রূপান্তরের গল্প ২৮৮ | Rupantorer Golpo 288

কেওড়াশুঁটির কেওড়া বন, অপরাধের স্বর্গরাজ্য | রূপান্তরের গল্প ২৮৮

কেওড়াশুঁটির কেওড়া বন, অপরাধের স্বর্গরাজ্য | রূপান্তরের গল্প ২৮৮ | Rupantorer Golpo 288 | দস্যুমুক্ত সুন্দরবন | সুন্দরবনের গল্প | জীবনে ফেরার গল্প | Jibone Ferar Golpo | Sundarbaner Goppo | Story of Sundarbans | মোহসীন উল হাকিম | Mohsin Ul Hakim


রূপান্তরের গল্প ২৮৮ : ধুপধাপ করে লাফিয়ে লাফিয়ে নামছে জেলেরা। আমাদের দেখে ভয় পেয়েছে। বুঝতে পারছি না এতো ভয় পাওয়ার কী হলো? পাশে দাঁড়ানো মামুন। সে বললো, ওরা আমাদের ডাকাত ভেবেছে ভাই। ভোর রাতে এখানে হয় দস্যুরা আসবে, না হয় প্রশাসন। বললাম, ভাটার সময় প্রশাসনের এখানে আসার কথা না। কুয়াশা ভরা রাতে উজান ঠেলে বন বিভাগের ট্রলার চালানোর কথা না।

মামুন বললো, ফরেস্টের সাথে চুক্তি করে আসে ওরা। সেদিক থেকে ভয় পাওয়ার কথা না। এদিকে কয়েকদিন আগে অপহরণের ঘটনা ঘটেছে। মনে হয় সেই আতঙ্ক চেপে বসেছে জেলেদের মাথায়।

পুরো রাত জেগে ক্লান্ত আমরা। কিন্তু রাতের বেলা বড় নদীতে এসে যে বিপাকে পড়েছিলাম তাতে ঘুমানো দূরের কথা, এক মুহুর্ত নদী থেকে চোখ সরাতে পারিনি। ভাটার স্রোত ঠেলে বিশাল পশুর নদী পাড়ি দেওয়া, কুয়াশার মধ্যে পথ খুঁজে এই খালে আসা, পুরোটাই অনেক বেশি ঝুঁকিপূর্ণ ছিলো। মামুনকে বললাম, এই জেলেদের বহরের পাশেই নোঙ্গর করো।

পেছনে ফিরে বেলায়েত সরদারকেও ইশারা দিলাম। ট্রলারের গতি এমনিতেই কম ছিলো। এবার গিয়ার ফেলে সোজা এগিয়ে গেলো ট্রলার। খালের ভেতরে একটা চক্কর দিয়ে ঘুরে ওই নৌকা বহরের দিকে রওনা দিলাম আমরা। এদিকে বনের ভেতরটা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে না। তবে আবছা আলোয় বুঝতে পারছি যে জেলেরা নৌকা থেকে নামলেও জঙ্গলের ভেতরে খুব বেশি দূরে যায়নি।

একটু এগিয়ে আবার ফিরে আসতে দেখে তাদের আরও ভয় পেয়ে গেলো তারা। জঙ্গলের ভেতর দিয়ে ছুটে পালালো জেলেরা। জঙ্গলের ভেতরে দৌড়ঝাঁপ করলে বাইরে থেকে বুঝা যায়।

কুয়াশার ভোরে খুব ভালো করে সবকিছু দেখতে পারছি না। তাই ট্রলার গিয়ে ছোটখাটো একটা ধাক্কা খেলো কেওড়া গাছের ডালের সাথে। এর পর পরই আরেক পাশ বাড়ি খেলো নৌকার সাথে। বেঁধে রাখা নৌকাগুলোর সাথে বাড়ি খেয়ে থামলো ট্রলার।

সরদার চিৎকার করে বলছেন, ব্যাক গিয়ারটা পড়তে একটু সমস্যা হয়েছে ভাই। এই এক-দুই সেকেন্ডের দেরির কারণে ধাক্কাগুলো খেলাম, ঠেকানো গেলো না। ট্রলারের ক্ষতি হয়নি কিন্তু নৌকাগুলোর মনে হয় একটু ক্ষতি হয়ে গেলো। একটি নৌকার একপাশ ভেঙ্গে গেছে দেখতে পাচ্ছি।

