রূপান্তরের গল্প ২৯০ | Rupantorer Golpo 290

বাঘ থাকলে শরীর ভার ভার লাগে | রূপান্তরের গল্প ২৯০

বাঘ থাকলে শরীর ভার ভার লাগে | রূপান্তরের গল্প ২৯০ | Rupantorer Golpo 290 | দস্যুমুক্ত সুন্দরবন | সুন্দরবনের গল্প | জীবনে ফেরার গল্প | Jibone Ferar Golpo | Sundarbaner Goppo | Story of Sundarbans | মোহসীন উল হাকিম | Mohsin Ul Hakim


রূপান্তরের গল্প ২৯০ : প্রায় বুক সমান পানি। আসলে পানি এতো বেশি না। এখানে কাদা প্রায় কোমড় পর্যন্ত। জেলেরা নেমে হাঁটা দিয়ে চলে গেছে সামনে। কিন্তু আমি এখন নড়তেও পারছি না। নৌকায় বসে সরদার বললেন, কীরাম হলো ভাই?

সময় যাচ্ছে। কাদার মধ্যে আরও গেঁথে যাচ্ছি। নিজেকে কিছুতেই তুলতে পারছি না। হাতের কাছে নৌকা ছাড়া ধরার মতো কিছু নাই। কিছুক্ষণ মজা দেখে সরদার নামলেন পানিতে। তারপর টেনেটুনে তুললেন। কোনো রকমে হেঁটে জঙ্গলের ধারে গিয়ে উঠলাম।

কাদা, কাঁটা, হেতাল-হরগজার ঝোপ। জঙ্গল এখানে সত্যি ভয়ঙ্কর। বনের পাশেই দাঁড়ানো। অথচ দুই ফুট ভেতরের কিছু দেখতে পাচ্ছি না। সরদার আর আমি দাঁড়িয়ে আছি। সামনে নৌকা বাঁধা কেওড়া গাছের ঝুলন্ত ডালের সাথে। আমাদের পূর্ব দিকটা খালি। পশ্চিমে জাল। ভাটায় পানি প্রায় পুরোটাই নেমে গেছে। জেলেরা হেঁটে হেঁটে মাছ তুলছে। চর ভর্তি মাছ।

কাদার ওপর ছটফট করছে অসংখ্য দাতিনা মাছ। মাঝে মাঝে ভেটকী, তাইড়েল মাছও আছে। বিশাল একটি ভাঙ্গন মাছ তুলে ড্রামে রাখতে রাখতে জেলে ভাই বললো, এই মাছটা খুব স্বাদ হবে ভাই। এটা নিয়ে যাবেন।

খুব ইচ্ছা করছে ওদের সাথে সাথে হাঁটি। কিন্তু সাপ-কুঁচিয়া দেখে ভয় লাগছে। বেলায়েত সরদার জানেন সে কথা। এছাড়া কাইউন মাছের পোণা, টেংড়া মাছ থাকে কাদার ভেতর। ছোট ছোট শাপলা পাতা বা স্টিং রে থাকে। এগুলোর কাঁটায় ভয়ঙ্কর বিষ।

কাদায় বসে গল্প করছি সরদারের সাথে। তাঁর মুখ, চোখ, কান, নাক একসাথে কাজ করছে। বনের ভেতরে আসলে সবগুলি ইন্দ্রীয় একসাথে কাজ করাতে হয়। জঙ্গলের ভেতরে একটু দূর পর্যন্তও দেখা যায় না। গরগজা, টাইগার ফার্ন অথবা ধানসি বনের আড়ালে কখন মামা এসে দাঁড়াবে টেরও পাবো না। জেলেদের মধ্যে বেশির ভাগ এই চরপাটার জেলেরা বাঘের শিকার হয়।

সরদার বললেন নাকে কিছু পাই না, কানেও কোনো ঝামেলার শব্দ পাচ্ছি না। আশেপাশে হরিণ বানর আছ, পাখিও আছে। তার মানে মামা আশেপাশে নাই। তবে কয়দিন আগে এদিক দিয়ে হাঁটছে মামা। বলেই হরগজা ঝোপের ভেতর দিয়ে বাঘের পায়ের পুরনো ছাপ দেখালেন। সত্যিই তো। বাঘ আসছিলো এখানে। কিন্তু এই চাপ বেশ পুরনো। সরদার বললেন, বেশি পুরানো না ভাই। খুব বেশি হলে দুই দিন।

