রূপান্তরের গল্প ৩০২ | Rupantorer Golpo 302

সরদারের জঙ্গলি রান্না | রূপান্তরের গল্প ৩০২

সরদারের জঙ্গলি রান্না | রূপান্তরের গল্প ৩০২ | Rupantorer Golpo 302 | দস্যুমুক্ত সুন্দরবন | সুন্দরবনের গল্প | জীবনে ফেরার গল্প | Jibone Ferar Golpo | Sundarbaner Goppo | Story of Sundarbans | মোহসীন উল হাকিম | Mohsin Ul Hakim


রূপান্তরের গল্প ৩০২ : জেলেরা গজগজ করছে। বলছে, ওজনে ঠকাচ্ছে ঠকাক। এরপর আবার দামেও বাড়ি দিবে। এতো তাজা মাছ! তারপরও বলে নরম হয়ে গেছে। একটু পরেই ওরা মাছে বরফ দিবে। তারপর একবারে আড়তে গিয়ে খুলবে। সেই মাছ নরম থাকে কী করে?

আপনারা প্রতিবাদ করেন ভাই। বললাম, কথা না বললে ওরা এভাবেই চলবে। কোনো ভাবে একটু পুঁজি গড়েন। তারপর একা একা মাছ ধরবেন। ভয় পাবেন না। মনে সাহস রাখেন। বনদস্যুরা ঝামেলা করলে আমাকে বলবেন। আগের সেই দিন কিন্তু নাই। ওরা তাকিয়ে রইলো। বলল, জেলেদের জীবনে শান্তি নাই ভাই। যেদিকেই যাই খালি মার খাই।

মুহুরি সাহেব হাঁকডাক করছেন। চলছে শেষ মুহুর্তের কাজ। মাছগুলো সব গুছিয়ে তুলেছে ভরের ট্রলারে। মহাজনের কর্মচারিরা হাত পা ধুয়ে নিলো। ট্রলারে উঠে মাছের ড্রামগুলো সাজিয়ে দিচ্ছে জেলেরা। সব মিলিয়ে চল্লিশ মণ মাছ হবে। এক রাতের জালের মাছ।

ট্রলার ছাড়লো। এখান থেকে কেওড়াশুঁটি হয়ে ওরা যাবে কাগার খালে। বড় ট্রলারে নিয়ে মাছগুলো বরফে দিবে। ওই ট্রলারে আছে চারটি মাছ রাখার কেবিন। সব মিলিয়ে একশ’ মণ মাছ ধরে ।

জানতে চাইলাম, আপনারা কবে ফিরবেন? মুহুরি সাহেব বললেন, আরেক পাটার মাছ নিলে ট্রলার ভরে যাবে। তারপর রওনা দিবে। মাছ বিক্রি করে আবার ফিরে আসবে সুন্দরবনে।

ক্লান্ত সবাই। জেলেরা যে যেখানে পারে বসে পড়লো। চা-বিড়ি খেয়ে ভাসালো নৌকা। বড় করে পান বানিয়ে মুখে পুরলো কেউ কেউ। ভাত না খেলেও চলে। কিন্তু চা, পান আর বিড়ি ছাড়া জেলেদের চলবে না।

আমরা বড় খালে যাবো। নৌকায় নৌকায় রান্না হয়েছে আগেই। অন্যদিন হলে এখানে বসেই খাওয়া দাওয়া সারতো তারা। আজ আমরা আছি বলে ট্রলারে নৌকা ভিড়িয়ে খাবে।

সাথে খালপাটার জেলেরাও আছে। নৌকা বেয়ে সবাই মিলে বেরিয়ে পড়লাম কেওড়াশুঁটি খালে। সামনেই আমাদের ট্রলার নোঙ্গর করা। ট্রলারে গিয়ে বেলায়েত সরদার রান্না শুরু করবেন। জেলেরা খেয়ে যে যার মতো রওনা দিবে। আমরা রাতে এখানেই থাকবো। ভোর বেলা যাবো বালির গাঙ-এ। সেখানে এই ভাটাতে খালপাটা জাল দিবে জেলেরা। সকালের ভাটায় আমরা মাছ ধরা দেখবো।

নৌকা ভিড়িয়ে ট্রলারে উঠলাম। বালতি দিয়ে পানি তুলে গোসল সেরে নিলাম। বিকালের রোদে বসে সারা গায়ে সরিষার তেল মেখে বসে রইলাম। ওদিকে রান্নার প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছে মামুন আর শহীদুল কাকু। এখন হাত লাগাবেন সরদার।

খালপাটার জেলেরা অনেক দূরে যাবে। ভ্ত খেতে খেতে ওরা বললো, পরের জাল ফেলবে বালির গাঙ-এ। আড়পাঙ্গাসিয়া নদীতে মিশেছে ওই খাল। তার আগে ডানে বামে বেশ কয়েকটি ছোট খাল আছে।

বললাম, ওই খালগুলোকে ছোট বলছেন? খালপাটা জাল তো আরও সরু খালে দেয়। জেলেরা বললো, আমরাও সরু খালেই দিবো। বড় খাল থেকে যেকোনো একটা ছোট খালে ঢুকবো। আগার দিকের খালগুলোর মধ্যে তিন-চারটা খালে আমরা জাল দিবো।

আমাদের নিয়ে যাবেন? একজন অন্যজনের দিকে তাকাচ্ছে। ঠিক রাজি না। এর মধ্যে জেলে বহরের প্রধান বললেন, ভাই যেতে চাচ্ছে, আর কোনো কথা নাই। তোমরা নিয়ে যাবা। ওরা মাথা নাড়লো। জিজ্ঞেস করলো, আমাদের কোনো বিপদ হবে না তো ভাই?