ট্রলার থামলো। কেওড়া গাছের সাথে বেঁধে ফেললাম ট্রলারের সামনের দিকটা। নোঙ্গর নিয়ে পেছনের দিকে ফেলা হলো। ভেতর থেকে শহীদুল কাকু এসে হাত লাগিয়েছেন। সামনে পেছনে শক্ত করে বাঁধা হলো ট্রলার। সুকানি ছেড়ে বেরিয়ে আসলেন বেলায়েত সরদার। বললেন, ও ভাই, সারা রাতে পেটে তো কিছু দিতে পারিনি। ওই দেখেন নৌকায় ভাত রান্না হচ্ছে। চলেন খেয়ে নেই।

হাসতে হাসতে বললাম, আরেক জন ভাত খাবে বলে রান্না করছে। সেই খাবার আপনি খেয়ে ফেলবেন? সরদার বলে, শুধু আমি না। আপনিও খাবেন আমার সাথে। চুরির দায় কি শুধু আমি একা নিবো? বলেই হাসতে হাসতে ট্রলার থেকে নেমে নৌকায় উঠলেন। মামুনের হাত ধরে আমিও নামলাম। এখানে ১০-১২টি নৌকা আছে একসাথে বাঁধা। সবগুলোই চরপাটা জালের নৌকা।

নৌকায় নামতে নামতে সরদারকে বললাম, জেলেদের ডাক দেন ভাই। উনি বললেন, ওরা কি আশেপাশে আছে? এখনও দৌড়াচ্ছে। ভেতরে গাছ ভেঙ্গে দৌড়ানোর শব্দ পাচ্ছেন না? বললাম, একটু আধটু পাচ্ছি। কিন্তু কেউ না কেউ আশেপাশে আছে। একটা চিৎকার দেন। বলেন, ভয়ের কিছু নাই। আমরা ডাকাত বা প্রশাসনের লোক না। তাহলে দেখবেন একে একে এসে হাজির হবে।

বেশ কিছুক্ষণ ডাকাডাকি করেও কোনো সাড়া পেলাম না। বনের ভেতর থেকে এখন কোনো শব্দই আর আসছে না। মানে ওরা কোথাও গিয়ে থেমেছে।

এবার মামুন আর শহীদুল কাকাকে নামানো হলো জঙ্গলে। বললাম, দুইজন মিলে একটু আগান। দেখেন আশেপাশে কাউকে পেলে আমাদের সংবাদ দেন। ওদের নৌকায় ফিরে আসতে বলেন। ট্রলার থেকে নামতে নামতে শহীদুল কাকু বললেন, ওরা এমনিতেই চলে আসবে ভাই। বললাম, তবুও যান।

ওরা বনের ভেতরে চলে গেলো। সরদারের কাছে জানতে চাইলাম, এমনি এমনি কেন ফিরবে তারা? সরদার বললেন, এরা সব চরপাটার জেলে। এই যে ভাটা হচ্ছে। এই ভাটার শেষের দিকে তারা নৌকা নিয়ে যার যার জালের কাছে চলে যাবে।

শেষ ভাটায় মাছ না তুললে এই পাটার মাছগুলো আবার খালে চলে যাবে। কিছু মাছ নষ্টও হবে। তাই জোয়ার লাগার আগেই তাদের জালে যেতেই হবে। অর্ধেক ভাটা হয়েছে। তার মানে জেলেদের নৌকা ছাড়ার সময় হয়ে গেছে। তাই ভোর রাতে রান্না সেরে নিচ্ছিলো তারা। হয়তো খেয়ে রওনা দেওয়ার প্রস্তুতি ছিলো। কিন্তু আমরা হুট করে চলে আসায় পরিস্থিতি পাল্টে গেছে।

সকাল হয়েছে। আলো ফুটেছে চারপাশে। কিন্তু কুয়াশা কাটেনি এতোটুকু। খালের উল্টো পাশের বনটাকেও দেখা যাচ্ছে না। দেখিনি উল্টো পাশে রাখা আরও কয়েকটি নৌকা। এদিকের খালগুলো মাছে ভরা। মাছ ভরা খাল বলতে যা বুঝায় তা লিখে প্রকাশ করার ক্ষমতা আমার নাই।

সুন্দরবনের এদিকটাতে মাছ আর পানি মনে হয় যেন সমান সমান। চরপাটা বা খালপাটা জালে যে পরিমান মাছ ওঠে তা মাঝে মাঝে বয়ে নেওয়ার উপায় থাকে না। বনের ভেতরে ফেলে যেতে হয় তখন। সময় মতো ভরের অর্থাৎ মাছ কালেকশনের ট্রলার না আসলে নষ্টও হয় মাছ। সরদারকে বললাম, যেমন করে হোক জেলেদের ফিরিয়ে আনতে হবে।

