ওই সাংবাদিককে তাড়াও! | রূপান্তরের গল্প ২৯৮ | Rupantorer Golpo 298 | দস্যুমুক্ত সুন্দরবন | সুন্দরবনের গল্প | জীবনে ফেরার গল্প | Jibone Ferar Golpo | Sundarbaner Goppo | Story of Sundarbans | মোহসীন উল হাকিম | Mohsin Ul Hakim
রূপান্তরের গল্প ২৯৮ : হয় ওই সাংবাদিককে তাড়াও না হলে নিজেরা সরে যাও। ডাঙ্গা থেকে কোম্পানি ফোন দিয়ে একথা বলেছেন তাঁর মুহুরিকে। মুহুরি ফোন করেছে এই জেলে বহরের প্রধানকে। বলেছে, যে করেই হোক, মাছ টানার ট্রলার আসার আগে যেন আমাদের সরিয়ে দেওয়া হয়।
বিষয়টি নিয়ে লজ্জা পাচ্ছে জেলেরা, আমিও একটু বিব্রত। বললাম, আপনাদের সমস্যা হলে আমরা চলে যাই? ওরা একসাথে বললো, কী বলেন ভাই? আপনি থাকেন। আমরা মাছ ধরি। ওরা যা ইচ্ছা তাই রেট দেয়। যা বলে শুনি। তাই বলে এই জঙ্গলে এসেও ওদের কথা মতো চলতে হবে? বেশ মজার বিষয়।
ভাবছি, বিষয়টা দেখার জন্য হলেও আমাকে থাকতে হবে। অভয়াশ্রমে তাদের অপকর্ম দেখে ফেলছি, বিষয়টি তাদের জন্য বেশ দুশ্চিন্তার। বনের মাছ ভিত্তিক সিন্ডিকেট এসব লুকিয়ে রাখে। তাই আমার উপস্থিতি নিয়ে তাঁরা বেশ হম্বিতম্বি করছেন। এদিকে ফোনের নেটওয়ার্ক কম। তবুও কেমন করে তাদের কাছে খবর গেলো বুঝতে পারছি না।
গলদা চিংড়ি হলো এক ড্রাম। চাকা আর হরিনা মিলে হয়েছে তিন ড্রাম। আধা ড্রাম টাইগার চিংড়ি আর আধা ড্রাম হয়েছে বাগদাসহ কয়েক জাতের চিংড়ি। সব মিলিয়ে শুধু চিংড়িই হয়েছে প্রায় দশ মণ।
বড়সড় ভেটকী মাছ হয়েছে ২১টি, ছয়টি ইলশে তাইড়েল আর ভাঙ্গন হয়েছে কয়েকটি। দাতিনা মাছ হয়েছে দেড় ড্রাম, আড়্রাই ড্রাম পায়রা বা চিত্রা মাছ। এই মাছগুলো বেশ বড় বড়। এছাড়া পারশে আর বারো মিশালী মাছ হয়েছে দুই ড্রাম। গত রাতের চরপাটা জালের এই হলো মাছের হিসাব।
পরে যে খালপাটার জেলেরা আসলো তাদের মাছ এখনও বাছা শেষ হয়নি। ওরা চিংড়ির চেয়ে বেশি পেয়েছে পারশে মাছ। ভেটকী মাছ পড়েছে সবচেয়ে বেশি। সব মিলিয়ে ৭০-৮০টি ভেটকী ধরা পড়েছে তিনটি খালে। এর মধ্যে ১০ কেজির বড় সাইজের মাছ আছে কয়েকটি। একটা বিশাল কই কোরাল আছে, প্রায় মণ খানেক ওজনের। বাউশ মাছ আছে এক ঝুরি। সব মিলিয়ে চার থেকে পাঁচ মণ মাছ তো হবেই।
খালপাটা জাল সুন্দরবনে নিষেধ। চরপাটার অনুমতি থাকলেও ফাঁসের মাপ নির্ধারণ করা। জাল ফেলতে হবে অনুমোদিত এলাকায়। সুন্দরবনে পশুর নদীর পশ্চিমে প্রায় পুরোটাই অভয়াশ্রম।
