রূপান্তরের গল্প ৩০০ | Rupantorer Golpo 300

অভয়াশ্রমে কাঁকড়া শিকারীদের তান্ডব | রূপান্তরের গল্প ৩০০

অভয়াশ্রমে কাঁকড়া শিকারীদের তান্ডব | রূপান্তরের গল্প ৩০০ | Rupantorer Golpo 300 | দস্যুমুক্ত সুন্দরবন | সুন্দরবনের গল্প | জীবনে ফেরার গল্প | Jibone Ferar Golpo | Sundarbaner Goppo | Story of Sundarbans | মোহসীন উল হাকিম | Mohsin Ul Hakim


রূপান্তরের গল্প ৩০০ : ঝিরঝির করে বইছে বাতাস। সরু খালের দুই পাশের গড়ান আর গেওয়ার বন। রোদ পড়েছে। বাতাসে দুলছে পাতাগুলো। রোদে চিকচিক করছে সেই পাতাগুলো। সরু খাল বলে রোদ মাটি পর্যন্ত আসছে না। কিন্তু সূর্যের উত্তাপ অনুভব করছি।

চারপাশটা বেশ স্বস্তির ছিলো। কিন্তু ভরা জোয়ারে একটু বেকায়দায় পড়লাম। এখন আর হেঁটে বেড়ানোর উপায় নাই। কারণ বনের উপর জোয়ারের পানি এখন হাঁটু সমান।

জেলেরা সবাই উঠে এসেছে নৌকায়। আমরা উঠেছি আরও আগে। চুলায় চুলায় ভাত হচ্ছে। একটু পর ভাটা শুরু হবে। এই ভাটার মাঝামাঝি সময় জেলেরা জাল নিয়ে রওনা দিবে।

কুকু পাখির ডাকছে। মানে জোয়ার শেষ। ভাটা শুরু হলো। এতোক্ষণে মাছ নিতে আসার কথা কোম্পানির লোকজনদের। মানে কয়েক জন কর্মচারি নিয়ে মুহুরি সাহেব আসবেন। ছোট ট্রলার নিয়ে ঘুরে ঘুরে জেলেদের কাছ থেকে মাছ তুলে নিবে। তার আগে মাপামাপি হবে।

ওজনের হিসাব খাতায় লিখে নিবেন মুহুরি সাহেব। এই ওজন আর মাছের দাম নিয়ে বিরাট কারসাজি চলে। জেলেরা বললো, কোম্পানির বড় ট্রলারটি এসে গেছে। অন্য খালে তাদের মতো জেলেদের আরও বহর আছে। ওদিকের মাছগুলো তুলে আসবে এখানে। তার মানে আমাদের এখান পর্যন্ত আসতে আসতে তাদের আরও ঘন্টা দুই লাগবে।

দুই ঘন্টা পানিতে ভেসে থাকবো? বেলায়েত সরদার বললেন, কাঁকড়ার জেলেদের প্রাসাদটা দেখতে যাবেন না ভাই? মনে পড়লো, ওরাই নিয়ে যেতে চেয়েছিলো। বললাম, চলেন ভাই।

কাঁকড়ার জেলেরা নৌকা আনেনি। তাই জেলেদের যে নৌকা নিয়ে এসেছিলাম সেটি নিয়েই রওনা হলাম। দুই জেলে নৌকা বাইবে। সাথে থাকবো সরদার আর আমি।

এখান থেকে প্রথমে বড় খালে বের হতে হবে। তারপর উজানে গিয়ে ঢুকতে হবে ডান পাশের আরেকটি খালে। এখন জোয়ার হচ্ছে। তাই খুব বেশি হাঁটতে হবে না। জানতে চাইলাম, যেতে আসতে সব মিলিয়ে কতোক্ষণ লাগবে? কাঁকড়ার জেলেরা বললো, খুব বেশি হলে এক ঘন্টা।

পুরো সুন্দরবন এখন জোয়ারের পানিতে নিমগ্ন। ভাটা শুরু হয়েছে। ধীরে ধীরে নামছে পানি। প্রথমে জঙ্গলে উঠে পড়া পানি নামবে। ছোট খালগুলো ধরে সেই পানি নামবে মাঝারি খালে। ভাটার স্রোতে সেই পানি এসে পড়বে বড় খালে। ততোক্ষণে আধা ভাটি। তীব্র স্রোত নামবে বড় নদীতে। নদীর পানি যাবে সাগরে। ততোক্ষণে জঙ্গলের ভেতরটা শুকিয়ে যাবে।

এরপর জঙ্গলের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসবে হরিণের পাল। খালের পাড়ে, বালির চরে দাঁড়িয়ে তারা বিকালের রোদে রোদ পোহাবে। কেওড়া গাছের কচি পাতা আর সবুজ ঘাস দিয়ে চলবে ওদের বিকালের খাবার। জোয়ার আসলে তারা আবার ঢুকে পড়বে বনের ভেতর।