জোয়ারের কারণে গর্তগুলো ছোট হয়ে আসছে। এটা বড় বাঘ। ছেলে বাঘ। বললাম, পায়ের ছাপ দেখে বড় ছোট হিসাব করা যায়। কিন্তু বাঘটি ছেলে না মেয়ে সেটাও বুঝতে পারেন? সরদার এবার ছাপ দেখে ছেলে মেয়ে বুঝার পদ্ধতি বললেন। বললাম, অনেক কিছু জানেন আপনারা। সরদার বললেন, বাদার মানুষদের এটুকু জানা হয়ে যায়। জঙ্গলে থাকতে থাকতে, বিপদ সামলাতে সামলাতে শেখা হয় যায়।

ভালো করে খেয়াল করলাম। পায়ের ছাপগুলো সত্যিই বেশ বড়। দুই দিন আগে পরে সে হেঁটেছে খালের পাশ দিয়ে। ওরা আপন মনে ঘুরে বেড়ায়। এতো বছর ধরে সুন্দরবনে আসি, ভালো মতোতো বাঘ দেখা হয়নি একবারও। জেলেরা বলে, বাঘ না দেখাই ভালো। আমি জেলেদের কথা মেনে চলি সুন্দরবনে। জেলেদের মতো করে চলার চেষ্টা করি। বাঘ এড়িয়ে চলি।

আশেপাশে বাঘ থাকলে বুঝার আর কোনো উপায় আছে? সরদার বললেন, কাছে-কূলে মামা থাকলে জঙ্গলটা ভারি ভারি লাগে। বাতাস ভারী হয়ে যায়। বুঝতে পারছি না। জঙ্গল বা বাতাস ভারি লাগে কী করে? জেলেদের মুখেও শুনেছি এই কথা।

বিষয়টি আসলে অনুভবের। ষষ্ঠ ইন্দ্রীয় বলতে যেটি আছি আমাদের, সেই ইন্দ্রীয় দিয়েই জঙ্গলের মানুষেরা অনুভব করে। করতে পারে। সরদার বললেন, আশেপাশে মামা থাকলে শরীরটাও দেখবেন ভারি ভারি লাগবে। বললাম, আমার তো সব সময়ই শরীরটাকে ভারি লাগে। বিশেষ করে জঙ্গলে নামলে অনেক বেশি ভারি লাগে। দেখেন না কাদার মধ্যে কী ভাবে গেঁড়ে গেলাম।

সরদার বললেন, ওরে ভাই ওই ভারি না। ও আপনি বুঝবেন না। জঙ্গলে এসে থাকতে হবে। বনের ভেতরে হাঁটতে হবে। রাতের বেলা গাছে উঠে ঘুমাতে হবে। পানির অভাবে পড়তে হবে। ক্ষুধায় কাতর হতে হবে। শীতের রাতে সাঁতরে নদী পাড়ি দিতে হবে। এরকম বিপদে না পড়লে আপনি ওইসব বুঝবেন না, কেউই বুঝবে না। জানতে চাইলাম, জঙ্গল করে যারা তারা তো এটা বুঝতে পারে, বিপদ সংকেত পায়! তারপরও বাঘের পেটে যায় কী করে?

কপালে যদি মরণ থাকে ভাই তাহলে মরতেই হবে। এছাড়া সতর্ক থাকতে হয়। কথাগুলো বলতে বলতে সরদার বললেন, মামা যেখানেই থাকুক আমাদের এখানে থাকা যাবে না। সে দুই দিন আগে এদিক দিয়ে গেছে বলে আবার আসবে না এমন কোনো কথা নাই। এখন হয় নৌকায় যাবেন না হয় জেলেদের কাছে। কী করবেন বলেন। বললাম, জেলেদের কাছে যাবো। মাছ ধরা দেখবো। বললেন, হাঁটতে পারবেন এই কাদা দিয়ে? বললাম, আপনি পারলে আমিও পারবো।