পূর্ব দিকে দুবলার চর বন বিভাগের অন্তর্গত সুন্দরবনের খাল নদীতে অনুমতি আছে। কিন্তু সমস্যা একটাই। ওদিকের সবগুলো নদী, খাল ও চর বড় সাহেবদের দখলে। ওদের এলাকায় পা রাখারও সাহস পায় না সাধারণ জেলেরা।
জেলেদের কাছে শুনলাম, সাহেবের জেলেরা আসেনি বলে একটি চর এক গোন ফাঁকা ছিলো। সুযোগ বুঝে, সাহস করে জেলেদের একটি দল সেখানে জাল ফেলতে যায়। মহাজনের লোকজন এসে তাদের পিটিয়ে তাড়িয়ে দেয়, কেড়ে নেয় জাল। এনিয়ে অনেক জায়গায় অভিযোগ করেও সমাধান পায়নি সেই জেলেরা।
বন বিভাগ বলে, সাহেবদের চরে তোমরা জাল ফেললে কেন? এই অঞ্চল পুরোটা তাদের তা জানো না? উল্টো মামলা দেওয়ার ভয় দেখানো হয় তাদের। তারপর বলা হয় বড় সাহেবের কাছে গিয়ে মাফ চাও।
ওই জেলেরা বলেছিলো যে তারাও অনুমতি নিয়ে এসেছে। সরকারকে কর-খাজনা দিয়েছে। পাস পার্মিট নিতে যে উপরি দেওয়া লাগে তাও দিয়েছে। জবাবে অফিসের বড় সাহেব তাদের বলেছিলেন, তোমাদের জাল বসায়ে দেওয়া আমাদের কাজ না। যেখানে পারো যাও, এখানে জাল দিতে পারবে না।
এসব কারণেই সাধারণ জেলেরা পশ্চিম সুন্দরবনে আসে। অভয়াশ্রম জেনেও আসে। এছাড়া পশ্চিমে মাছ বেশি হয়। ধরা পড়ার ঝুঁকি থাকে, তারপরও ম্যানেজ করে তারা পশ্চিমেই যায়।
আরেক শ্রেণির জেলে আছে যারা অনেক বছর ধরে অভয়াশ্রমে মাছ ধরে অভ্যস্ত। প্রশাসনের সাথে তাদের লাইন ঘাট করা থাকে। কোম্পানি বা মহাজনেরা ওই বিষয়টা ম্যানেজ করে।
আপস-রফার মধ্য দিয়ে অভয়াশ্রমে মাছ-কাঁকড়া শিকার চলে। একারণে বন বিভাগ কিংবা মহাজনেরা বিষয়টি ঢেকে রাখতে চায়। সাংবাদিকদের কাছ থেকে তারা এই অপকর্ম ঢেকে রেখেছে এতো বছর।
সাধারণত সাংবাদিকরা এতো ভেতরের খবর পান না। পথ-ঘাট চিনেন না। সাংবাদিকদের এতো সময়ও নাই। আবার কেউ আসতে চাইলেও ভেতরে প্রবেশের সুযোগ থাকে না। এতো কষ্ট করে বনের ভেতরে এসে সাংবাদিকতার অভ্যাসও গড়ে ওঠেনি।
বড় কোনো ঘটনা ঘটলে উপকূলের সাংবাদিকরা কিছু কিছু খবর পান। দস্যুতা বা অপরাধ নিয়ে কাজ করতে গিয়ে তাদের অন্যের দেওয়া তথ্যের ওপর ভরসা করতে হয়। সোর্সরা তাদের অভায়শ্রমে মাছ শিকারের তথ্য দেয় না, বিষ দিয়ে মাছ শিকারের তথ্য আসে না বললেই চলে। সুন্দরবনের এতো বড় একটা ক্ষতি হয়ে যাচ্ছে, তাঁরা কল্পনাও করতে পারেন না।
ধরা না পড়লে হরিণ শিকারের তথ্য দেয় না কেউ। সোর্সরা বনের ভেতরে দস্যুদের তৎপরতার খবর দেয় না, এমন কী ভেতরে যে ঘুষের কারবার চলে সেই বিষয়েও তথ্য-প্রমাণ আসে না তাঁদের কাছে। তবুও কিছু সাংবাদিক চেষ্টা করেন। তাঁদের আবার চাপের ওপর রাখে সহকর্মীদের কেউ কেউ। আমাকে সরাসরি কিছু বলতে পারেন না। তবে আমার সুন্দরবনে যাওয়া আসা নিয়ে বনের ভেতরকার দুষ্টু চক্র বেশ চিন্তিত।
