আস্ত মানুষ মুখে নিয়ে হাঁটে বাঘ | রূপান্তরের গল্প ২৯২ | Rupantorer Golpo 292 | দস্যুমুক্ত সুন্দরবন | সুন্দরবনের গল্প | জীবনে ফেরার গল্প | Jibone Ferar Golpo | Sundarbaner Goppo | Story of Sundarbans | মোহসীন উল হাকিম | Mohsin Ul Hakim
রূপান্তরের গল্প ২৯২ : চরপাটার জেলেরা কাদা মাছ তুলছে থেকে। গল্পে গল্পে ভুলে গেছি কেওড়াশুঁটির ঝুঁকিপূর্ণ জায়গায় আমরা। কিছুক্ষণ আগে পাশের খাল থেকে গুলির শব্দ এসেছে।
আবারও গুলির শব্দ পেলাম। একই দিক থেকে আসছে। তার মানে নিশ্চিত, দস্যুরা আছে ওই দিকে। হংসরাজ নদী এখান থেকে বেশ দূরে। মাঝে আরেকটি খাল আছে, নাম- কাগা। আশেপাশের অন্য খালগুলোর নামও খুব সুন্দর। চেরাগখালী, মোরগখালী নামে ছোট্ট দুটি খাল আছে পশুর নদীর সাথে।
অসাধারণ সুন্দর এদিকের খালগুলো। আমাদের দক্ষিণে আছে নীল কমল নদী। তার দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর। ওদিকে সাগরের দিকে বের হয়েছে কয়েকটি খাল। শুরুতে ছোট্ট খাল, মরা চান্দাবুনিয়া। সেখানে একটি পুরনো বাতিঘর আছে। বানেশ্বর নামে এক পুরনো জেলে সারা বছর ওই বাতিঘরে থাকে। সেখানেই জাল ফেলে, মাছ ধরে।
আরেকটু দক্ষিণে সাগরের সাথে প্রথম খাল চান্দাবুনিয়া। তারপর বইন্দে নামে আরেকটু খাল আছে। এর পশ্চিমে আংপাঙ্গাসিয়া নদীর মোহনা। এই নদীর সাথে নীল কমলের আরেকটি খাল আছে, নাম-কলাতলা। এখানে বিশাল বড় চর পড়েছে।
ছোট খালটিতে ঢুকতে হলে ভরা জোয়ারে আসতে হয়। এর উত্তরের বালির গাঙ। নীল কমল নদী অনেকটা পথ এঁকেবেঁকে এখানে বেরিয়েছে। সবগুলো খাল ও নদী থেকে সবদিকে যাওয়া যায়। পথ চিনলে আড়পাঙ্গাসিয়া থেকে পশুর নদী বা সাগরে চলে যায় বনদস্যুরা। ঝামেলা হলে ঢুকে পড়ে যেকোনো সরু খালে।
নীল কমল এলাকার খালগুলোর ভেতর মাছের অভাব নাই। জঙ্গলে বন্যপ্রাণিরাও বেশ ভালোই আছে মনে হয়। সুন্দরবনের এই অঞ্চলে বন্যপ্রাণিদের খোলামেলা বিচরণ সব সময় দেখা যায়। পর্যটকরা আসে নীল কমল পর্যন্ত। সেখানে অনেকেই বাঘ দেখেছেন, বাঘের পায়ের ছাপ দেখা যায় অহরহ।
প্রায় প্রতি রাতেই বন বিভাগের ঘরগুলোর আশপাশ দিয়ে বাঘ হাঁটে। এখানে বন্দর ও নৌবাহিনীর স্থাপনা আছে। সেদিকেও মামারা ঘুরাঘুরি করে। তবে কাউকে ধরে দিয়ে গেছে এমন খবর এখনও শুনিনি।
ভাটা প্রায় শেষের দিকে। জেলেদের সাথে গল্প করতে করতে এগিয়ে যাচ্ছি। ওরা বললো, মামা প্রশাসনের লোকদের ধরে না। কিন্তু আমাদের পেলে ছাড়ে না। একটু অসতর্ক হলেই আস্তে করে তুলে নিয়ে যায়।
বিড়াল যেমন ইঁদুর ধরে মুখে নিয়ে হাঁটা দেয়, সুন্দরবনের বাঘও মানুষ মুখে নিয়ে হাঁটা দেয়। মুখে শিকার নিয়ে বিশাল বিশাল লাফও দিতে পারে ওরা। গলা আর কাঁধে কামড় দিয়ে আছাড় মারে শুরুতে। মারা যাওয়ার পর টেনে নিয়ে যায় বনের ভেতর। বললাম, সতর্ক থাকবেন ভাই। এতো পরিশ্রম করেন, বাড়ি ফিরতে না পারলে হবে?
