রূপান্তরের গল্প ২৯৬ | Rupantorer Golpo 296

গহীন বনে হারিয়ে গেলো সরদার | রূপান্তরের গল্প ২৯৬

গহীন বনে হারিয়ে গেলো সরদার | রূপান্তরের গল্প ২৯৬ | Rupantorer Golpo 296 | দস্যুমুক্ত সুন্দরবন | সুন্দরবনের গল্প | জীবনে ফেরার গল্প | Jibone Ferar Golpo | Sundarbaner Goppo | Story of Sundarbans | মোহসীন উল হাকিম | Mohsin Ul Hakim


রূপান্তরের গল্প ২৯৬ : বেলায়েত সরদারকে দেখছি না। গেলো কোথায়? নৌকায় তাকিয়ে দেখি সেখানেও নাই। ডাক দিলাম, কুঁই দিলাম। কোনো পাল্টা সংকেত পাচ্ছি না। একটু ভয় পেলাম। কোনো অঘটন ঘটলো না তো?

একজন চারপাশ ঘুরে আসলো। না! আশেপাশে কোথাও নাই। নৌকা থেকে একজন বললো, খালের পাশ দিয়ে একজন ওপরের দিকে গেছে। ওদিকে গিয়ে দেখি কাদার উপর পায়ের ছাপ। মানে এদিক দিয়ে হেঁটেছেন সরদার। কই গেলো? মনে হয় বাউলা ফল আনতে গেছে।

ভাবছি একটা নৌকা নিয়ে এগুবো। কিন্তু খাল দিয়ে নৌকা চালানোর মতো পানি হয়নি এখনও। জোয়ার আরেকটু হলে যেতে পারতাম। ভাবছি কাউকে পায়ের ছাপ ধরে যেতে বলি। কিন্তু এই ব্যস্ততার মধ্যে পাঠালে কাজের ক্ষতি হবে।

ভেতরে ভেতরে আমি ছটফট করছি। বেলায়েত সরদারকে বকাঝকা করছি। কই গেলো? কেন গেলো? যাওয়ার সময় বলে গেলে তো টেনশনে পড়া লাগে না।

আমাকে দুশ্চিন্তা করতে দেখে এক প্রবীন জেলে বললেন, হয়তো টয়লেট করতে গেছে। টেনশনের কিছু নাই কাকা। সে তো জঙ্গলের মানুষ। সমস্যা হবে না। আমি বললাম, সুন্দরবনে বাঘের মুখে যারা গেছে তারা সবাই তো জঙ্গলের মানুষ! উনি বললেন, কারও কপালে মৃত্যু লেখা থাকে তাহলে কিছু করার নাই।

আধা ঘন্টা কাটলো। কোনো খবর নাই। এরপর এক ঘন্টা হয় হয়। সরদারের ফিরে আসার খবর নাই। দুশ্চিন্তা এখন উৎকণ্ঠায় রূপ নিলো। জেলেরা তবুও নিশ্চিন্তে। বলে, আপনি ভাই বসেন নৌকায় গিয়ে। ও দেখবেন ঠিক চলে আসবে। বেলায়েত সরদার জঙ্গল খুব ভালো বুঝে!

দুশ্চিন্তা আমার কাটছে না। নানা শংকা মাথায় ঘুরছে। কতো বিপদ হতে পারে এই বাদায়। জেলেরা জঙ্গলকে বাদাবন বলে। অনেকে বলে- বাদা। লোকমুখে শুনেছি বাধায় ভরপুর বলে এই বনকে বাদা বলে ডাকে তারা।

সুন্দরবনের এদিকে বাঘ আছে কোনো সন্দেহ নাই। তার আলামত আমরা সকালে পেয়েছি। চরপাটার অন্য জেলেরা বাঘের টাটকা পায়ের ছাপ দেখেছে আরেকটু সামনে। কিছুক্ষণ আগে খালপাটার জেলেরা আসলো। ওরাও বললো, মামার আনাগোণা আছে কাছাকাছি।

ভাবছি, লোকটা একা একা কেন গেলো? কিছুতেই মাথায় আসছে না। আরেক কাপ চা নিয়ে আসলো এক জেলে। কাপ হাতে দেওয়ার সময় সে বললো, ওই যে আপনার সরদার? বললাম কই? কিছুই তো দেখছি না। ছেলেটি বললো, কথার আওয়াজ পাচ্ছেন না?