এদিকে সহযাত্রীরা এখনও গভীর ঘুমে। ছইয়ের ভেতরে কম্বল মুড়ি দিয়ে শুয়ে আছে তারা। সারা রাতের দুশ্চিন্তার সফর কিংবা ভোরবেলা জেলেদের এই দৌড়ঝাঁপ, কিছু টেরও পায়নি তারা। সরদার আর আমি ট্রলার থেকে নেমে নৌকায় দাঁড়িয়ে আছি।

জেলেরা কেউ না আসলে এই নৌকাগুলোতে যাওয়া ঠিক হবে? পরে আবার চুরির দায়ে পড়া লাগবে! সরদারকে বললাম অপেক্ষা করেন। সরদার বললেন, অপেক্ষা না হয় করলাম ভাই। কিন্তু চুলার উপর রাখা পাতিলগুলো তো পুড়ে যাবে। না নেভালে চুলার আগুনে নৌকাও পুড়ে যাবে একটু পর। কী আর করা? বললাম, যান ভাই। চুলায় কী রান্না হচ্ছে দেখেন।

প্রায় প্রতিটি নৌকায় চুলা জ্বলছে। কোনো হাঁড়িতে রান্না হচ্ছে ভাত। কোনোটাতে ডাল। আবার কোনো চুলায় গরম হচ্ছে আগের রাতের তরকারি। সরদার ঘুরে ঘুরে চুলার ওপর রাখা হাঁড়ি আর কড়াইগুলো নামিয়ে রাখলেন। বললেন, লোকগুলোর মেলা কষ্ট হয়ে গেলো ভাই। বললাম, ওদের পালাতে বলেছে কে? এমনিতে ডাকাত দেখলে তো দাঁড়িয়ে যায়। আমাদের ট্রলার তো আর দেখতের ডাকাতদের ট্রলারের মতোও না। এছাড়া ইঞ্জিনের শব্দ শুনলেও ওরা বুঝতে পারে কার ট্রলার আসছে!

সরদার বললেন, এই ট্রলারের শব্দ ওদের কাছে পরিচিত না। এজন্যই ভয় পাইছে। বলতে বলতে একটি নৌকায় থামলেন। বললেন, এই নৌকার জেলেরা একটু ভালো-মন্দ খায় ভাই। বলেই স্টিলের থালা নিয়ে বসে পড়লেন।

ভাত আন তোপসে মাছের ঝোল। ল্যাটা দিয়ে বসে পড়লেন সরদার। বললেন, আমার রান্না তো অনেক খাইছেন। এবার জেলেদের রান্না একটু খান। বললাম, ক্ষুধা লাগছে ঠিক। কিন্তু ওরা এসে খাবে কী? লোভ সামলাতে পারলাম না। কয়েকটি নৌকা ডিঙ্গিয়ে গেলাম। বসে পড়লাম সরদারের পাশে। চুলা জ্বলছে তখনও। একটি কৌটা থেকে কয়টা শুকনা মরিচ নিয়ে পুড়িয়ে ফেললাম। তাজা মাছ, বাটা মসলা দিয়ে রান্না, একটু ঝাল ঝাল, সাথে গরম ভাত। এই স্বাদের তুলনা হয় না।

পাশের নৌকায় চা জ্বলছিলো। চিনি মিশিয়ে লাল চা নিলাম এক কাপ। যতোক্ষণ ওরা না আসে ততোক্ষণ এখানেই বসবো। শীত পড়েছে অনেক। ক্লান্তি ভর করেছে শরীরে। সরদারকে বললাম, আমি একটু ঘুম দেই।

ঘুম আসছে না। কারণ মাথার ওপর কেওড়া গাছ। টপ টপ করে শিশির পড়ছে। ভিজে যাচ্ছি রীতিমতো। এর মধ্যে জঙ্গলের ভেতর থেকে কথাবার্তার শব্দ পেলাম। কান খাড়া করে বুঝলাম, বেশ কয়েকজ হেঁটে আসছে এদিকে। কিছুক্ষণের মধ্যে ওদিক থেকে কুঁই দিলো কেউ। পাল্টা কুঁই দিয়ে সবুজ সংকেত দিলাম। মিনিট দুই এর মধ্যে জঙ্গলের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসলো ওরা।

