চাঁদা দেই, ঘুষ দেই, তারপরও মাছ ধরি চুরি করে | রূপান্তরের গল্প ২৯৩ | Rupantorer Golpo 293 | দস্যুমুক্ত সুন্দরবন | সুন্দরবনের গল্প | জীবনে ফেরার গল্প | Jibone Ferar Golpo | Sundarbaner Goppo | Story of Sundarbans | মোহসীন উল হাকিম | Mohsin Ul Hakim
রূপান্তরের গল্প ২৯৩ : ঠকঠক করে কাঁপছি। ভয়ে না, ঠান্ডায়। শীতের ভোরে এই খালের পানিতে দাঁড়িয়ে আমরা। প্রায় দেড় ঘন্টা হলো এখানেই আছি। দেখছি চরপাটার জেলেদের মাছ ধরা। ধরছি নিজেও। এর মধ্যে অন্ধকার থেকে ভোর হলো। গভীর কুয়াশা কাটলো। সুন্দরবন রূপ নিলো ভয়ঙ্কর সুন্দরে।
অদ্ভুত এক পরিবেশ। এর আগে শুধু দূর থেকে দেখেছি। এই প্রথম চরপাটার জেলেদের সাথে পানিতে নেমেছি। আসার সময় ভেবেছিলাম, নানা জাতের মাছ দেখবো, মজা পাবো। নামার পর দেখছি শুধু মাছ না, এই জঙ্গলে আরও অনেক কিছু দেখার আছে।
এর আগে বঙ্গবন্ধুর চরে চরপাটা দেখেছি। মাছ ধরা দেখেছি বেহালার চরে, পাগড়াতলীর চরে, নিলবাড়িয়া আর ছাপড়াখালীর চরে। সবগুলোই বালির চর, সাগর পাড়ে। এবারে অভিজ্ঞতা ভিন্ন। জঙ্গলের ভেতরে কাদায় মাছ ধরা এই প্রথম।
ভাটা শেষ। এখন পানি দাঁড়াবে কিছুক্ষণ। তারপর জোয়ার শুরু হবে। সাগরের পানি ফুলবে। সেই চাপ এসে পড়বে বড় নদীতে। নদীর পানি চাপ দিবে খালে খালে। ভরা জোয়ারে ছোট খালগুলো উপচে পড়ে পানি। আবার ভাটায় নেমে যায়। এখন ভাটা শেষ হয়েছে। কিছুক্ষণ স্থির থাকবে পানি। আমরা সময় পাবো বড়জোর আধা ঘন্টা। জেলেরা এর মধ্যেই মাছ তোলার কাজ শেষ করবে, শেষ করতেই হবে।
অনেক সময় জোয়ারের হিসাব বুঝতে পারে না জেলেরা। ওরা বলে, মাঝে মাঝে সময়ের আগেই জোয়ার এসে যায়। মানে পানি বেড়ে যায়। কখনও ভাটা শেষ হলেও পানি যতোটুকু নামার কথা ততোটুকু নামে না। সাধারণত দূরে কোথাও নিম্নচাপ থাকলে এমন হয়।
জোয়ার ভাটার একটু অনিয়ম হলে নদী সাগরের জেলেরা বিপাকে পড়ে যায়। তেমন হলে মাছেরাও জালে আসে না, বড়শি খায় না। জেলেরা বলে, চাঁদের সাথে হিসাব করে এখানে সবকিছু চলে। এর বাইরে কোনো কিছুই হয় না। তাই দিন-রাতের হিসাবে না, আমরা চলি চাঁদের সাথে হিসাব মিলিয়ে।
চরপাটার সব জেলে এখন এক জায়গায়। মাছগুলো ড্রামে ড্রামে রাখা। কিছু ড্রাম নৌকার ওপর। এখনও কয়েকটি ড্রাম আছে কাদার ওপর। শেষ মুহুর্তে যতোটুকু সম্ভব মাছগুলো কাদা থেকে তুলে নিতে হবে।
এরপর মাছের ড্রামগুলো নিয়ে জেলেদের এক দল যাবে ছোট কোনো খালে। সেখানে মাছ বাছাই ও ধোয়ার কাজ শুরু হবে। আরেকটি দল থেকে যাবে খালে। জাল আর খুঁটিগুলো তুলবে। জাল পরিস্কার করে গুছিয়ে নিয়ে আসবে। যেখানে মাছ বাছাই চলবে সেখানে গিয়ে জড়ো হবে সবাই।