এক জেলে বললো, চার বছর আগে তার সামনে থেকে একজনকে বাঘে নিয়ে গেছে। চোখের সামনে বাঘের আক্রমণ? জানতে চাইলাম, কী করতে আসছিলেন বনে? কোথাকার ঘটনা? সেই জেলে বললো, ওই ঘটনা মনে পড়লে এখনও বুকের ভেতরে কাঁপন দেয়।
এমনিতে বাঘ যখন সামনে পড়ে তখন ওকে বিড়ালের মতো লাগে। লেজ নামিয়ে এমর ভাবে হাঁটে যেন কিছুই বুঝে না, কিছুই চিনে না। তখন মনে হয় লেজ ধরে টান মারলেও কিছু বলবে না। এসময় চোখের দিকে তাকালেও মনে হয় সাধারণ এক বিড়াল। কিন্তু যখন শিকার করে বা রেগে থাকে তখন তার চেহারা বদলে যায়।
পাশ থেকে বেলায়েত সরদার বললেন, বাঘ যখন আক্রমণ করে তখন ওর চোখ মুখের দিকে তাকালেই মানুষ ভয়ে প্রশ্রাব করে দেয়। জঙ্গলে এরকম অনেক ঘটনা ঘটেছে ভাই। মামা যখন চোখ গরম করে তাকায় তখন তার চোখের দিকে তাকাতে না পারলে আপনি শেষ। আর শিকার যখন তার দখলে থাকে তখন আপনি দাঁড়াতেও পারবেন না।
এসময় বাঘের চেহারা ভয়ঙ্কর রূপ নেয়। তর্জন গর্জনে পুরো জঙ্গল কাঁপে। মুখ দিয়ে লালা ঝরে। শিকার ধরা থাকলে মুখে নিয়ে লাফ দিয়ে সরে পড়ে। আস্ত মানুষ মুখে নিয়ে ও এমন ভাবে হাঁটে, মনে হয় যেন মানুষের শরীরে কোনো ওজনই নাই।
সামনে দাঁড়ানো ওই জেলে বললো, সেই বছর চরপাটা নিয়ে মাছ ধরতে আসলাম। ভোরবেলা কালির চরে মাছ ধরছিলাম। এসময় সাথের একজনকে বাঘ ধরলো। উল্টো দিক থেকে মামা এসে আক্রমণ করলো। কিছু বুঝে ওঠার আগেই মাথার পেছনে থাবা দিলো। খট করে একটা শব্দ হলো। বাকী সব ঘটে গেলো চোখের নিমিষে।
কিছুক্ষণ কী করবো বুঝতে পারলাম না। দেখি চরের পাশ দিয়ে আস্ত মানুষটিকে মুখে নিয়ে হাঁটা দিলো বাঘ। মনে হলো যেন মানুষ না, ইঁদুর নিয়ে হাঁটছে বড়সড় একটি বিড়াল।
তারপর কী করলেন আপনারা? জানতে চাইলাম। বললো, এরপর সবাই হৈ হৈ করে আগায়ে গেলাম। আমাদের হৈচৈ করতে শুনে টুপ করে বনের ভেতর ঢুকলো বাঘ। তারপর হারায়ে গেলো। পালায়ে যাবো? নাকী মাছ ধরবো? সবাই বললো, ওই বাঘের মুখ থেকে ছেলেটাকে ছাড়ায়ে আনতে হবে।
দা আর লাঠি নিয়ে সবাই মিলে ভেতরে গেলাম। ওই দিন আর খুঁজে পাইনি। পরের দিন অর্ধেক খাওয়া অবস্থায় ছেলেটার লাশ নিয়ে বাড়ি ফিরলাম আমরা। তারপর গত তিন বছর জঙ্গল করিনি। এই বছর আবার নামলাম। জঙ্গল না করলে পেট চলে না।
বাঘের গল্পে মজে গেছি। মাথার ভেতরটাতে শুধু বাঘের আতঙ্ক ঘুরছে। একটু আগে মামার পায়ের ছাপ দেখে আসলাম। আছি খালের পাশে, জঙ্গলের ভেতর। জেলেরা গল্প করতে করতে মাছ তুলছে।
চরের কাদা থেকে আমি নিজেও মাছ ধরছি আর তুলছি। জেলেরা সতর্ক, সরদারও সতর্ক যাকে কোনো ভাবে কোনো শংকার মধ্যে না পড়ি। চারপাশে কড়া নজরদারি আছে। সরদার আবারও বললেন, সকাল থেকে চারপাশ ভারি ভারি লাগছে। শুধু বাঘ নানা, কেরেল সাপ বা কাউইন জাতীয় মাছ আক্রমণ না করে, সেদিকেও লক্ষ রাখছে ওরা।
সুন্দরবনে আরেকটি ভয়ঙ্কর জলজ প্রাণি আছে। সেটি হলো স্টিং রে বা শাপলা পাতা। এদের লেজে কাঁটা থাকে। সেটিও ভীষণ বিষধর। কাজেই আমাকে নিয়ে তারা ঝূঁকি নিতে রাজি না। বিশেষ করে কেরেল সাপ নামে যে সাপটি আছে সেটি দেখা মাত্র তারা লেজ ধরে খালের ভেতর ছুড়ে ফেলছে।
ওপাশের জেলেরা মাছ তুলতে তুলতে কাছাকাছি চলে এসেছে। তার মানে মাছ তোলা প্রায় শেষের দিকে। জঙ্গলের ভেতর থেকে ডেকে উঠলো কুকু পাখি। চারপাশ থেকে কয়েকটি পাখি পর পর ডাকাডাকি করছে। তার মানে শেষ হয়েছে ভাটা।
দ্রুত হাত চালাচ্ছে জেলেরা। সরদারও তাদের সাথে হাত মিলিয়েছেন। আমিও কাজ করছি তাদের সাথে। সারা গায়ে কাদা মেখে জেলেদের সাথে মিশে গেছি। ওরা যেভাবে দাঁড়ানো, সেভাবে দাঁড়িয়েছি। ওরা যে ভাষায় কথা বলছে, আমিও সে ভাষায় বলছি। মাছের ড্রামগুলো টেনে নৌকায় তুললো ওরা।
জালের অন্য জেলেরা এসে গেছে। তাদের নৌকাতেও মাছের ড্রামগুলো তোলা। ড্রাম আর নৌকার খোল ভর্তি মাছ। আনন্দের সীমা নাই। ওরা বললো, খালের ওদিকে মামা আছে। তাজা পায়ের ছাপ দেখেছে। বললো, গত রাতে ওদিক দিয়ে হেঁটেছে বাঘ। মামা নাকী আশেপাশেই আছে।
(সুন্দরবন ২০১৬)