বাউলা খায় আউলা বান্দরে | রূপান্তরের গল্প ২৯৭ | Rupantorer Golpo 297 | দস্যুমুক্ত সুন্দরবন | সুন্দরবনের গল্প | জীবনে ফেরার গল্প | Jibone Ferar Golpo | Sundarbaner Goppo | Story of Sundarbans | মোহসীন উল হাকিম | Mohsin Ul Hakim
রূপান্তরের গল্প ২৯৭ : শুধু বাউলা ফল খেয়ে তিন দিন কেটেছে বনদস্যুদের। কয়রার ইলিয়াস তখনও দস্যুনেতা হয়ে ওঠেনি। রাজু বাহিনীর সাধারণ সদস্য। এই বাহিনী তখন শতাধিক বনদস্যু নিয়ে বিরাট দস্যুদল। ২০১২ সালে এদের বিরুদ্ধে একটা বড় অভিযান হয়েছিলো। দস্যু দমনে বিশেষ টাস্কফোর্সের অভিযান।
শিবসা নদীর পূর্ব দিকে নিশানখালীর ভেতরে রাজু বাহিনীর আস্তানা। তখন সুন্দরবনের গাছ কেটে স্থায়ী ঘর তুলতো দস্যুরা। ওই আস্তানায় জঙ্গল পরিস্কার করে চলার পথ তৈরি হয়েছিলো।
সুন্দরী গাছের ওপর মাচা, তার উপর বেশ কয়েকটি ঘর। এক ঘর থেকে আরেক ঘরে যাওয়ার জন্য ছিলো সাঁকো। মোটামুটি এলাহী কারবার। বনদস্যুরা বিশ্রাম নিতো সেখানে। ছিলো চুল কাটানোর ব্যবস্থা, মুদির দোকান।
সে বছরের রাস মেলার পর পর রাজু বাহিনী বিশ্রামে ছিলো। গোয়েন্দা তথ্য নিয়ে সেখানে অভিযান চালায় আইন শৃঙ্খলা বাহিনী। বেলমারী খালের তিন পাশ ঘেরাও দেয় তারা। অন্য পাশে খাল নাই, গভীর বন। অভিযান শুরু হতেই সেদিক দিয়ে পালিয়ে যায় দস্যুরা।
ইলিয়াস সহ কয়েকজন পালায় অন্য পথে। তারপর বনের ভেতরে তিন দিন হেঁটে বেড়ায়। এই তিন দিন বেঁচে থাকার জন্য, তৃষ্ণা মেটানোর জন্য শুধু মাত্র বাউলা ফল ছিলো ভরসা। সুন্দরবনে এই ফলকে কেউ কেউ ওল বাউলাও বলে।
বাউলা ফল আমি আগেও খেয়েছি। লতানো গাছে আলুর মতো দেখতে। ঝুলে থাকে গড়ান, সুন্দরী অথবা গেওয়া গাছের ডালে ডালে। খুব বেশি পাওয়া যায় না। কারণ বানরেরাও নাকী এই ফল খায়। এছাড়া বনজীবীরাও সামনে পেলে পেড়ে ফেলে।
সত্যি বলতে সুন্দরবনে খাওয়ার মতো ফল বেশি নাই। গোল ফল খাওয়া যায়। জেলেরা কখনও কখনও হেঁতালের মাথিন খায়। এছাড়া কেওড়া ফল আছে। তবে এটি পেট ভরানোর ফল না, তীব্র টক হয়। এর বাইরে আছে একমাত্র বাউলা ফল।
রান্না করে খেলে কাঁচা পেঁপে বা আলুর মতো লাগে। কাঁচাও খাওয়া যায়। জেলেরা বনের ভেতরে হারিয়ে গেলে, খাবারের সংকট হলে, পানির সংকট হলে এই ফল খেয়ে বেঁচে থাকে। বনদস্যুদের কাছেও শুনেছি এই ফলের গুনের কথা।
বাউলা ফল পেড়ে আমরা ফিরছি জেলে বহরের দিকে। সরু খাল ধরে ঘুরতে ঘুরতে নানা রকমের গল্প শুনছি, হচ্ছে নিত্য নতুন অভিজ্ঞতা। নৌকায় বসে বেলায়েত সরদার এবার তাঁর গল্পের ঝুরি খুললেন।
সরদার বলছেন, শোনেন ভাই, এই বাদায় অনেক অকাজ করছি। পেটের টানে করছি, আর যা করছি সব ছোট বেলাতেই। বড় হয়ে যখন বুঝতে শুরু করলাম, তখন ভালো হয়ে গেলাম। বললাম, একদম ভালো হয়ে গেছেন?
