রূপান্তরের গল্প ২৮৫ | Rupantorer Golpo 285

মৌচাকে ঢিল মেরেছি! | রূপান্তরের গল্প ২৮৫

মৌচাকে ঢিল মেরেছি! | রূপান্তরের গল্প ২৮৫ | Rupantorer Golpo 285 | দস্যুমুক্ত সুন্দরবন | সুন্দরবনের গল্প | জীবনে ফেরার গল্প | Jibone Ferar Golpo | Sundarbaner Goppo | Story of Sundarbans | মোহসীন উল হাকিম | Mohsin Ul Hakim


রূপান্তরের গল্প ২৮৫ : চল্লিশ জনের রান্না হচ্ছে। ট্রলারের রান্নাঘর ঘিরে বসে আছি। দেখছি আলমিরার সমান ছোট্ট একটি রান্নাঘরের কর্মযজ্ঞ। আমাদের সাথে পাতিল আছে দুইটি। আছে একটি মাত্র কড়াই। বড় হাঁড়িতে ভাত হয় আর ছোটটিতে হয় তরকারি বা ডাল।

ট্রলারের রান্নাঘরে সাধারণত ৭-৮ জনের রান্না হয়। কিন্তু আজ দুটি রাজহাঁস দিয়ে তরকারি হচ্ছে। চর থেকে বড় পাতিল আনা হয়েছে। তাতেই চড়বে তরকারি। রাজহাঁসের মাংস ছোট ছোট করে কাটা হয়েছে। অনেক মানুষ খাবে আজ। চলবে সরদারের চামচের বাড়ি।

নোংড়া অর্থাৎ মসলা বাটার পাত্রে ঘটঘট ঘটঘট করে বাটা হচ্ছে মসলা। কাজটি সরদার নিজ হাতে করেন। তার কথা বলো, তরকারির স্বাদ হবে মসলায়। অন্য কাউকে দিয়ে মসলা বাটিয়ে মনের মতো রান্না করা যায় না। অন্যদিকে মাছ হোক বা মাংস, কাটার পর ধোয়ার কাজটিও তিনি নিজের হাতেই করেন।

সরদার বলেন, মাছ বেশি করে ধুতে হয় আর মাংস ধুতে হয় অল্প করে। একদম ঝকঝকে পরিস্কার না করে কোনো তরকারি চুলায় উঠান না তিনি। পরিবেশ ও পরিস্থিতি অনুযায়ী তার রান্নার ধরণ পরিবর্তন হয়। অনেকে বলে, সরদারের হাতে যাদু আছে। আমি বলি, সরদারের রেসিপি অনন্য। কারণ তার কোনো নির্দিষ্ট রেসিপি নাই। যখন যা থাকে তাই দিয়ে তিনি রান্না করেন ফেলেন মজার মজার সব খাবার।

আমাদের ট্রলার চরে ওঠানো সেই কবে থেকে! চার দিন হয়ে গেছে। আজ রাতের জোয়ারে ভাসানো হবে। এনিয়ে একটু দুশ্চিন্তা হচ্ছে। কারণ সামনের জোয়ারে পানির চাপ একটু বেশি না থাকলে ট্রলার নামানো যাবে না।

ট্রলার না নামলে আমরা যেতেও পারবো না। মামুন বললো, টেনশন করেন না ভাই। ব্যবস্থা একটা হয়ে যাবে। এই রাতে ট্রলার যদি নাও ভাসে তবে ট্রলারের নিজে খাল কেটে ফেলবো। জোয়ার হচ্ছে। আরেকটু পর মাছ নিয়ে জেলেরা আসবে। আর কিছু না হলেও সবাই মিলে ঘাড়ে করে তুলে পানিতে নামায়ে ফেলবো ট্রলার।

জোয়ার শুরু হয়েছে আরও আগে। পূর্ব আকাশে উঠেছে রাস পূর্ণিমার চতুর্থীর চাঁদ। অর্ধেক হয়ে গেলেও বেশ আলো ছড়াচ্ছে। তবে কুয়াশা বাড়লে চাঁদের আলো কমে যাবে। চাঁদ ওঠার সাথে সাথে জোয়ার হয়। বাড়তে থাকে সাগরের পানি। এসময় বাতাস থাকলে অদ্ভুত এক পরিবেশ তৈরি হয়। ভালো লাগে। মনে হয় সবকিছু জীবন্ত।

জোয়ারে পানির স্রোত বেড়ে যায়। এসময় মাছের দৌড়াদৌড়ি বাড়ে। ছুটতে গিয়ে জালে আটকা পড়ে তারা। সাগরে স্রোত আর ঢেউ বাড়লে জেলেরা খুশি হয়। কারণ এসময় জালে বেশি মাছ পাওয়ার সম্ভাবনা থাকে।

রাত বাজে প্রায় ১২টা। এরই মধ্যে একটি দুইটি করে ট্রলার ফিরছে সাগর থেকে। মাছগুলো রেখে তারা আবার পরের ভাটায় নেমে যাবে। পূর্ণ জোয়ার হতে হতে হতে রাত দুইটার মতো বাজবে। এর মধ্যে রান্না হবে। খাওয়া-দাওয়া সেরে নিয়ে আমরা বিদায় নিবো। দুবলার চর থেকে বের হবো। ভরা জোয়ারে বের হয়ে বড় নদীতে যাবো। তার পরের ভাটায় কোথাও নোঙ্গর করে থাকবো। সকালের জোয়ার শুরু হলে রওনা দিবো মংলার উদ্দেশ্যে।