বড় নদীতে উঠে উজান ঠেকলো। মানে এবার চলতে হবে স্রোতের বিপরীতে। নৌকার সামনে-পেছনে দুইজন বৈঠা বাইছে। মাঝখানে বসা আমি আর বেলায়েত সরদার। টুকটাক গল্প চলছে। এর মধ্যে শুরু হলো গান। গলায় খুব ভালো সুর নাই। তবে গাইছে মন দিয়ে।

বড় খালের এখানে আমাদের ট্রলার রাখা ছিলো। পরে পাশের আরেক খালে ঢুকিয়ে রেখেছি যাতে মহাজনের লোকজন এসে না দেখে। সামনেই সেই খাল। বললাম, ভাটায় আটকে না যায়। সরদার বললেন, যাওয়ার সময় ওদের বড় খালে বের হয়ে থাকতে বলবোনে।

নৌকা বেয়ে একটু এগিয়ে ডান পাশের খালে ঢুকলাম। এই খালটি অনেক বেশি ছোট। ভরা জোয়ার বলে পানিতে ভরা। জঙ্গলের ভেতর দিয়ে, গাছের ফাঁক দিয়ে নৌকা চলছে। মিনিট পনেরোর মধ্যে ঠেকে গেলাম। আর এগুনো যাবে না। জেলেরা বললো, বসেন ভাই। একটু সামনে গেলে আরেকটা খাল পাবো। বললাম, সেই পর্যন্ত যাবো কী করে? ওরা বললো, দেখেন ভাই কী করি আমরা!

পেছনের জন নেমে পড়লো পানিতে। একাই নৌকা ঠেলে নিয়ে গেলো। এবারের খালটি আরও বেশি সুন্দর। দুই পাশে হেঁতালের বন। বনের ভেতরে কিছুই দেখা যায় না। জেলেরা এবার একটু জোরেসোরে নৌকা বাইলো। এবার খালটি বেশ চওড়া। এক পাশে হেঁতালের বন। আরেক পাশে কেওড়া বাগান। সেখানেই বেশ খানিকটা জায়গা পরিস্কার করা। স্তুপ করে রাখা কাঁকড়া ধরার চারো। সংখ্যায় না হলেও হাজার খানেক হবে। কয়েকটি নৌকা বাদার ওপর তুলে রাখা। ওদিকে গাছ কেটে জঙ্গল পরিস্কার করে বেড়া দেওয়া। তার ভেতরে রাখ শ’খানেক কাঁকড়া রাখার ঝুড়ি।

এখানকার গাছগুলো বেশ বড় বড়। মাঝে মাঝে বাইন গাছ। তার মাঝ বরাবর ছোট ছোট টঙ ঘর। নিচে এক পাশে চুলা জ্বলছে। কিন্তু একজন মানুষও নাই। জেলেরা বললো, আমাদের আসার শব্দ পেয়ে ওরা পালিয়েছে। ওদের বললাম, ডাক দেন। একটু গল্প করে যাই।

সরদারের যা কাজ! কখন যে চুলার পাশে গিয়ে দাঁড়িয়েছেন খেয়ালই করিনি। আমাকে ডেকে বললেন, যতোই ডাকাডাকি করেন, ওরা আর আসবে না ভাই। কী রান্না হচ্ছে দেখেন! এগিয়ে গিয়ে দেখি মাংসের ঝোল। মানে হরিণের মাংস? পাশে দাঁড়ানো জেলেদের চেহারা ফ্যাকাসে হয়ে গেছে। বললো, ও ভাই, আমরা এসব করি না। বললাম, করেন না? তাহলে মাংস রান্না হচ্ছে কী করে?

ডোয়া ফেলছেন কোথায়? জেলেরা আবারও বলে, আমরা কিছু জানি না ভাই। ছিলাম ওইদিকে। আমরা কাকড়া ধরা হলে এখানে এসে জমা করে যাই। সারাদিন আমরা বাদায় থাকি ভাই।

বললাম, আপনারা সারাদিনই অকাজ করেন। এগুলো বন্ধ করেন। সুন্দরবন তো আপনাদেরই। এখান থেকেই আপনাদের পেটের ভাত জোগাড় হয়। এই যে বন কেটে বসবাস করছেন, অভয়াশ্রমে কাঁকড়া ধরছেন সবই তো অবৈধ। এই যে চারো দিয়ে ধরেন, এটাও তো নিষেধ।

