রূপান্তরের গল্প ২৯৪ | Rupantorer Golpo 294

সরদার বলে- ও কুনো বিপার না ভাই! | রূপান্তরের গল্প ২৯৪

সরদার বলে- ও কুনো বিপার না ভাই! | রূপান্তরের গল্প ২৯৪ | Rupantorer Golpo 294 | দস্যুমুক্ত সুন্দরবন | সুন্দরবনের গল্প | জীবনে ফেরার গল্প | Jibone Ferar Golpo | Sundarbaner Goppo | Story of Sundarbans | মোহসীন উল হাকিম | Mohsin Ul Hakim


রূপান্তরের গল্প ২৯৪ : পায়ে কাদা, গায়ে কাদা, কাপড়ে কাদা, চুলেও কাদা। সুন্দরবনের কাদায় নাকী প্রেম আছে। গায়ে লাগলে যেতে চায় না। যতোই ধুই কাদা সরে না। আমারও আজ সেই অবস্থা! পুরো শরীরে কাদা। ট্রলারে ফিরে তাই সবার আগে হাত পা ধুতে বসলাম। খাল থেকে বালতির পর বালতি পানি তুলছে মামুন। জামা কাপড়ের কাদাগুলো যাচ্ছেই না। সরদার বললেন, কাপড় বদলায়ে নেন ভাই। ওরা ধুয়ে দিবে পরে।

হাত মুখ ধুয়ে একটু বসলাম। বেলায়েত ভাই মাছ নিয়ে বসতে গেলেন। বললাম, যা আছে তাই দিয়ে খেয়ে নেই। শহীদুল কাকু বললো, ভাত তো বেশি করে রান্না করছিলাম। জেলেরা চলে গেলো। ওরাও খেতে পারতো। বললাম, আমরা খেয়ে তাদের জন্য নিয়ে যাবো।

এমনিতে এই বেলায় জেলেদের ভাত খাওয়ার সুযোগ নাই। আমরা যে খাবার নিবো সেগুলো খাওয়ার সময় পেতে পেতেও তাদের বিকাল হবে। কারণ সকলেই মাছ ধোয়া আর বাছাইয়ের কাজে ব্যস্ত থাকবে। আজ মাছ যেহেতু বেশি সেজন্য কাজের চাপ আজ অনেক বেশি থাকবে।

সরদার বললেন,খালে গিয়ে আগে ভাত-তরকারি দিবো। তারপর দুই ভাই মিলে বাউলা ফল পাড়তে যাবো ভাই! ওই খালের ভেতরে কি বাউলা পাবো? এদিকে তো কেওড়া বাগান বেশি। বড় বড় গাছের অভাব নাই। বাউলা ফলগুলো বেশির ভাগ দেখি খালের পাড়ে ছোট ছোট গড়ান-গেওয়া গাছের সাথে ঝুলে থাকে। সরদার বললেন, খালের ভেতরে গেলে গড়ানের ঝোপ পাবো। কপালে থাকলে পাবো। এখন খেয়ে নেন।

আলু ভর্তা বানালো মামুন। শহীদুল কাকু এখনও রান্নাঘরে। ডাল নামলো চুলা থেকে। আমরা যে যার মতো করে দাঁড়িয়ে পড়লাম প্লেট হাতে। ট্রলারের সামনের দিকে সবাই জড়ো হলাম। ওখানেই খেতে বসবো। প্লেটগুলো একটু ধুতে হবে। এজন্য ডিটারজেন্ট পাউডারের প্যাকেট ঝোলানো থাকে ট্রলারে। লবণ পানির এই দুনিয়ায় হাত ও প্লেট ধোয়ার জন্য ডিটারজেন্ট পাউডারই ভরসা।

গরম ভাতের সাথে আলু ভর্তা এমনিতেই ভালো লাগে। তার সাথে গরম গরম পাতলা ডাল সোনায় সোহাগা। ক্ষুধা পেটে এই খাবার বেলায়েত সরদারের ভাষায় অমৃত। এর সাথে আবার শুকনো মরিচ ভাজা আছে।

সরদার নিজের হাতে মরিচ ভাজেন। কড়াইয়ে সরিষার তেল যখন হাল্কা গম হয় তখন একটু লবণ ছাড়েন। মিনিট দুই পর ছাড়েন শুকনা মরিচ। হাল্কা পোড়া পোড়া হলে তুলে ফেলেন। সাথে সাথে লবণের ছিটা দিয়ে কিছুক্ষণ খোলা বাতাসে রাখা হয়।