বাছাই ও পরিস্কার করার কাজটি বেশ লম্বা সময়ের। মাছ বেশি হলে কখনও দুপুর গড়িয়ে যায়। এসময় এক কাপ চা বানিয়ে খাওয়ারও সময় থাকে না।
সব কাজ শেষ করে বিকালের ভাটায় আবার তারা যাবে আরেকটি চরে। সন্ধ্যার ভাটায় জাল ফেলবে। ভরা জোয়ারে টেনে তুলে দিবে জাল। আবার কাল সকালের শেষ ভাটায় এসে মাছ তুলবে। মহাজনের ট্রলার আসবে রাতে।
ঘুরে ঘুরে সবগুলো জেলে নৌকাগুলোর কাছে যাবে। মাছ নিবে, বরফে রাখবে। মাছের কেবিন ভরলে রাতেই তারা টান দিবে খুলনার উদ্দেশ্যে। সময় মিললে রাতে সেই দৃশ্যও দেখবো। মাছ না ভরলে অবশ্য আরেক দিন থাকবে মহাজনের মাছ পরিহনের ট্রলার।
এখন ফিরতে হবে। মাছের ড্রামগুলো নিয়ে দুটি নৌকা রওনা হলো। আরেকটি নৌকার খোল ভর্তি মাছ। চতুর্থ নৌকাটি থেকে গেলো। জাল গুছিয়ে ওই নৌকা নিয়ে ফিরবে বাকী জেলেরা।
নৌকা চলছে কেওড়াশুঁটি খালের উল্টো পাশ দিয়ে। উজান স্রোত হলেও বৈঠা বেয়ে এগুতে খুব একটা কষ্ট হচ্ছে না। স্রোত নাই বললেই চলে। জেলেদের হাতে হাতে বিস্কিট, হাঁড়িতে চড়েছে চায়ের পানি।
বিস্কিটের প্যাকেট হাতে নিয়ে দেখি ভেতরটা ভেজা। কখন যেন পানি ঢুকেছে। খেতে গিয়ে দেখি লবণ পানি। মানে খালের পানি ঢুকেছে কোনো ভাবে। নৌকার একজন বললো, নৌকায় ড্রাম তোলার সময় পানিতে পড়ে গেছিলো। আরেক জন বকা দিলো ছেলেটিকে। বললো, ওই বিস্কিট কেন ভাইকে দিলি? নতুন প্যাকেট খোল। ছেলেটি বললো, নৌকায় আর বিস্কিট নাই। আমি বললাম, খাওয়া যাচ্ছে তো, অসুবিধা নাই।
মহাজন ঠিকঠাক বাজার দিচ্ছে না। শুকনো খাবার, পান-সুপাড়ি, সিগারেট-বিড়ি পর্যাপ্ত দেয়নি, সময় মতো অন্য বাজারও আসেনি। এসব নিয়ে জেলেরা বেশ অসন্তুষ্ট। একজন বলছে, মেহমান আসছে, তাকে ভেজা বিস্কিট দেওয়া লাগলো। কী লজ্জার ব্যাপার! আরেকজন বললো, মহাজন ঠিকঠাক টাকা দেয়, মুহুরি ঝামেলা করে। বললাম, এই বিস্কিট খেতে আমার সমস্যা হচ্ছে না। ট্রলারে অনেক খাবার আছে। মহাজনের বাজার না আসলেও চলবে।
একটু থামতে হবে। সামনের চর থেকে শাক তুলবো। সরদার বললেন, আজ আপনাকে এই শাক দিয়ে চাকা চিংড়ি খাওয়াবো। পথে ওল বাউলা ফলও পাড়তে হবে। ভাঙ্গন মাছের তরকারির সাথে দেখবেন অমৃত লাগবে। রান্নার স্বাদ বুঝাতে এই শব্দটি প্রায় ব্যবহার করেন আমাদের বেলায়েত সরদার।
বললেন, কেওড়া বনের ভেতরে ঢুকলে এখনও কিছু কেওড়া পাবো। টক বানায়ে দিবো। দেখবেন কেওড়ার খাটাও অমৃত লাগবে। বলতে বলতে চরে ঠেকলো নৌকা। সরদারের সাথে আরেকজন নামলো। দুজন মিলে শাক তুললো। সুন্দরবনের এই শাকের নাম জানি না। তবে খেতে নিশ্চয়ই ভালো হবে।
আরেকটু এগুলেই আমাদের ট্রলার। আরেকটি বাঁক ঘুরতে হবে। এদিকে কুয়াশা কেটে গেছে প্রায়। রোদ ঝলমল করছে। সারাদিনের ভেজা শরীরে এই রোদটুকুই এই জেলেদের জন্য স্বস্তির। ওরা নৌকা বেয়ে আমাদের নামিয়ে দিবে ট্রলারে। তারপর গিয়ে ঢুকবে সরু কোনো খালের ভেতর।