কাদা থেকে উঠে হাঁটা দিলাম। প্যাচ প্যাচ করে ধাপ ফেলছি। সামনে বেলায়েত ভাই। পেছনে আমি। জেলেদের কাছ পর্যন্ত পৌঁছাতে অন্তত দশ মিনিট হাঁটতে হবে। কষ্ট করে হাঁটবো। সমস্যা নাই। কিন্তু মাছের কাঁটা, কুঁচিয়া বা পানির সাপগুলোর ভেতর দিয়ে হাঁটা অসম্ভব। সামনে একটা সাপ ছুটোছুটি করছে। আমার ভয় পাওয়া দেখে সাপটির লেজ ধরে তুলে খালে ছুঁড়ে মারলেন সরদার। এভাবে প্রায় পনেরো মিনিট হেঁটে পৌঁছালাম জেলেদের কাছে।

বাঘের পায়ের ছাপের কথা বললাম তাদের। মাছ খুঁটতে খুঁটতে এক জেলে বললো, এই জায়গায় সারা বছর মামা হাঁটে। তবে মালে না উঠলে ঝামেলা করে না। মাল-এ ওঠা মানে জঙ্গলে ওঠার কথা বলছেন উনি। বললেন, একটা মর্দা বাঘ আছে এই খালে। খুব চালাক। কখন যে পেছনে এসে দাঁড়াবে টেরও পাবেন না। সেজন্য আমরা সব সময় পেছন ফিরে হাঁটি, জঙ্গল সামনে রেখে কাজ করি। বাদা থেকে এক সেকেন্ডের জন্যও চোখ সরাই না।

কথা বলতে বলতে হঠাৎ থেমে গেলো সবাই। কান খাড়া করলো সবাই। কান খাড়া করে কিছু শোনার চেষ্টা করছি। আমিও চুপ। কান খাড়া করে শোনার চেষ্টা করছি। ফিসফিস করে জানতে চাইলাম, কী হলো? কোনো সমস্যা? জেলেরা বললো, জঙ্গলের ভেতর থেকে কাঠ ভাঙ্গার শব্দ হচ্ছে। ভাবছিলাম কী না কী! ওদিকে শুয়োরের পাল হেঁটে বেড়ায়। ওরাই হবে। হরিণও হতে পারে। আবার মাছ খুঁটতে শুরু করলো তারা। হাত মিলালাম আমিও।

উত্তেজনায় বেড়ে পোকার কথা ভুলে গেছিলাম। খেয়াল করলাম হাত ও পায়ের জায়গায় জায়গায় চুলকাচ্ছে। পানি থেকে পা তুলে দেখি জায়গায় জায়গায় ফুলে গেছে। হাতে পায়ে কেরোসিন মেখেও রেহাই পাইনি। জেলেরা বললো, কেরোসিনের অ্যাকশন বেশিক্ষণ থাকে না ভাই।

নেমে পড়ছেন যখন তখন আর বাইড়ে পোকার কামড় নিয়ে দুশ্চিন্তা করে লাভ নাই ভাই। সাপে না কামড়ায় সেদিকে খেয়াল রাখেন। জালের ভেতর কিন্তু কয়েকটা কেরেল সাপ আছে। ও কামড়ালে কিন্তু ডাঙ্গা পর্যন্ত যাওয়া লাগবে না। তার আগেই শেষ। বললাম, সাপ কামড়ানো লাগবে না। আমার পায়ে প্যাঁচ লাগলেই আমি শেষ! আমাদের কথা শুনে জেলেরা আশেপাশে যতোগুলো সাপ ছিলো সবগুলো তুলে জালের ওই পাশে ফেললো। বললো, তারপরও সাবধান থাকবেন। কাইউন মাগুরের ছাও এর অভাব নাই এদিকে।

জেলেদের বললাম, মামার প্রধান টার্গেট নাকী আপনারা? একজন গাল ভরে হেসে বললো, ওই দায়িত্ব তো আল্লাহর কাছে দেওয়া। আমরা সতর্ক থাকি। জানতে চাইলাম, আশেপাশে মামা থাকলে টের পান কী করে? চোখে দেখা, কানে শোনা বা গন্ধ পাওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় আছে? জেলেরা বললো, সেরকম কিছু তো নাই ভাই। তবে কাছে-কোলে মামা থাকলে শরীরটা ভার ভার লাগে।

মজা করে বললাম, আমার শরীরও এখন ভার ভার লাগছে। তাড়াতাড়ি মাছ খোঁটেন। ট্রলারে ফিরতে হবে।

(কেওড়াশুঁটির খাল | সুন্দরবন | নভেম্বর ২০১৬)

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top