কানটুপি, মাফলার, ভারী সোয়েটার-জ্যাকেট পড়া মানুষগুলোর চোখে মুখে আতঙ্ক। আমি মুখগুলো দেখছি, আর পরিচিত মানুষ খুঁজছি। এখানে পরিচিত একজনকে পেলেই পরিবেশটি স্বাভাবিক হয়ে যাবে।

পেছন থেকে একজন আমাকে দেখেই চিনে ফেললো। বললো, ভালো আছেন ভাই? কয়েক মুহুর্ত সময় নিলাম। মনে করার চেষ্টা করছি। লোকটি এগিয়ে এলো। নাম পরিচয় দিলো। বললো, একবার মাস্টার ডাকাতের ওখানে আসছিলেন, গত শীতে। মনে আছে? বললাম, গেছিলাম। কিন্তু আপনার কথা মনে করতে পারছি না।

সে বললো, ঝাইলোর খালে গোলাগুলির মধ্যে পড়লেন মনে আছে? তখন আমি ওদের ধরা জেলে। আপনি আসার তিন দিন আগে অপহরণ করছিলো আমাকে। বললাম, মনে পড়েছে। তো আপনারা পালালেন কেন? হাসি দিয়ে এড়িয়ে গেলো সে। বললো, জঙ্গলে চুরি করে মাছ মারি। অবৈধ জায়গায় মাছ ধরতে গেলে বিপদ মাথায় নিয়ে থাকতে হয়।

একদিকে ফরেস্ট, অন্যদিকে ডাকাত। এই দুই দিক সামাল দিয়ে চলি। তারপরও ঝামেলা করে অনেকে। মানে ফরেস্ট ধরলে হবে মামলা, ডাকাতে ধরলে দেয়া লাগবে মুক্তিপণ। মাফ পাওয়ার কোনো লাইন নাই ভাই। বোনাস হিসাবে মার খেতে হয়। ডাকাতেও মারে, ফরেস্টাররাও মারে। আমরা মার খাওয়ার ভয়ে থাকি সারা বছর। সবাই টাকা নেয়। তারপর বলে সামনে পড়বি না। সামনে পড়লে আটক করে। মামলা দেয়।

কথা বলতে বলতে ভয় ভাঙ্গলো ওদের। জেলেদের সবার বাড়ি কালাবগী। সেখানকার এক ইউনিয়ন পরিষদ মেম্বারের জেলে তারা। জঙ্গলে দৌড়ঝাঁপ করে হাত পা কেটে গেছে অনেকের। হাঁটু পর্যন্ত কাদা। হাত পা ধুতে ধুতে তারা উঠে আসলো নৌকায়। সবাই যার যার নৌকায় উঠলো। আমরা যে নৌকায় বসে ভাত খেলাম সেই নৌকার জেলেদের বললাম, আপনাদের ভাত আমরা দুই ভাই খেয়ে ফেলছি। কী হবে এখন?

সুন্দর করে হাসি দিলো ওরা। বললো, আমরা আবার রান্না করে নিবোনে। আপনারা পেট ভরে খাইছেন তো? তাকেও বললাম, পালালেন কেন? বললো, জঙ্গলে ঢুকি জীবনটা হাতে নিয়ে। কতো রকমের বিপদ এখানে! জীবন মরণের মাঝখান দিয়ে আমাদের জীবন চলে। বাদায় আসলে ফিরতে পারবো এমন গ্যারান্টি নাই।

কথায় কথায় লোকটি বললো, এই যে আমরা যেখানে আছি, এই কেওড়াশুঁটি থেকে পশ্চিম বাদার এমন কোনো খাল নাই যেখানে জেলেরা নাই। অবৈধ মাছ ধরা চলে, কেউ কেউ বিষ দিয়েও মাছ ধরে। এদিকে খালে খালে ডাকাত ঘোরে। শিকারীরা আসে। আবার মাঝে মাঝে ব্ল্যাকের ট্রলারও ঢোকে। এই কেওড়াশুঁটিতে ঘুরলেই দেখতে পাবেন, অপরাধের কারখানা এই খাল।

গোছগাছ করে জালে যাবে জেলেরা। বললাম, আমিও যাবো। নিয়ে যাবেন? জেলেরা বললো, চলেন, সমস্যা নাই। আজ মনে হয় মাছ পড়বে খুব!

(কেওড়াশুঁটি, সুন্দরবন | নভেম্বর ২০১৬)

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top