁটা দিলাম।
নিউমার্কেটে কয়েকটি সেলুন আছে। কিন্তু বেশ ভীড়। আলী আজম বললো, যেখানে যাচ্ছি সেখানে একটা নতুন সেলুন খুলছে। ওখানে গিয়ে দাড়ি কামায়েন। যাওয়ার পথে দুই কেজি গজা কিনলাম। বোয়ালিয়ার ঠোঁটায় গিয়ে সবাই মিলে খাবো। ওখানে কয়েক ঘন্টা সময় কাটাবো। চলতি পথে দেখি একটি দোকানে রাজহাঁস বাঁধা। বিক্রি হবে। দুটি রাজহাঁস কিনে নিলাম। আরেকটি দোকান থেকে চুঁইজাল নিলাম। শুকনা মরিচসহ কিছু সদা কিনলাম। বেলায়েত সরদার বললেন, আপনি দেখি সত্যি সত্যি নগদ টাকায় বাজার করছেন ভাই!
হাসতে হাসতে বেলায়েত সরদার বললেন, এভাবে নগদ টাকা দিয়ে আমাকে বিপদে ফেললেন ভাই। এরপর আসলে সবাই আমার কাছে টাকা চাইবে! হাসতে হাসতে বললাম, আপনারা যে পরিশ্রম করেন, ভবিষ্যতে সত্যি সত্যি নগদ টাকা দিয়েই বাজার করবেন। এই যে মাছের কারবার করেন আপনারা, কোটি কোটি টাকা লেনদেন হচ্ছে। লাভের প্রায় পুরোটাই নিয়ে যাচ্ছে অল্প কয়েকজন মানুষ। আপনাদের আওয়াজ তুলতে হবে। পুঁজি নিয়ে এসে নিজের মতো করে ব্যবসা করবেন আপনারা। ওই যে আল আমীন কাটারীর যে বড় মাছের শুঁটকির ঘর দেখলাম, একদিন আপনারাও এরকম মাছের ব্যবসা করবেন।
সরদার বললেন, অতো বড় ব্যবসা কী করে করবো আমরা? বললাম, সুন্দরবন থেকে ডাকাত উঠে গেলে দেখবেন পরিবেশ হয়ে যাবে। আপনারা শুধু নিয়ম কানুন মেনে চলবেন। সহযাত্রীরা মনোযোগ দিয়ে কথাগুলো শুনছে। আলী আজম বললো, এই চরে গরীব মানুষের ঘুরে দাঁড়ানোর সুযোগ নাই ভাই। শক্তিশালীরা এখানে সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করে। আমাদের নিয়ে প্রশাসনের কারও মাথা ব্যাথাও নাই। বললাম, অপেক্ষা করেন। সুন্দরবন দেখবেন একদিন দস্যুমুক্ত হবে। আপনাদেরও দিন ফিরবে।
রাতের রান্না হবে ট্রলারে। রাজহাঁস দুটি নিয়ে ট্রলারে ফিরলো মামুন। বোয়ালিয়ার ঠোঁটা ঘুরে আমরাও ফিরবো। সবাইকে দাওয়াত দিতে দেখে বেলায়েত সরদার বললেন, ও ভাই, ৪০ জনের বেশি রান্না করার পাতিল নাই ট্রলারে। বললাম, দুইটা রাজহাঁস দিয়ে এতো জনকে খাওয়াতে পারবেন? সরদার বললেন, ও কোনো ব্যাপার না ভাই!
(দুবলার চর, সুন্দরবন, ২০১৬)