ওদিক থেকে লোকজনের কথা বলার শব্দ পাচ্ছে তারা। ভালো করে খেয়াল করলাম, কান খাড়া করলাম, তবুও কিছুই শুনতে পাচ্ছি না। আমি না পেলেও ওরা শুনছে। আসলে তাদের শ্রবণ শক্তি প্রখর, প্রতিটি ইন্দ্রীয় বেশ শক্তিশালী।

কিছুক্ষণের মধ্যে আমার কানেও শব্দ এলো। মনে হলো ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়লো। হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। ভাবছি, সরদার তো গেছে একা। ভেতরে কয়েক জন কথাবার্তার শব্দ আসছে কেন? বিষয়টা কী?

দেখতে দেখতে বেরিয়ে আসলো ওরা। খালের পাশ ধরেই ফিরলেন সরদার। সাথে আরও দুইজন কাঁকড়া শিকারী। হাতের গামছায় কিছু বাঁধা। গিট খুললো, দেখি অনেকগুলো কেওড়া ফল। বললাম, এখনও কেওড়া আছে বনে? সরদার বললেন, মৌসুমের শেষ কেওড়া। একদম পাকা। আজ কেওড়ার খাটা বানায়ে খাওয়াবোনে!

কেওড়ার খাটা খাবো ভাই। কিন্তু বাউলা ফলের কী হবে? সরদার বললেন, বাউলা সব আউলা বান্দরেরা খেয়ে ফেলছে ভাই। গাছ আছে, ফল নাই। সব ওই বান্দরেরা খেয়ে ফেলছে! বললাম, বানরগুলোর সাথে দেখা হয়েছে? সাথের দুইজনকে দেখিয়ে বললেন, এরাই সেই আউলা বান্দর ভাই! বলেই সেই হাসিটা দিলেন!

কাঁকড়ার জেলেরা বললো, মাঝে বাজার ফুরায়ে গেলো ভাই। দুই দিন খাবার ছিলো না। কোম্পানির ট্রলারও আসেনি। তাই এইটা খেয়েই ছিলাম। ওরা বললো, পাশের খালে গেলে মেলা বাউলা ফল পাবেন। বললাম, তাহলে নৌকায় ওঠেন। চলেন, পেড়ে নিয়ে আসি।

কতোক্ষণের পথ? ওরা বললো, ঘন্টা খানেক সময় লাগবে। সরদারের দিকে তাকালাম। উনি বললেন, আর বলা লাগবে না ভাই, চলেন!

জোয়ার হয়েছে চার ঘন্টা হলো। খালের পানি এখন অনেক বেড়েছে। নৌকা ভাসলো। স্রোতের বিপরীতে রওনা হলাম। মিনিট পনেরো সামনে গেলে ওই দোঢালা পড়বে। বামে গেলে বড় খাল- কেওড়াশুঁটি। ওখান থেকে ডানদিকে গেলে কাগা খালের ভাড়ানী। কাঁকড়া শিকারীরা বললো, ওই ভাড়ানী ফুঁড়ে কয়েক বাঁক গেলে ডানে বামে অনেকগুলো জোলা খাল। যেকোনো খালে ঢুকলেই পাওয়া যাবে ওল বাউলা।

নৌকা চলছে ছন্দে ছন্দে। দুপুর বেলা, একটু গরম পড়েছে। বৈঠার ছন্দের সাথে গল্পও চলছে ছন্দে ছন্দে। সরদারের কাছে জানতে চাইলাম, এই আউলা বান্দরদের মানে কাঁকড়া শিকারীদের কই পেলেন? উনি বললেন, এই সুন্দরবনের ভেতর যতো গভীরে যাবেন, আর কাউকে পান না পান এই কাঁকড়ার জেলেদের পাবেন। এরা জ্বীন-ভুতের মতো জঙ্গলে হেঁটে বেড়ায়!