বললাম, আপনারা তো বড় খালে বসেই মাছগুলো বাছাই আর পরিস্কার করতে পারেন। অন্য খালে যেতে হবে কেন? জেলেরা হেসে দিলো। বললো, আমরা তো এখন চোর! চুরি করে মাছ ধরছি অভয়াশ্রমে। নিজেদের চোর চোরই মনে হয়।
এই জেলেদের বড় খালে থাকার নিয়ম নাই। সারাদিন ছোট খালের আগায় থাকে তারা। বের হয় না। উঁচু গলায় কথাও বলে না। রাতের বেলা বের হয় কারণ ছোট খালে বাঘের ঝুঁকি। এক জেলে বললো, বাঘ তো শিকারও করে রাতের বেলা। এছাড়া ফরেস্টের লোকজন রাতের বেলা কম আসে। মাঝে মাঝে ডিএফও সাহেব নামেন, তখন এখানকার অফিস থেকে আমাদের সতর্ক করে দেয়। স্মার্ট টিম নামে কন বিভাগের বিশেষ টিম যখন নামে তখনও আগেভাগে খবর পাই।
নৌকা চলছে। আমরা গল্প করছি। আধা ঘন্টার মতো সময় লাগলো। পৌঁছে গেলাম ট্রলারের কাছে। ততোক্ষণে সহযাত্রীদের ঘুম ভেঙ্গেছে। কেউ ব্রাশ করছে। কেউ চায়ের কাপ হাতে নিয়ে হাঁটাহাঁটি করছে।
শহীদুল কাকু রান্নাঘরের সামনে বসা। ভাত রান্না শেষ। এখন উঠেছে ডাল। ভাত থেকে সেদ্ধ আলু বের করে ছিলে নিচ্ছে মামুন। ডাল নামলে শুকনা মরিচ ভাজা হবে। পেঁয়াজ কেটে রাখা হয়েছে গামলার ভেতর।
আমরা কি শুধু ভর্তা ভাত খাবো? আমার প্রশ্নের উত্তরে শহীদুল কাকু বললো, তা কেন? পাতলা ডালও তো রান্না হচ্ছে। নৌকা থেকে কিছু মাছ তুলে দিলো জেলেরা। বললো, এই মাছগুলো নেন। টাটকা মাছ। যেমন ভাবেই রান্না করেন, স্বাদ লাগবে।
একটি বাঁশের টুকরিতে না হলেও দশ কেজি মাছ তুলে দিলো জেলেরা। দাতিনা, পায়রা, পারশে, গলদা চিংড়ি, বাগদা চিংড়ি, চাকা চিংড়ি আর বড় একটা ভাঙ্গন মাছ। আরেক জন হাতে করে একটা বড় ভেটকি, দুইটা বড় বড় কাউইন মাগুর তুলে দিলো।
জেলে ভাইদের ধন্যবাদ জানালাম। বললাম, এতো মাছ তো আমরা খেতে পারবো না ভাই। ওরা বললো, না পারলে বাড়ি নিয়ে যাবেন। বললাম, বাড়ি যেতে দেরি আছে। তার চেয়ে বরং এগুলো রাখেন আপাতত। বাড়িতে মাছ নিলে চেয়ে নিবো।
সুন্দরবনের জেলেরা মাছ দেয় মনের আনন্দে। আদর করে বড় মাছগুলো তুলে দেয়। এ এক অদ্ভুত ব্যাপার। যখন ডাকাত বা ফরেস্টের লোকজন খাওয়ার মাছ নেয় তখন বড়গুলো বেছে নেয়। জেলেরা দিতে চায় না। তবুও নেয়। কখনও বড় সাহেবের নাম করে সবগুলো বড় মাছ নিয়ে যায়। বলে যে দাম দিয়ে দিবে। কখনও দাম দেয় না। শুধু বলেই। জেলেরা বলে, ওরা মাছ নেয় আমাদের বুকের উপর পাড়া দিয়ে।
আমি বললাম, আমাকে কেন বড় মাছ দিতে চাইছেন? ওরা বললো, আপনাকে আমরা ভালোবাসি। বেলায়েত ভাইয়ের সাথে অনেক আগের পরিচয়। কোনোদিন একটা মাছ টাকা ছাড়া নেয়নি। বিপদে পড়লে সবার আগে এগিয়ে আসে। এছাড়া আপনিও আমাদের জন্য কতো কাজ করছেন!