সময় করে তিন বেলা খাওয়া, দিনের কাজ শেষ করে রাতে ঘুমাতে যাওয়া, এভাবে চলে না এখানকার জীবন। সুন্দরবনের মানুষের জীবন চলে চাঁদের ওপর। আরও নির্দিষ্ট করে বললে জোয়ার ভাটার ওপর। অমাবশ্যা ও পূর্ণিমার ভরা কাটালের সময়টিকে এদিকে বলে গোন। চট্টগ্রাম-কক্সবাজার উপকূলে এই সময়টিকে বলো জো।

মরাকাটালের সময়কে উপকূলে বলা হয় মরা গোন বা ঢালা। আজ চতুর্থী। আর দুই দিন গোন চলবে। মানে জেলেরা মাছ ধরবে সাগরে। তারপর মরা গোন বা ঢালা শুরু হবে। ষষ্ঠী থেকে একাদশী পর্যন্ত তারা ডাঙ্গায় থাকবে। একাদশীর রাতেই আবার ফিরবে মাছ ধরতে।

মরা গোনে তেমন কোনো কাজ থাকে না। জাল সারানো, গাব দেওয়া, ট্রলারের টুকটাক মেরামতের কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকে সবাই। বাকী সময় কোনো কাজ থাকে না। এসময় বাড়ি ঘুরে আসতে পারলে ভালো হয়। কিন্তু ডাকাতের যে চাপ চলছে তাতে কেউই যখন তখন ট্রলার চালিয়ে ওপরে যাওয়ার সাহস করে না। পশুর নদীর দুই পাশে কয়েকটি দস্যুদল ওঁৎ পেতে থাকে।

রান্না চলছে। মসলা মাখিয়ে চুলায় উঠেছে রাজহাঁসের মাংস। আলোর কোলের জেলেরা আসছেন একে একে। যাদের দাওয়াত দিয়েছিলাম তাদের অনেকেই এসেছেন। সাথে করে আশেপাশের আরও কয়েকজনকেও নিয়ে এসেছেন তাঁরা।

রান্নাঘর থেকে উঠে আসলেন সরদার। বললাম, ও ভাই, লোক তো বেড়ে যাবে। সরদার বললেন, ৪০ জনের রান্না করছি। ৫০ জন পর্যন্ত খাওয়াতে পারবো। ভরসা করলাম। কিন্তু দুশ্চিন্তা মাথার ভেতরে রয়েই গেলো। দাওয়াত দিয়ে ভরপেট খাওয়াতে না পারলে লজ্জার ব্যাপার হবে।

সরদারের চামচের বাড়িই এখন ভরসা। কারণ যাদের বলে এসেছিলাম প্রায় সকলেই চলে এসেছেন। ট্রলার ঘিরে মানুষ এখন ৬০-৭০ এর মতো হবে। বেলায়েত সরদার বললেন, চিন্তা করেন না ভাই। ব্যবস্থা নিচ্ছি। বললাম, কী ব্যবস্থা নিবেন এই রাতে? এই রাতের বেলা কী করবেন? সরদার বললেন, দেখেন কী করি। বলেই মামুনকে ডাক দিলেন। আমাকে বললেন, টাকা দেন। আর মামুনকে বললেন, নিউমার্কেটে যা। মুরগির ডিম নিয়ে আয় দুই ডজন।

আমরা গল্প করছি। আধা ঘন্টার মধ্যে ডিম নিয়ে ফিরলো মামুন। চরের এক ঘরে সেই ডিম সেদ্ধ করে আনা হলো। একসাথে বসে ডিমগুলো ছিললাম। এবার রাজহাঁসের তরকারিটা নামিয়ে পাশে রাখলেন সরদার।

কড়াইয়ে তুলে সেদ্ধ ডিমগুলো লবণ-মরিচ আর তেল দীয়ে ভেজে নিলেন। এরপর ঢেলে দিলেন রাজহাঁসের তরকারির মধ্যে। সরদার বলে, এই হলো আমার কেরামতি ভাই। এখন আশি জনকেও খাওয়াতে পারবো। শুধু ভাত আরেকবার চড়াতে হবে।

জেলেদের সাথে গল্প চলছে। পাশেই দুটি চায়ের দোকান। সেখানে বসে আড্ডা দিচ্ছিলাম। এমন সময় একটি ট্রলার এসে ভিড়লো। বন বিভাগের ট্রলার। নেমেই আমাদের দিকে এগিয়ে আসলেন তাঁরা। পরনে বন বিভাগের পোশাক। পেছনে হাঁটছেন সাধারণ পোশাকের দুইজন।

আমাকে দেখে এগিয়ে এসে পাশে বসলেন তাঁরা। পরিচয় জানতে চাইলেন। একজন বললেন, সুন্দরবনে কী করছেন আপনি? পরিচয় কী? রাসমেলা শেষ হয়েছে তিনদিন আগে। এখনও ফিরে যাননি কেন? আপনি কি জানেন যে আপনার নামে বন মামলা করতে পারি আমরা?

অবাক হবো নাকী ভয় পাবো বুঝতে পারছি না।

(ঘটনা ২০১৬ | দুবলার চর | সুন্দরবন)

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top