জানতে চাইলাম, আপনাদের নৌকা কোথায়? বললো, মালে তুলে রাখছি ভাই। নৌকা তো লাগে না আমাদের। কাঁকড়া ধরি চারো দিয়ে। চারো হলো বাঁশের খাঁচা দিয়ে তৈরি এক রকমের ফাঁদ। অনেকটা বাঁশের তৈরি চাঁই এর মতো। বললাম, সুন্দরবনে তো এটা দিয়ে কাঁকড়া শিকার নিষেধ! বললো, নিষেধ তো ভাই সব কিছুই। কিন্তু এই জঙ্গলে চলে না কী? পয়সা দিলে সব চলে।

সামনে বসে বৈঠা বাইছেন যিনি তিনি একটু প্রবীন। বললেন, ফরেস্টারদের মধ্যে কিছু মানুষ আছে ভালো। আর কিছু আছে যাদের টাকা দিলে পুরো জঙ্গলটাই বেচে দিবে। সুন্দরবনের নিচের দিকে এমন অনেক লোক আছে। তা না হলে আমরা এদিকে আসি কী করে? নৌকা প্রতি গোনে তিন হাজার করে টাকা দেই।

কাঁকড়া পাইছেন? ওরা বললো, কাঁকড়ার কারখানা এদিকে ভাই। জঙ্গলের মধ্যে হেঁটেও কাঁকড়া ধরা যায়।

কতোগুলো কাঁকড়া ধরলেন? কোথায় সেগুলো? বললো, ওই মালের ভেতরে বাইন্ধে রাখছি। প্লাস্টিকের ঝুরি আছে। তার ভেতর রাখা। আপনার ট্রলারে দিয়ে দিবোনে। বললাম, কাঁকড়া দেওয়া লাগবে না। এমনি একটু দেখতে যাবো।

ওরা বললো, তাহলে আগে আমাদের একটা গোপন আস্তানায় চলেন ভাই। বললাম, সে আবার কী? যা জানলাম তা হলো, সামনে খালের পাশে তাদের একটা থাকার জায়গা আছে। সেখানে আরও লোকজন আছে। বললাম, যাবো, কিন্তু আগে বাউলা ফল পেড়ে আনি। তা না হলে সরদার আবার হারিয়ে যেতে পারে।

নৌকা চলছে। গল্প চলছে একই তালে। দেখতে দেখতে চলে আসলাম দোঢালায়। তারপর ডানের ভাড়ানীতে ঢুকলাম। কিছু দূর এগিয়ে ঢুকলাম আরেকটি সরু খালে। একটু এগুতেই নৌকার তলা ঠেকে গেলো। এখানে বসেই সামনে বাউলা ফল ঝুলতে দেখছি।

জঙ্গলে নামলাম না। পাড় থেকেই কয়েকটি ফল পাড়লাম নিজের হাতে। তবে বেলায়েত সরদার নেমে গেলেন জঙ্গলে। কয়েক মিনিটের মধ্যে গামছা ভরে বাউলা ফল পেড়ে আনলেন। নৌকা ঘুরিয়ে রওনা দিলাম।

ফেরার পথে কয়েকটি ছোট খালের ভেতর ঢুকলাম। সুন্দরবন এখানে আরও গভীর, আরও বন্য। সরদার বললেন, আজ রাতের খাবারটা তাহলে অন্যরকম হবে ভাই!

এক জেলে বললো, বাউলা ফলের মেলা গুন। রান্না করেও খাওয়া যায়। কাঁচাও খাওয়া যায়। এই একটা ফল আছে যেটা খেলে ক্ষুধা মিটে, পিপাসাও মিটে। বললাম, জঙ্গলের চোর ডাকাতদের কাছে এই ফলের চাহিদা অনেক। বিশেষ করে যখন তাদের মধ্যে বন্দুকযুদ্ধ হয়, বা তাড়া খায় তখন এই ফল সবচেয়ে বেশি কাজে লাগে।

বেলায়েত সরদার বললেন, ছোট বেলায় তাদের এলাকার অনেককেই সুন্দরবনের গাছ চুরি করতে দেখেছেন, শিকার করতে দেখেছেন। তারা জঙ্গলে ঠিকঠাক ভাত খেতো না। শুকনা চিড়া আর পানি নিয়ে বনে ঢুকতো। চিড়া পানি ফুরিয়ে গেলে এই বাউলা ফল খেয়ে টিকে থাকতো তারা।

আপনি কখনও বিপদে পড়ে এসব খাননি? সরদার বললেন, জঙ্গল করবো আর বিপদ হবে না? তবে লম্বা সময় না খেয়ে কাটাইনি কখনও! আমার তো নানা কায়দা জানা আছে! সুন্দরবনে এসেই তো নগদ টাকার বাজার করা শিখছি। খাবারের জন্য মাঝে মাঝে নানা কৌশলও করছি। সে অনেক গল্প ভাই! এসময় আমারও একটি গল্প মনে পড়লো।

(সুন্দরবন, নভেম্বর ২০১৬)

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top