এরপর ভাতের সাথে ভাজা মরিচ ডলে নেই। মরিচের ঝাল আর ঘ্রাণ খাওয়ার রুচি বাড়িয়ে দেয়। আমাদের জঙ্গল জীবনে এমন অনেক দিন হয়েছে যে শুধু মরিচ পোড়া দিয়ে এক বেলার ভাত খেয়ে ফেলেছি। আজ আবার এর সাথে ভর্তা আর ডালও আছে।

খেতে আধা ঘন্টার মতো সময় লাগলো। তারপর কিছুক্ষণ রোদ পোহাবো। এর মধ্যে মামুন আর শহীদুল কাকু খেয়ে নিবে। তারপর উঠবে চায়ের পানি। গরম ‌এক গ্লাস চা খাবো। তারপর চাঙ্গা হয়ে আবারও নামবো জঙ্গলে।

জেলেরা যেখানে মাছ বাছতে বসেছে সেখানে যাবো। তারপর নৌকায় বা পায়ে হেঁটে বাউলা ফল সংগ্রহ করবো। কপাল ভালো হলে সাথে সাথেও পেতে পারি। আর মন্দ হলে হয়তো একটিও পাবো না। বড় খালের পাশ দিয়ে চলার সময় একটি ওল বাউলা ফলও চোখে পড়লো না।

জঙ্গলের এই ফলটি আমাদের লাগবেই এমন কোনো কথা নাই। কিন্তু সরদার আজ কথা দিয়েছেন, ভাঙ্গন মাছের সাথে বাউলা ফল দিয়ে কী একটা রান্না করবেন। রাতে সেই তরকারি খাবো আমরা।

ট্রলার ছাড়লো। জেলেদের বলে দেওয়া পথ ধরে এগিয়ে গেলাম। দুই বাঁক ঘুরে ডান পাশের প্রথম খাল বরাবর দাঁড়ালাম। নোঙ্গর করতে করতে দেখি খালের ভেতর থেকে একটি নৌকা বেরিয়ে আসলো। তার মমানে ওরা এই খালেই আছে। জেলেরা যেভাবে বলেছিলো সেভাবেই পেয়ে গেলাম। খাল খুঁজতে সময় নষ্ট হয়নি একদম।

নৌকা ভিড়লো ট্রলারের পাশে। ভাতের হাঁড়ি,ডাল আর ভর্তা নামানো হলো। পানির বোতল,শুকনো খাবার,চা,চিনি আর গুঁড়া দুধের প্যাকেট নিয়ে নেমে পড়লাম আমরা। মনে হচ্ছে এক রকমের ভাসমান বনভোজনে যাচ্ছি।

জেলেদের প্রতিটি নৌকায় একটি করে চুলা থাকে। থাকে শুকনো লাকড়ি। যেকোনো সময় রান্না বা চা জ্বালানোর ব্যবস্থা থাকে। কিন্তু ব্যস্ততা ও বাস্তববতার কারণে দুই বেলার বেশি রান্না হয় না এখানে। ভারী খাবারও তাদের দুই বেলাই হয়। সকালে আর সন্ধ্যার আগে।

সন্ধ্যার পর সুন্দরবনের জেলেরা কোনো রকমের আলো জ্বালে না। চুলা জ্বালানো তো অনেক পরের কথা। তখন কথাও বলে নিচু স্বরে। যা কিছু করুক কোনো ভাবে ডাকাত ও ফরেস্টাদের নজরে পড়া যাবে না। বিশেষ করে বনদস্যুরা দূর থেকে আলো দেখেই জেলেদের টার্গেট করে।

যারা নৌকা নিয়ে দস্যুতা করে তারা চলে নিঃশব্দে। কান খাড়া রাখে, চোখ থাকে সতর্ক ও তীক্ষ্ণ। অনেক দূর থেকেও যদি আলো দেখতে পায় তাহলে সেই জেলের আর রক্ষা নাই। এজন্য সুন্দরবনের জেলেদের সন্ধ্যার পর আর কিছুই করা হয় না। খাওয়া দাওয়াও হয় না। পান বিড়ি আর বড়জোর এক কাপ চা খেয়ে রাত পার করে তারা।

নৌকার মাঝখানে বসেছি আমি। সাথে আছেন সহযাত্রীরা। না ফেরা পর্যন্ত আমাদের ট্রলার থাকবে বড় খালে। অন্য সময় হলে কোনো সরু খালে রাখতাম। এবার যেহেতু সাধারণ সফর তাই লুকিয়ে থাকার প্রয়োজন নাই।

কেওড়াশুঁটি খালটি এখানে বেশ বড়, প্রশস্ত। কিন্তু বড় নদীর দিকে একদম সরু। দুই পাশের কেওড়া বনের কারণে পশুর নদী থেকে এর ভেতরটা খুব বেশি দেখা যায় না। ওদিক দিয়ে ট্রলার নিয়ে চলাফেরা করাও বেশ মুশকিল। পুরোটাই চর পড়ে গেছে। তবে ভেতরটা বেশ গভীর।