অবৈধ জায়গায় অবৈধ জাল দিয়ে মাছ ধরে তারা। তাই ভয় পাচ্ছে। এমনিতে সাংবাদিকদের নিয়ে তাদের ভয় বেশি। আমার পেশার লোকজনদের তারা পছন্দও করে না। তবুও যাবো আমরা।

ভাটা চলবে আরও দুই ঘন্টা। পানি কমছে। বিশাল বড় খালের দুই পাশে চর জেগেছে। মাঝ বরাবর নোঙ্গর করা আমাদের ট্রলার। এর মধ্যে সরদারের রান্নাঘর সরগরম হয়ে উঠেছে।

জঙ্গলের শাকগুলো কাটা বাছা শেষ। বাউলা ফলগুলোও ছিলে কেটে রাখা। ভাঙ্গন মাছ কেটে ধুয়ে টুকরো করা। চাকা চিংড়ি মাছগুলোও বেছে রেখেছে মামুন আর শহীদুল কাকু। বাউলা ফলগুলো নিয়ে সেদ্ধ দিলেন সরদার। কষগুলো কাটিয়ে নিতে পারলে ভালো হয়। সরদার বলেন, জঙ্গলের একটা গন্ধ আছে এই ফলে। গরম পানিতে ফুটিয়ে নিলে সেটা কেটে যায়। বাউলা তখন খেতে পেঁপের মতো লাগে।

বাউলা দিয়ে ভাঙ্গন মাছের ঝোল হবে আজ। জঙ্গলি শাক দিয়ে হবে চাকা চিংড়ি। গরম ভাতের সাথে আরও থাকবে কেওড়ার খাটা। মসলার ভান্ডার নিয়ে বসেছেন সরদার। একে একে জিরা, আদা, রসুন, মরিচ বাটা হলো। মাটির নোঙড়ায় মসলা বাটার শব্দের সাথে সাথে নামলো সন্ধ্যা।

যে যার মতো ভাত খেয়ে জেলেরা বিদায় নিলো। এই ভাটায় জাল ফেলবে তারা। রাতে এখানেই থাকবে চরপাটার জেলেরা। জাল ফেলে আবার ফিরবে এখানে। খালপাটার জেলেরা যাবে বালির গাঙ-এ। ওদের সাথে দেখা হবে ভোর বেলা।

শেষ ভাটায় স্রোত নরম হয়ে আসলো। সামনেই পশুর নদী। কিছুক্ষণ পর পর পণ্যবাহী জাহাজ যাচ্ছে। ভাটার শুরুতে এগুলো মংলা থেকে রওনা দিয়েছে। মাঝে মাছে ট্রলারও যাচ্ছে তীর ঘেঁষে।মসলা বাটার শব্দের সাথে মিশে যাচ্ছে জাহাজের ইঞ্জিনের শব্দ। আমরা একটু সতর্ক এখন। কারণ সন্ধ্যার পর থেকে পুরো রাত এই জঙ্গল থাকে দস্যু বাহিনীগুলোর দখলে। হুট করে কারও সাথে দেখা হলেও হতে পারে।

সরদার বললেন, খালি খালি টেনশন করে লাভ নাই ভাই। ওরা আসলে আসুক। চা নাস্তা করে চলে যাবে। আপনি বড়শি ফেলেন। শেষ ভাটা চলে। এই খালে মাছ হবে।

চিংড়ড়ি মাছ গেঁথে বড়শি ফেললাম। বড়শি মাটিতে পড়তে না পড়তে দিলো টান। পরের এক ঘন্টায় এক বালতি মাছ উঠলো। ওদিকে রান্না বান্না সেরে হাত বড়শি নিয়ে পাশে বসলেন সরদার। বেশ কয়েকটা বড় বড় গাঙ টেংড়া ধরলাম দুজন মিলে।

কুকু পাখি ডাকছে। মানে জোয়ার শুরু হলো। উত্তরা বাতাস বেড়েছে। শীতে ঠকঠক করে কাঁপছি। মাছ ধরার উত্তেজনায় ক্ষুধা টের পাইনি। ভাত নামিয়ে ডাক দিলো মামুন। বড়শি তুলে ডেক এর ভেতর গেলাম।

গরম ভাতের সাথে শুকনা মরিচের ভর্তা। জঙ্গলি শাক আর চিংড়ি আর ওল বাউলা দিয়ে ভাঙ্গন মাছ। ক্ষুধা পেটে সেই জমলো রাতের খাবার। জঙ্গলে বসে জঙ্গলি খাবারগুলোর কথা কোনোদিন ভুলবো না।

সরদার বললেন, রাতে কী খাবেন? বললাম, রাতেও রান্না হবে? সরদার বললেন, চিংড়ি মাছ আছে মেলাগুলো। চিংড়ি দিয়ে পাতলা খিচুরি করলে কীরাম হবে? বললাম, খুব ভালো হবে। তবে রান্না একটু বেশি করে করবেন। ডাকাত দল আসলে খাওয়াতে হবে। সরদার বললেন, ও কুনো বিপার না ভাই।

(সুন্দরবন ২০১৬)

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top