আরেক জেলে বললো, আপনি তো মাছ খেতে চান না। যখন ডাকাত দলের কাছে গেছেন, ওরাও আপনাকে মাছ দিতে চাইলো। মনে আছে আমার। তখন আমি অপহরণ করা জেলে। ট্রলারে বসে দেখছিলাম, সাগরের বড় একটা কলাপাতা মাছ (সোর্ডফিশ) দিলো, আপনি ফিরায়ে দিলেন। চিংড়ি মাছও নেননি।
চোখে পানি চলে আসে! এরা এতো কিছু খেয়াল করে? বললাম, আমার মাছ খেতে ইচ্ছা করলে কিনে নিবো। সামর্থ যতোটুকু আছে সেটুকু দিয়ে চলতে পারি। আরেক জনের কাছ থেকে জোর করে কিছু নেওয়া শিখিনি, উচিৎও না। এই যে কতো ঝুঁকি নিয়ে আপনারা মাছ ধরেন, কতো কষ্ট করেন! এই কষ্টের কি দাম হয়? এই মাছের দাম কি দেওয়া যায়? খুব খেতে ইচ্ছা করলে খুলনার রূপসার মাছের আড়ৎ বা সন্ধ্যা বাজার থেকে কিনি।
জেলেরা বললো, আপনার আর মাছ কেনা লাগবে না। এখন থেকে আমরা পাঠাবো। বললাম, আপনার কোম্পানি তো ধরবে তখন। মাছের হিসাব চাইবে। এর মালিক তো আর আপনারা না। তাই না? ওরা বললো, সে ঠিক আছে। কিন্তু আমাদের কিছু বলবে না।
আরেক জন বললো, এই কোম্পানির পুরনো জেলে আমরা। অনেক বছরের সম্পর্ক। সে সম্পদ যা করেছে সে সব তো আমাদের দিয়েই করা। আমরা মাছ ধরে না দিলে মহাজনেরা এতো টাকার মালিক হতে পারতো?
গল্প করতে করতে বড় মাছগুলো নিয়ে ছবি তুললাম। তারপর ফিরিয়ে দিলাম জেলেদের নৌকায়। বললাম, মাছ লাগলে বলবো। এখন একটু খাওয়া দাওয়া করেন। তারপর যেখানে যাবেন যান। জেলেরা বললো, হাতে সময় নাই। মাছগুলো পরিস্কার করতে হবে। আমরা আগাই। আপনারা চাইলে আসতে পারেন। বলেই নৌকা ছাড়তে গেলো তারা।
সরদার বললেন, একটা নৌকা রেখে যান। খেয়ে আমরাও যাবো। ওরা বললো, কেওড়াশুঁটিতেই থাকবে তারা। এক বাঁক সামনে গিয়ে ডান পাশে প্রথম যে খাল পড়বে, তার ভেতরে ঢুকবে। দুই বা তিন বাঁক পার হয়ে দোঢালা আছে। ডান দিকের খালে থাকবে তারা।
নৌকা ছেড়ে দিলো। আমরাও যাবো। তার আগে হাত-মুখ ধুয়ে জামা কাপড় বদলাবো। ভাত খেয়ে ছুটবো আমরাও। ওরাও ছুটছে কোনো দিকে না তাকিয়ে। মাথায় একটা কথা ঘুরছে। ওরা নিজেদেরকে চোর বলছে।
সত্যিই তো। ডাকাতদের চাঁদা দিয়ে, ফরেস্টের লোকদের ঘুষ দিয়ে মাছ ধরে তারা। তারপরও ওরা চোর। ধরা পড়লে মার খাবে, জরিমানা হবে, মামলাও হবে। সবকিছুই যাবে তাদের পিঠের ওপর দিয়ে। ঝুঁকি, পরিশ্রম সবই তাদের। তারাই মাছ ধরছে। কিন্তু মাছের মালিক তারা না। লাভের সামান্য অংশের মালিক তারা। অথচ লোকসানের পুরোটাই পড়ে জেলেদের কাঁধে।
(সুন্দরবন ২০১৬)