এই খাল থেকে বড় নদীতে বের হওয়া বা প্রবেশ করা একটু কঠিন হলেও আশেপাশের যেকোনো খাল বা নদীতে বের হওয়া যায়। বিশেষ করে নীল কমল নদী, কাগা খাল হয়ে হংসরাজে যাওয়া যায় অনায়াসে। ওদিক দিয়ে বের হওয়া যায় শিবসা নদী ও আড়পাঙ্গাসিয়া নদীতে। আবার সোজা পশ্চিমে গেলে বালির গাঙ দিয়ে যাওয়া যায় বড় নদী- আড়পাঙ্গাসিয়ায়। তার মানে একই পথ ধরে এদিকে আসাও যায়।

সরদার বললেন, যে কারও নজর এড়াতে আমাদের ট্রলারটি বড় নদীতে না রেখে ছোট কোনো খালে ঢুকিয়ে রাখলে ভালো হয়। আশেপাশের কোনো খালের ভেতর কি তুলে রাখবো ট্রলার? বললাম, না। বড় খালেই থাকুক। ফরেস্টাররা আসলে কথা বলে নিবো। আর ডাকাত দল আসলে একসাথে বসে চা নাস্তা খাবো। এখানে আসলে একমাত্র নোয়া বাহিনী আসবে। তার সাথে দেখা করা দরকার। ওদের সারেন্ডার করাতে হবে।

ট্রলার একটু মাঝ খালে নিয়ে নোঙ্গর করতে বললাম। যাতে দূর থেকে দেখা যায়। মামুনকে বললাম, আমরা ভেতরে যাচ্ছি। যদি এর মধ্যে ফরেস্ট বা বনদস্যুরা আসে তবে আমাকে ডাক দিবে। ভয় পাবে না। বলেই নৌকা বেয়ে রওনা দিলাম।

যাওয়ার সময় শহীদুল কাকুকে সরদার বললেন, শাকগুলো কেটে-বেছে রাখো কাকা। চাকা চিংড়িগুলো বেছে রাখো। ভাঙ্গন মাছটা কেটে রাখো। আমি এসে ধুয়ে রান্না তুলবো।

আমি বললাম, আজ কিন্তু বাউলা ফল নিয়েই ফিরবো। সরদার বলে, ও কোনো ব্যাপার না। প্রয়োজনে নৌকা বেয়ে একটু এদিক সেদিক যাবো।

ফিরবো কখন আমরা? উত্তরে সরদার বললেন, সবকিছু ঠিক থাকলে, কোনো ঝামেলা না হলে ট্রলারে ফিরতে ফিরতে দুপুর পার হবে। শহীদুল কাকুকে বললেন, সন্ধ্যার মধ্যে রান্না চড়াবো। সেই ভাবে কাজ কারবার গুছিয়ে নাও তোমরা। খাবো কিন্তু জেলেদের সবাইকে নিয়ে। সেই মাপে ভাত রান্না করে রাখবা। সন্ধ্যার মধ্যে রান্না সেরে ফেলতে হবে।

বড় খাল পারি দিয়ে নৌকা ঢুকলো সরু খালে। চারপাশে গভীর বন। রোদ ঢুকছে না। শীতল বাতাস একটা ধাক্কা দিয়ে গেলো। শিরশির করে উঠলো পুরো শরীর।

আমরা আবারও যাচ্ছি জঙ্গলে। ঠিক করেছি আর কাদায় নামবো না। এমনিতে বাইড়ে পোকার কামড়ে পুরো শরীর চুলকাচ্ছে। বেশ কষ্ট হয়। চুলকাতে চুলকাতে চামড়া উঠে যায়, ক্ষত হয়। সারতে সারতে প্রায় দুই সপ্তাহ লেগে যায়।

আগে যখন সুন্দরবনে এসে এই পোকার কামড় খেতাম তখন বুঝতাম না। পোকাটি এতো ছোট যে খালি চোখে সহজে দেখা যায় না। ভাবতাম হয়তো চিংড়ি মাছ খাওয়ার কারণে অ্যালার্জি হচ্ছে। কিন্তু যখন চিংড়ি খাই না তখনও এরকম চামড়া ফুলে উঠতো, চুলকাতো। বেলায়েত সরদারের সাথে বনে আসার পর জানতে পারলাম যে ঘটনাটি ঘটাচ্ছে জঙ্গলের বাইড়ে পোকারা।