বনদস্যুদের নিয়ে কাজ করতে গিয়ে সুন্দরবনের ভেতরটা দেখার সুযোগ হচ্ছে। এমন অনেক ঘটনার সাক্ষী হয়েছি আমি যা কখনও দেখবো বলে ভাবতেও পারিনি। বনের ভেতরের সেই কাহিনীগুলো এভাবে না ঘুরলে দেখা সম্ভবও না। এভাবে বনের ভেতরে সময় না কাটালে জানাও হবে না অনেক কিছু।
আমি এই সুন্দরবনের সাথে মানুষের যতো রকম সম্পর্ক সবটুকু জানতে চাই। বন আর মানুষের বিরোধের কথা অনেক শুনি, পড়ি। কিন্তু এই দুটির মধ্যে যে নিবিড় সম্পর্কও আছে সেই গল্প সেভাবে খুঁজে পাই না। আমি সেই গল্পের খুব কাছাকাছি পৌঁছে গেছি।
বনের গহীনের খুঁটিনাটি আমার জানতে হবে, জানাতে হবে। এদিকের ব্যবসায়ী আর প্রশাসনের লোকজন সবকিছু ঢেকে রাখতে চায়। ঢেকে রাখার কারণ হিসাবে বলা হয় বন সংরক্ষণের কথা। আমি মানি সে কথা। কিন্তু ভেতরে এসে এসব কী দেখছি?
শুরুর দিকে ভাবতাম, দস্যুতাই সুন্দরবনের একমাত্র সমস্যা। কিন্তু ভেতরে ঢুকে দেখি সমস্যার শেকড় অনেক গভীরে। দায়িত্বশীল কিছু মানুষের বসবাস সেখানে। তারা সমঝোতা করে এই জেলেদের রক্ত চুষে খাচ্ছে। বেশ মজবুত সিন্ডিকেট।
এই সিন্ডিকেট ভাঙ্গা কঠিন। তবে অসম্ভব না। এখানে আমার কাজ শুধু ভেতরের আসল খবর বের করে আনা। আমার কাজ হবে সেই খবর মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়া। সেই কাজটি করতে গিয়ে দেখছি যে এসব অপকর্মের তথ্য যাদের দিচ্ছি, তাদের একটি অংশের মানুষ নিজেরাই ওই সিন্ডিকেটের অংশ।
এদের সাথে যুদ্ধ করতে হলে নিজেকে আরও প্রস্তুত করতে হবে। আমার প্রতি পাঠক আর দর্শকদের বিশ্বস্ততাও তৈরি করতে হবে। তা না হলে ওদের কূটচালে শুরুতেই পরাস্ত হতে হবে। ওরা কাঁচা টাকার মালিক। নিজেদের অবস্থান ধরে রাখতে ওরা অনেক দূর যাবে।
জেনেছি, আমার ওপর আক্রমণ করানোর কয়েক দফা চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে। বিশ্বস্ত জেলেদের মুৃখে শুনেছি, চাঁদাবাজির মতো অপবাদ দিয়ে আমাকে হামলা করানো হবে, মেরে ফেলা হবে, এমন আলোচনাও হয়েছে।
শুধু জেনে রাখছি। কিছু বলছি না। কারণ, এদিকে সময় দিলে আমার মূল কাজটি নষ্ট হবে। দস্যুমুক্ত সুন্দরবনের এই যাত্রা নষ্ট হলে ক্ষতি হবে জেলেদের, লাভ হবে এই বড় সাহেবদের। উনাদের লোকসানের খাতা নাই। আছে শুধু লাভের হিসাব। লোকসানের ভার সব জেলেদের কাঁধে।
(ঘটনা: সুন্দরবন, নভেম্বর ২০১৬)