সরদার বললেন, একদম ভালো ছিলাম না। আপনি আসার পর একদম ভালো হয়ে গেছি। এখন সুন্দরবনের নিয়ম কানুনও মেনে চলি। বেলায়েত সরদারের হাসিমুখ, মজার মজার কথা শুনলে বুঝা যায় না কতো কঠিন শৈশব কেটেছে তার!
সরদার বলছেন, আমি তখন স্কুলে যাই। বাবা দ্বিতীয় বিয়ে করলো। সেদিন ঘরে এক ছটাক চাল ছিলো না। চাল কেনার টাকাও ছিলো না। ওই দিন থেকে মা, ভাই আর বোনদের পেট চালানোর ভার পরে আমার কাঁধে। বড় ছেলে আমি। বয়স তখন ১১ কী ১২ বছর! সেই কাহিনী আরেকদিন বলবো। আজকে একটু অন্য গল্প করি!
আমরা শুনছি। সরদার বলছেন, একবার গাছ চোরদের সাথে আসলাম পূর্ব সুন্দরবনে। আসার সময় গামছায় করে কয়টা শুকনো চিড়া বেঁধে আনতাম। এক বা দুই দিন থেকে আবার বাড়ি ফিরতাম। একবার ফরেস্টের তাড়া খেলাম। ছড়িয়ে ছিটিয়ে গেলাম। কাউকে ধরতে পারেনি। নৌকাটা নিয়ে গেলো ফরেস্টাররা।
আমরা দুইজন, আমি আর গনেশ। সারাদিন হাঁটি, রাত কাটাই গাছের ডালে। এরপর চিড়া শেষ হলো। একদিন সারাদিন বাউলা আর হেঁতালের মাথিন খেয়ে কাটালাম। তারপর আবার রাতের বেলা গাছে চড়ে বসলাম। এসময় শুনি খাল দিয়ে কারা যাচ্ছে। দুজন মিলে ফিসফিস করে যুক্তিবুদ্ধি করলাম। তারপর গম্ভীর গলায় জঙ্গলের ভেতর থেকে হাঁক দিলাম, এই কারা তোরা?
খাল থেকে পাল্টা উত্তর আসলো, আমরা ওমুক। বড়শির জেলে। আরও চড়া গলায় বললাম, ওখানেই থাম! ১২ জনের ভাত রান্না কর! জেলেরা বললো, জ্বি স্যার। এদিক থেকে গনেশ বললো, কোনো রকম নড়াচড়া করবি না। এদিকে তাকাবি না একদম! কেউ নৌকা থেকে নামবি না। চুপচাপ ভাত রান্না কর!
সরদারের কাছে জানতে চাইলাম, মানুষ দুইজন! ১২ জনের ভাত রান্না করতে বললেন কেন? সরদার বললেন, ওরা বহর নিয়ে যাচ্ছে। তিন-চারটা নৌকা। না হলেও ৮-১০ জন ওরা। এখন যদি বলি দুইজনের খাবার দাও তখন ওরা ভয় পাবে না। উল্টা গালি দিয়ে চলে যাবে, মারতেও পারে। কিন্তু ১২ জন বলাতে ওরা ভাবছে আমরা ডাকাত দল।
ডাকাত শুনলে জেলেদের বুকে পানি থাকে না। বিশেষ করে রাতের বেলা ভয়টা আরও বাড়ে। কেউ জোর গলায় ডাক দিলে বা টর্চ ধরলেই জেলেদের হাত পায়ের শক্তি হারিয়ে যায়। ভয় পেয়ে যায়। সেই রাতে ভয় দেখায়ে ভাত রান্না করালাম। কয়েক দিন ভাত খাইনি। গরম ভাত না খেলে গায়ে শক্তি বল পাচ্ছিলাম না।
সরদার বলছেন, রান্না শেষে জেলেরা আওয়াজ দিলো, কী করবো স্যার? বললাম, খালের পাড়ে হাঁড়ি রেখে চলে যা। কাল এখান থেকে পাতিল নিয়ে যাবি! পেছনে তাকাবি না। সোজা বের হয়ে যা!