খালের ভেতরটা বেশ সরু, ভয়ঙ্কর সুন্দর। এর কোনো নাম নাই। একপাশে কেওড়া বন। আরেক পাশে গড়ান, পশুর আর সুন্দরীর বন। ঝোপঝাড় বেশ গভীর, জমাট বাঁধা। দেখলেই ভয় লাগে।

নৌকা চলছে ধীরে ধীরে। আমি হাতে পায়ে ভালো করে সরিষার তেল মেখে নিলাম। বেড়ে পোকার কামড় আর খেতে পারবো না। সরদার বললেন,কেরোসিন তেলেও ওই পোকা থামে না ভাই! সরিষার তেলে মানবে? বললাম, না মানুক। চেষ্টা তো করি! শহীদুল কাকু বললো যে সরিষার তেল দিলে পোকা শরীরে বসে না?

সামনে থেকে জেলে ভাই এক টাকা দামের কয়েকটি মিনিপ্যাক শ্যাম্পু এগিয়ে দিলো। বললো,জঙ্গলের বাইড়ে পোকার সবচয়ে বড় ওষুধ এটা। শ্যাম্পুর উপর ওরা বসে না। একটু পানি মিশিয়ে গায়ে মাখেন।

এই জঙ্গলে যে যা করতে বলে আমি তাই করি। সাথে সাথে শ্যাম্পু বের করে খালের পানিতে মিশিয়ে একটু পাতলা করে নিলাম। তারপর শরীরের খোলা অংশগুলোতে মেখে ফেললাম।

জেলেরা বললো, আসলে শ্যাম্পু বিষয় না। যেকোনো সুগন্ধ ওরা সহ্য করতে পারে না। গায়ে তেলের মতো করে শ্যাম্পু মেখেছি। চট চট করছে। ভাবছি যা করে করুক। পোকা না কামড়ালেই হয়।

এদিকে সাবানের ব্যবহার দেখি না। সবাই শ্যাম্পু ব্যবহার করে। লবণ পানিতে সাবানের ফেনা হয় না। সুন্দরবনে তাই সাবান একদমই চলে না। অন্যদিকে আমরা যেসব ব্রান্ডের শ্যাম্পু ব্যবহার করি সেগুলোও এখানে খুব একটা কাজ করে না। মানে ফেনা হয় না।

বনঘেঁষা বাজার আর দোকানে অজানা অচেনা ব্রান্ডের মিনিপ্যাক শ্যাম্পু পাওয়া যায়। এক টাকা করে দাম। এই শ্যাম্পুটাই লবণ পানিতে কাজ করে, মানে ফেনা হয়। এর বাইরে জেলেরা হাত পরিস্কার করার জন্য ডিটারজেন্ট পাউডার ব্যবহার করে। থালা-বাসন ধোয়া থেকে হাত-পা ধোয়ার জন্য প্রতিটি নৌকায় থাকে ডিটারজেন্ট। ওরা সাধারণ ও কম দামী পাউডারগুলো ব্যবহার করে।

দুই বাঁক পার করলাম। খাল ক্রমেই সরু হয়ে আসছে। তৃতীয় বাঁকের আগেই একটি দোঢালা পড়লো। সেখান থেকে ডান দিকে ঢুকলাম। আরেকটু আগে থেকে জেলেদের কথা শুনতে পাচ্ছি। এখন দেখতে পাচ্ছি। ছোট ছোট ডিঙ্গি নৌকা একটার সাথে আরেকটা লাগানো। ডান পাশের জঙ্গলে মাছের স্তুপ। মহা উচ্ছাসের সঙ্গে তারা মাছ বাছাই ও ধোয়ার কাজ করছে। দেখে মনে হচ্ছে না যে সারা রাত এরা ঘুমায়নি, সারাদিন খায়নি। আমাদের নৌকাও কিছুক্ষণের মধ্যে পৌঁছে যাবে সেখানে।

গত রাতে দুবলার চর থেকে মংলার উদ্দেশ্যে ট্রলার ছেড়েছিলাম। কিন্তু ভোর রাতে পরিকল্পনা বদলে যায়। ভেবছিলাম দিনের জোয়ারে উঠবো। এখন সেই সিদ্ধান্তও বদলে ফেললাম। জেলেদের সাথে আরও এক দুই দিন থাকতে চাই।

সরদারকে বললাম, দুই দিনের খাবার কি আছে ট্রলারে? সরদার বললেন, চাল-ডাল আছে। তেল মসলা একটু শর্ট পড়তে পারে, তবে চালায়ে নিতে পারবো। বললাম, তাহলে আর দুই দিন থেকে যাই? সরদার বললেন, কোনো সমস্যা নাই। ও কুনো বিপার না ভাই। চালায়ে নিবানে!

(নভেম্বর ২০১৬ | সুন্দরবন)

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top