তরকারির হাঁড়ি তুলে নিয়ে খালে ফেললাম। এদের কাছে আরও মাংস আছে কী না খোঁজ নিতে বললাম সরদারকে। উনি বললেন, এদের আকামের কোনো শেষ নাই ভাই। যেদিকে তাকাবেন খালি আকাম আর আকাম।

আমাদের নিয়ে আসা জেলেরা কোনো কথা বলছে না। অনেক উৎসাহ নিয়ে তারা আমাদের নিয়ে এসেছে। কিন্তু শুরুতেই তাতে ভাটা পড়লো। সরদারকে নিয়ে ঢুকলাম বনের ভেতর। হরিণ ধরার ফাঁদ আশেপাশে আছে কী না দেখতে হবে।

কিছু দূর গিয়েও কিছু পেলাম না। সম্ভবত ডোয়া পাতা আছে দূরে কোথাও। ফিরে আসলাম কাঁকড়া শিকারীদের ডেরায়। চারোগুলো যেখানে রাখা সেখানে এসে দাঁড়ালাম। ততোক্ষণে ভেতর থেকে ফিরেছে তিন কাঁকড়া শিকারী।

আমাদের দেখে বেশ ভয় পেয়েছে ওরা। কাঁকড়ার ঝুড়িগুলোর উল্টো পাশে গাছের আড়ালে দাঁড়িয়ে দেখছে আমাদের। ওরা অন্যদিকে ছিলো। আমরা এসেছি সে খবর পায়নি। হুট করে আমাদের দেখে তাদের ভুত দেখার মতো অবস্থা। পালাতে যাবে। এমন সময় বললাম, খবরদার পালাবে না। ওরা থেমে গেলো। বললাম, এদিকে আসো তোমরা।

জানতে চাইলাম, ডোয়া পাতা কোথায়? ওরা বললো কোন এক খালের নাম। জানতে চাইলাম, কতোদূর সেটা? ওরা বললো, এখন বস্তায় করে লুকানো আছে। কেওড়াশুঁটির মুখের দিকে যে কেওড়া বন সেখানে পাতা আছে সেদিকে কোন খালের পাশে। বললাম, ওটা বের করে আনবে আজ। ওরা মাথা নাড়লো। বললো, যেতে মেলা সময় লাগবে। বললাম, দূরের রাস্তা না হলে তো আমি এখনই যেতাম!

ধরা কাঁকড়াগুলো বেশ কায়দা করে রাখা। গাছ কেটে ঘেরাও দেওয়া। তার ভেতর রাখা প্লাস্টিক আর বাঁশের ঝুড়ি। সেগুলোর ভেতর হাজার হাজার কাঁকড়া। সবগুলোর হাত পা বাঁধা। ঝুড়িগুলো কেওড়ার পাতা দিয়ে ঠাসা। অনুমান করছি না হলেও দশ মণ কাঁকড়া আছে এখানে।

ফিরতে হবে। হাতে সময় নাই। তিন জেলেকে একটু ভয় দেখালাম। ওরা ঠিক বুঝতে পারছে না আমরা কারা! ভেবেছে হয়তো বন বিভাগের কেউ হবো। বার বার হাত জোড় করছে, মাফ চাইছে। বললাম, তোমরা সুন্দরবনের সবগুলো অপরাধ একসাথে করছো। নিজেদের ভবিষ্যৎ নিজেরাই ধ্বংস করছো। ওরা বললো, ডোয়ার বস্তা নিয়ে আসবে। ধ্বংস করে ফেলবে আজই।

সবাইকে নিয়ে নৌকায় উঠলাম। ভাটার স্রোতে একটু এগুতেই তলা ঠেকে গেলো খালে। আবারও নেমে ঠেলা-ধাক্কা দিয়ে নৌকা এগিয়ে নিলো জেলেরা।

মিনিট পনেরোর মধ্যে বড় খালে নেমে পড়লাম। সেখান থেকে আমাদের ট্রলার যেখানে রাখা সেই খালে গেলাম। মামুন আর শহীদুল কাকা আছে সেখানে। ওদের বড় খালে এসে ট্রলার নোঙ্গর করতে বললাম।

কেওড়াশুঁটি খালে তখন তীব্র স্রোত। ভাটার টানে কয়েক মিনিটে পৌঁছে গেলাম আগের খালে। ভেতরে ঢুকতেই উল্টো স্রোত। বৈঠা বেয়ে দোঢালা থেকে ডানের খালে ঢুকলাম। একটু দূর থেকে ওখানকার শব্দ আসছে। আরেকটু এগিয়ে দেখি ট্রলার এসে গেছে। কোম্পানির মুহুরি এসেছেন লোকজন নিয়ে। চলছে মাছ মাপামাপি।

ছবি: শিকারীদের অবৈধ বসতি
ঘটনা : ২০১৬, সুন্দরবন

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top