তারপর কী করলেন? এতোগুলো ভাত দুইজন মিলে খেলেন? বললেন, না ভাই। ওরা ভাতের সাথে তরকারিও দিলো। লবণের প্যাকেট আর পানির একটা জ্যারিকেন রেখে গেছিলো। আমরা দুই ভাই পেট ভরে খেলাম। তারপর গাছে উঠে গামছা দিয়ে শক্ত করে নিজেদের বেঁধে দিলাম ঘুম। ভোরবেলা উঠে দেখি ভাতের হাঁড়ি উল্টানো। নেমে দেখি বন্যশুকরের পায়ের ছাপ।
জঙ্গলে আরও কতো কাহিনী ঘটে ভাই! শুনলে হাসিও লাগে। কষ্টও লাগে। এক জেলে বললো, এক দুই দিন না খেয়ে থাকার অভিজ্ঞতা আমাদের সবারই আছে। একবার বাঘের তাড়া খেয়ে পানিতে পড়লাম। ওই হরমল খালের ভেতর। ওখানে তো কুমির আর কুমির।
কোনো রকমে খাল পাড়ি দিয়ে আরেক পারে উঠলাম। ওই পাড়ে গিয়ে দেখি আরেকটা কুমির ডাঙ্গায় বসা। মনে হয় ডিম দিছে। সেও দিলো ধাওয়া। আমরা দৌড়ে বনের ভেতর ঢুকে পড়লাম। থামলাম আরেক খালের গোঁড়ায় গিয়ে।
তখন মরা গোন। জঙ্গলে নৌকা খুঁজে পাচ্ছিলাম না। ওই দিন, তার পরের দিন এক ভাবে ছিলাম। সাথে কিছু ছিলো না যে খাবো। পাতায় কুয়াশা জমে থাকে। সেই দিয়ে পিপাসা মিটানোর চেষ্টা করি। সাথে দা ছিলো না। তাই গোলফল অথবা হেঁতালের মাথিনও কাটতে পারিনি।
দুই দিনের মাথায় একটা কাঁকড়ার নৌকা পেলাম। তারা ভাত খাওয়ালো। তারপর নৌকায় করে হরমলে এসে নিজেদের নৌকায় উঠলাম।
সুন্দরবন এক বিচিত্র জায়গা। বিপদগুলোও বিচিত্র। দূর থেকে বনটাকে যতো সুন্দর মনে হয়, কাছে আসলে এর রূপ ততোটাই ভয়ঙ্কর। এমনিতে দেখতে বেশ স্নিগ্ধ, কিন্তু পা রাখলে টের পাই কতোটা রুক্ষ এই বাদা বন। নৌকা বেয়ে ছোট্ট খাল ধরে যাচ্ছি আর ভাবছি, এই রহস্যময় সুন্দরবনের অজানাগুলোকে আমার জানতে হবে, জানাতে হবে।
জেলেদের বহরের কাছে চলে এসেছি প্রায়। জোয়ার প্রায় শেষ। খালের পানি বেড়ে এখন জঙ্গলের সমান সমান। রুছো মাছ ছুটোছুটি করছে। পানিতে মেনি মাছ লাফঝাঁপ দিচ্ছে। ভেসে বেড়াচ্ছে কাকিলার মাছ। খাল ভর্তি পারশে মাছে পোণা। কিছুক্ষণ আগে যে খালটিকে একটি মৃত নালা মনে হচ্ছিলো, সেটি এখন যেন জীবন ফিরে পেলো। এসব দেখতে দেখতে নৌকা গিয়ে ঠেকলো বহরের সাথে।
কাজ গুছিয়ে জেলেরা শেষ এক কাপ চা খাচ্ছে। আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে। এরই মধ্যে নৌকায় নৌকায় চুলা জ্বলেছে। চলছে রান্না। এই বেলায় গোসল সেরে তারা খেয়ে নিবে। তারপর কোম্পানির নৌকা আসবে। মাছগুলো মেপে দিয়ে আবার ছুটবে খালে খালে।
জেলেদের বললাম, আজ রাতেও আপনাদের সাথে থাকবো। ভোরবেলা খালপাটা জালে মাছ ধরা দেখবো। নিবেন সাথে? খালপাটার এক জেলে বললো, নিবো না মানে? রাতে তাহলে আমাদের নৌকায় থাকবেন। বললাম, ট্রলার নিয়ে একসাথে থাকা যাবে না? ওরা বললো, খাল ধরবো জঙ্গলের অনেক ভিতরে।
নামতে নামতে বেলায়েত সরদার বললেন, রাতে বাউলা ফল আর জঙ্গলী শাকের দুইটা পদ রান্না করবো। খেয়ে তারপর নৌকায় যাবেন। বললাম, এই ফল খুঁজতে গিয়ে মেলা কষ্ট হলো আজ! বললেন, আউলা বান্দরেরা সব খেয়ে ফেলে। পারলে পুরো বনটাই খেয়ে ফেলে। বাউলা পাবেন কই?
কথা শুনে বহরের সবাই হেসে উঠলো। একজন বললো, তাদের কোম্পানি মানে মহাজন আমার আসার খবর পেয়েছেন। উনি বেশ ক্ষেপেছেন। জেলেদের বলেছেন, আমাকে বিদায় করে দিতে!
(ছবি: সুন্দরবনের বাউলা ফল। নভেম্বর ২০১৬, সুন্দরবন)